শ’য়ে- শ’য়ে নাকি হাজারে হাজারে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে- যারা মানুষের মতো দেখতে; দুটো হাত একটু এঁকেবেকে গিয়ে ডানার মতো হয়ে গেছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে।
ঘোরপাখি
কিশোরবেলায় কত গল্প-উপন্যাসে পড়েছিলাম- ঢং ঢং শব্দ করে সময় জানান দেয় অভিজাত পরিবারের ড্রয়িং রুম ওয়ালে বসানো বিশাল কোনো গ্র্যান্ড ঘড়ি; যে ঘড়ি দম নিতে জানত। শহরে শহরে সিটি কর্পোরেশনের সংস্কারহীন শরীরে ঝোলানো থাকে এখনো বিশাল কোনো ঘড়ি- কোনটা চলমান থেকে আমাদের সতর্ক করার চেষ্টা চালাচ্ছে, মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছে সময়ের মূল্য রচনার কথা। বস্তুত ভুলে থাকার ভান করেও আমরা অতি ব্যস্ত। ঘড়ির প্রয়োজন মেটাচ্ছি মোবাইল দিয়ে, ঐ সব দম নেয়া ঘড়ির প্রয়োজন ফুরিয়েছে বহু আগেই। মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ একজন কানের কাছে ওমন ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে সময় জানান দিয়ে গেলে বেশ হতো। মা’র কাছে শুনেছি বলে মনে পড়ে- তোর দাদার বাড়িতে কী একটা ডাক দেয়া ঘড়ি ছিল, সারারাত ধইরে বাইজে উঠত; এজন্য তো তুই পেটে থাকা অবস্থায় ঠিকমতো ঘুম হয় নাই, তোর স্বাস্থ্যটাও ভালো হয় নাই।
স্বাস্থ্য নিয়ে মা’র আক্ষেপ চিরকালের। কেবল আমি না, আমার বাকি ভাই-বোনদের এক-ই কথা শুনতে হয়েছে। এখন অবশ্য কিছু বলেন না। হয়ত বলার বয়স পার করে এসেছি কিংবা চোখের সামনে থেকে ঘড়িটি চলে যাবার পর মা আর দায়ী করার মতো কাউকে অথবা কিছুকে খুঁজে পান না দেখে চুপ হয়ে গেছেন অথবা বলা যায়- এমন-ই তো হবার কথা; ছেলে বড় হয়ে যাবার পর মা’রা ছোট হতে থাকেন, তখন উল্টো ছেলেমেয়েদের বলতে হয়, খাচ্ছেন না কেন ঠিকঠাকমতো?- আমি কী কখনো বলেছি? ভ্রু কুঁচকে স্মরণ করতে চেষ্টা করি।
বাড়ি যাই না কতদিন হয়ে গেল। মা’র শরীর এখন কেমন আছে?-সেটাই তো জানা নেই। মনে পড়ে, আমার ছোটভাই জন্মের সময়কার কথা। তীব্র প্রসব বেদনায় কাতর মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে বাবা। ঘরের ভেতরে ছুটোছুটি। আমি মা’র হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম- কী, হয়েছে? শ্বাস আটকে আটকে মা কোনোমতে জবাব দিলেন- কিছু না বাবা।
আমার অফিস শেষ হয় পাঁচটায়। এমন নয় যে বাড়ি ফেরার তাড়া আছে আমার, কোনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, প্রিয় কেউ চোখের ভেতর অপেক্ষা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কোথাও- তারপরেও লাঞ্চ আওয়ারের পর থেকেই বারবার ঘড়ি দেখতে হয়- মোবাইলের ঘড়ি। তখন মনে হয় সময় জানান দেয়া ঘড়ি থাকলে বড্ড সুবিধে হতো। কী আশ্চর্য! ঠিক তখন-ই আমার মা’র কথা মনে হয়ে বেদনাকে আলিঙ্গন করে ফেলি। হয়ত সেই অর্থে আলিঙ্গন নয়, ক্ষণিকের আক্ষেপ- তাতে একটা লাভ হয়, আমি কাজে মনোযোগ দিতে পারি, বাকি সময়টা কেটে যায়।
বিকেলের শেষ সময়ে এসে গাড়িগুলো দীর্ঘক্ষণ ধরে একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে- যেন তারা সদ্য প্রেম হওয়া কোনো তরুণ-তরুণী; একটু দূরে গেলেই বুঝি সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। এরপর গায়ে গায়ে লেগে ঢিমেতালে দূরত্ব অতিক্রম করে। আর আমি অথবা আমার মতো অন্য অনেকেই বাসের বিশ্রী ভিড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হতে হতে ভাবি- এরচেয়ে হেঁটে গেলেই বোধহয় ভালো করতাম। অবসাদ বিষয়ক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ভাবনার বাস্তব রুপায়ন সম্ভব হয়ে ওঠে না। পায়ের উপর পা- আমার মতো শুকনো মানুষের অথবা আরো ভারি কারো দ্বারা অবলীলায় বিন্যস্ত হয়। তাই আমার অনেকদিন আগে কেনা জুতো মেসের খাটের নিচে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে মরে যাচ্ছে। কোনো প্রোগ্রামে যাবার সময় পায়ে গলিয়ে বের হতে চাইলে অভিমানে ধূলোসাজ দিয়ে বসে থাকে। জুতার মেকাপ বক্স নেই। রান্নাঘর থেকে শুকনো ন্যাকড়া এনে ছুঁয়ে দিতে চাইলে অনেক জোর করে একটু হাসে।
এই তো ক’দিন আগে বাসের ভেতর খেয়াল হলো মোবাইল নেই। প্রথমে প্রথাবিরোধীভাবে মন খারাপ হলেও কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে নেমে যাই বাস থেকে গন্তব্যে পৌঁছাবার আগেই। আমাকে কেউ খোঁজে না, মাঝে মাঝে বাসা থেকে টুকটাক ফোন আসে- এই যা; এমন বৈশিষ্টহীন মানুষের মোবাইল হারানো খুব একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার না।
মাঝে মাঝে তবু এই ক্লিশে সার্কেল থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তখন রিকশা করে বাড়ি ফিরি। টাকা একটু বেশি খরচ হয় বৈকি। মোহাম্মদপুর যাবার বদলে রিকশাকে বলি ধানমন্ডির ভেতরে ঘুরে-বেড়াতে অথবা কখনো কখনো ঢাকা ভার্সিটি এরিয়ার ভেতর- ফুলার রোড হয়ে পলাশী, পলাশী থেকে ধানমন্ডি। বাসায় ফিরতে সেদিন একটু দেরি হয়ে যায়। কারো কিছু এসে যাবে- এমন কেউ অপেক্ষায় নেই। রফিক আজাদ প্রতীক্ষার কথা বলেছিলেন। প্রতীক্ষা করার একজন মানুষ অবশ্য ছিল। আক্ষরিকভাবে তার প্রস্থান হয়েছে। অথচ এই ধানমন্ডি এলেই বুঝতে পারি, কী অসংকোচেই না সে আছে হৃদয়ের খানিকটা জুড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার দখলদারিত্ব কমে যাচ্ছিল কিন্তু এখন নির্দিষ্ট জায়গা দখল করে চুপচাপ বসে আছে।
অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডুপ্লেক্স বাড়িগুলো কমছে। কতশত ডেভলাপার কোম্পানি। এর মাঝে অনেকটা গভীর সমুদ্রের মাঝে একখন্ড জমি খুঁজে পাবার মতো করে ডুপ্লেক্স বাড়িগুলোর দেখা মেলে- অহংকার নেই বরং দেখে মনে হয় বিষণ্ণ, একটু পর কেঁদে ফেলবে। অন্তিমা- আমার প্রতীক্ষার মানুষের বাড়িটি দেখলে আমার ঠিক তাই মনে হতো। অন্তিমা নেই, ওদের বাড়িও আর নেই। অন্তিমার সঙ্গে শেষ দেখার দিনটি অসস্পষ্টভাবে মনে পড়ে।
তুমি সত্যি চলে যাবে?- আমার এই নির্দোষ প্রশ্নের জবাবে সে হেসে বলেছিল, তোমার চোখে আগুন নেই, উত্তাপ নেই, তুমি জড় পদার্থ, তুমি ভীরু।
চোখের ভেতরে কিভাবে আগুন থাকে? তাকে জিজ্ঞেস করব বলে ভেবেছিলাম, করা হয় নি। জড়মানুষ বলে কোনো বস্তু আছে বলে শুনি নি কখনো। আমি তাই ধাঁধার ভেতরে থেকেই তাকে মনে মনে বিদায় জানাই।
এখন আমার অবসরের কথা বলার সঙ্গী বলতে মেস সতীর্থ রাজুকে বলা যায়। কোনোদিন রাত দশটার আগে বাড়ি ফিরতে পারে না। তার একটি ভাঙ্গা টেপরেকর্ডার আছে। এসেই বাজাতে শুরু করবে-চাকরিটা ছেড়ে দিব কালকেই। আজকালযুগের টেপরেকর্ডারের অসারতা প্রমাণ করতেই যেন তার কথা সত্যি হয় না। তারপরেও অপেক্ষায় আছি তার টেপ রেকর্ডারের ক্যাসেট হয়ত পরিবর্তন হবে, সেখানে বেজে উঠবে- চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি দোস্ত। চল দুই বন্ধু মিলে এখন হাওয়া খেয়ে বেড়াব। অবশ্য তাকে কি আমার বন্ধু বলা যায়? রাতের বেলা কিছু টুকরো বাক্যলাপ ছাড়া আর কোনো কথা হয় না। এমনকি তার দেশের বাড়ি কোথায়, ক ভাই বোন- জানা নেই আমার। বন্ধু হতে গেলে কি এসব জানা আবশ্যক?
আমার বন্ধু তো ছিল ইমরুল- ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হওয়া, একসঙ্গে ঢাকা আসা, এরপর হুট করে আলাদা হয়ে যাওয়া। হুট করে আলাদা হয়ে যাওয়াটা বোধহয়, আমার দিক থেকে প্রযোজ্য- পরে বুঝতে পেরেছি, ইমরুলের আলাদা হয়ে যাওয়ার আয়োজন চলছিল অনেকদিন ধরেই। দেশ ছেড়ে চলে যাব দু’জন এমন কথাই হচ্ছিল। টাকা দিয়েছিলাম তাকে। টাকা এবং বন্ধু এরপর হারিয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হলে কষ্ট হয়- যদিও বুঝতে পারি না, কষ্টটা কেন? টাকার জন্য নাকি বন্ধুর জন্য?
আমার তাই বাড়ি ফেরার কোনো তাড়াই থাকে না। স্কুলে পড়ার সময় বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার আগে কত ধরণের প্ল্যান করতাম- ছুটিতে এটা করব, সেটা করব; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার অনেককিছু করা হতো না। তারপরেও ছুটির সময় আনন্দের অভাব হতো না। স্কুলে না যাবার আনন্দ, বিকেলে দুঃশ্চিন্তাহীনভাবে ক্রিকেট খেলার আনন্দ, খালাত ভাই-বোন মিলে পাড়া বেড়ানোর আনন্দ। তারপর পুনারাবৃত্তি হতো সেই একই সাইকেলের।
এখন অবসরের কথা আলাদাকরে ভাবার প্রয়োজন পড়ে না।
বাবা মারা যাওয়ার পর অথবা বলা যায় বাবাকে মেরে ফেলার পর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। চাচাদের হাতে সম্পত্তি দখল হয়ে গেল। বাবার লাশ চোখে দেখার সৌভাগ্য হলো না- এরপর থেকে আনন্দ শব্দটি কিংবা অনুভূতিটি আমার সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা শুরু করল।
বাবাকে হত্যা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায়। একদিন অফিসে গিয়ে আর ফিরে এলেন না। পোস্ট-মর্টেম ছাড়াই কিভাবে যেন দাফন হয়ে গেল। আসলে কী ঘটেছিল? বিস্ময়কর হলেও সত্য আমার জানতে ইচ্ছে করে না। এজন্য কী অন্তিমা বলেছিল- তোমার চোখে আগুন নেই? তুমি ভীরু, তুমি জড় পদার্থ? অন্তিমা সরাসরি বললে হয়ত তাকে বলতে পারতাম- যাই করি না কেন, আমার বাবা কি আর ফিরে আসবে?
এখন বরং কাজের সময় ভালো থাকি। ফাইল হাতে ছুটে বেড়ানো, কখনো কখনো সাইটে ঢাকার বাইরে যাওয়া, বাসের ভিড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়া এই নিয়েই কাটছে জীবন। অবসরের কাজ বলতে, ঐ মাঝে মাঝে রিকশা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো। শূণ্য পকেট মাঝে মাঝে চোখ রাঙানি দিলে চুপসে গিয়ে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াই। আজ তেমন একটি দিন। আমি চুপসে গিয়ে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াই। অনেক বিশাল লাইন।
বাস আসছে কম, রাস্তায় জ্যাম।
এর ভেতর কোথায় জানি ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে ওঠে- বাজতেই থাকে, বাজতেই থাকে। আমি শব্দের উৎস সন্ধানে এদিক-সেদিক তাকাই, আমার পাশের মানুষ তাকায়, বাস থেমে যায়, বাসের জানালা গলে মাথা বের করে যুবক পড়ে যেতে নেয়। তখন আমরা সবাই মিলে খেয়াল করি, শ’য়ে- শ’য়ে নাকি হাজারে হাজারে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে- যারা মানুষের মতো দেখতে; দুটো হাত একটু একেবেকে গিয়ে ডানার মতো হয়ে গেছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে।
হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ভেবে চোখ একবার বন্ধ করি, আবার খুলি- তখন দেখতে পাই, ওরা উড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
দেখেন দেখেন ভাই, পুরা মানুষের মতো দেখতে।
পাশের ব্যক্তি অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে নিজেই উড়তে চেষ্টা করে ধপাস করে পড়ে গেল। ততক্ষণে শব্দ থেমে গেছে। মানুষপাখির দল চলে গেছে। অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ঠিক কতক্ষণ মনে নেই।
২)
ডুবসাঁতার
কেমন করে মেসে ফিরে আসি, টের পাই না। ঐ হৈ-হট্টগোলের ভেতরে, মানুষের বিস্ময়, প্রশ্ন, মানুষপাখির উড়াল বিদ্যার কারণ অনুসন্ধান- এর ভেতরে কোনোমতে শরীর একটা বাসের ভেতর গলিয়ে দিয়ে চলে আসি সেখান থেকে।
ঘড়িতে বারটা বাজবে বাজবে করছে। রাজু আসে নি এখনো। এত দেরি কখনো করে না। রাজু কি পাখিদের দলে যোগ দিয়েছে? এমন হবার সম্ভাবনা খুব কম। আকন্ঠ হতাশায় নিমজ্জিত রাজু হয়ত কখনো ওড়ার স্বপ্নই দেখেনি। আমি কি দেখেছিলাম?
হয়ত ওমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বাড়ি ফিরেছি দেখে এখন এমন মনে হচ্ছে, এসব প্রশ্ন আসছে। যা দেখেছি তা হয়ত ভুল, কিন্তু একসঙ্গে এতগুলো মানুষ ভুল দেখতে পারে?
ঘুমে চোখ লেগে এসেছিল। হন্তদন্ত হয়ে তখন রুমে ঢুকল রাজু।
এই উঠ, ঘুমাই গেছিস?
আমি ঘুমোয়নি। তারপরেও চোখ খুলি না। চুপ করে থাকি। এটা তো রাজুর-ই কন্ঠ? এমন আন্তরিকভাবে ও আমাকে ডাকছে? একটু করে চোখ খুলে রাজুকে দেখে আবার বন্ধ করে ফেলি।
চাকরিটা এবার ছেড়েই দিচ্ছি। কালকেই ছেড়ে দিব। এবার আর পিছু হটব না। এই উঠ না, কথা আছে।
চাকরি ছেড়ে দেবার কথা রাজু তো প্রতিদিন বলে। তবে প্রতিদিন এই কথা বলে সে চুপ হয়ে যেত, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শার্ট খুলে ছুড়ে মারত, তারপর ধুম করে বিছানায় শুয়ে যেত।
তাই আজ যখন কথাটির পর বাড়তি বলে-এই উঠ না, কথা আছে তখন আর চোখ না খুলে পারি না।
আমি চোখ খুলতে খুলতে রাজু বাইরের পোশাক বদলে ফেলেছে। একবার ভাবি জিজ্ঞেস করব, এত রাত হলো কেন? অফিস থেকে কোথাও গিয়েছিলি? কিন্তু করি না অথবা বলা যায় করার সুযোগ পাই না। করি না কারণ এতটা ঘনিষ্ঠতা তো কখনো ছিল না যে জানতে চাইব, দেরি হলো কেন? করার সুযোগ পাই না কারণ, আমাকে উঠে বসতে দেখেই রাজু বলতে শুরু করে- তোর অফিস শেষ হয় কয়টায়? আচ্ছা যখন-ই শেষ হোক, তুই কাল সন্ধ্যার ভেতরে শাহবাগ চলে আসবি।
শাহবাগ! কেন?
তুই জানিস না কিছু? আজ কী ঘটেছে?
একবার ভাবি, বলব সেই উড়ে যাওয়া মানুষদের কথা, ঘন্টার কথা- যা, আমি দেখেছি বলে জানি।
কী ঘটেছে?
আরে, কাদের মোল্লার রায় ছিল আজকে। এটা তো জানিস?
হ্যা, জানি। ফাঁসি দিয়েছে তো?
আমার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে রাজু বলল, এটাই তো ঘটনা। ফাঁসি তো দেয় নাই। যাবজ্জীবন দিসে।
ওহ, দেয় নাই। এজন্য তুই এত উত্তেজিত কেন?
উত্তেজিত হবো না? এটা তুই কী বললি? আমার কথায় আশাহত হয় রাজু। চুপ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। লাইট অফ করে দেয়।
আসলেই কী এত উত্তেজিত হবার কোনো কারণ আছে? একাত্তরের এই ঘৃণ্য রাজাকারের ফাঁসি হবে না, এটা ভাবাই যায় না। অবশ্যই ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট-পাট এতকিছুর সঙ্গে জড়িত থাকলেও ফাঁসি হবে না? ভাবা যায়? এখন ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর, যে এতকিছুর পরেও কাদেরের ফাঁসি হয় নি। একটু একটু করে আমার ভেতর রাগ বাড়তে থাকে, যার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমার কোনো পরিচয় নেই অথবা কোনোকালেই পরিচয় হয় নি। আমি শেষ কবে রাগ করেছিলাম? মনে করতে পারি না।
রাজুকে ডাকি- ঘুমায় গেছিস?
না।
শাহবাগ যেতে বললি কেন? শাহবাগে কী?
তা দিয়ে তোর দরকার কী? তুই তো ভাবিস, উত্তেজনার কিছু নেই।
আমি আবার চুপ হয়ে যাই। জীবন-যাপনে পিষ্ট রাজুর মনে এত বিদ্রোহ লুকিয়ে ছিল কে জানত? একবার ভাবি, রাজুকে বলব- বাবার মৃত্যুর কথা। যে ছেলে নিজের বাবার হত্যাকারীদের বিচার নিয়ে চিন্তিত না, চিন্তা তো দূরের কথা- বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, তার কাছে কী এমন মনে হওয়া খুব অস্বাভাবিক? অথচ নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি এখন, একটু একটু করে চাপা ক্ষোভ আমার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে, মাথা প্রচন্ড ভারি লাগছে। আচ্ছা, ব্যাপারটা কি এমন নয় যে পূর্বপুরুষদের রক্তের ঋণ শোধ করি নি বলেই, আমার বাবার হত্যার বিচার চাইতেও আমার কুন্ঠা হয়? কোনোভাবে কী আমার ভেতরে একটি বার্তা সেট হয়ে আছে- অপরাধীদের বিচার হয় না?
রাজু, তুই ঠিক বলেছিস। উত্তেজনার অনেক কিছুই আছে। অনেক কিছুই।
তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়। কাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থাকব। ওখানে সবাই একত্রিত হচ্ছে ফাঁসির দাবিতে।
তোর অফিস? বের হতে পারবি?
নিরুত্তাপভাবে রাজু উত্তর দেয়- বললাম না, ছেড়ে দিব।
কেন জানি, আমার রাজুর কথা বিশ্বাস হয়। গতকালের রাজুর সঙ্গে এই রাজুর অনেক পার্থক্য।
৩)
হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল কিছু একটা। হাওয়ায় কত কিছুই তো উড়ে যায়; সত্যিকারের পাখি উড়ে যায়, অনেক দূর দিয়ে পাখির মতো করে বিমান উড়ে যায়, কখনো চট করে ভাসতে থাকা মেঘ ওড়ার মতো করে অদৃশ্য হয়ে যায়, চোখের অলক্ষ্যে কত ধুলো উড়ে যায়, যত্ন করে রাখা চিঠি বাতাসের টানে ডানা বানিয়ে ওড়ার স্বাদ নিয়ে ফেলে--এমন কত কিছুই তো হয়।
শাহবাগ মোড়ে জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে টের পাই, সেদিন আসলে আমি মানুষপাখিদের এখানেই উড়ে আসতে দেখেছিলাম। আমিও আজ তাদের দলে, তাদের পাশে। কাউকে চিনি না, আমি জানি- রাজু এখানেই কোথাও আছে, হয়ত সে আজ চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে, আমার মতো সবাইকে দেখছে আর অবাক হচ্ছে।
স্লোগান ওঠে, ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।
স্লোগান ওঠে, আমি কে? তুমি কে? বাঙালি, বাঙালি।
স্লোগান উঠতেই থাকে, জামাত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাঙলা ছাড়।
এত এত মানুষ, এত এত শব্দের ভিড়ে নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করি। আমি কাউকে চিনি না, কেউ আমাকে চিনে না, চেনার প্রয়োজন নেই, সব প্রয়োজন মিলে গেছে একটি সূত্রে, স্লোগানে- জয় বাঙলায়; বিয়াল্লিশ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে আর আমি টের পাচ্ছি সেই বাষ্পের সঙ্গে আমার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা কাপুরুষ বাঘ নেই হয়ে যাচ্ছে।
বেঁচে থাকা মানে যে কেবল নিঃশ্বাস নেয়া নয়, বেঁচে থাকা মানে যে কেবল দু বেলা খেয়ে-পড়ে চলতে পারা নয়- এই থিওরিটিক্যাল সত্যটি এত বাস্তব হয়ে ধরা দেয় নি আগে। মরে মরে বেঁচে থাকার কী মানে? কে আসে নি এখানে? পাঁচ বছরের শিশুটাও গালে বাংলাদেশের পতাকা মেখে স্লোগান দিচ্ছে, হুইল চেয়ারে করে ছুটে এসেছে মানুষ।
আর আমি কিংবা রাজু তরুণ রক্ত শরীরে নিয়ে এমন ধুঁকে ধুঁকে মরছি?
এখান থেকে বাড়ি যেতে হবে। বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে একটা সুরাহা এবার করতেই হবে। অন্তিমাকে গিয়ে বলব- আমি এসেছি, আমাকে বিয়ে করবে?
এমন করে দিন কেটে যায়। রাজিব হত্যার খবর শুনে রাজুকে বলি- পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। আমি রাজুর চোখে দেখি- আগুন ঝরছে। এই আগুনের কথাই কী অন্তিমা বলেছিল? আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, রাজুও নিশ্চয় আমার চোখে আগুন দেখছে।
আমি শাহবাগ যাই, রাজু যায়, আরো অনেকেই যায়- সবার চোখে আগুন, সবার চোখে স্বপ্ন, সবাই এখন পাখি- ঘোরপাখি, উড়ছে তবু ক্লান্তি নেই। তখন কী আর জানতাম, পাখিদের ডুবসাঁতারে আটকা পড়ে যাব?
৪)
শাহবাগ অধ্যায়ের এক বছর পার হয়ে গেছে। এর মাঝে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। রাজু আর আমি সেদিন গলা জড়াজড়ি দিয়ে কেঁদেছি। কতটা হালকা লেগেছে বলে বোঝাতে পারব না। তারপরেও রাজুকে দেখি আবার আজকাল আগের মতো হতাশ হয়ে যাচ্ছে। ওই জনসমুদ্রের অবসান হবার পর থেকেই একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। আমিও কি তাই?
সবকিছু তো বদলে যাচ্ছিল। আবার কেন এমন হচ্ছে বল তো? সেই হতাশা, সেই সার্কেল? এখনো অনেকগুলো রায় কার্যকর হওয়া বাকি দেখে? আমি তাকে জবাব দেই না। আমার বাড়ি ফিরতে হবে। বাসায় অনেক কাজ। অন্তিমাকেও বলা হয় নি, আমি এখন আর জড় পদার্থ না, আমি এখন একটু হলেও মানুষ, কিছুটা পাখি।
ঘোরপাখিরা এখন ডুবসাঁতারে, বিশ্রামে। কখন হুঁশ করে মাথা তুলে আবার উড়াল দিবে- আমি সেই অপেক্ষায় বসে আছি। নিজেকে কথা দিয়েছি- পাখি হবো, ডানায় ঘোর নিয়ে চলে যাব বহুদূর, মা’য়ের কাছে, মাটির কাছে, সত্যের কাছে, সুন্দরের কাছে।
মন্তব্য
বিষণ্ণতার সঙ্গে বিপ্লব। সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া। ভালো লাগল।
বাহ! তুমি লগইন করে মন্তব্য দিয়েছ। অবাক লাগতেসে
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
চমৎকার! কিছু কিছু বাক্য মাথায় গেঁথে গেলো যেনো!
আরো লিখুন রিশাদ। শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ভালো লাগল, উপমা নিয়ে খেলার ঝোঁকটা দারুণ!
আপনার বইটা জলদি পড়ে ফেলব।
facebook
ধন্যবাদ।
বিষণ্ণতা ও আন্দোলন- পুরোপুরি বিপরীতধর্মী দুটি বিষয়। একটি আন্দোলন কখনো বিষণ্ণ হতে পারে না, আবার একজন বিষণ্ণ মানুষ আন্দোলনে অংশ নিতে পারে না। আসলেই কি তাই?
এই চিন্তা থেকেই লেখা
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আজকে সচলে ঘুরতে ঘুরতে আরেকবার পড়ে ফেললাম গল্পটা। যথারীতি আগের ভালো লাগা।
বহুদিন পর গদ্যে কবিতার স্বাদ পেলাম, উপমা, বর্ণ, ছন্দ!
বলেন কী! কবিতা! ধন্যবাদ, শুনে ভালো লাগল
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
নতুন মন্তব্য করুন