সাদি মহম্মদ ও তাঁর বেল জার

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: সোম, ১৮/০৩/২০২৪ - ৬:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদ আত্মহত্যা করেছেন। একাত্তরে অবাঙালিদের হাতে নিজের পিতাসহ আরো অনেকের নির্মম হত্যাকাণ্ড তিনি চাক্ষুষ দেখেছিলেন। সে বর্ণনা পড়ে যে কেউ শিউরে উঠতে বাধ্য। আত্মহত্যার পরে জানলাম সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় তার মনে অভিমান ছিলো। শহীদজায়া হিসেবে তাঁর মাকে কোনো সম্মান দেয়া হয়নি তা নিয়েও ক্ষোভ ছিলো। এই রাজাকার ও পাকবান্ধব সমাজ, রাষ্ট্রীয় অবহেলা এবং হয়তো আরও অনেক কিছু নিয়ে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন, নিজেকে উপেক্ষিত ভেবেছিলেন। তাঁর আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ আমরা কখনোই জানবো না। কিন্তু তাঁর চারপাশের বাতাস যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিলো, তিনি দমবন্ধ অনুভব করছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কাম্যু 'দ্য মিথ অফ সিসিফাসে' আত্মহত্যাকে একমাত্র গুরুতর দর্শনগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ("There is only one really serious philosophical problem, and that is suicide,” -The Myth of Sisyphus)। মানুষ কেন আত্মহননের পথ বেছে নেয়- এই প্রশ্নের উত্তর মনে হয় সরল নয়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে নিজের বিচারের সময় আদালতে সক্রেটিস উচ্চারণ করেছিলেন "The unexamined life is not worth living"। বিচারে সক্রেটিসের দণ্ড হয়েছিলো নির্বাসন অথবা মৃত্যু। কিন্ত যে জীবন নির্বাসনের ও উপেক্ষার, সক্রেটিস তা বেছে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। মৃত্যুই তাঁর কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিলো। বিচার ছাড়াই আমরা কত মানুষকে উপেক্ষায় ফেলে দেই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে যেমন ছিলেন কাদম্বরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় বৌঠান আফিম সেবনে আত্মহত্যা করেছিলেন, ঠাকুর পরিবার যা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছিলো। নিম্নবিত্ত কর্মচারীর কন্যা ঠাকুরবাড়ির বৌ হিসেবে এসে হয়তো উপেক্ষিত ছিলেন। তাই আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন। "জীবিত ও মৃত" গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।" হয়তো বৌঠানকে উদ্দেশ্য করেই এই গল্প লিখেছিলেন।

আত্মহত্যাকারী সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক/কবি ছিলেন সম্ভবত সিলভিয়া প্ল্যাথ। যদিও আত্মহত্যার সময় সাহিত্যজগতে তাঁর পরিচিতি তেমন ছিলো না, অকালমৃত্যুই তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছে বলা যায়। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে আত্মহত্যার ঠিক এক মাস আগে ১৯৬৩ সালে ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর একমাত্র উপন্যাস 'দ্য বেল জার'। এস্থার গ্রিনউড চরিত্রের মাধ্যমে প্ল্যাথ বিশ বছর বয়সে তাঁর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এখানে তুলে এনেছেন যার মধ্যে আত্মহত্যার বিভিন্ন চেষ্টার উল্লেখ ছিলো। ভীষণ মেধাবী ও বুদ্ধিমতী এস্থার বস্টনের শহরতলী থেকে নিউইয়র্কে এক ফ্যাশন ম্যাগাজিনে ইন্টার্ন করতে আসে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা বৈষম্যের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে সে আবার ম্যাসাচুসেটসে ফিরে যায়। সেখানে এক বিখ্যাত লেখকের অধীনে কোর্স করতে যেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়, তার উপন্যাস লেখার চেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে সে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয় এবং ইলেকট্রিক শক থেরাপিসহ নানা চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়। এস্থার তার বিষন্নতাকে একটা বেল জারের সাথে তুলনা করে, যেখানে তার মনে হয় অম্ল বাতাসে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে (“under the same glass bell jar, stewing in my own sour air.”)। বাস্তবে সিলভিয়া প্ল্যাথও হার্ভার্ডে তাঁর প্রিয় এক লেখকের সেমিনার কোর্স থেকে প্রত্যাখাত হয়েছিলেন। তাঁর প্রেমিক ও স্বামী, পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছিলেন। লন্ডনে তীব্র শীতকালে ১৯৬৩ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চতুর্থবারের চেষ্টায় তিনি যখন আত্মহত্যা করেন, ফ্ল্যাটে তাঁর দুই শিশুসন্তান পাশের রুমেই ঘুমন্ত ছিলো। অম্ল বাতাসে তাঁর বেল জার হয়তো তখন পরিপূর্ণ ছিলো।


১৯৬৩ সালে ভিক্টোরিয়া লুকাস ছদ্মনামে প্রকাশিত 'দ্য বেল জার' উপন্যাসের প্রচ্ছদ

আমাদের প্রত্যেকেরই হয়তো একটা বেল জার আছে, বিষণ্ণতা বা নানা কারণে যেখানে আমরা সমাজ থেকে গুটিয়ে নেই। সাদি মহম্মদের বেল জার কীভাবে অম্ল বাতাসে পূর্ণ হয়ে উঠেছিলো সেটা তাঁর কাছের লোকরাই ভালো বলতে পারবেন। তিনি ভুল নাকি ঠিক করেছেন, রাষ্ট্রীয় সম্মান বা পদক পেলে কী হতো এসব কথা বলা এখন নিরর্থক ও অসম্মানজনক। যদিও দুঃখজনক, কিন্তু জীবন আগে স্বেচ্ছায় সাঙ্গ করার মধ্যেও কোনো পাপ-পূণ্যের ব্যাপার নেই। এই পৃথিবীতে কে, কয়দিন বাঁচলো; কে, কী পেলো- তার মধ্যে আসলে কোন ফারাক নেই। বেশিদিন বেঁচে থেকে কী হাতি-ঘোড়া করছি আমি, আপনি? কোন পদক, সম্মান বা সম্পদপ্রাপ্তি আপনাকে ইতিহাসে অমর করে রাখবে? অমর বলে যাদের আমরা মনে করি সেই অমরত্ব আসলে কয়দিনের? পৃথিবীতে এক সময়ের পরাক্রমশালী রাজাধিরাজ ওজিম্যান্ডিয়াসের (ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস) বিশাল সাম্রাজ্যও বালির নিচে তলিয়ে গেছে। সেখান থেকে তার একটা ভাঙা মূর্তি উদ্ধার করে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা হয়েছিলো (যথারীতি চুরি/ডাকাতি করে), যেটা নিয়ে শেলি লিখেছিলেন-

"My name is Ozymandias, King of Kings;
Look on my Works, ye Mighty, and despair!
Nothing beside remains. Round the decay
Of that colossal Wreck, boundless and bare
The lone and level sands stretch far away.”
- Ozymandias, Percy Bysshe Shelley, 1818.

ব্যক্তি আল মাহমুদকে আমি অপছন্দ করলেও, কবি হিসেবে তিনি অসাধারণ তাতে সন্দেহ নেই। আল মাহমুদের কবিতা ধার করেই বলি-

"আমি থাকবো না, এর চেয়ে আনন্দের
সংবাদ আর কি হতে পারে। পৃথিবীটাতো
না থাকারই জায়গা। যারা ছিলেন
তারা তো মাত্র একটি শতাব্দীর মধ্যে ইতিহাসে
মিলিয়ে গেছেন। ইতিহাস? আমার হাসি পায়!"

সিলভিয়া প্ল্যাথ তাঁর শেষ কবিতা "Edge" এ লিখেছিলেন-

"The woman is perfected.
Her dead
Body wears the smile of accomplishment."

সিলভিয়া প্ল্যাথ, সাদি মহম্মদ পৃথিবী নামক নরক থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তি নিয়েছেন। তাঁদের মরদেহ নিশ্চিত সেই অভীষ্টপূরণের আনন্দ ধারণ করেছে। তাঁদের বেল জার কারা বিষাক্ত করেছে, এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। সাদি মহম্মদকে গান গেয়ে বিদায় জানিয়েছেন সহশিল্পীরা। এমন একটা সুন্দর দৃশ্য দেখেও অনেকে কটুক্তি করেছেন, গান গাওয়ার জন্য তাঁর নরকবাস নিশ্চিত। যে দেশে এত এত লোক মৃত্যুর পরেও এমন অমঙ্গল কামনা করতে পারে, সেখানে তিনি দমবন্ধ অনুভব করবেন এতে আর আশ্চর্য্য কী।

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।

ছবি: 
31/10/2007 - 3:50পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

Sazzadur Rahman এর ছবি

কি বুঝাতে চাইলেন?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

সাদী মোহাম্মদ আমাদের সবার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন। বেঁচে থাকতে আমরা যারা তাঁকে ভুলে গিয়েছিলাম, তাদের মনে পড়লো সাদী মোহাম্মদ ছিলেন। তিনি আরো অনেকদিন থাকতে পারতেন, যদি মৃত্যুপরবর্তী মনোযোগের এক দশমাংশও পেতেন তাঁর জীবদ্দশায়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

অসাধারণ লিখেছেন। লেখা চলমান থাকুক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।