# শেষ হয়ে যাওয়া বিকেলের রোদ আর শুরু হতে যাওয়া রাতের আকাশ আমাকে প্রায় দ্বিধায় ফেলে দেয়। আঙ্গুলের ফাঁকে হাহাকার মেশানো বিষণ্ণতা নিয়ে তো এখন দিব্যি ভালো আছি। সবচেয়ে ঝামেলা হয় যখন দ্বিধাটি কী নিয়ে সেটাই বুঝে পাই না। সেদিন হয়ত আড্ডায় যাওয়া হয় না, কোনো মেয়েকে শিস দেওয়া হয় না, কাউকে নিয়ে টিপ্পনী কাটা হয় না। ফোনের পর ফোন আসে, ফোন বেজেই চলে আর আমি চুপচাপ বসে থাকি জানালার ভাঙ্গা কাঁচের সামনে। অবশ্য ভালো থাকাই বা কাকে বলে? দিনরাত টইটই করে ঘুরে, রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে, আরামসে সিগারেটে টান দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ার নাম ভালো থাকা? দ্বিধাটাই বা কিসের? এই অনিশ্চিত শান্তিপূর্ণ জীবন ছেড়ে নিশ্চিত অশান্তিময় কোনো কিছুর দিকে পা বাড়ানো? নাকি এই দ্বিধাটা বুঝতে না পারার নাম-ই দ্বিধা? বিকেলের রোদ শেষ হয়ে যখন রাতের অন্ধকারে নিজেকে খুঁজে পায় তখন আমি মাঝে মাঝে আধো আধো আলোর সন্ধানে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যাই। কেবল মনে হয়, আমার জীবন বুঝি কোনো এক সন্ধ্যাতেই থেমে গেছে; না পারছি পেছনে গিয়ে রোদ লাগাতে, না পারছি সামনে এগিয়ে চাঁদ মাখাতে। আমি এখন সন্ধ্যাবন্দী এক মানুষ।
এলাকার লোকজন প্রায় আমাকে সভাপতি বলে ডাকে। যদিও শ্লেষ মেশানো তবু এই ডাক শুনলে নিজেকে বেশ কেউকাটা গোছের মানুষ মনে হয়। আমার বন্ধুরা, আমাদের বেকার সৈনিকদলের এতে কোনো আপত্তি দেখি নি। বরং তারাও এখন মাঝে মাঝে আমাকে সভাপতি বলে ডাকে; আমি এই বেকার সৈনিকদনের সভাপতি। এই ডাকটা ওদের থেকে আমাকে একটু হলেও আলাদা করে দেয়। আমার নিরুত্তাপ জীবনে খুব সম্ভবত একমাত্র আনন্দের উপলক্ষ্য; এই আলাদা হয়ে যাওয়া। আমি যে কী ভীষণ সাধারণ একজন তা আমি মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে যাই।
আজ সকাল থেকে মেঘ করে আছে, বৃষ্টি হয় নি। সারাদিন মেঘবন্দী হয়ে শুয়ে থেকে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। খানিকটা পড়াশোনা করার কারণে আমার শ্রেনী উত্তরণ ঘটার পর বাড়ির লোকজনের সাথে বেশ দুরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে।
আমি কখন আসি, কখন যাই, কিভাবে থাকি, কিভাবে বাঁচি এই নিয়ে তাদের ভেতরে বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। হুটহাট বাবা এসে করুণ চোখে তাকিয়ে বলেন, আমার তো বয়স হয়ে এলো। এবার কিছু একটাতে যোগ দে। কিছু না পারলে মাস্টারী কর। আমি কিছু না বলে, চোখ গরম করে তাকালে বাবা বিনা প্রতিবাদে চলে যান।
পরিবারের সঙ্গে আমার সংযোগ তাই সীমাবদ্ধ থাকে মাঝে মাঝে বড় আপার বাসায় যাওয়াতে। অনেকদিন হয়ে গেলো সেই বড় আপার বাসায় যাওয়া হয় না। নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, স্রেফ যাওয়া হয় না।
শেষবার গিয়েছিলাম প্রায় এক মাস আগে। এর আগে নিয়মিত বিরতিতে যেতাম, সপ্তাহে একবার না হলেও দশদিনে একবার। বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে না। বিশ টাকা রিকশা ভাড়া। আপা, দুলাভাই দু জনেই চাকরিজীবী। বাসায় থাকে আমার ভাগ্নে আর তাকে দেখাশোনার জন্য দুলাভাই এর কোনো এক লতা-পাতায় আত্মীয়। দেখতে দেখতে ভাগ্নের সাত বছর হয়ে গেল। ওর যখন জন্ম হয় তখন আমার অনার্স শেষ হয়েছে। তারমানে এই বেকার জীবনের সাত বছর পার হয়ে গেছে। ভার্সিটির বন্ধুরা কেউ কেউ বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলেছে, অনেকেই চাকরি করছে, দেখা-সাক্ষাৎ নেই বলতে গেলে। আমার সময় কাটানোর ভরসা তাই ঐ এলাকার বন্ধুরা, যারা আমার মতো করেই হতাশা পান করে চলছে।
আমার ভাগ্নে অনি সেদিন হুট করেই আমাকে বলেছিল, মামা তুমি আমাকে জাদু শেখাবে?
আমি নরম ফোমের সোফায় গা ডুবিয়ে দিয়ে আয়েশ করে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তার কথায় বেশ অবাক হয়ে তাকালাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিসের জাদু?
অনি এই বয়সে ভারী চশমা পড়ে, কোঁকড়া চুলে তাকে বয়সের তুলায় বেশ বড় লাগে। অবশ্য বড় লাগার আরেকটি কারণ হতে পারে, সে হাসে না, খেলে না, তার বয়সী কোনো বন্ধু আমার চোখে পড়ে নি।
তাই অনি যখন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার জাদু। আমি অবাক হই নি। ছেলেটি হয়ত জন্ম হয়ে শৈশবে যাবার পরিবর্তে একেবারে কৈশোরে চলে গিয়েছে, তাই তার কাছ থেকে এমন ভারিক্কি উত্তরে অবাক হবার কিছু থাকে না। অবশ্য ব্যাপারটা এভাবেও দেখা যায়, শৈশবে আছে বলেই এমন ছেলেমানুষী ইচ্ছে হয় তার কিংবা পরিচিত কাউকে সে দেখেছে পাখি হতে চাইছে। আমরা বড় মানুষেরাও তো কখনো কখনো চাই পাখি হয়ে উড়ে চলে যেতে। আবার আমাদেরকে ভয় আঁকড়ে ধরে পাখি হতে গিয়ে যদি কোনো খাঁচায় বন্দী হয়ে যাই? আমরা কেউ তো আসলে চাই না, এক খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে অন্য খাঁচায় চলে যেতে। তাই পুরোনো চেনা খাঁচাতেই আমরা চুপচাপ মরে যেতে যেতে দিন কাটাতে থাকি।
আমি তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়েছিলাম, কেন নয়? অবশ্যই শেখাবো।
সে মুচকি হেসে চুপ হয়ে গিয়েছিল। এই মুচকি হেসে চুপ হয়ে যাবার ব্যাপারটি কেবল বড়দের ক্ষেত্রে দেখা গেলেও অনির এমন হাসিতেও আমি বিন্দুমাত্র অবাক হই না, বরং সে যদি উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরত অথবা চকোলেট খেতে চাইত আমি অবাক হতাম।
আমি তাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলাম। ভাগ্নে জানে না, যতো ভয় থাকুক না কেন উড়ে যেতে পারলে আমি কবেই উড়ে চলে যেতাম।
বাইরে বিজলী চমকানোর শব্দ শোনা যায়। ভাগ্নে খুব সম্ভবত জানালা দিয়ে এখন গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখবে। আমি একদিন তাকে বলেছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হয় না? সে বলেছিল, ভিজতে ইচ্ছে হবে কেন?
বেচারা বাসায় এখন একা বসে আছে নিশ্চয়। ইচ্ছে করছে, চলে যাই ওর বাসায়। বাসার ছাদের উঠে ওকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আসি। তার পাখি হবার স্বাদ কিছু হলেও পূরণ হয়ে যাবে। আমার মামা আমাকে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সাঁতার কাটা শিখিয়েছিলেন, বাড়ির সবার চোখ লুকিয়ে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, সাইকেল চালিয়ে কিভাবে টই টই করে ঘুরে সকালকে সন্ধ্যা বানাতে হয় তা শিখিয়েছিলেন। আমি হয়ত আমার ভাগ্নেকে কিভাবে ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয় তা নিজের অজান্তেই শেখাচ্ছি।
রেডি হবার জন্য বিছানা থেকে উঠতেই ওকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে যায়; জাদু শেখানোর প্রতিশ্রুতি, যে সে জাদু নয়, পাখি হবার জাদু। মনে মনে ঠিক করে ফেলি, আমি আজ তাকে সন্ধ্যার ট্রেন থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব, যে ট্রেনের যাত্রী এতদিন ছিলাম কেবল আমি।
#
এবার একটু পেছনে ঘুরে আসা যেতে পারে। যখন আমার জীবনে আচমকা একজন রাজকন্যা এসেছিল আর এসেছিল নিজেকে সাধু অথবা
তান্ত্রিক বলে পরিচয় দেয়া এক রহস্যময় ব্যক্তি। অবশ্য এই যে রাজকন্যা আজ আর নেই, এর পেছনে ঐ বিশেষ ব্যক্তির সামান্য হলেও ভূমিকা ছিল সে কথা আমি আদৌ অস্বীকার করতে পারি না কিংবা অস্বীকার করতে চাই না।
বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখনো আমার বয়স বেশ কম। আচমকা এক রাজকন্যার সঙ্গে পরিচয় হয়, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। এমন ক্ষেত্রে রুপকথার মতো করে রাজকন্যা আমাকে ভালোবেসে ফেলে। রাজকন্যাকে ফেরায় সেই সাধ্য কার? আমিও ফেরাতে পারি নি।
তারপর দিন কাটতে লাগল, কাটতে লাগল রাত। আর সেই দেশে ছিল এক তান্ত্রিক; ঘটনাচক্রে একদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। রাত করে বাড়ি ফেরা আমার অভ্যাস। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে কোনো কোনো দিন বাড়িতেই ফিরি না। তো এমন এক রাতে সাদা পাঞ্জাবী পড়া, মুখ ভর্তি রবীন্দ্রনাথের মতো দাঁড়িওয়ালা একজন ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে বলল, সিগারেট হবে?
সিগারেট শেয়ার করতে গিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতে তান্ত্রিক আমার পকেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, সাবধান, এই ছুরি দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, এই ছুরি দিয়ে কেবল কুয়াশা কাটা যায়, কুয়াশার ফুল বানানো যায়, তোমার কাজে লাগবে। হেয়ালি ভেবে ভুলে গিয়েছিলাম। আর ভুলব না কেন? মাতাল কোনো এক রাতে কেউ যদি এসে বলে এই নে ছুরি। এটা দিয়ে কুয়াশা কাটা যায়, তবে পরদিন সুস্থ মস্তিষ্কে সেটা ভুলে যাওয়ার-ই কথা।
এরপর আরেকটি মাতাল রাত্রি শেষে বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি কুয়াশায় পথে হাঁটা দায়। তান্ত্রিকের দেয়া ছুরির কথা মনে পড়ে যায়। ভাবি, কুয়াশা কেটে বোধহয় বাড়ি ফিরতে হবে। না হয় খোলা ম্যানহোলে না পড়লেও, ঘুমন্ত পথমানুষকে পাড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
পকেটে হাত দিয়ে কিছু পাই না। কিছুটা হতাশ হয়ে হাত বের করে ফেলি। ওমা, দেখি এক টুকরো কুয়াশা আমার হাতের ভেতরে চলে এলো, তারপর আরো। একটু একটু করে পথ পরিষ্কার করে করে আমি হাত ভর্তি কুয়াশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে ফুল বানাতে বসি। কাগজের ফুল-ই বানাই নি কখনো, তাই কুয়াশার ফুল বানাতে রাত পার হয়ে সকাল হয়ে যায়। বানিয়ে তোমার কাছে নিয়ে যেতেই, তুমি ফুল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলে। তারপর যে যার পথের দিকে নিঃশব্দে চলে গেলাম।
আমি এক ফোঁটা অবাক হই নি। বস্তুত, আমরা দু জনেই বুঝতে পেরেছিলাম একটা কুয়াশার মতো সুন্দর কিন্তু ঝাপসা আবহে এক পথে হাঁটার চেয়ে আলাদা পথ খুঁজে নেয়া ভালো।
আমার গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, যদি সান্ধ্যকালীন নিজস্ব ট্রেনে আমার গোপন যাতায়াত না থাকত।
#
পড়াশোনা শেষ হয়েছে, চাকরি নেই। প্রেম এসেছিল জীবনে, প্রেম আছে এখনো তবে প্রেমিকা নেই। আকন্ঠ হতাশায় ডুবে থাকার জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্ম আছে যেহেতু ট্রেন তো থাকতেই হয়। সেজন্য কি’না স্বপ্নে কিংবা বাস্তবে আমি একটি ট্রেন প্রাপ্ত হলাম। ধোঁয়াটে রঙ এর ট্রেন। একটাই বগি, পুরো বগি জুড়ে ঘাসের কার্পেট। ইনসোমনিয়াক আমি বিছানা ভেবে গা পেতে দেই। চোখের ভেতরে ঢুকে যায় ঘাসফুল, বেগুনী রঙ এর প্রজাপতি এসে বসে পায়ের পাতায়, ট্রেন ঝিক ঝিক শব্দ তুলে কোথায় জানি এগিয়ে যায়।
কখনো সময়কে পেছনে ফেলে শৈশবে যায়। আমার নিজস্ব টাইম-মেশিনে তখন আমি ছোট্ট শিশু হয়ে এলাকার ছেলেদের কোলে কোলে ঘুরে লজেন্স খেতে থাকি; আহা, সেই কোকাকোলা লজেন্স।
আমি সুন্দরী বোনের ছোট ভাই ছিলাম। এলাকায় ছিল বাড়তি খাতির। তখন বুঝতাম না। আমার ট্রেন আমাকে দেখিয়ে দেয়, কিভাবে আমাকে লজেন্স খাওয়ানো নিয়ে ঝগড়া হতো। নিরীহ লজেন্স এর কত শক্তি।
আবার কোনোদিন চলে যাই ব্রিজে, ব্রিজের নীচে নদী। আমি ট্রেনে বসেই শুনতে পারি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আমি তখন একটা ছোট্ট মাছ হয়ে যাই। লাফ দেই জলে আর কোথা থেকে এসে জুড়ে বসে জেলেদের জাল। আমি ফাক-ফোকর খুঁজে পালানোর। কোনোদিন পালিয়ে চলে যাই। ডুব দেই আরো গভীর জলে। গিয়ে দেখি, সেখানে আমার মতো শত শত ছোট মাছ। মাছ হয়ে গেলে কথা বলা যায় না, তাই তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় না তাদের ও কী গোপন ট্রেন আছে কি’না।
আবার কোনো কোনো দিন ধরা পড়ে যাই। জেলের চেহারার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি। অবিকল আমার মতো চেহারা। হিংস্র চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি আমার মতো চোখ দেখে আবার অবাক হয়ে যাই। নিজের চোখ বুঝি মানুষের কাছে এত অচেনা থাকে?
ট্রেনে উঠে গেলে আমি ডাইনোসর হতে পারি। ডাইনোসর হয়ে দাপড়ে বেড়াই শহর। সবুজ রঙ এর ডাইনোসর। মাঝে মাঝে ঘাসের মাঝে কাদা লেগে থাকার মতো করে ধূসর রঙ এর ছোপ। রুপকথার গল্পের মতো বিশাল বড় দাঁত। ডাইনোসর হয়ে চারপেয়ে আমি থপথপ করে হেঁটে বেড়াই। মুখ দিয়ে আগুনের পরিবর্তে বের হয় বরফ। প্রথমেই জমিয়ে শীতল করে দেই পাড়ার দোকানদারদের, যারা আমার কাছে টাকা পায়। আর ভাবি, এই ট্রেন ও আমাকে আগুন নিক্ষেপ করতে শেখালো না? বাস্তব জীবনে তাই বুঝি আমি কেবল শীতল থেকে শীতল হতে থাকি।
আমার ট্রেন আমাকে যা ইচ্ছে তা হতে দেয়। অন্যের ইচ্ছেয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ক্লান্ত আমি ট্রেন ভ্রমণে হয়ে উঠি রাজা। ট্রেনের কোনো যাত্রায় এটা পর্যন্ত দেখতে পাই, বাবা আমাকে নিয়ে গর্ব করছে।
ছোটবেলায় বাবা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো আর কারো সঙ্গে দেখা হলে বলত, এইটা আমার ছেলে। ছেলে বেকার সৈনিকদলের সভাপতি এসব বিষয় নিয়ে বাবারা গর্ব করতে জানে না, একদম-ই জানে না।
আজ এই প্রথম আমার ভাগ্নের সঙ্গে যাবো ভাবতে বেশ ভালো লাগছে। আমি দ্রুত রেডি হয়ে নেই। ওর বাবা মা ফিরে এলে কোথাও যাওয়া হবে না। ভাগ্নের বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ।
#
ওদের বাসার বেল বাজাতে কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। এই অসময়ে কারো বাসায় থাকার কথা না থাকলেও আমাকে দেখে দুলাভাই বের হয়ে এলেন। মুখে রাজ্যের আঁধার।
আমাকে দেখে বললেন, এবার আর হচ্ছে না রে। আর পারছি না।
আমাদের কাউকে বলো নি কেন?
বলে কী হবে? এখন মাসে দুইবার দেয়া লাগে। একেবারে সব শেষ হলেই না হয় খবর দিবো।
দুলাভাই এর হতাশা আমি বুঝতে না পারলেও বোঝার ভান করি। ভাগ্নের রুমে ঢুকতেই দেখি মলিন মুখে সে শুয়ে আছে। শরীরে ব্লাড যাচ্ছে। আগে হাসপাতালে গিয়ে দিতো। এখন ঘন ঘন দিতে হয় বলেই বাসায় দেয়া হয়। এমনিতে ও নেগেটিভ ব্লাড। পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। আপার মুখ শুকিয়ে আছে। আমাকে দেখেও দেখে না।
থ্যালাসেমিয়া রোগ যখন ধরা পড়ল তখন ডাক্তার বলেছিল, রক্ত দিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে ওকে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে এটা আমরা কেউ ভাবতে পারি নি।
আপা বলতে থাকেন, ওর পেটের বাম পাশ ফুলে অনেক বড় হয়ে গেছে। অপারেশন করাতে হবে। কী করব বল?
করাতে হলে করাবে। এরপর নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে ঘরে। আমার দমবন্ধ হতে শুরু করে। এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধ্যা হবে হবে করছে এমন সময়ে বাসায় ফিরে আসি।
ট্রেনের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়। কিন্তু ট্রেনের দেখা পাওয়া যায় না। বিচ্ছিরি ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ফ্যান ঘুরতে থাকে। সন্ধ্যা কেবল নীরবতা নিয়ে জেগে থাকে। একসময় সে বিদায় নেয়। রাত আসে। মা খাবারের জন্য ডাক দেয়। খাবার একসময় ঠান্ডা হয়ে যায়। আমার প্ল্যাটফর্মে আমি একাকী বসে থাকি। কেবল একটি জিনিষ-ই মাথায় ঘুরতে থাকে পাখি হবার আসল জাদু যেনেও ভাগ্নে আমার কাছ থেকে জাদু শিখতে চেয়েছিল, পাখি হয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল। সে হয়ত একদিন উড়ে চলে যাবে, আমরা তার পালকগুলো নিয়ে সাজিয়ে রাখব, তাতে ধুলো জমতে দিবো না, হারিয়ে যেতে দিবো না।
ট্রেন মানুষকে মাছ হওয়া শেখাতে পারে, ডাইনোসর বানাতে পারে, টাইম মেশিনের মতো করে শৈশবে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু পাখি হবার জাদু শেখাতে পারে না। আর আমার মতো কেউ কেউ তবুও সান্ধ্যাকালীন ট্রেনের অপেক্ষায় দু এক প্যাকেট সিগারেট বেশি খেয়ে ফেলবে।
মন্তব্য
লেখাটার মধ্যে একটা ছোটগল্পের আঁটো-সাঁটো জামায় হাঁসফাঁস করা একটা উপন্যাসকে দেখলাম মনে হল। টুকরো টুকরো অনেকগুলো বিষয় (হতাশা ঘেরা আত্ন-মন্থন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, রাজকন্যা, তান্ত্রিক, কুয়াশা, সান্ধ্যট্রেন, ভাগ্নে) এনেছেন যেগুলোর প্রতিটা আলাদা আলাদা মনোযোগ ও জায়গা দাবী করে গল্পটার শরীর গঠনে, আর এদের মধ্যে যোগসূত্রটাও আরেকটু স্বচ্ছতা দাবী করে বলে আমার মনে হয়। আপনাকে বলব দস্তোয়েভস্কির ‘Notes from the Underground’ আর ‘ Crime and Punishment’ পড়ে দেখতে (যদি এখনো না পড়ে থাকেন)। এ বই দু’টোতে দেখবেন একটা টানা বলে যাওয়া গল্পে (ফর্ম হিসেবে নয়) একেকটা ঘটনার জন্য জায়গা বরাদ্দ আর ঘটনার যোগসূত্র তৈরীর ক্ষেত্রে লেখক কী অসাধারণ পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। লিখে যান। শুভকামনা।
Crime and Punishment’ পড়া আছে। ওই ধরনের ডিটেইলিং আসতে অনেক চর্চার প্রয়োজন। অনেক কিছুই করা হয় কিন্তু এই চর্চাটাই করা হয় না। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সচলায়তনের সাথে পরিচয়ের অনেকপরে আপনার লেখার সাথে পরিচয় হয়েছিল, (এখন সে জন্য দুঃখ করি, কেন আগে হল না)।
"সন্ধ্যাবন্দী" আমাকে যেন নিয়ে গেল কোন এক দেশে। অসাধারন একটি গল্প পড়লাম আপনার সৌজন্যে। ধন্যবাদ।
আমি অনিয়মিত। এখন পরিচয় হয়েও বোধহয় খুব একটা লাভ হলো না। মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম, অত্যন্ত নিয়মিত হবার জন্য
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
এত দীর্ঘ গল্পে পাঠককে আটকে রাখতে কব্জির জোর লাগে।
চোকে> চোখে, কাঁদা > কাদা, ঝিঁক ঝিঁক > ঝিক ঝিক --- এরকম দু-একটা টাইপো আছে।
আমার পছন্দের সচল গল্পকারদের মধ্যে আপনি একজন, এটা বোধহয় আগেও বলেছি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আরো অনেক টাইপো আছে। বসে বসে কিছু ঠিক করলাম। বাকিগুলাও করব। বলেছেন আগেও এবং প্রত্যেকবারের মতো এবারেও লজ্জা পেলাম
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আমার CMC 'র প্রিয় একজন ছোট ভাই এর লেখা ,লেখার মুন্সীয়ানায় ভরপুর !
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
দারুণ ! খুব ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ওরে বিষাদের রাজা !
খুব ভালো রিশাদ, খুবই
মাঝের কিছু লাইন অবাক করার মত সুন্দর !
আমি তোমাকে নতুন গল্পের কথা জানিয়ে মেসেজ দিতে নিসিলাম
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
বেশ কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা সুন্দর করে গেঁথে তুলেছেন। এতো বড় গল্প পড়ছি মনেই হয়নি। ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ। আমার ব্লগে স্বাগতম
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সুন্দর গল্প। এবং মনে হচ্ছে তোমার নিজের লেখার একটা নিজস্বতা এই গল্পে খুঁজে পেলাম। সিগ্নেচার মার্কের শুরু বোধহয় এভাবেই হয়
সিগনেচার মার্ক
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আপনার লেখা দেখে পড়তে ঢুঁ দিলাম। উদ্দেশ্য আশাতীত রকম সফল।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
যাক
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অসাধারণ রিশাদ! গল্প বলার ঢংটা এমনই যেন মনে হয় একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনেকেরই একটা একটা ট্রেণ আছে, না? নিয়মিত লিখবেন আশা করি।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
থ্যাঙ্কস।
নিয়মিত না লিখি, ইন্ট্যারেকশনে নিয়মিত হবার ট্রাই করবো
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
চমেৎকার গল্প।
[প্যারগুলোর মধ্যে আরেকবার করে এন্টার চাপুন রিশাদ, কোন গ্যাপ ছাড়া পড়তে চোখের ওপর বেশ চাপ পড়ে]
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অনেক ধন্যবাদ। দিয়ে দিলাম স্পেস। আসলে একটু বড় গল্প দেখে নিজেই কমিয়ে দিসিলাম
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
চমৎকার লেখা এরকম লেখা সচারচার চোখে পড়েনা। শুভকামনা রইল।
তুহিন সরকার
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
এককথায় মুগ্ধ হলাম।
কেমন যেন ভেসে ভেসে সূত্র ধরে চলা।
খুশি হলাম।
অনেক ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অনেকদিন মনে থাকবে এটা।
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
থ্যাঙ্কস মেট
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
দারুন !
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
তিনবার চেষ্টা করেও পড়তে পারলাম না । আমার মত যাদের চোখের জ্যোতি কম, তাদের জন্য কি দয়া করে অনুচ্ছেদগুলো একটু দূরবর্তী করে দেবেন ?
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আপু গ্যাপ দিয়েছিলাম। এরচেয়ে বেশি দিলে যে আরো বড় হয়ে যায়
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অবশেষে পড়লাম রিশাদ এই ট্রেনের গল্প । আপনাকে একটা কথাই বলার আছে, জীবন যাপনের জন্য কী কাজ করেন জানি না । জীবনের সেই দায়িত্ব পালনের পরে হাতে যদি কিছু সময় বাঁচে তাহলে লেখার কাজটি চালু রাখবেন । আপনারে দেখার চোখটি তীক্ষ্ণ, খুব তীক্ষ্ণ ।
তবে আপনার টাইপের চোখটি ভাল না । কিংবা কে জানে হয়তো সেটাও খুব তীক্ষ্ণ, আর সে কারনেই অনুচ্ছেদের/লাইনের পরে এন্টার দিতে আপনাকে অনুরোধ করতে হয় । লেখা “বড়” দেখালে অসুবিধা কী রিশাদ ? আমার মত যাদের চক্ষু ভাল না, তাদেরতো পড়তে আরাম হয় । আর এই রকম ভাল গল্প পড়ার সময় কুঁচকানো চোখের ব্যাথা কী ভাল লাগে ?
তারা ফারা কিচ্ছু না এই সব গল্পের কাছে । তবু দিতে হয়, দিলাম আর কী ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
প্রশংসা এবং অভিযোগ দুটোই মাথা পেতে নিলাম
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অসাধারণ! আপনি সচলায়তনের শক্তিশালী গদ্যকারদের একজন সেটা আবারও প্রমাণিত।
ফারাসাত
অনেক অনেক ধন্যবাদ। শক্তিশালী না হলেও অনিয়মিত বটে
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
দুর্দান্ত লাগলো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
থ্যাংকস
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
লেখার হাত আপনার দারুন। প্লটটাও অভিনব!। চালিয়ে যান। শুভকামনা রইল!
--মুস্তাফা গোলাম
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
নতুন মন্তব্য করুন