“সিরাজ উদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরুঢ় হইয়া, মাতা মহের পুরাণ কর্ম্মকারক ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা প্রতিদিন তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। সেই সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল, যে তৎকালে প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোন স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই।”
শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাঙ্গালার ইতিহাস।
….....................
নবাব আলিবর্দি মারা যাবার পর তাকে গোর দেবার আগেই সিরাজউদ্দৌলা তখতে লাফ দিয়ে বসেন। বসেই তিনি প্রথম কলকাঠি নাড়া আরম্ভ করেন খালা ঘষেটি বেগমের ঘষটামি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। ঘষেটি তার অঢেল পয়সাকড়ি নিয়ে মতিঝিল প্রাসাদে থাকতেন। প্রাসাদের চতুর্দিকে পানি, শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ভিতরে ঘষেটি বেগম তার লাভার নাজির আলি আর কয়টা সিপাই। কিন্তু ফাইট হলনা, আলিবর্দির বিধবা স্ত্রীর অনুরোধে ঘষেটি আত্মসমর্পণ করেন। নাজির আলিকে কানে ধরে দরবার থেকে বের করে দেয়া হয়, ঘষেটিকে চালান করা হয় হেরেমে আর তার পয়সাকড়ি চালান করা হয় কোষাগারে। এ সবই হয় আলিবর্দি দেহরক্ষার দশ দিনের মধ্যে। নবাব কিছুটা চিন্তামুক্ত এখন। তবে পুর্ণিয়ার নবাব, শওকত জং আর ইংরেজের সাথে বোঝাপড়া বাকি।
মারাঠা যন্ত্রণা কিছুটা কমে আসার পর আলিবর্দি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নানান ফ্যামেলি ঝামেলি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার অতি আদরের ধন সিরাজ গদি পাবার জন্য লাফঝাঁপ আরম্ভ করে দেয়, ১৭৫০ সালে সে বিদ্রোহও করে বসে। তরুণ গর্দভটিকে আলিবর্দি ক্ষমা করে দেন, বৃদ্ধ নবাবের এই নাতিটির প্রতি অসীম ভালবাসা ছিল। সেই ভালবাসার সুযোগ নিয়ে সিরাজ ইচ্ছেমত পাইকারি বজ্জাতি চালিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় ঐতিহাসিক গুলাম হুসেন খানের মতে,
“ভালমন্দের বাছবিচার না করে, আদব লেহাজের ধার না ধেরে তিনি যখন যা খুশী তাই করতেন। ছোট বড় মেয়ে মদ্দ কারুরই ছাড় ছিলনা তার সামনে। অতি অল্প সময়ে মিশরের ফারাও এর মতই তিনি ঘৃণ্য হয়ে উঠলেন, আর তাকে দেখা মাত্র লোকে মনে মনে ভাবত ও আল্লা বাঁচাও ডরাইসি!”
…
বিদ্বত্ত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।। ০১।। (চাণক্য নীতিশাস্ত্র)।
অর্থাৎ : বিদ্যাবত্তা এবং রাজপদ কখনোই সমান হয় না। রাজা কেবলমাত্র নিজ রাজ্যেই সম্মান পান, বিদ্বান (স্বদেশ-বিদেশ) সর্বত্র সম্মান পান।
চাণক্য নীতিশাস্ত্রের প্রথম শ্লোক এটি। শ্লোকটির বহুল ব্যবহৃত দ্বিতীয় চরণটা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত মনে হওয়ার কথা। কারণ, ‘স্বদেশে পূজিত রাজা, বিদ্বান সর্বত্র’- এরকম একটা ভাবসম্প্রসারণের বিষয় মাধ্যমিক ক্লাসের জন্য যথার্থই বলা চলে। এবং মজার বিষয় হলো, এরকম একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে বসলে আমরা যে-যত বিদ্যাদিগ্গজই হয়ে উঠি না কেন, বিশেষ ব্যতিক্রম বাদ দিলে, আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের জ্ঞানটাই খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।
চাণক্য
চাণক্যের প্রধান পরিচয় অতিপ্রসিদ্ধ একজন প্রাচীন ভারতীয় কূটনীতিজ্ঞ হিসেবে। মানবজীবনের প্রায় সকল কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে তাঁর শ্লোকসমূহ শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সকলের কাছেই অল্পবিস্তর পরিচিত। ভারতীয় বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে এযাবৎ যতজন পণ্ডিত-রত্নের কথা আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে চাণক্যকেই সবচাইতে প্রতিভাবান ও বাস্তববাদী বলে মনে হয়। বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’-প্রণেতা কৌটিল্য আর ‘চাণক্যশ্লোক’ নামে প্রসিদ্ধ শ্লোকসমূহের রচয়িতা একই ব্যক্তি কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও চাণক্যের একাধিক নামের মধ্যে কৌটিল্যও অন্যতম।
তাঁর একাধিক নাম বিষয়ে হেমচন্দ্রের ‘অভিধান-চিন্তামণি’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
‘বাৎস্যায়নো মল্লনাগঃ কৌটিল্যশ্চ ণকাত্মজঃ।
দ্রামিলঃ পক্ষিলস্বামী বিষ্ণুগুপ্তোহঙ্গুলশ্চ সঃ।।’
(আগের পর্বের পর...)
...
ভর্তৃহরির রচনাবলী
শৃঙ্গারশতক, নীতিশতক ও বৈরাগ্যশতক- এই শতকত্রয়ের কোথাও ভর্তৃহরির নাম লেখা না-থাকলেও তিনিই যে শতকত্রয়ের রচয়িতা- এ ব্যাপারে সকলেই প্রায় একমত। তবে কারো কারো মতে অবশ্য ভর্তৃহরি শতকত্রয়ের রচয়িতা নন, সঙ্কলয়িতা মাত্র। তিনি অন্য কবিদের রচিত এবং লোকমুখে প্রচলিত শ্লোকসমূহ বিষয়বস্তু অনুসারে তিনটি শিরোনামে বিন্যাস করেছেন বলে তাঁদের অভিমত (-Dr.Bohlen Ges Abraham Roger)।
.
এছাড়া শতকত্রয় ব্যতীত ভর্তৃহরির নামের সঙ্গে আরও কয়েকটি গ্রন্থের নাম যুক্ত করেছেন কেউ কেউ তাঁদের গ্রন্থে। সেগুলো হচ্ছে- ভট্টিকাব্য (বা রাবণবধ), বাক্যপদীয়, মহাভাষ্যদীপিকা, মীমাংসাভাষ্য, বেদান্তসূত্রবৃত্তি, শব্দধাতুসমীক্ষা ও ভাগবৃত্তি। এগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি যে শতককার ভর্তৃহরির রচনা নয় সে সম্পর্কে ইতঃপূর্বেই আলোচনায় এসেছে। অবশিষ্ট গ্রন্থগুলি সম্পর্কে পক্ষে বা বিপক্ষে যথার্থ কোন যুক্তি বা তথ্য এখনো অজ্ঞাত বলে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা এখনি সম্ভব নয়।
ভর্তৃহরি
.
সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য রক্ষিত না হওয়ায় সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম কবিশ্রেষ্ঠ ভর্তৃহরির জীবন-চরিতের জন্যে জনশ্রুতি-নির্ভর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিভিন্ন জনশ্রুতি-প্রসূত তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতককে ভর্তৃহরির অধিষ্ঠানকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী- ভর্তৃহরি ছিলেন মালব দেশের অধিবাসী এবং জাতিতে ক্ষত্রিয়। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভর্তৃহরির পিতার নাম ছিলো গন্ধর্ব সেন। গন্ধর্ব সেনের দুই স্ত্রী। প্রথমা স্ত্রীর পুত্র ভর্তৃহরি এবং দ্বিতীয়া স্ত্রীর পুত্র বিক্রমাদিত্য- যার নামে ‘সম্বৎ’ সন বা ‘বিক্রমাব্দ’ প্রচলিত। উল্লেখ্য, বিক্রম সম্বৎ গণনা শুরু হয় ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে।