• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

ক্ষুধা ও প্রেমের যুগল কান্না

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০১/০৬/২০০৮ - ৫:৫২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো পিজি হাসপাতালের বহির্বিভাগে। হাতে সদ্য সংগৃহীত ব্যবস্থাপত্র। লাইনে দাঁড়িয়েছে ওষুধের জন্য।

আমি লাইনে দাঁড়ানোর কথা ভেবেও একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরই মধ্যে দেখেছি যে, বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার কাউন্টার থেকে অনেককেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওষুধ নেই। তবে ওষুধ যে একেবারেই নেই, তাও কিন্তু নয়। ছোটখাট ও স্বল্পমূল্যের কিছু কিছু ওষুধ দেওয়া হচ্ছিলো।

ডাক্তার আমার ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধগুলোর নাম লিখে দিয়েছে, তা এখানে পাওয়া যাবে না। একটি সিরাপ আর দু ধরনের ক্যাপসুল। সব মিলিয়ে শ দুয়েকের মত খরচ হয়ে যাবে। যদিও আমার কাছে চার-শ টাকার মত ছিলো। তবুও সাহস পেলাম না। মেসের খরচ বাদ দিলেও প্রতিদিনকার টুকটাক খরচ, তা ছাড়া কখন কোন বিপদ এসে হানা দেবে ঠিক নেই। এ থেকে একটি জরুরি বই কিনতে লাগবে দেড়-শ টাকা। তাই ঠিক করেছিলাম যে, কিপ্টেমী করেই মাসের বাকি দিনগুলো চালিয়ে নেবো। আট-দশদিন পর তো টিউশানির টাকাগুলো পেয়েই যাবো। আর তখন ওষূধগুলো কিনতে কোনো সমস্যা হবে না।

পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পরপর তাকে লক্ষ্য করছিলাম। ব্যাপারটা সেও লক্ষ্য করেছে। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সে একবার হাসিহাসি মুখে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলো। তাও সামান্য সময়ের জন্য। নিজের অজ্ঞাতেই হয়তো আমার মুখেও হাসি ফুটে উঠেছিলো। যেটার প্রভাব তখনই তার চেহারায় প্রতিভাত হয়ে উঠতে দেখেছিলাম। কিন্তু কাউন্টারের গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে সে ওষুধ নিয়ে বের হয়ে এলেও তার মুখের অন্ধকার দূর হয়নি।

কিছু একটা গভীর ভাবে ভাবতে ভাবতে আমার সামনে খানিকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। হঠাৎ আমাকে কিছু বলতে চেয়ে মুখ তুললেও কোনো কারণে ইতস্তত করে আবার মুখ নামিয়ে নেয়। আমি টের পাই তার বিবক্ষা। বলি- সবগুলো পেলেন?

- নাহ। ফ্লাজিল আর প্যারাসিটামল। আসল দুটোই বাকি রয়ে গেছে।

- ও দুটো কি?

- বুজুরি আর একটা ভিটামিন ইনজেকশান!

বলি, বুজুরি তো খুবই সস্তা! বারো-চৌদ্দ টাকা মাত্র।

সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, বারো-চৌদ্দ টাকা তো দূরের কথা, বারো-চৌদ্দ পয়সা হলেও সম্ভব না!

হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়- কেন?

- কেন আবার? পয়সা নেই, তাই!

- ওষূধ কার জন্য?

- আমার ছোট ভাইয়ের!

তারপরই সে কেমন রুক্ষ কন্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে- এত কথায় আপনার কাজ কি?

তার বিষাদিত মুখাবয়বের বিকৃতি দেখে আমার চুপসে যাওয়ার কথা থাকলেও বলে উঠি- কে কখন কাজে লাগে কি করে বলবেন?

সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকায়। তারপরই একটি ক্লিষ্ট হাসি দিয়ে শান্ত স্বরে বলে- তাহলে ওষুধ দুটো কিনে দেন!

আমার মনের ভেতর কোনো ক্ষোভ বা অনুকম্পা কাজ করছিলো না। তবু কেন জানি বলে উঠি- চলেন!

হাসপাতাল চত্বর থেকে বেরিয়ে এসে ওষুধের দোকানগুলোর দিকে যাই। একটি দোকানে ঢুকে সে ব্যবস্থাপত্রটি দোকানির সামনে মেলে ধরে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

আমি এগিয়ে গিয়ে বলি- দাম কত আসবে?

- আটাত্তর টাকা।

- ঠিক আছে।

পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। তখনই সে উজ্জ্বল মুখে বলে উঠলো- টাকাটা ফেরত দিলে না করবেন না কিন্তু!

- না করবো কেন?

তারপর বলি- আপনি খয়রাত নেবার মেয়ে যে নন, দেখেই কিন্তু বুঝতে পেরেছি!

- সামনের সপ্তাহে আপনাকে কোথায় পাবো?

- শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন গেটের সামনের চায়ের দোকানটায় বসে থাকি।

-কী করেন এই সময়টা?

- কিছুই না। বসে থাকি।

- তারপর?

- ছয়টার দিকে বাসে উঠে পড়ি। মোহাম্মদপুর যাই।

আমরা হেঁটে ফুটপাতে এসে দাঁড়াই। সে বললো- এই একঘন্টা সময় বসে থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?

- লাগলেও কিছু করার নেই।

- থাকেন কোথায়?

- পরীবাগ।

- বাবা-মা সঙ্গে আছে, না একাই?

- একাই। মেসে।

- ও। বলেই যেন হঠাৎ চুপসে গিয়ে রাস্তার ব্যাস্ত যানবাহনের দিকে সে তাকায়। তাকিয়েই থাকে।

বলি, কিভাবে যাবেন?

- হেঁটে।

- কতদূর?

- বনগ্রাম।

আমি বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠি, এতদূর হেঁটে যাবেন?

এবার সে হাসে। বলে, প্রতিদিন তো হেঁটেই আসা-যাওয়া করি। শেষ কোনদিন রিকশায় উঠেছিলাম মনে করতে পারি না।

তারপরই সে ফুটপাত থেকে নেমে আমার দিকে ফিরে বললো, আচ্ছা, চলি! সহযোগীতার জন্য ধন্যবাদ!

আমি মাথা নেড়ে সায় দেই। রাস্তা পেরিয়ে সে দক্ষিণে হেঁটে যায় ফুলের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে। আমি এক ঠায় তাকিয়ে থাকি তার চলে যাওয়ার দিকে। কিন্তু সে একবারও ফিরে তাকায় না।


হঠাৎ করেই আমার জ্বরের তীব্রতা বেড়ে গেলে নতুন মাসের প্রথম সপ্তাহটা কাউকে পড়াতে যেতে পারিনি। ক্লাসের কথা তো বাদই দিলাম। এরই মাঝে রুবা আমাকে পরপর তিনদিন ক্লাসে না দেখতে পেয়ে দশটার দিকে মেসে চলে এলো। কিন্তু ঠিকানা যে কোত্থেকে যোগাড় করেছে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও বলেনি। মুচকে মুচকে হাসছিলো কেবল। বলতে না চাইলে থাক। আমি আর তাকে চাপাচাপি করি না।

আমার বিছানার পাশে একটি চেয়ার টেনে বসে সে বললো, -ক্লাস করছিস না কেন?

- কিভাবে করবো? শরীরটা ভালো না।

- হয়েছে কি? জ্বর?

আমার কপালে হঠাৎ সংকোচহীন হাত রাখে রুবা। বলে, ইস, জ্বর তো অনেক! এক্ষুনি মাথায় পানি ঢালতে হবে।

আমিও বুঝতে পারছিলাম যে, আমার জ্বরের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু করবো কি, বিছানা থেকে উঠবার শক্তি পাচ্ছিলাম না। মাথায় পানি দিতে পারলে ভালোই যে হবে জানি। তবুও বলি, তোকে অতটা উদ্বিগ্ন হতে হবে না। তুই যে এসেছিস, এ নিয়েই পরে অনেক কথা হজম করতে হবে।

রুবা হাসে। বলুক না। যেটুকু সত্যি ততটুকুই তো বলবে। নাকি?
আমার কথা বলতে ভালো লাগছিলো না। এমন সময় বুয়া এসে বলে, ভাইয়ের জ্বর কমে নাই?

রুবা বললো, মাথায় পানি দিতে বলছিলাম। শুনলো তো না!
তারপরই সে উঠে যায়। বুয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হয়তো রান্নাঘরের দিকেই যায়। আর তার কিছুক্ষণ পরই মাথায় পানির শীতল পরশ পাই। আমার ঘোর লেগে যায়। ছোট থাকতে জ্বরের সময় ঠিক এভাবেই মা মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে এক হাতে তালুটা চটকে চটকে দিতেন।

জ্বর হয়তো আরো বেড়ে গিয়ে থাকবে। যে কারণে আমি মায়ের পরশ কিংবা অন্য কারো পরশ পার্থক্য করতে পারি না।

তারপর রুবা প্রতিদিনই আসে। অর্থাৎ একটানা চারদিন। আমার খোঁজখবর নেয়। ওষুধ পরীক্ষা করে দেখে যে, ঠিকমত খাচ্ছি কি না। জ্বর থেকে মুক্তি পেয়ে রুবাকে বলি, তোর হাতে আমার জননীর ছোঁয়া পাই।

আমার কথা শুনে হয়তো মনেমনে সে খুশিই হয়। কিন্তু তা আড়াল করতেই বুঝি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, দিলি তো বারোটা বাজিয়ে। এখন ইচ্ছে থাকলেও তোকে বিয়ে করতে পারবো না!

আমি জানি এটা তার বাহ্যিক আবরণ মাত্র। শাহিনকে ভালোবাসে। হয়তো কোনো একদিন তাদের বিয়েও হবে। কিন্তু এও জানি, আমার সঙ্গে যত গাঢ় বন্ধুত্বই হোক না কেন, রুবাদের মত বাস্তববাদী মেয়েরা জেনেশুনে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। সাধ করে কে-ই বা নিজের ঘরে আগুন লাগাবে? তাই রুবার কথায় আমি আরো জোরে জোরে হাসি। ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের কাছে রুবার মাতৃমনের পরিচয় তুলে ধরলে কেউ কেউ ওকে আন্টি বা খালাম্মা বলতে আরম্ভ করলো। কিন্তু এতে তার মাঝে তেমন কোনো ক্ষোভের প্রকাশ দেখি না। মনে হয় ব্যাপারটা সে খুবই উপভোগ করছে।

পরদিন শাহিন এসে হঠাৎ রুবা আর আরো কয়েকজনের সামনেই আমাকে বলে বসলো, রুবা তোর জননী হলে আমাকে আব্বা বলিস না কেন?

অন্যরা মজা পেলেও রুবার মুখ কালো হয়ে যায়। কিন্তু শাহিনকে জব্দ করার জন্য বলি, তোদের তো এখনো বিয়েই হয়নি!

- হয়নি। হবে!

আমি বেশ মজা পাচ্ছিলাম। বললাম, জননীর স্বামী যে আব্বা হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আমি জানি জন্মদাতাই আব্বা হতে পারে!

রুবা খুশি হয়ে শাহিনের দিকে তাকিয়ে বললো, এবার বোঝো! সবাই তোমার মত স্টুপিড না!

- আমার শিক্ষা হয়েছে।

হাসতে হাসতে হাত জোড় করে শাহিন।

তারপর বলে, কে কে চা খাবে?

বলতে গেলে আমি আর রুবা ছাড়া সবাই মাথা নাড়ে। কিন্তু রুবা জানায়, আমি লেবু-চা হলে খাবো।

চা-অলা আসে। খেলনার মত পিচ্চি পিচ্চি কাপে করে সবার হাতে লেবু-চা ধরিয়ে দেয় লোকটা। চায়ের কাপ হাতে আমরা সবাই ভিন্ন প্রসঙ্গে মেতে উঠি।


এতদিন কোথায় ছিলেন?

জীবনানন্দ দাশকে প্রশ্ন করেছিলেন বনলতা সেন। কিন্তু আমার প্রশ্নকর্তৃ তিনি নন। ভিন্ন একজন।

আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সে আবার বলে, বাসায় ফেরার সময় প্রতিদিন একবার করে এখানে আসছি।

বললাম, অসুস্থ ছিলাম।

সে ক্ষণকাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, মুখটা কেমন শুকনা শুকনা দেখাচ্ছে। কী হয়েছিলো?

- জ্বর।

সে আমার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বলে, স্বাস্থ্যটাও কেমন ভেঙে গেছে।

- তাই?

কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতর হাতড়াতে হাতড়াতে বললো, আমি তো ভাবছিলাম আমার দেরি দেখে বুঝি মনে মনে কত কিছুই না বলছেন! তবুও অফিস ছুটি হলে এদিকটা একবার ঘুরে যাই।

- অফিসটা কোথায়?

- পল্টনে।

মনে মনে ভাবি, এ পথটুকুও সে হেঁটে আসে। পরিণামে তাকে হাঁটতে হয় দ্বিগুণ। ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও বলি, কী অফিস?

- বিজ্ঞাপন বানায়।

আমি আর জিজ্ঞেস করি না যে, তার কাজটা কী ধরনের।

ব্যাগ হাতড়িয়ে সে একটি ভাঁজ করা খাম বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে। বলি, এটা কি?

- আপনার টাকাটা।

যেহেতু আমি অর্থশালী নই, তা ছাড়া প্রথম দিনই সে টাকাটা ফেরতের অঙ্গীকার করেছিলো। তাই খামটা নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখি। ব্যাপারটা দেখে সে আৎকে উঠে বলে, করছেন কি? বাসে পকেট মার থাকে!

- জানি!

তারপর হাসতে হাসতে বলি- বাসে উঠার সময় ওয়ালেটের সঙ্গে হাতে নিয়ে নেবো।

- আপনি কি করেন তা তো জানা হলো না। অবশ্য আমিও কখনো জিজ্ঞেস করিনি।

আমি কি বলবো? সে যেভাবে কথা বলছিলো, যদি শোনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ছি, তাহলে হয়তো তার প্রগলভতায় বাধা পড়বে। তার কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করি- আপনার ভাইয়ের অবস্থা কি?

তার মুখটা অকস্মাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। স্বতস্ফুর্ত ভাবে বলে উঠলো, পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে! সবাই তো অবাক। ছ-মাস ধরে যে অসুস্থ, মাত্র দুই সপ্তাহেই সেরে উঠেছে!

মনেমনে ভাবছিলাম, অবাক হওয়ারই কথা।

-জানেন, মা বলছিলো আপনাকে একদিন নিয়ে যেতে।

বিস্মিত হয়ে বলি, আমার কথা ঘরে বলতে গেলেন কেন?

- বারে, উপকারের কথা বলবো না কেন?

আমি চুপ করে থাকি। কী বলবো, তেমন কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তার পায়ের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখি ডান পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলের শুকতলা নেই। হাঁটতে হাঁটতে সস্তার স্যান্ডেলের শুকতলা কোথায় খসে পড়েছে তা হয়তো বুঝতেই পারেনি। এখনও হয়তো বুঝতে পারছে না। যদি ব্যাপারটা তাকে মনে করিয়ে দেই, তাহলে বেচারি লজ্জা পেতে পারে। বলি, এককাপ চা খান!

সে মাথা নাড়ে।

তারপর কেমন অস্থির ভাবে হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, যাই!

সে ফিরে ফুটপাত থেকে নেমে পড়ে রাস্তায়। তখনই আবার কি মনে করে উঠে এসে বলে, মাঝে-মধ্যে দেখা করতে এলে বিরক্ত হবেন না তো?

আমি মাথা নেড়ে বলি, না। বিরক্ত হওয়ার কি আছে?

- খুশিও হবেন না!

- না, খুশি হবো!

- সত্যি?

- সত্যি!

মাথার ঝুঁটি বাঁধা চুলে ঝাঁকুনি দিয়ে সে ফের নামে রাস্তায়। ডানে-বামে তাকিয়ে দ্রুত পেরিয়ে যায় ব্যস্ত রাজপথ। পুষ্পহাটের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে এগিয়ে যায় দক্ষিণে। আমি তাকিয়ে থাকি তার চলার সঙ্গে সঙ্গে হেলতে দুলতে থাকা চুলের ঝুঁটির দিকে। আমি তাকিয়েই থাকি। এক সময় সে আড়াল হয়ে যায়। কিন্তু একবার পেছন ফিরে তাকায় না।


তার নাম যে পুষ্পরানী এতদিনে আমার জানা হয়ে গেছে। প্রতি বৃহষ্পতিবার তার অফিস ছুটি হয়ে যায় দুটোয়। আগে নাকি এই নিয়মটি ছিলো না। তাই সেদিন অফিস থেকে বেরিয়েই চলে আসে আমার কাছে। সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এক সঙ্গে কাটে আমাদের। এরই মধ্যে তাদের বাসায় অনিয়মিত হলেও আমার যাওয়া আসা হয়। প্রতি শুক্রবার না হলেও মাসের কোনো একটি শুক্রবার তাদের বাসায় যাই। গেলে অবশ্য ওরা খুশিই হয়। বিশেষ করে পুষ্পর ছোট ভাই আনন্দ। প্রত্যেকবারই তার জন্য জুস কিংবা চকলেট নিয়ে যাই। পকেটের উপর বাড়তি চাপের কারণে আরো দুটো টিউশানি ধরেছি। সব মিলিয়ে এখন ভালোই পাই। যে শুক্রবারটায় বনগ্রাম পুষ্পদের বাসায় যাই, ঠাটারী বাজার থেকে ভালো মাছ, মুরগি নয়তো গোশ নিয়ে নেই। ওরা খুশি হয়। দিনটির আশায় ওরা পথ চেয়ে বসে থাকে। এসব ঘরোয়া ব্যাপারগুলো অবশ্য পুষ্পর মুখ থেকেই জানতে পাই। কথার ফাঁকে ফাঁকে আরো জানতে পাই, তাদের বিপত্মীক বাড়িঅলা প্রস্তাব দিয়েছে পুষ্পকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু সে রাজি নয়। বিয়ে হয়ে গেলে তো সে আমার সঙ্গ পাবে না।

আমি তাকে কিছু বলি না। কিংবা সেও আমাকে বলে না বিয়ের জন্য। অথচ বলাটা তেমন কোনো অন্যায় হতো না। বরং ব্যাপারটি গোপনে গোপনে আমার প্রত্যাশিতই বলা যায়।
এতদিনে সেও জেনে গেছে যে, পিতৃমাতৃহীন অনাথ আমি। টিউশানি করে ঢাকা শহরে থেকে নিজের লেখাপড়া সহ যাবতীয় খরচ চালাচ্ছি। তার আরো জানা হয়ে গেছে যে, শুধু ঢাকা শহর তো দূরের কথা, পৃথিবীতেই আমার আপনজন বলতে কেউ নেই।

এখন আমি যদি বলি, পুষ্প, তোমার কাপড়গুলো বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। একটি থ্রি-পিস নয় তো সাতগজ সূতী-কাপড় কিনে দেই? কিংবা বলি, এই টাকা কয়টা রাখ। আনন্দকে স্কুলের ড্রেস বানিয়ে দিও। তখন সে অনায়াসে হাত পেতে টাকাটা নিতে কোনো সংকোচ বোধ করে না। কিংবা আমাকে দিয়ে অঙ্গীকার করায় না যে, ফেরত দিলে নিতে হবে। কোনো কোনো মাসে অকস্মাৎ আমার টাকা ফুরিয়ে গেলে বা টিউশানির টাকা পেতে দেরি হলে তাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পুষ্প, শত খানেক টাকা দিও তো! আমার পকেট একেবারেই খালি!

এভাবেই কেমন স্বপ্নের মত পেরিয়ে যাচ্ছিলো আমার সময়গুলো। পড়া তৈরী করা। টিউশানি ঠিক রাখা। কাপড়-চোপড়ে আরো খানিকটা ধোপ-দুরস্ত হওয়া, বলতে গেলে সবটাতেই তার নির্দেশ মেনে চলতে চেষ্টা করি। শুধু কি তাই? আজকাল মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, বিয়ে যদি করতে হয় তো পুষ্পকেই। কিন্তু বলি বলি করে আর বলা হয়ে উঠছিলো না। কারণ কিছুদিন পরই শুরু হবে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। তা ছাড়া একটি ভালো চাকরির অফারও আছে। আমি যে তাকে ভালোবাসি, কথাটি মুখ ফুটে এখনও না বললেও সে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে আমার অন্তর্গত যাবতীয় দীর্ঘশ্বাসের ওজন আর অনুভব করতে পারে তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আমার ছোটছোট স্বপ্নগুলো।

পরীক্ষার কারণে পুষ্প সাময়িকভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ করেই যেন আমি বনগ্রাম যাই। শুক্রবার আসতেই আমার যেন তর সয় না। ছুটে যাই প্রায় সকাল সকাল। আমাকে দেখতে পেয়েই আনন্দ যেন ফেটে পড়ে উল্লাসে। কবির দা! কবির দাদা আসছে!

একটি মাত্র ঘরে তিনজন থাকলেও পুষ্পকে দেখতে পাই না। রান্নাঘরে তার মায়ের কাজে ব্যস্ততার আভাস পাই। আনন্দকে বলি, দিদি কোথায়?

আমার কথার জবাব না দিয়ে সে বললো, জানো দাদা, শুক্কুরবার দিদির বিয়ে! লোকটা বুড়ো। আমার একটুও ভালো লাগে না!

ভেতরে ভেতরে ভাঙচুড় শুরু হলেও আমি চুপ থাকি। কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো যে, চিৎকার করে বলি, না! পুষ্পকে আমি বিয়ে করবো!

কিছুক্ষণ পরই পুষ্প ঘরে এসে তার ভাইকে বললো, আনন্দ, তুই বাইরে যা! যতীনের সঙ্গে ক্যারাম খেল গিয়ে!

আনন্দ যেন উড়ে বেরিয়ে যায়।

পুষ্পকে দেখে অভিমানে আমার বুক ভারী হয়ে আসে। ইচ্ছে হয় তাকে বলি, এটা কী করলে পুষ্প? মাত্র দুটো সপ্তাহের অদর্শন আমাকে দূরের মানুষ করে দিলো? মনে হচ্ছিলো আমি কেঁদে ফেলবো। কিন্তু তবুও চেষ্টা করে নিজকে সংযত রাখলাম। আমি যে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছি, অবয়বে হয়তো কোনো প্রকাশ ছিলো না। যে কারণে পুষ্প স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারে, কেমন আছ? কাল যাইনি বলে কি রাগ করেছো?

কোনোরকমে বলতে পারি, কত সমস্যাই তো হতে পারে!

আমি যে আনন্দর কাছ থেকে তার বিয়ের সংবাদ জেনে গেছি তা আর প্রকাশ করি না।

পুষ্প আমার পাশে বসে বললো, ধরো, কোনো কারণে যদি তোমার আমার দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কি খুব কষ্ট পাবে? বলতে বলতে তার উজ্জ্বল মুখ বিষাদে ছেয়ে যায়।

বেদনা হত আমি বুকে পাথর চেপে তাকিয়ে থাকি তার মুখের দিকে।

সে আমার একটি হাত ধরে বললো, অনেক ভেবে দেখলাম, বিয়েতে রাজি না হয়ে উপায় নেই। তা ছাড়া বুড়ো তার আগের ছেলে-মেয়ে আর পঞ্চায়েতের সামনে কথা দিয়েছে আনন্দ আর মাকেও দেখবে। আমার কারণে যদি তাদের খাওয়া-পরার সমস্যাটা মিটে যায় তো মন্দ কি? আমিই যে তাদের একমাত্র অবলম্বন!

তারপর অকস্মাৎ তার বিষাদ মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বললো, শুক্রবার আমার বিয়ে!

কথাগুলো বলার সময় তার মুখে হাসি থাকলেও কেন যেন তা স্বাভাবিক থাকে না। কেমন জোর খাটানো বলে মনে হয়। তবুও আমি বলতে চাচ্ছিলাম, বিয়েতে রাজি হওয়ার আগে আমাকেও তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারতে। তা ছাড়া মাত্র দুটো সপ্তাহ তোমার চোখের আড়াল ছিলাম। এটুকুর জন্য আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারলে না? তখনই সে আমার হাতে ঝাঁকি দিয়ে বলে, আসবে না?

প্রচন্ড রাগে আমি মুখ তুলি এই বলার জন্যে যে, আমি কি তোমার মা-ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে পারতাম না? কিন্তু তার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই কি বলতে চাচ্ছিলাম ভুলে যাই।
সে ফের আমাকে ঝাঁকি দেয় কাঁধ ধরে। আসবে না বিয়েতে? সেই সঙ্গে তার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখে যেন বজ্রাহত হয়ে তাকিয়ে থাকি।

একবার চোখ মুছে হেসে আবার সে বলে, বাজারে বুড়োর আড়ৎ আছে। অনেক পয়সাঅলা। আমাদের খাওয়া-পরার কোনো অভাব থাকবে না!

তার মুখ হাসি হাসি থাকলেও আবার অশ্রুসজল চোখে বলে, আসবে তো?

আমি নির্বোধের মত তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। হ্যাঁ কিংবা না বলতে পারি না। এমন কি পারি না মাথা দোলাতেও।

আমার অন্তর্গত আমিটা ব্যাকুল ক্রন্দনে পুষ্পর হা-ভাতে মনের পাথুরে দেয়ালে যেন মাথা কুটে বলতে থাকে, তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো? কার জন্যে বাঁচবো? কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সে চিৎকার পুষ্পর কর্নগোচর হয় না। আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। কে যেন মুখ চেপে ধরে আছে। বুকের ভেতর হুহ কান্নার প্রাবল্যে আমার দুচোখ জ্বালা করে উঠলেও আমি কাঁদতে পারি না। পুষ্প কষ্ট পাবে। হয়তো তার আগামী দিনের সুখ-সাচ্ছ্বন্দ্য ব্যহত হবে। সেই ভয়ে আমার যাবতীয় কষ্ট যেন পাথর হয়ে তলিয়ে যেতে থাকে দূরাগত বেদনার অন্তহীন ধারা তলে। (সমাপ্ত।)
-জুলিয়ান সিদ্দিকী


মন্তব্য

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

এইটা গল্পই মনেহয় না। গল্পের গন্ধও এখানে নাই, এতটাই প্রাণবন্ত লাগলো। আসল ঘটনা কী?

অতিথি লেখক এর ছবি

ঘটনা তেমন কিছু না। গল্পটা পড়তে পড়তে আপনিই নায়ক কবির হয়ে গেসিলেন। তাই গল্পের গন্ধটা পান নাই। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

উফ... আমার ব্যস্ততার মধ্যেই কেন এত বড় বড় গল্প পোস্টানো হয়? দৌড়ে আছি... পরে পরুমনে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

পোলাপান তো দৌঁড়ের উপরেই থাকে। দৌঁড় পারতে পারতেই খায়। খেলাধূলা সবই করে।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুর্ধর্ষ একটা গল্প

০২
গল্পের নামটা গল্পের তুলনায় নেহায়েতই সাদামাটা
একটু চিন্তা করবেন নামটা নিয়ে?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার চিন্তা যে এর বেশি যেতে পারলো না। কী করবো বলেন!
ভালো শিরোনাম পেলে তো আপত্তি থাকার কথা না। আন্তরিকতার ছোঁয়াটুকু ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

সবজান্তা এর ছবি

ভাইরে আপনার লেখার হাত তো দেখি অসাধারণ। গল্পের প্লট সে অর্থে খুব চমকপ্রদ নয়, গতানুগতিক একটা গল্পই বলেছেন, কিন্তু এতো সুন্দর ভঙ্গিমায়, যে খেয়ালই করিনি কখন পুরাটা শেষ হয়ে গিয়েছে। সাধারণত আমি বড় ব্লগ বেশি ধৈর্য নিয়ে পড়তে পারি না - কিন্তু আপনার লেখার গাঁথুনি শেষ পর্যন্ত আমাকে বেঁধে রেখেছিল। অভিনন্দন আপনাকে - এত চমৎকার একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।

আরো পড়ার প্রত্যাশায় রইলাম।


অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার প্রতিটা গল্পে আর উপন্যাসে পাঠকের এই ধরনের আন্তরিক অনুভূতির কথা শোনার জন্যই তো চেষ্টা চালাচ্ছি। তবুও তেমন আর পারছি কই বলেন?
হয়তো আপনিও আমার মতই পাঠক। পড়তে পড়তে নিজেই গল্পের চরিত্রের সঙ্গে মিশে যান। মন্তব্য পড়ে ভালো লাগছে। শ্রমের সুফল বিন্দুমাত্র হলেও পাচ্ছি মনে হল।

আন্তরিক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। জুলিয়ান সিদ্দিকী, আরো আরো গল্প চাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। আজকে সারাদিন গেস্ট হিসেবে লগইন করতে পারি নাই। মন খারাপ ছিলো। সেই কষ্ট নিয়াই আরেকটা খুবই মামুলী প্লট সাজাইছি।
আগ্রহ প্রকাশের জন্য আবারও ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

অতিথি লেখক এর ছবি

নুশেরা তাজরীন, এখানে আগে মুড়ি না ধানের একটা ঝাঁকা আছিলো। এই মাইয়াটা কি ওখান থাইক্যাই বাইর হইলো কি না বুঝতে পারতেছি না। আপনে কি এরে চিনেন?
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

রায়হান আবীর এর ছবি

প্রথম প্রথম বড় লেখা পড়তে পারতাম না। খেই হারিয়ে ফেলতাম। ইদানিং পারি। কেন জানি ছোট লেখা চেয়ে এখন বড় লেখাই বেশ লাগে। একটা সিগারেট টানতে টানতে পড়া।

মন ভালো নাই। নানা কারণে এক্কেবারে জর্জরিত হয়ে আছি। বাসায় নেট নেই। হলে চলে আসছি। একা একা সচল পড়ছি আর চন্দ্রবিন্দুর গান শুনছি।

গল্পটাকে শুরুতে মিষ্টি প্রেমের গল্পই মনে হচ্ছিল। শেষে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ভালো থাকেন, সুখে থাকেন...আরো বেশী বেশি লিখেন।
---------------------------------

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের সকল সুন্দর দুঃখজনক। কোন বিদেশী কবি জানি বলছিলেন- আমাদের মিষ্টি গানগুলাই দুঃখের। কী আর করা!

গল্পটা পড়তে পারলেন বলে ধন্যবাদ। আমি উপন্যাস লিখতেই পছন্দ করি। কিন্তু মাথাটারে যখন বিশ্রাম দেই, তখনই দু-একটা গল্প কবিতা বাইর হইয়া আসে। মাঝে মাঝে নিজেই অবাক মানি! মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।