“হি ইজ অ্যা গুড ম্যান”- ছবিটার দিকে একটানা মিনিটখানেক তাকিয়ে, চোখ-মুখ ভুরু কুঁচকে, দুই-চারবার সাপের মত জিহবা বের করে নিচের ঠোট ভিজিয়ে উপর নিচে মাথা দুলিয়ে গমগমে কন্ঠে বলল জ্যুড। জ্যুড সেঙ্কুঙ্গু আমার বাথরুম্মেট, বাড়ি উগান্ডা, পেশায় শিশুচিকিতসক। বাংলাদেশে এসেছে পাবলিক হেলথে মাস্টার্স করতে। আমরা দুজন থাকি পাশাপাশি রুমে, কিন্তু দুজনের জন্য বাথরুম একটাই; সেই সুত্রে আমরা বাথ্রুম্মেট। মানুষের স্বভাব বিচারে জ্যুডের নিজের উপর অগাধ আস্থা। আমার তখন যে যা বলে তাই বিশ্বাস করি অবস্থা। কথা হচ্ছে আমার ‘হলেও হতে পারে’ পিএইচডি সুপারভাইজার রুবেনকে নিয়ে।
ব্যাচেলরস শেষ করার পর বাইরে পড়তে যাব (সবাই যাই, আমিও যামু), সেই আশায় ক্রমাগত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রফের কাছে মেইল করছি। বেশিরভাগই কোন উত্তর দেয় না। যারা দেয় তারাও না-সুচক দেয়। ইতোমধ্যে ভর্তি হলাম পাবলিক হেলথে মাস্টার্স করতে। আমার আগের পড়া বিষয়ের সাথে যার কোন মিলই নেই। তাই থিতু হতে বেশ সময় লাগল। মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রফের কাছে লিখছি। ‘কভু ছেড়োনা হাল-পাকে পাকুক বাল (আই মিন চুল)”- এই বাক্যকে ধ্রুব ধরে একের পর এক লিখে চলেছি আর আশাহত হচ্ছি। হঠাত একদিন রুবেন জানাল “তুমি যদি ফান্ডিং ম্যানেজ করতে পার, তাহলে আমি তোমাকে পিএইচডিতে নিতে পারি”। এই প্রথম কেউ হ্যা বল্ল, তাও শর্তসাপেক্ষে। আনন্দ আর দুঃখ দুইটাই একসাথে হল। আনন্দ হল যে কেউ একজন হ্যা বলেছে, আর দুঃখ হলে যেই আমার নিজের হাতখরচের ফান্ডিং যোগাড় করতেই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা, সেই আমি পিএইচডির ফান্ডিং কোত্থেকে যোগাব। ওকে জানালাম সে কথা। সে বলল, “ঠিক আছে, দেখি ডিপার্টমেন্টে কথা বলে। যদি টিএ পাওয়া যায়, তাহলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। তুমি প্রাথমিক দরখাস্ত করে দাও।“ কথামত প্রাথমিক দরখাস্ত করলাম। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়-ডিপার্টমেন্ট থেকে কোন আওয়াজ আসে না। সহ্য করতে না পেরে একদিন রুবেনকে জানালাম যে আমার ‘সহে না যাতনা-দিবসও গনিয়া গনিয়া’। উত্তরে রুবেন বলল সে আসলে স্যাব্বাটিক্যালে ইংল্যান্ডে আছে, তাই তার কাছে ডিপার্টমেন্ট থেকে এখনও কাগজপত্র পাঠাচ্ছে না। আমি যেন ওর কথা বলে ডিপার্টমেন্টে একটা ইমেইল করি।
ডিপার্টমেন্টে ইমেল করা হল। উত্তর এল, ‘ওয়েইট খাও, ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে’। কি আর করা- অচেনা পাবলিক হেলথের প্যারা-পাংগা আর ওয়েইট একসাথে খেতে লাগলাম। হঠাত একদিন উত্তর পেলাম, ‘হ্যা, তুমি টিএ পেতে পার, এফজিএসআর (ফ্যাকাল্টি অফ গ্রাজুয়েট স্ট্যাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ) যদি তোমাকে নেয়। সুতরাং পুরোপুরি দরখাস্ত কর।‘ এখন পড়লাম বিশাল ছিরিংখলায়। মাস্টার্সের থিসিস শুরু হয়েছে। সবাই যার যার বিষয় নির্ধারণ করেছে, আমিও একটা করেছি। ওটার কাজ শুরু করতে হবে। এর মধ্যে আবার এই দরখাস্ত। দুনিয়ার কাগজপত্র যোগাড় করতে হবে। এখন থিসিস করব, নাকি দরখাস্ত করব। থিসিসের সময় দুই মাস দশদিন। এক সেকেন্ডও বেশি না। বহু চিন্তা ভাবনা করে, কয়েকলাখবার কয়েন টস করে সিদ্ধান্ত লিনাম আগে দরখাস্ত করব, তারপর সময় যা বাঁচে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব। পাক্কা একমাস লাগল সব যোগাড় যন্ত্র করে কাগজপত্র গুছিয়ে দরখাস্ত কানাডার উদ্দেশ্যে পাঠাতে। থিসিস জমা দেয়া বাকি আছে আর একমাস দশদিন। সাথের সবাই মোটামুটি ডেটা কালেকশন করে উঠে এসেছে বা আসছে। দেহমন ঢেলে থিসিস শুরু করলাম। বরাবরের মত সবার শেষ ব্যক্তি হিসেবে থিসিস জমাও দিলাম। কাছাকাছি সময়েই ডিপার্টমেন্ট থেকে উত্তর পেলাম, হয়েছে- ভর্তি নিশ্চিত। কাগজপত্র সব ঠিক আছে। তারা এখন বাকি সব পাঠাবে, আমি যেন ভিসার দরখাস্ত করার প্রস্তুতি নেই।
অনেক ত্যানা প্যাচালাম। আর না- এবার সরাসরি নিয়ে যাচ্ছি কানাডায়। মাঝে যেই পরিমান ঘোল খেয়েছি তা আর নাই বলি।
আগেই রুবেন জানিয়েছিল ও আমাকে নিতে আসবে এয়ারপোর্টে। থাকার জায়গা ঠিক করেছে এক বন্ধু। এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে তার হাতে তুলে দেবে রুবেন। সে নিজ দায়িত্বে আমার বন্ধুকে খুঁজে বের করে, তার ল্যাবে বারকয়েক হানা দিয়ে এই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত হয়ে এসেছে। বত্রিশ ঘন্টার চরম বিরক্তিকর ভ্রমনের পর ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাইরে বের হতেই প্রথম যে চেহারাটা চোখে পড়ল তা রুবেনের। একটা ট্রলি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার ছবিই দেখেছি, তাই প্রথম দেখাতেই চিনতে পারলাম, সে আমার ছবি দেখা ছাড়াই আমাকে চিনে নিল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার নাম বলল নির্ভুল উচ্চারণে। তারপর জানাল প্লেন যদি আগে চলে আসে এই ভয়ে সে দুই ঘন্টা আগে এসে ট্রলি ধরে দাঁড়িয়ে আছে (আমি যদি ট্রলি না পাই)। তারপর জানাল তার চরম বাথরুম পেয়েছে, ট্রলি হাতছাড়া হয়ে যাবে এই ভয়ে সে বাথরুমে যায় নি। এখন যদি আমি দয়া করে বাইরে অপেক্ষা করি তাহলে সে বাথ্রুম যেতে চায়। আমি দয়া করলাম। বাথ্রুম শেষে এসে আমাকে যাবার সুযোগ দিল নিজে থেকেই, সে ব্যাগ পাহারা দিল। ট্রলি ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস কর। এই প্রথম দেশের বাইরে এসেছি শুনে সহমর্মিতা জানাল। গাড়ি পর্যন্ত গিয়ে আমার ভারি লাগেজ বুটে তুলতে হাত লাগাল। আমি তখনও জানি না কানাডায় যে গাড়ি বাংলাদেশের উলটা দিকে চালায়। তাই স্বভাব সুলভ কো-ড্রাইভারের সাইডে, কানাডার ড্রাইভিং সাইডে যেয়ে দাঁড়ালাম। ‘তুমি ড্রাইভ করবা?” জিজ্ঞেস করল ও; ‘ না তো!!” ‘ তাইলে ওই সাইডে খাড়াইসো কেন মিয়া?” আমি ঝুকেঁ জানালা দিয়ে দেখি আমার পাশে স্টিয়ারিং। জিহবায় কামড় দিয়ে জানালাম ভুল হইছে, মাটি খাই। হেসে বল্ল, ‘ ইটস ওকে মাই সান, আমিও প্রথম ইংল্যান্ড গিয়ে এই কাজ করেছিলাম”। এই প্রথম মাই সান বলল। তারপর সব সময় আমাকে সে ‘মাই সান’ বলেই ডেকেছে। ল্যাবে অ্যালেক্সও ছিল (ওর কথা ইউরোট্রিপে বলেছি), ওকে কোনদিন মাই সান ডাকতে শুনিনি।
যেতে যেতে অনেক কথা হল। তার সবই আমি কোথায় কোথায় ঘুরতে যেতে পারব, কি কি দেখতে পারব এই সব। পড়ালেখার কথা একটাও বলেনি। কথায় কথায় চলে এলাম ভার্সিটিতে যেখানে আমার বন্ধু থাকে। আমাকে নামিয়ে দিল। আমি দেশ থেকে ওর জন্য আনা পাঞ্জাবি আর ওর বৌয়ের জন্য আনা একটা শাল দিলাম। পরম আদরে বুকে টেনে নিল। প্রচন্ড খুশি হয়েছে পাঞ্জাবি পেয়ে। এই পাঞ্জাবির কথা সুযোগ পেলে পরে আরো বলব। চলে যাবার আগে বলে গেল যে সে সপ্তাহখানেকের জন্য বাইরে যাচ্ছে। আমার সাথে এর মধ্যে আর দেখা হবে না। আমি যেন ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াই, অ্যালেক্সের সাথে পরিচিত হই, কাজের কথা কিছুই বলল না।
পরদিন সকালেই ল্যাবে গেলাম। অ্যালেক্সের সাথে পরিচিত হয়েছি। দু’জন দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এমন সময় সে হাজির কি একটা কাগজ নিতে। আমাকে দেখেই বলল, ‘আরে তুমি এইখানে কি কর? তোমার তো আজকে জেট ল্যাগে থাকার কথা। বাড়ি যাও; বাড়ি যাইয়া ঘুমাও”। জানালাম “আমারে জেট ল্যাগে ধরে না”। “তাইলে থাক” বলে চলে গেল। যাবার আগে অ্যালেক্সকে বলে গেল আমাকে যেন কাজের চাপ না দেয়। আমার ইচ্ছা হলে কিছু দেখতে, না হলে নাই।
সপ্তাহখানেক পরে ফিরে এল একগাল হাসি নিয়ে। আমার কুশলাদি জানল, সাথে সাথে জানাল, ‘যেহেতু এইখানে আমার মা-বাপ নাই, তাই সেই আমার মা-বাপ; আমার কখনো কোন কিছু দরকার হলে আমি যেন তারে জানাই, এমনকি টাকা-পয়সাও।‘ তারপর লেগে গেল কাজ শিখাতে। আমি নতুন মানুষ, জানি না কিছুই। কথা যা বলে তার মোটামুটি সবই এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান, নাক-মুখ আর বাকি সব ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। ছিটেফোটা যা থেকে যায় তাতেই মাথা ঘুরায় বমি বমি লাগে। এতে আমি যতটা না দুঃখ পাই, রুবেনের দুঃখ তারচে কয়েকগুন বেশি। দশমিনিট কাজ দেখালে দুই ঘন্টা বিশ্রাম টাইপ অবস্থা। আমি নিজের উপর যতটা বিরক্ত, সে আমার পারফর্মেন্সে ততটা খুশি। গ্রুপ মিটিঙে ঘোষনা দিল যে আমাকে যেই প্রজেক্ট দেয়া হয়েছে তা যদি কেউ শেষ করতে পারে, সে হব আমি। এর আগে ব্রায়ান আর অ্যালেক্স ছেড়ে দিয়েছে না পেরে। ব্রায়ান আমাদের ল্যাব থেকে পিএইচডি করে এখন ইয়েলের টেনিউরড প্রফ।
আমার মধ্যে সে কি দেখেছিল জানি না, এত কুকীর্তির পরও আমার জন্য তার স্নেহ এখনও অটুট আছে দেখে তাজ্জবই লাগে...
বিরক্তি ধরে গেল না তো?
চলবে?
মন্তব্য
বিরক্তি ধরবে কেন? কি বলেন এইসব! ধুমায়া চালান।
গোঁসাইবাবু
হ, চালাই, একটু রইয়া সইয়া চালাই
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
চলবে ভাই। আর বিরক্তি ধরে নাই, কারণ তুচ্ছ কথাও আপনি মজা করে বলেন, ফলে সেগুলো আর তুচ্ছ থাকে না।
আমি তো রুবেনের আরও কাহিনি জানতে উদ্গ্রীব হয়ে আছি। পরবর্তী পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
আপ্লুতায়িত হলেম।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
"বিরক্তি ধরে গেল না তো?"
>> বিরক্তি ধরাতে হলে আরেকটু চেষ্টা করতে হবে।
"চলবে?"
>> মানে কি? এই লেখা বন্ধ হলে, পুড়বে বেগুন ঘরে ঘরে।
[img]IMG_0647 by rigsthedevil, on Flickr[/img]
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
আবার জিগস??? না চালালে আপনার---- (থাক, আর কইলাম না)।
____________________________
না কইয়া ভাল করছেন। আমি আবার ইয়ারকি ফাজলামি পছন্দ করি না।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
বিরক্তি ধরবে, ইয়ার্কি করেন নাকি ভাই। সামান্য কথা এত মজা করে বললে কারো বিরক্তি ধরা কি আদৌ সম্ভব।
চলবের পরে "?" কেন, কর্তৃপক্ষ জবাব চাই।
পরের পর্ব দিতে গিয়ে আবার হিমু ভাইয়ের মত চা খেতে বসেন না। চা খাওয়া খুব খারাপ।
----ইমরান ওয়াহিদ
চা খাই না, কফি খাই। হিমু ভাই চা খায়, সে খুব খারাপ।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
না চললে ৫৭-৬৬ ধারা টারা না মেনে কিন্তু এক্কেবারে দিমু।
মাসুদ সজীব
গোলাগুলি করা লাগবো না, যেই গরম পরছে, ফার্মগেটে ঘন্টাখানেক খাড়াইয়া থাকলেই বার্বিকিউ
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
ধুর মিয়া, ইউরোট্রিপরে তো গাছে তুইলা বসায় রাখছেন, ওস্তাদরেও যদি তুলছেন তো আপনার খবর আছে।
আপনি লাকি ম্যান, এমন ওস্তাদ পাওয়া সহজ ব্যপার নয়।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
হুম, আমার ওস্তাদভাগ্য বেশ ভাল।
আমার ওস্তাদ্রে গাছে তুলতে পারুম না। বেচারার বয়স হইছে।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
মনে ত হয় চলবে!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন