আগে যেখানে থেমেছিলাম
বাইরে বেশিক্ষন তাকানো যাচ্ছে না। মাথা ঘুরায়। শেষে না আবার বমি বমি লাগে এই ভয়ে ব্যাগ থেকে মাসুদ রানা বের করে পড়া শুরু করে দিলাম। আমার সামনের সিট তখনও ফাঁকা। আমি তখনো জানি না আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। মিনিট বিশেক পর ট্রেন একটি স্টেশনে থামল। কিছু যাত্রী নামল, কিছু উঠল। আমার সামনের সিটেও মনে হল একজন আসল। আমার চক্ষু আবার চড়কগাছ, চোয়াল আবারও মাটিতে। নাহ... এই ট্রিপে আর শান্তি পাবো বলে মনে হয় না............
আবার শুরু করার আগে একটু বগিটার বর্ণনা দেই। বেশ হ্যাঞ্চাম বগি। ভিতরে ঢুকলেই একটা শান্তি শান্তি ভাব লাগে। পরিপাটি করে সাজানো প্রতিটা সিট। প্রতি সিটের সাথে গান শুনার ব্যবস্থা। গোটা বগি যতদূর মনে পড়ে তিন ভাবে সাজানো (ভুল হয়ে থাকলে যারা নিয়মিত রেনফে তে যাওয়া আসা করেন, শুধরে দেবেন আশা করি)। এক পাশে অভিমুখে সিট, অন্য পাশে তার বিপরীত দিকে, আর একদিকে ছোট্ট একটি অংশ দরজা দিয়ে আলাদা করা যেখানে হাতে গোনা কয়েক্টি সিট। এই অংশেই পড়েছে আমার সিটটি যা আগের পর্বে বলেছি ছবিসহ। আমার মুখোমুখি আরেকটি সিট, আর পাশে ডাবল সিট আছে এক জোড়া, তাও মুখোমুখি।যাই হোক, এই স্টেশনে ট্রেন থামতেই আমার এইপাশে উঠে এল একটি পরিবার, দুটো ফুটফুটে বাচ্চা সহ। বাইরে বেশ গরম পড়েছে। বাচ্চাদের বাবার পরনে হাফপ্যান্টস, গায়ে হাফ হাতা সুতির শার্ট, পরণে স্যান্ডেল, বাচ্চাদের মায়ের গায়েও হালকা একটা ফ্রক। বাচ্চা দুটির গায়েও সুতির কাপড়। বেশ হাসি খুশি পরিবার। প্রথম দেখাতেই ভাল লাগে এমন। যদিও তারা উঠেই স্প্যানিশ বলা শুরু করল, তাও আমার বেশ ভাল লাগল। আমার কেম্রাটা সামনের টেবিলমত জায়গায় রাখা ছিল, ছেলে বাবুটি এসে হাত দিতেই বাবা স্প্যানিশে হা হা করে উঠল, আর আমাকে কি যেন বলল। আমি সাথে সাথেই চোথাবাজি করে জানিয়ে দিলাম ,"”লো সিয়েন্তো, নো আবলার ইস্পানিওল” (মাফ করবেন, আমি স্প্যানিশ কইতারিনা)"। সাথে সাথেই ভদ্রলোক হেসে ইংলিশে বললেন, "“কিছু মনে করবেন না বাবুর আচরণে”"। আমি বললাম, "“না না মনে করার কি আছে?” ওরা দেখুক ইচ্ছামত"।“ মনে মনে বললাম, "“যাই করস না কেন বাপ, ভাঙ্গিস না"।“ এই করতে করতে হঠাত দরজা খুলে গেল, আর একটা বড় স্যুটকেস এসে ঢুকল, এর মালিক এখনো পিছনে। আমি আর বাচ্চার বাপ দরজার দিকেই মুখ করে ছিলাম, দুজনেই একসাথে সেই দিকে তাকালাম, এইবার ঢুকল স্যুটকেসের মালকিন। পরনে জিন্সের হাফপ্যান্টস (এইটাকে হাফপ্যান্টস বললে জগতের সকল হাফপ্যান্টস ফুলপ্যান্টস এ উন্নীত হবে, ছেলেদের আন্ডুর চেয়ে এক সাইজ বড় হতে পারে, দেড় সাইজ হবে না), আর গায়ে ‘ভি’-গলার টি শার্ট, আর ভি টাও তিন সাইজ বড়, আর শার্টটিও মেয়ের গায়ের চেয়ে তিন সাইজ বড় হবে কমসে কম। এতে করে যা হচ্ছে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এসেই শুরু করল তার বিশাল স্যুটকেস নিয়ে টানা হ্যাচড়া, একবার উবু হয়, তো একবার সোজা হয়। বহু ধস্তাধস্তি করে সেটিকে সাইড করে রেখে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সে ধপ করে বসে পড়ল আমার মুখোমুখি সিটে, ঘামিয়ে গেছে। আমি নাহয় অবিবাহিত মানুষ, তাকাতেই পারি, কিন্তু ওই বাচ্চার বাপ পড়েছে ফাপড়ে, বেচারা না পারছে তাকাতে, না পারছে সাম্লাতে। বাচ্চার মাও তাকে ঝাড়ছে বলে মনে হল। তারপর একসময় ওই দম্পতি সিট বদল করল। আর আমি......কি আর করা, অনেক কষ্ট করে মাসুদ রানার দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলাম। আমাদের অসুবিধা বুঝেই হোক, অথবা এসির ঠান্ডায়ই হোক, ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে একটি চাদর বের করে গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে ফেলল। জাঝাকাল্লাহ খায়রান।
আমারও কেমন জানি হালকা ঝিমানো মত লাগলো, বাইরেও তাকাতে পারছি না ট্রেনের গতির কারণে, আবার মাসুদ রানায়ও মন দিতে পারছি না, এই করতে করতে ট্রেন এসে গেল জারাগোজাতে। ট্রেনে আমি সেই পরিবার আর সুন্দরীকে রেখে এলাম নিঃস্ব করে।
ট্রেন থেকে নেমেই ‘Salida’ (Exit) খুঁজে বের করে সেই দিকে হাঁটা দিলাম। অ্যালেক্স বলে দিয়েছে এইখান থেকে বাসে করে হোটেলে যাওয়া যায়। তবে ভাল হবে আমি যদি স্তাসিওর ইনফোরমাসিও থেকে জেনে নেই কোন বাস যাবে। এতোমধ্যে একবার উপরে আবার একবার নিচে করে ইনফরমাসিও খুঁজে বের করেছি, লাইনেও দাঁড়িয়েছি। কাউন্টারে বসা খালাম্মাকে যেয়ে চোথা বের করে বললাম, “"ওলা, আমি স্প্যানিশ কইতারিনা, তয় আমি এই হোটেলে যামু, কোন বাসে গেলে সহজে যাইতারুম?"” খালা স্প্যানিশে উত্তর দিল যার একবর্ণও আমি বুঝিনি। খালি বুঝতে পেরেছি, খালা ইংলিশ কইতারেনা, আর স্প্যানিশ যা কইছে তার পুরাটাই আমার টাওয়ারের উপর দিয়া গেছে। বিদিক ছিরিক্ষলা। তারপর চিন্তা করলাম এই অবস্থায় মাসুদ রানা হলে কি করত। পাঠক বলেন তো কি করত? হুমম, ঠিক ধরেছেন, একটা ট্যাক্সি নিত। আমিও সেটাই করলাম, একটা ট্যাক্সি ডাক দিলাম, মামা এসেই বলল, "ওলা", আমিও বললাম "ওলা"। তারপর বেশি কথা না বাড়িয়ে বললাম, "“হোটেল রয়্যাল জারাগোজা”"। এইটা শুনে মামা দেখি মাথা চুল্কায়। মানে হইল সে বুঝতারেনাই। আমি আবারও বললাম, “হোটেল রয়্যাল জারাগোজা”। মামা আবারো বুঝতারেনাই। তারপরই আমার মনে পড়ল আমি এইটারও অনুবাদ ও উচ্চারণ গুগুল মামার কাছে জিজ্ঞেস করে বাংলায় লিখে এনেছি। এবার সেটা দেখেই বললাম, "“হুসা ররয়্যাল ছারাগোচ্ছা"”, মামা এইবার ‘'ছি' 'ছি'’ করতে করতে আমার ব্যাগ ট্রাঙ্কে তুলল। তাও মান বাঁচানোর স্বার্থে মামাকে চোথায় লেখা ঠিকানা দেখালাম, মামা তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে আমাকে অভয় দিল, আর আঙ্গুলে ১০ দেখিয়ে মুখে বলল, '‘মিনিত'’। বুঝলাম, ১০ মিনিট লাগবে। যেহেতু আমার আর কিছু করার নেই, তাই শহর দেখায় মন দিলাম। প্রথম ধাক্কাতেই মনে হল, এইটা একটা সাফ সুতরো ঢাকা শহর, যেখানে রিকশা আর সিএঞ্জি নেই। আছে খালি ক্যাব আর গাড়ি। অন্যথায় সবই একরকম। আমাদের দেশের মত কেঁচি গেট, দোকানের সাটার, ঘিঞ্জি বিল্ডিং, বিল্ডিং-এর নিচে দোকান, চিপা রাস্তা। দুই বছরের কানাডার অভ্যস্ত চোখ যেন আবার ঢাকা দেখছে। আমার মনেই হল না এই শহরে আমি জীবনে প্রথম এসেছি। সবই কেমন যেন আপন মনে হচ্ছে।
এই করতে করতে এক সময় আমি পৌঁছে গেলাম হুসা ররয়্যাল ছারাগোচ্ছা-তে। একটা চিপা গলির ভিতরে অনেক বিল্ডিং-এর মাঝে একটা বিল্ডিং। বাইরে নাম লেখা না থাকলে কেউ বলবে না যে এটা একটা হোটেল। কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে গেলাম ভিতরে। হাতের বামেই পড়ল রিসিপশন। স্যুট-টাই পড়া মামা দাঁড়িয়ে। মামাকে ইংরেজীতেই বললাম আমার রুম নম্বর। আর জিজ্ঞেস করলাম যে আমার রুমমেট এসেছে কিনা (অ্যালেক্সের গতকাল আসার কথা বার্সেলোনা থেকে)। মামা জানাল যে সে এসেছে, আমি পাস্পোর্ট দেখিয়ে দস্তখত করে উপরে উঠে গেলাম। রুমের দরজায় নক করতে অ্যালেক্স দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই আবার চক্ষু আকাশে। না, এইবার আর কোন মেয়ে নয়। ওই ব্যাটা অ্যালেক্স।
এই পর্যায়ে এসে অ্যালেক্স সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। আমার দেখা অনেক অনেক অতীব ভদ্রলোকের একজন হচ্ছে অ্যালেক্স। সে বয়সে আমার কিছু বড়, আর জ্ঞ্যানে সে আমার কয়েকটার সমান বড়। লম্বায় আমার সমান, গড়পড়তা কানাডিয়ানের চেয়ে খাটো, ছিলিম ফিগার। মুখে দাঁড়ি আর কোমর ছুঁই ছঁই লম্বা চুল, চশমা পড়া মায়া মায়া চেহারা। কথা বলে খুবই কম, আর সারাদিন বই পড়ে। যাবতীয় ফ্যান্টাসির বই তার পড়া। তার মা চাকরি করে, একটি বিশাল কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, বাবা এক সময় অনেক কিছুই করতেন, এখন কিছুই করেন না। একদমই নিরহংকার এই ছেলে আমার পিয়ার মেন্টর। আশ্চর্য হলেও সত্য, কানাডিয়ান হওয়া সত্বেও অ্যালেক্স ড্রিংক করে না (খুবই কম, এক গ্লাস বিয়ার পুরোটা খায় না), তার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই (হাজারে একটা হয়ত পাওয়া যাবে এমন কানাডিয়ান, এবং সে '“গে'” ও নয়), উইকেন্ডে পার্টি করে না, প্রতিদিন সকাল ৮টায় ল্যাবে আসে, সন্ধ্যা ৬ টায় বাসায় যায়। ল্যাবে এসে বাসায় ফোন করে বলে সে এসেছে, ৬টায় যাবার আগে ফোন করে বলে সে রওনা দিচ্ছে (আমি ৩ বছর এই দেখে এসেছি)। তার সীমাহীন জ্ঞানের কারণে পিএইচডি শেষ হবার আগেই সে দুটি কোর্সের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। অত্যন্ত লাজুক এই ছেলেকে এক কথায় বলা যায় "“Mama’'s Boy"”। আপাতত এইটুকুই থাক, পরে আবার বলব।
তো যা বলছিলাম। দরজা খুলে দিল অ্যালেক্স। ওর দিকে তাকাতেই চক্ষু কপালে। না ব্যাটা নাঙ্গু বাবা হয়ে নেই। সে একটি টকটকে লাল রঙের আন্ডু পড়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন কানাডিয়ানের জন্য আন্ডু পড়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু আমার ২ বছর যাবত অ্যালেক্স-কে দেখা চোখ এই দৃশ্য বিশ্বাসই করতে চাইল না। তাও আন্ডুর যেই রঙ, আমার গলায় ছুরি ধরলেও আমি এই রঙের আন্ডু পড়ব কিনা সন্দেহ আছে। সে দরজা খুলে ওই অবস্থায়ই আমাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরল। যেন বহুদিন পর মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইকে সে খুঁজে পেয়েছে। আর চুপচাপ অন্তর্মুখী অ্যালেক্স হড়বড় করে কথা বলতে লাগল। আমি কথা বলব কি! তার অবস্থা দেখে আমি পুরাই তাব্দা। কথার কোন লাইন ঘাটও নেই, আমার জার্নি কেমন হল, সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, বার্সেলোনা তার কাছে অনেক ভাল লেগেছে, আরো ভাল লাগত যদি আমি থাকতাম, আমার ভিসা নিয়ে বেটারা যা করেছে তাতে তাদের পিটানো উচিৎ, জারাগোজাতে দেখার এই এই আছে, আজকে বিকেলে আমরা কোথায় যাব, কাল সকালে কোথায় যাব ইত্যাদি ইত্যাদি। এক বছরের কথা সে এক ঘণ্টায় বলে ফেলল। অনেকক্ষণ পর তার হুঁশ হল যে আমি সরাসরি কানাডা থেকে আসছি, সুতরাং আমি হয়ত ক্লান্ত হতে পারি। সে আমাকে এক ঘন্টা সময় দিল বিশ্রাম নিতে। তারপর আমরা পদব্রজে বের হব। তার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমি এক ঘন্টারও কম সময় নিলাম শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হতে। তারপর হাতে আমার সবেধন নীলমণি প্লাস্টিকবডির ডিএসেলার আর ১৮-৫৫ বাটখারা লেন্স নিয়ে বের হবার প্রস্তুতি নিলাম।
বের হবার ঠিক আগে আগেই হোটেলের জানালা খুলে বাইরে তাকালাম কোন অছাম ভিউ পাবার আশায়। যা পেলাম তা ঠিক অছাম না হলেও টাস্কি খাবার জন্য যথেষ্ট। এ যেন ঠিক মিরপুর। একটা দালানের সাথে লাগানো আরেকটা দালান, একেক্টা একেক সাইজের। কোন কোন ফ্ল্যাটে আবার এসি লাগানো, কোন কোনটার বারান্দায় কাপড় ঝুলছে, জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে লতা গাছ। কাউকে যদি না বলে এই ছবি দেখানো হয়, তাহলে নির্ঘাত সে বলবে যে এইটা ঢাকার কোন জায়গার ছবি।
১)
আবার দেখা গেল পলেস্তারা (পলেস্তরা?) ছাড়া দালান, যার উপর টিনশেড দেওয়া। বাইরে তাতানো রোদ, ফলে মাত্রা ছাড়া গরম (অনেকটা ঢাকার মতই, কিন্তু ২ বছর কানাডায় থেকে ৩০ °সে কেও মাত্রা ছাড়া মনে হচ্ছে), জানালা দিয়ে তাকালে খাঁ খাঁ দুপুর, সামনে পলেস্তারা ছাড়া দালান, জারাগোজায় বসে আমি যেন ঢাকার আমেজ পেলাম।
২)
বাইরে বেরুতেই গায়ে রোদের হলকা লাগলো। অ্যালেক্স অবশ্য চোর চুরি করতে যাবার আগে যেভাবে গায়ে তেল মাখে ঠিক সেইভাবে সানস্ক্রিন লোশন মেখেছে। আমি লোশন টোশনের ধার ধারিনি। ভাবখানা অনেকটা এমন যেন অ্যালেক্সকে দেখিয়ে বলছি, “দেখ ব্যাটা, তোর দেশে যাইয়া আমার যেমন লোশন মাখা লাগে, এই দেশে আইসা আমার কিছু লাগে টাগে না। তুই মাখ ইচ্ছামত। দেখ সারাদিন লোশন মাখতে আমার কেমন লাগে।“ সবকিছু উপেক্ষা করে হেঁটে যাচ্ছি। ছিমছাম শহর। চওড়া ফুটপাথ, আর তার অর্ধেক জুড়ে চেয়ার-টেবিল বসানো।
৩)
কিছুদুর হাঁটার পর আমরা দেখতে পেলাম এক বিশাল ভাস্কর্য। পরে অবশ্য দেখেছি কিছুদুর পর পরই একটা না একটা ভাস্কর্য করা আছে। বুঝা গেল, এই দেশে ছাগুরা এখনও এসে পৌছায়নি।
৪)
এই ভসমানু কে আমাদের মাইলস্টোন ধরে আমরা ডানদিকে গোত্তা খেলাম একটা গেট মত জায়গা দেখে। কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল এইটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে জেনেছি, এইটা জারাগোজা বিশ্ববিদ্যালয়, যারা আমাদের কনফারেন্স হোস্ট করছে।
৫)
গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের বামে পড়ল একটা নোটিশ বোর্ড। এতক্ষন আমাদের দেশের সাথে যাও বা মিল দেখছিলাম, এই নোটিশ বোর্ড দেখে আমার ধারণা আরো পোক্ত হল। একটার উপর একটা নোটিশ লাগানো। রং বেরঙের আধা ছিড়া, ছিড়া কাগজ এখানে সেখানে উঁকি দিচ্ছে। নর্থ আমেরিকার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি না, তবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এই রকম নোটিশ বোর্ড দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। আমার জন্য এই নোটিশ বোর্ড স্বাভাবিক অথবা নস্টালজিক হলেও অ্যালেক্সের ঘোর যেন কাটছেই না। তারও বা কি দোষ, সে তো আর জিন্দেগীতেও এই জিনিস দেখেনি বা শোনেনি।
৬)
ক্যাম্পাসটিকে বেশ ছোট বলেই মনে হল। আমরা মিনিট দশেকের মধ্যে কিছু বুঝে উঠার আগেই বের হয়ে গেলাম। বের হতেই দেখলাম একটি সুউচ্চ দালান, দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলির মতো। আমার মনে হল আমি গুলশান নিকেতনের দিকে এই রকম দালান দেখেছি।
৭)
বিল্ডিং এর পাশেই আমাদের দেশের পাড়ার মোড়ের মত একটি মোড় দেখলাম। মনের চোখে অনেক রিকশাও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, চোখের সামনে যদিও সাইকেল স্ট্যান্ডের মত একটি জায়গা, যেখানে একি রকম দেখতে অনেকগুলি সাইকেল দাঁড় করানো। এই রকম সাইকেল আরো দেখেছি। অ্যালেক্স জানালো যে এইগুলি ভাড়ার সাইকেল। কয়েন ঢুকিয়ে সাইকেল ভাড়া নিতে হয়, আবার গন্তব্যে পৌঁছে এই রকম আরেকটি স্ট্যান্ডে রেখে দিতে হয়। আমি নিশ্চিত না, তবে অ্যালেক্স যা বলেছে আমি তাই বিশ্বাস করেছি। ইউরোপে আছেন এমন কেউ হয়ত নিশ্চিত করবেন আমাদের যে এই তথ্য সঠিক কি না।
৮)
কিছুদুর আগাতেই দেখলাম বিশাল কন্সট্রাকশন সাইট। আমার কেন জানি এই কন্সট্রাকশন সাইটগুলো ভাল লাগে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বিশাল বিশাল ক্রেনগুলি বেশি ভাল লাগে। মনে হয় সভ্যতা বিনির্মানে এরা সদা জাগ্রত এবং উত্থিত।
৯)
অ্যালেক্স ম্যাপ দেখে আগাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে জানাল যে আমাদের কনফারেন্সের ভেন্যু খুবই কাছাকাছি। আমরা ইচ্ছা করলে সেটি দেখতে যেতে পারি। এতে পথ চেনা হবে এবং কাল থেকে আমাদের আসতে বেশি আগে হোটেল থেকে বের হতে হবে না। আমি আপত্তি করার কিছু খুঁজে পেলাম না। সেই রাস্তা ধরে কিছুদুর হাটঁতেই দেখলাম একটি সুন্দর জায়গা, মাঝে একটি বিল্ডিং। নাম পড়ে অ্যালেক্স জানালো এটাই আমাদের কনফারেন্স ভেন্যু। আমার প্রথম দেখাতেই ভাল লাগল। পাশে দেখলাম একটি স্টেডিয়ামও আছে। নাম লেখা দেখলাম এইটা স্প্যানিশ লিগে খেলা রিয়াল জারাগোজা টিমের হোমগ্রাউন্ড।
১০)
স্টেডিয়াম ও কনফারেন্স সেন্টারের মাঝখানে একটি চিপা রাস্তার মত আছে। আমরা সেই পথ ধরলাম। কিছুদুর হাটতেই দেখি একটি বিশাল টাওয়ার মত, মনে হল একটি প্রাচীন গির্জা। পরে জেনেছি এটি আসলেই প্রাচীন একটি গির্জা। এই রকম প্রাচীন স্তাপত্যের অভাব নেই এই শহরে।
১১)
এর নিচে আবার ধাতব ফলকে স্প্যানিশ ভাষায় এর নাম পরিচয় লেখা। ফলকের টাইটেল দেখে বুঝলাম এইখানে এই গির্জার ইতিহাস লেখা আছে।
১২)
এই রাস্তাতেই এইখানকার মেট্রোরেল দেখলাম। দুটো বগি নিয়ে একটি ট্রেন। দেখতেও সুন্দর চলেও নিঃশব্দে। একেবার রাস্তার উপরেই যাত্রি ছাউনী এবং লাইন। রাস্তাটি খুবই চিপা, চওড়ায় হয়ত আমাদের তাঁতিবাজার এলাকার রাস্তার মত হবে। এই রাস্তাতেই মেট্রো, বাস এবং কার এক সাথে চলছে। কোথাও কোন জ্যামও নেই।
১৩)
১৪)
এই পথ ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই আমরা হোটেলের সামনে এসে গেলাম। কনফারেন্স সেন্টার থেকে হাঁটাদুরত্ব। ভালোই হল। এতক্ষণে আমাদের দুজনেরই বেশ খিদা পেয়েছে। কিন্তু খাবার দোকানের মেন্যু বুঝি না, অ্যালেক্স জানালো সেও বুঝে না, আর খাবারের ও অনেক দাম। তাই অ্যালেক্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি স্টোরে ঢুকলাম। সেখান থেকে কিছু ফল, জ্যুস ও শুকনা খাবার কিনে হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম। দুজনেই যথেষ্ট ক্লান্ত। পা আর চলতেই চাইছে না। কোনমতে বিছানায় উঠতে পারলেই বাঁচি।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। কোনমতে হাতমুখ ধুয়ে একটু কিছু খেলাম। বাসায় কথা বললাম। হঠাত অ্যালেক্স তার প্যান্ট খুলে আবারও তার লাল আন্ডু পরে ঘুরে বেরাতে লাগল। আমার চোখ লাগি লাগি করছে, অ্যালেক্স লাইট নিভিয়ে দিল। আমি আবছা অন্ধকারে দেখলাম অ্যালেক্স খাটে উঠে কম্বলের নিচে ঢুকে গেল, আর তার হাত থেকে ছোট্ট একটি কাপড় উড়ে গেল চেয়ারের দিকে। আমার দিকে হালকা করে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “গুড নাইট”। আমিও নাঙ্গু বাবাকে গুড নাইট বলে আজকের মত চোখ বন্ধ করলাম।
অনেক লেখছি। আবারও চা বিরতি।
ওই বুলেট, সবাইরে চা দে।
গৃহবাসী বাউল
ইউরোট্রিপের আগের পর্বগুলো
ইউরোট্রিপঃ যাত্রা শুরুর আগে- ১
ইউরোট্রিপঃ যাত্রা শুরুর আগে- ২
ইউরোট্রিপঃ যাত্রা হল শুরু
মন্তব্য
লেখা ভাল লাগতেসে। ঐ রকম বিভিন্ন ফ্লায়ার লাগানো নোটিশ বোর্ড অবশ্য আমার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে (Stony Brook University) আছে। আমেরিকার আরও কিছু ক্যাম্পাসেও দেখেছি। এগুলি মূলত ছাত্রদের জন্য।
অনেক ধন্যবাদ
এবারের চা(টা) ছোট কাপে থাকায় ভাল লাগছে
এইবার কলসি ভরা চা নিয়া বসছি
এ বছরের গোঁড়ার দিকে একটা ছোটখাটো ইউরোট্রিপ আমিও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ছবি তুলি না মানে পারি না, আর ভ্রমন কাহিনী লিখতেও জানিনা। সাথে আপনাদের এত চমৎকার সব ভ্রমণের গল্প পড়তে পড়তেই দিন যায়, নিজেরটা লিখতে আর ইচ্ছে হয় না। আমি অলস এটাও একটা বড় কারণ।
লেখা বরাবরের মতই মজারু।
আপনার কি আমার তোলা ছবি দেখে আমাকে ফটুগফুর মনে হচ্ছে? আর ভ্রমনকাহিনী কি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখার মত মনে হচ্ছে? আররে ভাই, আমি কি জানতাম নাকি যে আমি লেখতে পারি? আমি তো খালি কি ঘটছে তার ধারাবর্ণনা দিচ্ছি। এই লেখার কোন সাহিত্যক মুল্য কি আছে? আপনার লেখা সেই তুলনায় ওয়ে বেটার। সো, দেরি না করে শুরু করেন। আপনার ইউরোট্রিপের কাহিনীও আমরা শুনে ফেলি।
বাই দ্যা ওয়ে, আলসেমির কম্পিটিশন করবেন আমার সাথে? ফেইল মেরে তাব্দা খেয়ে যাবেন। ভালোয় ভালোয় লেখা শুরু করেন। নাইলে কিন্তু হরতাল।
বাউল রক্স!
মজারু লেখা, লইয়া বসলাম বাউল ভাই।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
সাফিনাজ ওলসো রক্স।
পপকর্ণ আস্তে আস্তে টাইম লাগাইয়া খান। নাইলে পরে আবার ঝামেলা হয়ে যাবে।
পড়া শেষ
এইবার আপনার মিডটার্ম ক্লাস্টেস্ট
তাত্তারি পপ্পন শেষ করেন। পরীক্ষার সময় খাওয়া নিষেধ।
দিয়ে বাকি পপ্পন শেষ করেন।
আপনে খ্রাপ লুক
আমার চায়নিজ রুম্মেট নিয়াও আমার একই টাইপ সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে সকালে কিচেনে চা বানাতে গিয়ে দেখি একটা সবুজ রঙের আন্ডু পরে পারুটিতে মাখন মাখাচ্ছে।
উত্থিত ক্রেনের প্রতি আপনার আকর্ষন দেখে ভাল লাগল। কোন এক অদ্ভূত কারণে এই জিনিসটা দেখলে আমারও বেশ ভাল্লাগে। আমাদের ক্যাম্পসে চারদিকেই মোটামুটি এরকম উত্থিত দশা। কিন্তু এগুলারে নিয়ে কোন ভাল কম্পোজিশানে ছবি নিতে পারতেছিনা। উইন্টারের আকাশ এত মরা। দেখি সামারে আকাশের অবস্থার উন্নতি হইলে আপনার জন্যে ক্রেনের ছবি পাঠাব।
পৃথিবীর অনেক ভাষার লেখাই যখন দেখি, তখন আমার বাংলা ভাষার কথা মনে হয়। খুব গর্ব হয় আমাদের একটা নিজস্ব অনন্য বর্ণমালা আছে।
লেখা চলতে থাকুক।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আঁই কিচ্ছি?
আপনার তো খালি রুমমেট। আমার চাইনিজ রুমমেট ও তার গার্লফ্রেন্ড দুজনেই এই কাজ করত। বড়ই বিব্রতকর অবস্থা।
ক্রেনের ভালো কম্পোজিশন আসলেই টাফ। বেস্ট অফ লাক।
পরিশেষে
এইযে দুই ক্রেনপ্রেমী পাপিষ্ঠ, এই দেখেন। লন্ডনে ক্রেনের সঙ্গে ধাক্কায় হেলিকপ্টার ক্র্যাশে দুইজন মারা গেছে।
http://www.bbc.co.uk/news/uk-england-21040410
বাংলা বর্ণমালা অনন্য নয়, অসমীয়া বর্ণমালার সাথে আমাদের বর্ণমালার পার্থক্য খুবই কম। একটু চেষ্টা করলে অসমীয়ায় লেখা কোন কিছু গড়গড় করে পড়া যায় (সঠিক উচ্চারণ আর অর্থ বোঝাকে বিবেচনায় না নিয়ে)।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ পাণ্ডবদা। জানা হল নতুন তথ্য।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
হেহ হেহ , মজা পাইলাম।
হেহ হেহ,
জটিল হইতেছে।
'সদা জাগ্রত এবং উত্থিত' লেখা দেখে আমার মনে প্রথমে যা আসলো তাতে বুঝলাম আমি মানুষটা আসলে বিশাল বদ।
হ, আপ্নে মানুষটা আসলেই বদ আছেন। নাইলে "জাগ্রত এবং উত্থিত"-র মত একটা নির্দোষ ফ্রেইজ দেখলে কি মনে বদ চিন্তা আসে?
সামগ্রীকভাবে চমৎকার লেগেছে লেখাটা, ধন্যবাদ।
আব্দুল্লাহ এ.এম.
অনেক
লেখা ভালা পাইছি(Y)
তয় ট্রেনের সুন্দরীর না হোক সিটের ফটুকখান দেখাইলে তো বাকিটা কল্পনায় বসাই নিতাম:-P
চলুক পরের পর্বের আশায় রইলাম
লেখা ভালো পাওয়ার জন্য
আররে ভাই আমিই কি জানতাম নাকি যে ওই সিটে সুন্দরী আসবো? তাইলে খালি সিটের ছবি না, সিট থেইকা এক খাব্লা ফোম ও তুইলা আনতাম
পপ্পন খাইতে থাকেন
ইউরোপে অমন ভাড়া সাইকেলের ব্যবস্থা আছে, লন্ডনে তো প্রচুর। গত দু বছরে বস্টনেও চালু হয়েছিল, নিশ্চয়ই আমেরিকার অন্যত্রও হয়েছে।
ইউনিভার্সিটির গেট, ফ্লায়ারভরা বোর্ড, এসব তো বস্টনেও আছে। আপনারা কোন গাঁওগেরামে থাকেন কয়েন তো?
স্পেন আমার অতীব মনোরম লেগেছিল, আবহাওয়া পরিবেশ সবদিক থেকে।
লেখা
কানাডার টরোন্টোতেও আছে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আমি তো দেখি পুরাই বেক্কল। নাইলে সারা দুনিয়ায় যেই জিনিস আছে, তা আমি দেখি না কেন?
আপ্নেগো মন্তব্য দেইখা আমি আমার ভার্সিটি খুঁজলাম। ফ্লায়ার বোর্ড এইখানেও আছে, কিন্তু ছবির মত ছিড়া ফাড়া কাগজ নাই। এইখানে ডেট ওভার হয়ে গেলে সেই ফ্লায়ার সযত্নে খুলে ফেলা হয়।
চলুক আপনার ইয়োরোট্রিপ - সাথে আছি
সাথে থাকার জন্য
পুরা সিরিজ যারে কয়ঃ "এক্কেরে ফাডায়ালাইসেন!!"
আপ্নে অনেক গ্যাপ দিয়া ল্যাখেন। তারপরও ওয়েটাইলাম
ক্রেন এর ফটুর ক্যাপশন পড়ামাত্তর পাপী মন আমারে ১খান নোটিফিকেশন পাঠাইলো। তাতে লেখাঃ "আমরাও!! সদা সর্বদা সর্বাবস্থায়!! শুধুমাত্র মানব সভ্যতার সম্প্রসারনে!!"
আরেকখান কতা জিগাই। আপ্নে পুরা জার্নি খালি দেইখাই গেলেন?? ধুরো মিয়া!!!
আর ফাডাইতারলামকই? তাও আপ্নেরে
গ্যাপ দিয়া না লেইখা উপায় আছে? আমি যেই পরিমাণ আইলসা। তার উপর আবার বিখ্যাত লেখকগো মত সব সময় লেখার মুডও থাকে না। তাই বিশাল গ্যাপ পইড়া যায়। পপ্পনের প্যাকেট আরো কয়েকটা নিয়া বসেন। পরেরটা মার্কেটে আসতে টাইম লাগব।
আপ্নের শেষ কথাটা বুঝি নাই। দেখা ছাড়া আর কি করতারতাম? আমার মাথা দেখি চুক্লায়!!
না মানে কইতেসিলাম পুরা রাস্তা আপ্নের আশ-পাশ দিয়া হুরপরী ঘুরাঘুরি করলো আর আপ্নে দেখাই গেলেন?? আফসুস!!
মাথা ছুক্লায়া টাইম নষ্ট কইরেন্না বস। লেখতে থাকেন। প্রয়োজনে পার লেখা আপ্নেরে ১ঠোঙ্গা ঝালমুড়ি খাওয়ামু!
নতুন মন্তব্য করুন