স্টারপার্টি হবার কথা ছিলো এপ্রিলের শেষের দিকে, কোনো একটা সুন্দর সন্ধ্যায় যখন আকাশ স্বচ্ছ-নির্মল, একেবারে পরিষ্কার। কিন্তু কী কারণে যেন পাল্টানো হলো সময়, আসলে সেমেস্টার শেষ হবার মুখে ব্যস্ততা খুবই বেশী থাকে, সমস্ত ফাইনাল পরীক্ষা টরীক্ষা ফাইনাল-গ্রেডিং গ্র্যাজুয়েশান অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবই তো তখন! তখনের জন্য অপেক্ষা করলে হয়তো বাতিল হয়ে যেতে পারে, তাই ফেব্রুয়ারীতেই হলো স্টারপার্টি।
পেয়েছি! আর কিছু চায় না। এ যে বিভূতিভূষণের ময়নাকাঁটা। কত বন-বাঁদাড়ে এর খান তল্লাস করেছি, পায়নি। চিনিই না তো পাব কীভাবে? যারা দেখেছেন, চেনেন, তাঁদের মুখে বর্ণনা শুনে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তবুও দেখা মেলেনি। আজ এভাবে অপ্রত্যাশিত দর্শনের কথা ভাবিইনি। ময়নাকাটা বাংলাদেশের সবজায়গায় ছিল কিনা জানা নেই। তবে আমাদের এলাকায় যে এর প্রাচুর্য ছিল তার সাক্ষ্য বিভূতিভূষণই দিয়েছেন।
১।
আসে না আসে না করে শেষ পর্যন্ত বসন্ত এসেই গেল। কাজের পথে অনেক ফুল ফুটতে দেখছি গত কয়েকদিন। নজর কেড়ে নিচ্ছে মূলত ফোরসাইথিয়া আর ড্যাফোডিল। চেরি আর ম্যাগনোলিয়া এই সপ্তাহের শেষ নাগাদ ফুটে যাবে মনে হচ্ছে।
কাল বাড়ি ফিরে নিজের বাগানের দিকে তাকাচ্ছিলাম, আমার ওদের এখনো মাটির সাথে মাখামাখি। কেবলমাত্র ড্যাফোডিল গুলোকেই দেখা যাচ্ছে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে। এমনিতেও আমার ওরা একটু দেরিতে ফুটে। তাতে ভালো হল, সবার যখন ফুল ফোটা শেষ আমার তখন আমার প্রাঙ্গণ জুড়ে ফুল ফোটানোর খেলা। তবু এবার যেন একটু বেশী-ই দেরী হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গে ছিলাম মাত্র তিনটি বছর, প্রায় ছয় দশকের এই জীবনের তুলনায় কতটুকু আর তা! অথচ সেই দিনগুলির কত যে ছবি স্তরে স্তরে রাখা আছে স্মৃতির কোষে কোষে! কোষগুলি ধূসর নিশ্চয়ই, আমার সে স্মৃতিগুলি আজো ধূসর নয়, ক্যালিডোস্কোপের নড়াচড়ায় দিব্যি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে।
মাঠে মাঠে ঘোরা আমার ছেলেবেলার অভ্যাস। আমাদের একটা বাগান ছিল। একপাশে বাঁশবন আরেক পাশে দেশি আমের সারি। ঠিক দুপুরের বাগানে বসে আপন মনে খেলতে ভালবাসি। ঠিক খেলা নয়, ছেলেমানুষী। বুনো লতা পাতার গায়ে হাত বোলানো, কোন গাছে কটা ফল ধরেছে তা গুণে দেখা, শুভ্রপালক শাহ বুলবুল পাখির পেছনে বাগানময় ঘোরা--ছেলে মানুষী ছাড়া কী! নিরিবিলি খেলতে ভালবাসতাম, তেমনি ভয়ও পেতাম খুব। বেঁশেভূতের ভয়। মধ্যদুপুরেই তাদের যত বাহাদুরি।
ছোট্টোবেলার বন্ধুত্বের স্মৃতি ভারী মধুর। দুনিয়ার নানা জটিলতা তখনও জানা থাকে না বলে প্রথম বন্ধুত্বগুলো একেবারে অমলীন, শরতের শিশিরবিন্দুর মতন টলটলে, নির্মল। ঠিক যেন সবুজ পাতার উপরে মুক্তোবিন্দুর মতন জমে আছে, নতুন ওঠা সূর্য ঝলমল করছে তার ছোট্টো দেহে।
এমনিতে ঘুমের ক্লাসে মোটেই ঘুমাতাম না, একদিন কীজানি কী হলো ঘুমের ক্লাসে খুব ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের আগে শেষ যেটা মনে আছে, চিত্রালী আর আমি পাশাপাশি শুয়ে ফিসফিস করে গাইছিলাম, "আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই/ ঠাকমা গেল গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।" বারে বারে ঘুরিয়েফিরিয়ে এই লাইন দুটো গাইছিলাম আর ফিরফির করে হাসছিলাম। তারপরে আর কিছু মনে নেই।