প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় যখন নদীর কোল ঘেষে শহরটায় আলো জ্বলে ওঠে তখন রতনের খুব ভাল লাগে। এক এক করে বাতিগুলো জ্বলতে করলে ছায়াঘন নদীর জলে আলোর কারুকাজগুলো ফুটে ওঠে। ছোট ছোট ঢেউ এ লাল নীল সবুজ আলো তীর তীর করে কি রকম করে কাপে। এর মধ্যে একটা জাহাজ সিটি দিয়ে শহর ছেড়ে কোথাও চলে যায়। তারপর একটা একটা করে - ঠিক সন্ধ্যার পর অনেকগুলো সাদা সাদা জাহাজ বেরিয়ে যাবে বরিশাল, হুলারহাট, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর সহ কোথায় কোথায় ।
রতনের কাছে জাহাজগুলো ভোর বেলার শিউলীর মতো মনে হয় .. টুপ টুপ করে শহরের বুক থেকে খসে পড়ছে.. তাদের সারা গায়ে শিশির বিন্দুর মতো মানুষ জড়িয়ে থাকে। এত মানুষ শহর থেকে চলে যায় কিন্তু শহরের তাতে কোন ভ্রক্ষেপ নেই .. সে আছে নিজের তালে। কিন্তু তার এই শুকনো খটখটে শহরের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সে জানে একটু পরেই এই শহরটা তাকে গিলতে শুরু করবে। শুরুতে মাথা, শেষে পুরোটা শরীর। তার চেয়ে ভাবতে চেষ্টা করে -অনন্ত অনাদি কাল ধরে সে এই নদীর সামনে দাড়িয়ে আছে। নদীর উপরে নীল আকাশ ভাল, কুয়াশায় মোডা নদীতে ধোয়াটে নৌকা ভাল, ঝুম বৃষ্টিতে দুকুল ভেসে যাওয়া ভাল।
এই যেমন সেদিন।
জল বাড়তে বাড়তে ঘর অবধি। তারপরও কি থামে, বাড়তে বাড়তে পুরো ঘরটাতেই অর্ধেক জল। সে হটাৎ টের পায় ছোট ছোট মাছ আসছে। একটা বড় মাছ পাশ দিয়ে চলে গেল। জল বাড়ছে। একটা কালো বিড়াল কোথা থেকে আসে। ঘরের কোনে কাফকার বইটার ঠিক উপরে বসে আছে। কিচির মিচির শব্দ। তাকিয়ে দেখে ঘুলঘুলি দিয়ে অনেক পাখি আসছে। হাজার হাজার পাখি। পুরো ঘর পাখিতে ভরে গেছে।একটা বই কি ভাবে পানির নিচে ডুবে গেছে, তার অক্ষরগুলো ভাসতে ভাসতে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।
তারপরে তার ঘুম ভেঙে যায়।
বেশ একটা স্বপ্ন দেখা হলো ভেবে নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে যেই অফিসে যাওয়া ওমনি সমস্যাটা শুরু। ঠিক তখন নয় সমস্যাটা শুরু হয় বড়কর্তা যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন সে আগের দিন অফিসে আসে নি কেন। শুধু নিরীহ জানতে চাওয়া মাত্র, এর মধ্যে কৈফিয়তের সুরও ছিল না। সে বলে দিলেই পারতো শরীরটা ভাল ছিল না কাল। এরকমতো কতই হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো সে কালকে এসেছিল। রতনের প্রথমে মনে হয়েছিল বড়কর্তা কোথাও ভুল করছেন।
: কিন্তু আমিতো কাল এসেছি।
: কালকে এসছো। অ্যাবসার্ড, আমি নিজে তোমার ৩ বার খোজ করেছি... কেউই তোমাকে দেখে নি।
রতন কিছুতেই বুঝতে পারেনা ব্যাপারটা। আগের দিন দিব্যি সে অফিস করলো। বড় কর্তার সাথে দেখা হয় নি ঠিক কিন্তু সেতো কতদিনই হয় না। পারভেজভাই পরশু দিন তার কাজের অর্ধেকটা কাধে চাপিয়ে বাড়ি গেছে, পাক্কা ২ ঘন্টা লেগেছে ও টুকু সারতে, তারপর নিজের কাজতো আছেই। সব সামলে উঠতে উঠতে ঘাড় ওঠানোরই ফুসরত পায় নি সে। ক্লান্ত হয়ে কাল করবো ভেবে ফাইলটা কোনমতে উঠে গিয়েছিল। অফিসের সিড়িতে তার একবার মনে হয়েছিল আড্ডার কথা। অনেকদিন কারো সাথে দেখা হয় না, যাবে নাকি একবার। একবার চিন্তা করলো নিউমার্কেটে গিয়ে একটা প্যান্ট কিনবে। কিন্তু চিন্তাগুলো পাখির মতো। ঠান্ডা আর বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে কাপতে কাপতে খানিকদুর গিয়েই রতন দেখেএকটা আধা বানানো বাড়ির নিচের গ্যারেজে লেবাররা আগুন জ্বালিয়ে ওম নিচ্ছে। আগুনের আচে সবার লালমুখ। ওকে দেখেই ওরা জায়গা করে দেয়। পট পট আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের আচে শরীর গরম হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার আড্ডা, নিউমার্কেটের ব্যস্ত কেনাকাটা কোনকিছুই তখন মাথায় নেই। মনে হচ্ছিল এভাবেই সে রাতটা পার করে দিতে পারবে। কিন্তু একটু পর আগুনটা কমতে শুরু করে। চারপাশে খুজে আর কোন ছেড়া কাগজ, কাঠের টুকরো খুজে পাওয়া যায় না। নিভু নিভু আগুনটা থেকেও ফুলকি ওড়ে। কারো মুখ আর দেখা যায় না। রতনের সেই সময় বাবার শেষ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। একটু বাতাস শরীরে নেবার চেষ্টায় তার রগগুলো ফুলে ফুলে উঠছিল। কেমন একটা ঘড় ঘড় শব্দ। রতন মানিব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করে এক এক ছড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে আগুনটা আর একটু জ্বলে ওঠে। সবার মুখ বিষ্ময়ে আর একটু লালচে হয়ে ওঠে। আগুন নিভে গেলে বাসায় গিয়ে সে সটান শুয়ে পড়েছিল। গতকালই তো।
মাঝখানে কেবল একটা স্বপ্ন।
তারপরই অফিস। তাহলে!
বড়কর্তারই কোথাও একটা ভূল হচ্ছে। রতনের গলায় একটা জোর ঝম ঝম করে।
: না এসেছি তো
: তাহলে কোথায় ছিলে ..
ঠিক এই সময়েই ঘটনাটা ঘটে। হটাৎ বড় কর্তার পকেট থেকে একটা পাখি বের হয়ে জানালা গলে উড়ে যায়। তারপর আর একটা। ছোট্ট একটা কালো সাদায় মেশানো পাখি। মাথার কাছে হালকা একটা নীল রঙের ছোপ। মাছরাঙা নাকি। রতন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকে। বড়কর্তা ঝমঝমিয়ে ওঠেন।
: কি হলো - এভাবে চুপ করে আছো কেন ..
: পাখি
: পাখি- মানে
বড়কর্তার মুখ ঝুলে পড়ে।
: পাখি আপনার পকেটে
ঠিক এই সময়ে একটা পাখি বের হয়ে এলো। এবারেরটা হলুদ। রতন উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে ওঠে
: এই এই যে উড়ে গেল ...
বড়কর্তার একমূহূর্তের জন্য হতভম্ব মুখটা দেখেছিল রতন। তারপরেই অবশ্য অন্য মুখ। ঠাস বুনুনের একটা গাম্ভীর্য্য তকমা মুখে এটে গমগমে গলায় তাকে সাতদিনের ছুটি নিতে বলেই গটগট করে চলে গেলেন। শূন্য চোখে রতন তার যাওয়া দেখছিল। যতটুকু সময় তাকে দেখা গিয়েছিল ততটুকু সময় তিনি একবারের জন্য কোনদিকে তাকান নি।
এই ছুটির মানে জানে রতন।
বড় কর্তা এর আগে রুস্তম নামে একটা ছেলেকে এক সপ্তাহের ছুটি দিয়েছিলেন আর রতনকে বলেছিলেন বরখাস্তের চিঠিটার ড্রাফট তৈরী করতে। তার চিঠির ড্রাফটটা এবার কে তৈরী করেছে?
ধুর। নিজেকেই নিজে উডিয়ে দিতে চায় রতন। সে নদীটার দিকে তাকিয়ে ভাবে এ নদী ধরে কতদুরে যাওয়া যাবে।
ঝুমি আসে এবার। ঝুমির সাথে একবার লঞ্চে চড়ে নীল কমল গিয়েছিল রতন। গোপন অভিসারের মতন, কেউ জানে না। মাথার উপর পূর্ণিমার রাতের চাদ কুয়াশার পর্দার আড়ালে মুখ ডুবিয়ে থাকে। একটা নির্জন সাদা শূন্যতা ছিড়ে হটাৎ একটা দুইটা স্টিমার ভেসে ওঠে- একটা লাল আর হলুদ আলো মাথার উপরে সারাক্ষন জ্বলছে। নদীর মাঝখানে ওদের অন্যগ্রহের মতো লাগে। যেখানে কখনও যাওয়া যাবে না, ছোয়া যাবে না- খালি চেয়ে থাকা যায়। আকাশের তারাদের মত। এমন করে সেই সারারাত। সেই সকালবেলায় নীলকমল গিয়ে লঞ্চ ঝিমুবে এবার। দুইঘন্টা। নামের মতোই সুন্দর নীলকমল জায়গাটা শ্যামল একটা জায়গা। ঘাট থেকে নেমে নদীর পাড় ধরে আগে আগে হাটছিল ঝুমি। রোদের তেজে মাটির জমাট শিশিরগুলো উড়ে গেলে আস্তে আস্তে ভেজা মাটি শুকনো ধুলো হয়ে যাচ্ছিল। এলোমেলো গলায় গান ধরেছিল রতন
উড়িয়ে ধুলো পায়ে পায়ে নীল কমলে, সারাটা পথ হাটছি কেবল তোমারই তরে ...
স্মৃতিই ধুলো উড়োয় এখন।
ঝুমির মুখ মনে পড়ে। একটা লম্বা সময় ওর মুখ ছাড়া অন্য কোন মুখই চোখে পড়তোনা। এর মধ্যে রাস্তায় কয়েকবার দেখা হয়েছে। তাতে কি? ও এখন মাঝরাত্রে ছুটে চলা অন্য ষ্টিমারের মতো আকাশের তারা হয়ে গেছে।
বুকের খাচাটা ভারী বাতাসে ফুলে ওঠে। নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হয় রতনের।
উঠে দাড়ায় রতন।
ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার হাত থেকে বাচার জন্য সে নদীর কাছে এসেছিল। কিন্তু নদী তাকে বাচাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। নদী একটানা বয়ে চলে। উজান ভাটির খেলা। নদীর পাশে থাকলে স্মৃতি আসতে থাকবে। আজকে রতনের মোটেও অতীত কিংবা ভবিষ্যতের কোনটাই ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
সে হাটতে থাকে।
মন্তব্য
অসাধারণ! আর সেরা অংশ হল:
জাহাজগুলো ভোর বেলার শিউলীর মতো মনে হয় .. টুপ টুপ করে শহরের বুক থেকে খসে পড়ছে.. তাদের সারা গায়ে শিশির বিন্দুর মতো মানুষ জড়িয়ে থাকে।
.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...
.......................................................................................
Simply joking around...
অসাধারন লিখেছেন। খুব ভালো লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ভালো লাগলো পড়ে
...........................
Every Picture Tells a Story
অসাধারণ... মুগ্ধ হয়ে পড়লাম... পড়ে বিবশ হয়ে রইলাম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
চমৎকার
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
আপনার বর্ণনা খুব ভালো লাগে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
অদ্ভুত মুগ্ধতা ! আপনার কলম আমাদের সাহিত্যের সম্পদ, এ কথা না বললে আমার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বাস্তবে নীলকমল-এর অস্তিত্ব মুছে গেলেও আপনার কলম একে স্থায়ীত্ব দিয়ে দিলো, খুব ভালো লাগলো। নীলকমল ঘাটের সর্বশেষ অস্তিত্বটাও মুছে যাবার পর মেঘনা পাড়ের বন্ধুকে উৎসর্গিত কবিতটা ছেপেছিলো অধুনালুপ্ত দৈনিক 'আজকের কাগজ' সেই ৯৭ সালে। ওটাতেও বুকের ভেতর পাড়ভাঙার শব্দ ছিলো। আপনি আবারো মনে করিয়ে দিলেন।
আপনার কলমকে আবারো অভিবাদন জানাই।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
কী চমৎকার, সুন্দর বর্ণনা। দারুন লাগলো।
চমৎকার !
দুর্দান্ত বর্ণনা!
উল্টোচাঁদ : ০.১ - মানে উল্টোচাঁদ : ০.২, উল্টোচাঁদ : ০.৩... আশা করা যেতে পারে?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সিরিজ ঠিক, এখনও এলোমেলো.. ধারাবাহিকতার দিক থেকে .. ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়, তাই না
নতুন মন্তব্য করুন