মা রতনের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছেন। পঞ্চান্ন বছরের জীবনে এই প্রথম তিনি একলা বাড়ি থেকে এতদুর এসেছেন। প্রথমে তার খুব ভয় করছিল, কিন্তু গত দুটো স্টেশনের নাম চোখে পড়ার পর তার ভয় অনেকটা কমে আসছে। এরপর আর একটা স্টেশন, তারপরই ফুলগাছা। ওখানকার ষ্টেশনমাষ্টার আবদুল হক তার ফুপাতো ভাই। তিনি বার বার বলে দিয়েছেন - কোন চিন্তা করবেন না বুবু, আমারতো সারাক্ষনই স্টেশনে ডিউটি। বাস তো নয়, ট্রেন। একটাই রাস্তা। খালি ঠিকঠাক ফুলগাছা নামলেই হবে, বাকি সব আমার। যতই আবদুল হক ভরসা দিক মার জন্য ব্যাপরটা মোটেই সহজ ছিল না। পয়ত্রিশ বছরতো হবেই তিনি শেষ ফুলগাছা এসেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে কতটুকুই বা পথ, তবুও বিয়ের পর তার স্বামীর সাথে একবারমাত্র ফুপুর বাড়ি এসেছিলেন তারপর আর আসা হয় নি।
স্বামীর কথা মনে পড়লে মার চোখ ভিজে আসে। ইদানীং তার এমন হয়েছে। স্বামীকে তার খুব বেশি মনে পড়ছে। দুই দিন তিনি তার সাথে কথাও বলেছেন। তিনি রান্না করছিলেন। কাল দুপুরবেলা। হটাৎ তার মনে হলো পেছনে রতনের বাবা দাড়িয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে গিয়ে তিনি স্পষ্ট শুনতে পান তার স্বামী তাকে বলছেন
- আমি তোমাদের খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি..
- না না, আপনে যে কি বলেন, আমার কোন দুঃখ নাই
- আমাকে মিথ্যা বলার দরকার নাই। জীবিত মানুষকে ভুলাতে অনেক কিছু বলতে হয়।
- আমি মিথ্যা বলি নাই। আগে কষ্ট হইতো। এখন আর হয়না। এখন আপনার কাছে যাওয়েনের সময় । খালি একটা কাজই বাকি।
- রতনের বিয়ে।
- হ্যা ওর বউটা নিজের চোখে দেখে যেতে পারলে আর আমার চাওয়ার কিছু নাই।
- রতনকে নিয়া চিন্তার কিছু নাই। মা কষ্ট করলে সেই ছেলের কপালে সুখ লেখা থাকে। তুমি কষ্ট করছো তোমার ছেলে সুখেই থাকবে।
- ওর তো নিজেরে নিয়া খেয়াল নাই। কি যে কি করে। মিছিল মিটিং করে বেড়াইছে। ওর দাদাজান বৃটিশদের খেদমত করে খান উপাধী পেয়েছিল। রক্তের দোষ।
- আমি আপনাদের এইসব কথা বুঝি না। আমি খালি ওরে কইছি বাপজান যা করবি কর। আমি আর কয়দিন । আমি কত কষ্ট কইর্যা তোরে পড়াইতাছি যেন তোর বাপ যেন কোনদিন আমারে বলতে না পারে আমার ছেলেকে তুমি মানুষ করলা না। তুই পড়াশুনা শেষ করবি তারপর একটা চাকরী নিলে আমি একটা সুন্দর মেয়ে দেইখ্যা তোর বিয়া দিয়া নাতির মুখ দেইখ্যা তোর বাবার কাছে চলে যাবো। আমার আর কিছু চাই না।
- তাহলে তুমি সুখি এখন।
- হ্যা সুখী।
প্রথম যেদিন রতনের বাবা এসেছিলেন তিনি ভয়ে কুকড়ে গিয়েঝিলেন। সারারাত ঘুমাতে পারেন নি। সত্যি কি রতনের বাবা এসেছিলেন নাকি তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। কথা যতক্ষন মনের ভেতরে থাকে ততক্ষন জমাট বাধে। কিন্তু এই কথা কাকে বলবেন তিনি। যাকে বলবেন সে যদি তাকে পাগল বলে। হালিমা খালার কথা মনে হয়।
হালিমা খাতুন লাশ ধুয়ানোর কাজ করেন। এক ছেলে আছে, শহরে থাকে। মায়ের সাথে কোন যোগাযোগ নাই। জীবিকার আর উপায় না পেয়ে এই কাজ করেছিলেন এক যুগ আগে।এখন এই করেই তার পেট চলে। পাশের বাড়ির জোবেদা বু মারা গেলে হালিমা খালাকে দেখেছিল লাশ ধুয়ানোর সময় বিড় বিড় করে কথা বলতে। হালিমা খালাকেই কথাটা বলা যায়।
- এই যে মরামানুষ গোসল ধোও - তোমার ভয় লাগে না
হালিমা খালার মুখে প্রশান্তি লেগে থাকে।
- একটা মানুষ তার ঘরে ফিরে যাবে তারে একটু সাজায়ে দি, একটু ভাল করে যেন ফিরতে পারে। সবাইরে তো ঐ ঘরে ফিরতে হইবো।
- কখনও ভয় লাগে না।
- শুরুতে লাগছিল তখন তো বুঝি নাই।
- কি বুঝো নাই
- আমরা বলি লাশ। কিন্তু ওদেরও জান আছে। ওরাও কথা বলে। প্রথম প্রথম ভয়ে ভয়ে শক্ত হইয়্যা খাকতাম। চোখ বন্ধ কইর্যা কুনমতে শরীর ধুয়াইয়্যা দিতাম। একদিন এক বাড়ির ছোট বউ, মুখ দেইখ্যা মনে হইলো খুব ছটফটে মেয়ে আছিল। ওর শরীলটা ধুয়াইয়্যা উইঠ্যা যাইতেছি মেয়েটা বলে কি - খালা, চোখে সুরমা লাগাই দিবা না?এমনিভাবে ডাবো? তাইতো রে মা। আমার মন খুইল্যা গেল। এটা খুব যতেœর কাজ। যতœ না নিলে ওরা মন খারাপ করে।
- সবাই কথা বলে?
- সবাই বলে। বাড়ি ফিরতেছে না।
তাইতো। ফেরার সময় কত কথা জমে থাকে। অনেকদিন পর মা তার বাপের বাড়ির কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। এতা একরকম ফেরাই। মনের মধ্যে কত কথার বুদ্বুদ উঠছে। বলার কেউ নেই। অনেকদিন পর মায়ের মনে হয় একলা। সংসার বাধনের সব জজ্ঞাল একলা হাতে সরাতে সরাতে জীবনের শেষবেলায় একটু আক্ষেপ কি মনের মধ্যে জমে ওঠে। মা বুঝে উঠতে পারেন না। হালিমা খালার কথা আবার মনে হয়। স্বামী মারা যাবার পর ছেলের কাছে শহরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে একদম চুপ, খালি দুচোখ দিয়ে টপটপ পানি ঝরছে। মুখে একটা কথাও নাই। ছেলে কি মারা গেছে, না কি কোন কঠিন বিপদ? হালিমা খালা কোন কথা বলেন না। হালিমা খালা বলেছিলেন অনেক পরে যখন রতন যখন যাবে সেই শহরে পড়তে।
মা তখন নাচছেন। হালিমা খালা এসে বললেন, ছেলেরে শহরে পাঠাইওনা। মাতো অবাক। হালিমা খালার গলা শান্ত, খাখা দুপুরে ঈদগা মাঠের মতো। মা থমকে যান, কেন খালা কি হয়েছে।
- শহরে গেলে মানুষ মানুষ থাকে না।
মা কিছুই বোঝেন না।
- তুমিতো আসাদরে দেখছো। আমার শান্ত পোলাটা - কুনদিন আমার কথার অবাধ্য হয় নাই। শহরে গিয়া ছেলেটা দেখি ছেলেটা নষ্ট হয়্যা গেছে। শহর আমাগো জন্য না। শহর খুনী বানাইয়া দেয়।
- নষ্ট হইতে চাইলে যে কুন খানেই হইতে পারে। আর ও যাইতেছে পড়তে।
রহিমা খালা কিছু বলেন না। খালি এক দৃষ্টে চেয়ে থাকেন। যাবার বেলা খালি বলে যান- আমার মনে হইলো বললাম। আর মার মনে হয় তার রতন কখনও নষ্ট হতে পারে না।
একদিনের কথা মার মনে পড়ে। একদিন তার ভাসুর রতনের নামে নালিশ দিয়েছিল, সে তাকে বেয়দপ বলেছে। তখন রতনের বাবা বেচে ছিল। রতনের বাবা রতনকে ধরতেই সে কি দাপাদাপি। বড় চাচা বেয়াদপ.. বড় চাচা বেয়াদপ। রতনের বাবা থমকে গিয়েছিলেন। এ কি শুনছেন ছেলের মুখে। থমথমে গলায় মাকে তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন - কি বেয়াদপী করেছে । রতন যা বলেছিল মার মনে আছে।
- এই লোকটা কিভাবে পাখি মারে জানেন? ও বন্দুক হাতে হেটে যেত পাখিদের কাছে। পাখিরা বসে আছে .. সে হুস হুস করে পাখিদের তাড়াতো যেন দুষ্টুমী করছে। পাখিরা যেই উড়ে যেত এক মূহূর্তে তার চেহারাটা পাল্টে যেত হাতে উঠে আসতো বন্দুক - শূন্যে উড়ে যাওয়া পাখির দিকে গুলি ছুড়ে দিত ঠা ঠা ঠা.. পাখিগুলো বুকের কাছে লাল রঙ মেখে পড়ে যেত.. বেয়াদপ, আস্ত বেয়াদপ।
রতনের বাবা শুনে শুধু বলেছিলেন আর বড় চাচার কাছে যেও না। সেই কথা মনে পড়ে মায়ের বুক একটু কেপে ওঠে। রতনের রক্তে তেজ একটু বেশি। বাপের বংশের ধারা।কিন্তু এখন আর ভয় কি । রতন পাশ দিয়েছে, চাকরী করছে। এখন একটা লক্ষ¥ী দেখে একটা বউ এলেই নিশ্চিন্ত। ট্রেনটা থামতে শুরু করেছে। মা একটু চঞ্চল হয়ে ওঠেন। এখানেই তাকে নামতে হবে।
মন্তব্য
গায়ে কাঁটা দিল!
.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...
.......................................................................................
Simply joking around...
ভীষন ভালো হয়েছে।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
দারুণ চলছে...!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন