১
মাঘ মাসের মাঝামাঝি। বেজায় শীত পড়েছে। জয়নাল ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল ১০ টা বাজে, কিন্তু মনে হচ্ছে শেষ রাত এখনও পোহায়নি। ঘড়িটা জয়নালের শ্বশুর বিয়েতে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। ক্যাসিও ডিজিটাল ঘড়ি। জয়নালের লেখা পড়া ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। ঘড়িতে সময় দেখতে তাঁর অসুবিধা হয় না। শ্বশুরের দেয়া ঘড়ি আর ৬ আনার একটা সোনার আংটি জয়নালের সর্ব সময়ের সঙ্গী। পানিতে ভিজলেও কিছু হয়না বলে ঘড়ি আর আংটি পড়েই খাওয়া গোসল সারে সে। হাসিনার সাথে বিয়ের পর তাঁর ভাগ্য খুলে গেছে। তাত বুনে দিন চালায় জয়নাল। হাসিনার সাথে বিয়ের পর পর তাঁর বিক্রি বেড়ে গেছে। মহাজনরা দামও দিচ্ছে ভাল। ঘড়ি আর আংটি সে ভাগ্যের প্রতীক হিসাবে পড়ে।
ঘড়িতে দশটা পঞ্চাশ, এই সময়ে বদরুলের থাকার কথা ছিলো প্রগতি ফার্মের হেড অব মার্কেটিং সুমন কিবরিয়ার বাসার ডয়িংরুমে অথচ সে বসে আছে ফার্মগেট মোড়ে ছত্রিশ নাম্বার বাসের একেবারে পেছনের সারির একটি আসনে। অধিক জনসংখ্যা কি কারণে আর্শীবাদ বদরুল কোনদিনও বুঝতে পারেনি, তবু রাত বিরাতে টেলিভিশন টকশোতে কিংবা কোন কোন রাজনৈতিক নেতার উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে সে মাঝে মাঝে শুনতে পায় অধিক জনসংখ্যা নাকি সম্পদ। তার মনে পড়ে ছেলে বে
বাড়িতে আরও কতগুলি মেয়ে ছিল, তবু ফাতেমাই ছিল সেরা, আর এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ দেখায়নি কেউ! তাই যখন এক দুবাই-ফেরত ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে হুট করে বিয়ে হয়ে গেল, ভ্রু-টা পর্যন্ত কোঁচকালো না কেউ! বরং ঈদ-পার্বণ সামনে রেখে ফাতু যখন সোনায়-দানায় থলথল হয়ে বাড়ি আসতো, তখন মেয়ের উপচানো সুখে সবারই চোখ জুড়িয়ে যেত, শোকর-গুজরানও চলত পাল্লা দিয়ে, “হইব না? আল্লাহ্র নিজের হাতের জিনিস যে!”
লালচরী মাঠের উপর সুলতান মহব্বত জং এর তাঁবু। সকাল।
বড় একটা গাছের গুঁড়ি মাঠে পোঁতা, তাতে পিছমোড়া করে বাঁধা মধ্যবয়েসী হাসিন বানু। একটু দূরত্ব রেখে তাকে ঘিরে গোল হয়ে দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর মানুষ। ভীড় ঠেলে কসাই জমির আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তার দিকে, হাতে ছুরি। প্রতিদিন বিশটার উপর গরু জবে দেয় সে, চিকন ছুরি দিয়ে পশুর ছাল ছাড়িয়ে আনা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। তবে জ্যাতা মানুষের ছাল ছাড়ানো তার এই প্রথম।
খুব সাবধানে হাসিন বানুর ঘাড়ের পিছনে ছুরি দিয়ে পোঁচ দিতে শুরু করল জমির, আর হাসিন বানুর আর্ত চিৎকার শুনে ভয়ে ডানা ঝটপট করে উড়াল দিল পাশের ডালে বসা দুইটা পাখি।
সকালের বৃষ্টির ঝাঁঝালো শব্দ ছাপিয়ে টিঁউটিঁউ করে একটা কোলাহলময় মিষ্টি শব্দ কানে এলো। শব্দটা তেমন জোরালো না। একটু খেয়াল করে শুনলেই বোঝা যাচ্ছে। শব্দের উৎস খুঁজতে জানালার দিকে চোখ গেলে দেখলাম একজোড়া চড়ুই কার্নিশের আড়ালে বসে পালকের পানি ঝাড়ছে তিরতির করে। আমি জানালার এপাশে। ওরা নীলচে কাঁচের আড়ালে আমাকে দেখতে না পেলেও আমি ওদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পাখির জগত প্রায় সবসময় জুটিময়। তবে হলিউডের অ্যাকশান মুভিতে যেমন পুরুষের পাশে জোর করে একটা নারী চরিত্রকে বসিয়ে দেয়া হয় সেরকম আরোপিত কিছু না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ওরা পাশাপাশি থাকে।
১
৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। কাঁটায় কাঁটায় চার মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। আমি ঘড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। জিনিশটা অদ্ভুত। কারও সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে পারলে মনটা একটু হাল্কা লাগত। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমাকে?
সারওয়ার? লায়লা ডাকল।
ঠিক ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড আগেই আমি জানতাম আমাকে লায়লা ডাকবে। আমি কোন উত্তর দিলাম না। লায়লা আমাকে কেন ডাকছে সেটাও আমি এই মুহূর্ত থেকে ৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড আগেই জানতে পেরেছি। বসার ঘরে পত্রিকা পড়ছিলাম। দরজায় এসে দাঁড়াল লায়লা।
[সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেই দুই বোন দরজায় এসে দাঁড়ায়। আঁচল দরজা খুলতে পারে এবং সে কৃতিত্বের জন্য তাকেই কোলে নিতে হয় আগে । চারু হাত দুটো উঁচু করে আঁ আঁ করতে থাকে। কোলে নেই তাকেও। করপরেট খাটুনীতে বলহীন শরীর থাকে আরো দূর্বল। কিন্তু এই সুযোগ প্রতিদিন হয় না। বাসায় ফিরে দেখি বেশীর ভাগ দিন দুই বোন ঘুমিয়ে পরেছে। আঁচলের তিন বছর হওয়ার পরে আমাদের সংস্কৃতির অন্তত কিছুটা ছোঁয়া দিতে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ভারতীয় উচ্
আমি ওদেরকে দেখে থেমে গেলাম।
এই নির্জন শুনশান রাস্তায় একটা দোকানের শাটারের সামনে ওরা কিছু একটা করছে।
মনে হচ্ছে ওরা শাটার খোলার চেষ্টা করছে। তবে শাটারটা বেশ ভারী আর মজবুত। তাই বেশ বড়সড় একটা শাবল ব্যবহার করেও ওটা খোলা যাচ্ছে না।
আমি আসলে রাতের বেলা একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম, নির্দিষ্ট করে কোথাও যাচ্ছি না আমি। এই এদিক ওদিক ইতিউতি ঘোরাঘুরি আরকি!
আমি ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।