১) অলিখিত তবে প্রচলিত নিয়মের কারণে অথবা বলতে পারি, প্রকৃতির একটা খেলা হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে বেকার থাকা বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে হয়। আমার বাসা থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে আমার যে বেকার বন্ধুটি থাকে তাকে আমি ঐ নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়ে স্বভাবত এড়িয়ে চলি। আজ দুপুরে যখন বাসা থেকে বের হলাম ঠিক তখন হতচ্ছাড়া কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে ধুম করে পিঠে ঘুষি বসিয়ে দিল। পিঠে ব্যথা উপশম করতে করতে কী খবর, আমি একটু ব্যস্ত এসব বলে রিকশা ডাক দিতেই সে বলে বসল, সামনের মাসে দোকান দিচ্ছি।
এবার আমি কিছুটা আগ্রহী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের দোকান? ফ্লেক্সিলোড?
বন্ধু হাসতে হাসতে বলল, দোকানের নাম নরকবাস দিতে পারি। তোর কী মনে হয়, মানুষ আকৃষ্ট হবে?
কই যাইবেন? রিকশাওয়ালার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, মানে ঠিক বুঝলাম না। দোকানে কী থাকবে?
তুই যা, তুই তো ব্যস্ত।
এবার আমি গ্যাঁড়াকলে পড়ে যাই। তা ব্যস্ত, মানে কিসের দোকান? তাও এবার এমন নাম?
মোমের পুতুল বানাবো। প্রতিটা পুতুলের নীচে একটা করে গল্প লেখা থাকবে। মিউজিয়ামের মতো বলতে পারিস। কেউ ইচ্ছে করলে কিনে নিতে পারবে। সেই অর্থে এটাকে তুই গ্যালারীও বলতে পারিস।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, কার পুতুল বানাবি?
তোর পুতুল বানাতে পারি। আরো অনেকের; এখনো ঠিক করি নি।
ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বন্ধু গম্ভীর হয়ে বলল, তোর পুতুল। পুতুলের নিচে গল্প। কৈশোরের গল্প, বন্ধুত্বের গল্প, সব ভুলে যাওয়ার গল্প; হয়ে গেল না, নরকবাস? ঐখানে এর চাইতেও বেশি একাকীত্ব থাকে, এর চাইতেও বেশি দহন?
যাই রে আজ। রিকশাটা দাঁড়িয়ে আছে। ভালো থাকিস। আমি অবলীলায় জীবনের সূত্রে মেনে চলতে সমর্থ হই।
২)
এই দুইদিন আগে নতুন জ্যামিতি বক্স কিনে দিয়েছিল মা। সস্তা স্টিলের জ্যামিতি বক্স দেখে খানিকটা মন খারাপ হয়েছিল জিদনীর। ওর আগের বক্স অনেক সুন্দর ছিল; সুন্দর ডিজাইন, ওর মতো দেখতে গোলগোল একটা কার্টুন। অল্পদিনেই হারিয়ে ফেলেছে। এবার শাস্তিস্বরুপ একেবারে সাধারণ বক্স।
এই সাধারণের ভেতরে যে এমন অসাধারণ একটা ঘটনা লুকিয়ে থাকবে, এটা কে বুঝতে পেরেছিল?
কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আঁকতেই তাতে দিব্যি প্রাণ এসে গেল। বৃত্তটা খাতার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরতে থাকল। ভয়ে চিৎকার দিয়ে গিয়েও থেমে গেল জিদনী। কী ভেবে যেন, টুক করে দু'টো মানুষ একে ফেলল সে। মানুষ একজনের মাথায় ছোট্ট করে বেণী দিল, আরেকজনকে একটা টাই এর মতো পড়িয়ে দিল। ওর বাবা টাই ছাড়া বের হন না। ওর মা অবশ্য ওভাবে বেণী করেন না। তবু বোঝা যায়, জিদনী এই দুইজন মানুষকে ওর বাবা-মা হিসেবে বোঝাতে চাচ্ছে।
এরপর সে অপেক্ষা করতে থাকল। অপেক্ষা করতে থাকল, বৃত্তটি গিয়ে কখন ওর বাবা-মা'কে আবদ্ধ করে ফেলবে, তারপর সে নিজে টুপ করে গিয়ে বসে পড়বে তাদের কোলে।
মা'র ডাক শুনে তার অপেক্ষা ভাঙ্গে। মা এসে বলেন, আজ তোমার বাবা আসবে দেখা করতে। উল্টা-পাল্টা কোনো আবদার করবে না, কোথাও যেতে চাইবে না।
জিদনীর বাবা-মার ডিভোর্স হয়েছে দু বছর হতে চলল প্রায়।
বের হওয়ার সময় জিদনী খেয়াল করল,ওর বাবা -মা দুজন দু'টো আলাদা বৃত্তের মাঝে ঢুকে গেছে। জিদনী কোথাও নেই। বৃত্তের বাইরে বিন্দুর মতো কী জানি দেখা যাচ্ছে, হয়ত ঐটাই ও হবে।
৩)
অনেক দূরের কিছু বিন্দুর মতো মিলিয়ে যায়; এই ব্যাপারটা প্রথম ধরতে পেরেছিলাম বাবা চলে যাবার সময়। মা আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ। বাবা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, চলে আসব। আস্ত একটা গাড়ি নিয়ে আসব তোমার জন্য। সত্যিকারের গাড়ি। আমার বয়স তখন কত হবে? সাত কী আট? মা স্পষ্ট করে বলেন নি কখনো বাবা আসলে কোথায় যাচ্ছিলেন। আমি জানতে পারি দেশের বাইরে গিয়ে আর ফেরেন নি। মা'র নীরবতার ব্যাপারটাও আমাকে অবাক করে। নীরবতা দিয়ে কী বোঝাতে চান? বাবা কখনো ফিরবে না আর, তিনি জানতেন?
আজ মেইল চেক করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো, আগে বাড়ির সামনে ডাকবাক্সে চিঠি আসত। প্রতিদিন মা গিয়ে সেটা খুলে দেখতেন, নতুন কোনো চিঠি এলো কি'না। মাঝে মাঝে চিঠি বের করে নিয়েও হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বাবা কখনো চিঠিও পাঠান নি।
আজ মনে হতে থাকে, আমার আসলে কখনো সত্যিকারের গাড়ির প্রয়োজন ছিল না। আমার একজন বাবার দরকার ছিল, আমার একজন হাসিখুশি মা'র দরকার ছিল।
আসলে হয়ত, মা'রা চিরকাল ধরে দুঃখীই থাকে।
মন্তব্য
( )
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ভালো। কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাওয়া গেল না পুরোপুরি।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
চেষ্টা করব ভবিষ্যতে
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ভালো লাগলো
-আরাফ করিম
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সব কটাই ভাল লাগল। ১ নং বেশী ভাল লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
গান্ধর্বী
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
বাহ!
আমদের আশেপাশের মানুষেরই গল্প
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
মনটা খারাপ হলো একটু।
____________________________
কৃতজ্ঞতা
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ভালো লেগেছে। তবে প্রথম টা বেশি।
-ছায়াবৃত্ত
কৃতজ্ঞতা
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
এরকম গল্পগুলো পড়তে বেশ ভাল লাগে। খুব বড় না, অল্প কিছু কথায় জীবনের ভাবনাগুলি উঁকি দেয় এরকম।
সে অর্থে, আপনার গল্পগুলো সেরকমই।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
ভালো লাগল জেনে
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
এরকম গল্পগুলো পড়তে বেশ ভাল লাগে। খুব বড় না, অল্প কিছু কথায় জীবনের ভাবনাগুলি উঁকি দেয় এরকম।
সে অর্থে, আপনার গল্পগুলো সেরকমই।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
গল্পের বিষাদ ছুঁয়ে গেল মনকে , কিন্তু লেখনীর মুন্সীয়ানা মনে আনন্দের স্পর্শ এঁকে দিল :)। অনেক শুভেচ্ছা!
ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
চমৎকার! ২ আর ৩ অনেকটা একই, না?
একই একটু ভিন্ন প্রেজেন্টেশন, এই যা
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
১ নম্বর বেশী ভালো লাগলো। তিনটে গল্পের মধ্যে কোন একটা যোগসুত্র কি আছে? ধরতে পারছি না। ৩ নম্বরে বিষন্নতা ভর করলো।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নাহ! যোগসূত্র নেই। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন লেখা
অনেক ধন্যবাদ
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
প্রথমটা চমৎকার লাগলো।
ফেসবুকের কাছে আমাদের অজস্র ঋণের পাওনাও রয়ে গেছে কিছু। স্বল্পায়তনে এবং দ্রুততায় পাঠকের কাছে যাওয়ার আকর্ষণে অনভ সম্ভাবনার অনেক প্লটও নষ্ট হয়ে যেতে পারে, রিশাদ
প্রথমটাই...
ভালো লাগল , ২ নাম্বারটা বিশেষ করে
facebook
আরিশ, কেমন আছো তুমি? তোমার এই লেখাটা কেনো যেনো একটা ধাক্কা দিয়ে গেলো আমায়। ভালো থেকো খুব।
-নিয়াজ
প্রথম দুইটা মর্মস্পশী সার্থক গল্প হয়েছে,আর তৃতীয়টা অগোছালো মনে হয়েছে,কিংবা আমার বুঝার অক্ষমতাও হতে পারে।সুন্দর দুটি গল্পের জন্যে আপনাকে অসংখ্য ।
মাসুদ সজীব
সুহান, তারেক অণু, কড়িকাঠুরে, নিয়াজ ভাই, মাসুদ সজীব এবং উদাস দা সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। দু"খিত দেরীতে জবাব দেবার জন্য।
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
নতুন মন্তব্য করুন