বাবার কবর হারিয়ে যাবার পর

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব ময়ূখ রিশাদ [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৫/০৪/২০১৪ - ১০:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবরস্থানে বটগাছ থাকা আবশ্যক কি’না, বিষয়টি সম্পর্কে জানা না থাকলেও এই মুহূর্তে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রঞ্জুর মনে হলো- এই ছায়া না পেলে এখন সে মারাই যেত। দীর্ঘদিন পর গোরস্থানে এসে বাবার কবর খুঁজে না পেয়ে মধ্যদুপুরে কড়া রোদের উত্তাপ দ্বিগুণ হয়ে যাবার পর রঞ্জু ছায়া খোঁজে এবং তখন-ই বটগাছটি দেখতে পেয়ে তার নিচে এসে দাঁড়ায় হতবিহবল অবস্থায়। এমন হবার কোনো কথা ছিল না। উদাসীন, ভুলে যাওয়া স্বভাবগত- এই ঋণাত্মক বৈশিষ্ট ধারণ করলেও এতটা নয় যে বাবার কবর কোথায় সে ভুলে যাবে।

বাস থেকে নামার পর থেকে রঞ্জুর মনে হচ্ছিল, হয়ত ঠিকঠাকভাবে চিনে সে গোরস্থান যেতে পারবে না। বাসস্ট্যান্ড পনের বছরে বেশ বদলে গেছে। প্রতিটি বাসের জন্য আলাদা কাউন্টার, যাত্রীদের বসার জায়গা, অনেক বেশি ভিড়, বাস কেবল যাচ্ছে আর আসছে; আগে চিত্রটা এমন ছিল না। তখন বাস ছাড়ত ঘন্টায় একটা, আলাদা কোনো জায়গা ছিল না, টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না। তাই রিকশা খোঁজার মুহূর্তে রঞ্জুর মনে হলো, সে গোরস্থান খুঁজে পাবে না। তার ধারণা শিকড় গজিয়ে বসল কিছুদূর এগোতেই। পুরো শহর বদলে গেছে। অজস্র রোগ নিরাময় কেন্দ্র যেন জানান দিতে চায়, এই শহরের মানুষ ভালো নেই, অসুখ তাদের চারপাশে বৃত্ত বানিয়ে রেখেছে। ডেভলপার কোম্পানির সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখে আরেক দফা অবাক হয়। নিশ্চয় অল্পদিনের ভেতরে নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে বানানো দোতালা-তিনতলা বাড়িগুলো কালের ভেতর হারিয়ে যাবে। রঞ্জু দেখে আর অবাক হয়।

গতকাল রাতে নীলাকে যখন সে বলল, আজ সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবে তখন নীলা মৃদু হেসে বলেছিল, যে ছেলে ধর্ম পালনের ধারকাছ দিয়ে যায় না, সে কবর জিয়ারত করে কী করবে?

রঞ্জু বলেছিল, কবরস্থান তো কেবল ধর্মীয় চেতনার জায়গা না। এটাই তো এখন বাবার ঠিকানা, শেষবার এই ঠিকানাতেই বাবাকে দেখেছিলাম।

এতদিন একটিবারের জন্য গেলে না, গিয়ে খুঁজে পাবে তো?

গায়ে মাখে নি নীলার বিদ্রুপ। আজ এখন এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে, রঞ্জুর প্রথমে মনে হয় সে ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। এখানে কোনোকালেই তার বাবার কবর ছিল না। কিন্তু তারপরে পুরো কবরস্থানের অবয়ব চোখ বন্ধ করে স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, সবকিছু ঠিক আছে, কেবল তার বাবার কবরের জায়গা দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে, যার দু পাশে কবর আছে- অন্যমানুষদের। পুরো শহর বদলে গেলেও কেবল সীমানাপ্রাচীর বাদে আর কোন পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে চোখে পড়ে না রঞ্জুর।

সুন্দর একটি নেমপ্লেট লাগানো হয়েছিল। অবশ্য একদিক দিয়ে দেখলে বিশেষ কিছু না, কালো টিনের পাতে সাদা অক্ষর। এমন অনেক নেমপ্লেট বাঁশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে, তার বাবার নামসহ নেমপ্লেটটি কোথাও নেই। বটগাছের ছায়ায় বসেও ঘামতে থাকে সে। এখান থেকে পুরো গোরস্থান বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। ঢোকার মুখে লোহার গেট। মূল রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে সরু গলি দিয়ে প্রবেশ করলেই যে কারো এই বড় গেট নজরে পড়বে। রঞ্জুর স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনের কথা। এই গলি দিয়ে ঢোকার সময় অদ্ভুত এক ভয়, শীতলতা এমনভাবে বেধে ফেলছিল তাকে যেন পিচঢালা রাস্তার ভেতর দিয়ে কেউ তার পা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক মানুষ ছিল। ছোট্ট আকারের রঞ্জু ঐ ভিড়ের চাপে বোধহয় সামনের দিকে যেতে পারছিল, দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিল লোহার গেট।

গেট দিয়ে ঢোকার মুখে রাস্তার একপাশে দাঁড়ানো ভিক্ষুকের দল। তাদের পার হয়ে প্রবেশ করতেই সামনে একতলা বিল্ডিং- প্রার্থনা ঘর। ঘরের দুই পাশ দিয়ে ছোট্ট রাস্তা। তার দু পাশে সারি সারি করে চারকোণা বাঁশের ঘরে উঁচু হয়ে থাকা মাটির ডিবির ভেতরে কত মানুষ ঘুমিয়ে আছে। বামপাশে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে রঞ্জু দেখতে পেয়েছিল লুঙ্গি-শার্ট পরিহিত একদল কাদামাখা লোক সদ্য খোঁড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কার- চাচা না চাচাত ভাই এর আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়েছিল রঞ্জু, মনে নেই। টের পেয়েছিল কে জানি হ্যাঁচকা টানে তাকে কবরের ঠিকপাশে এনে দাঁড় করে দিয়েছিল।

মাটি দে, রঞ্জু।

একদলা মাটি হাতে নিয়ে খুব মোলায়েমভাবে কবরের ভেতরে ফেলছিল আর সাদা কাফনে মোড়া বাবার অবয়ব ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল। রঞ্জুর বারবার মনে হচ্ছিল, ওর হাতে কী বেশি মাটি চলে আসছে? এত তাড়াতাড়ি ভরে যাচ্ছে কেন? ওর বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, তোমরা একটু আস্তে আস্তে ফেল। কিন্তু চুপ করে ছিল।

বাবা মারা যাবার আগেরদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। বাসায় বাবাকে নিয়ে সবার ছোটাছুটির মাঝে নিজের রুমে রঞ্জু ঘুমিয়ে ছিল। বাবার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে ওর মা যখন চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, প্রতিবেশিরা সবাই ছুটে এল তখন রঞ্জু ঘুম ভেঙ্গে দেখেছিল বড় বোন মা’র চোখে-মুখে পানি ঢালছে। এরপর রঞ্জু জানতে পেরেছিল, বাবা আর নেই। কে তাকে এই নিষ্ঠুর খবরটি দিয়েছিল এই মুহূর্তে মনে করতে পারে না। পনেরবছর আগে মার্চ মাসের একরাতে এই ঘটনাটি ঘটেছিল এবং রঞ্জু তার বাবাকে এই গোরস্থানে রেখে গিয়েছিল। সারারাতের বৃষ্টিতে কাদায় রুপান্তরিত হওয়া মাটি সমস্ত শরীরে লাগিয়ে অচেনা জলস্রোত চোখে নিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল মনে নেই।

আজ বটগাছের নিচে বসে রঞ্জু খেয়াল করে তার হাতে এখনো কাঁদা লেগে আছে। এর মাঝে কত বৃষ্টি, কত ঝড়, কত তুফান এল-গেল, কত কাজ করা হলো এই হাত দিয়ে, কতকিছু!- অথচ এতকাল চোখে পড়ে নি, এই কাঁদা! কাপড়ে মুছতে গিয়ে লাগিয়ে ফেলে সারা শরীরে।
মানুষ আসছে- যাচ্ছে। কান্নার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে নতুন কোনো রঞ্জু হয়ত তার আপনজনকে নিয়ে আসছে। গাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। যত আগ্রহ নিয়ে এসেছিল টের পায় তার বিন্দুমাত্র কিছু অবশিষ্ট নেই। নীলাকে গিয়ে কী বলবে? নীলার কথা যে ভিন্নরুপে সত্য হয়ে ধরা দিবে তার কাছে কে বুঝতে পেরেছিল? মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করে রঞ্জু।

বাবার কবর হয়ত খুঁজে পাচ্ছে না কিন্তু এ কথা সত্য যে বাবাকে এখানেই সে রেখে গিয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন দেখা করতে আসে নি দেখে, বাবা কি রাগ করে কোথাও চলে গেলেন? কবরের ভেতরে চলাচলের কোনো রাস্তা আছে কি’না তা কারো জানা নেই।

রঞ্জু বিপন্ন বোধ করে। মরে যাওয়ার পর মানুষটাকে কষ্ট দিল সে! এমন একটি ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে ভাবে- বাবার উপর অকারণ দীর্ঘ অভিমান করা তার ঠিক হয় নি।

রঞ্জুর মনে পড়ে পরীক্ষায় খারাপ করে বাড়ির পেছনে এক গুপ্তঘরে গিয়ে সে লুকিয়ে ছিল। বন্ধুরা মিলে সেখানে লুকোচুরি খেলতে যেত। বাবা একে-ওকে জিজ্ঞেস করে খুব সহজেই গুপ্তঘরের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকটা বাঁশের কঞ্চি তার উপর অবলীলায় ভেঙ্গে পড়েছিল। এরপর বাবার ভেজা চোখ ভিজে উঠেছিল। রঞ্জুর হাত ধরে আইসক্রিমের গাড়ি খুঁজে বের করেছিলেন। আইসক্রিম খেতে খেতে তার দু’জন বাড়ি ফিরেছিল। অথচ ঠান্ডার ধাত আছে বলে, রঞ্জুর আইসক্রিম খাওয়া ছিল ভীষণভাবে বারণ। এই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি পরবর্তীতে বাবার প্রতি অভিমানের সূচনা করবে ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি রঞ্জু। অবশ্য এসব বোঝার বয়স তখন ছিল না তার।

গোরস্থান থেকে কিভাবে ফিরেছিল, চেনা চেনা পথ কত দীর্ঘ মনে হয়েছিল এখন এসব কিছু মনে আসছে না রঞ্জুর। মনে আসছে, আক্ষরিক অর্থেই তারা সাগরে পড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল রঞ্জুদের পরিবার। প্রথমেই দীর্ঘদিনের ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে ওর মামার বাসায় উঠেছিল। ওদের জন্য একটি মাত্র রুম বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এমন ভাবার কোন কারণ অবশ্য নেই রঞ্জুর মামা খুব পাষাণ কিংবা সুযোগ-সন্ধানী কেউ ছিলেন। আসলে তাদের পারিবারিক সঙ্গতির ভেতরে যা সম্ভব ছিল তারা তাই করেছিলেন।

মা বিছানায় থাকতেন, বোনসহ। নিচে ফ্লোরিং করে, রঞ্জু আর রঞ্জুর ভাই। এর মাঝে রঞ্জুর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শুরু হয়ে, শেষ হয়ে গেল। ফল খুব খারাপ। নতুন জায়গায় একেবারেই মানিয়ে নিতে পারে নি সে।

স্বভাবত রঞ্জুর ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যত না তার পরীক্ষায় খারাপ করার কারণে মন খারাপ হয়েছিল তার চেয়ে বেশি হয়েছিল বাবার হাতের মার না খাওয়ার জন্য, আইসক্রিম হাতে না পাওয়ার জন্য।

প্রতি শুক্রবারে রঞ্জু আর তার ভাই বাবার কবর জিয়ারত করতে যেত। রঞ্জু বুঝতে পারত কিছু একটা নেই, হৈ-চৈ নেই, ভয় নেই, সেই সঙ্গে হাসিটাও যে নেই হয়ে গেছে তা অবশ্য ধরতে পারত না। খালি মনে হতো, সবাই এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? সে কী করছে, না করছে কারো কোন মাথাব্যথা থাকছে না কেন?

পরীক্ষার রেজাল্টের পর গোরস্থানে যাওয়া বন্ধ করে দিল রঞ্জু। সেই শুরু আর আজ এতদিন পর এসে দেখে বাবা অভিমান করে চলে গেছেন অন্যকোথাও, অন্য কোনোখানে।

নামাজের পর ভাই যখন রিকশা ঠিক করছিল তখন রঞ্জু উল্টো পথে হাঁটা দিল।

কীরে, যাবি না তুই?

না, যাব না।

কেন?

জানি না। এই সংক্ষিপ্ত কথোপকথন শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রঞ্জুর মনে হয়েছিল, যে বাবা তাকে পরীক্ষায় খারাপ করলে বকা দেয় না, যে বাবা না থাকার কারণে তাদের এখন কত কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে, সে বাবার সঙ্গে কেন সে দেখা করতে যাবে?

নীলাকে বিয়ের পরপর ছেলেবেলার এই অভিমানের কথা বলেছিল। নীলা জানতে চেয়েছিল, তুমি কী এখনো ঐ অভিমান আঁকড়ে ধরে আছ?
রঞ্জু নিজেকে প্রশ্ন করেছিল, আসলেই কী নীলা যা বলছে তা ঠিক? তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারে নি। একটু থেমে থেকে বলেছিল, বাবার চলে যাওয়ার জন্য সময়টা একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। মামাদের সমস্যা হচ্ছিল, আমিও তা বুঝতে পারছিলাম। একটু হলেও তাদের আচরণে তা প্রকাশ পাচ্ছিল। আর পাবেই না কেন? মামার জায়গায় আমি হলেই বা কী করতাম? এই বাড়তি খরচ, বাড়তি মুখ, বাড়তি জায়গা- এত বাড়তির মাঝে মনটাই কেবল ছোট হয়ে থাকত।

নীলা রঞ্জুর হাত মুঠোর ভেতর নিয়ে শক্ত করে ধরেছিল।

এই যে, তুমি হাত ধরলে- একটা নির্ভরতা, একটা আশ্বাস দিতে চাইলে, এই নির্ভরতার জন্য আমি কতটা আকুল হয়ে থাকতাম, তা যদি বোঝাতে পারতাম তোমাকে। গাড়ি না, বাড়ি না, এসির বাতাস না, সুন্দর সুন্দর নতুন জামা-কাপড় না, বন্ধুদের মতো বাইসাইকেল না, ঘোষবাড়ির মিষ্টি না; কেবল একটু নির্ভরতা, ভালোবাসা, কাছে টেনে নেয়া, মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয়া, শার্টের বোতাম ছিড়ে গেলে বকুনি দেয়া, বকা খাওয়া- এগুলো যে এত প্রার্থিত ছিল, কতরাত কেঁদেছি আমি, ঐটুকু বাচ্চা চিন্তা করে দেখ। রঞ্জুর চোখ ভিজে উঠেছিল আবার। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করেছিল। স্কুলের স্যাররাও আমাকে আর বকা দিতেন না- যেন বাবার সঙ্গে আমিও মরে গেছি, আমার কোন অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই, যেন আমি টুকরো পলিথিন, ছিড়ে গেলেও অসুবিধে নেই। আর বন্ধুরা ছিল চোখভরা করুণা নিয়ে। বন্ধুদের মা’রা ছিল অযাচিত সব প্রশ্ন নিয়ে।

তোমার পড়াশোনার খরচ কে দিচ্ছে এখন?

থাক কোথায় তোমরা?

কোনো অসুবিধে হলে আন্টিকে বলবে কিন্তু।

আমি ঐটুকুন বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম, পৃথিবী আদতে একটি নিষ্ঠুর ভূমি যেখানে ছোটবাচ্চাদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতার চর্চা করা হয়, তাদেরকে শেখানো হয় মন থেকে হাসিখুশি থাকা শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। সবশেষে ঘনায়মান সন্ধ্যার কোলে মাথা রেখে রঞ্জু বলেছিল, এতকিছু বাবার জন্য হয়েছে। বাবার যাওয়া ঠিক হয় নি, একদম ঠিক হয় নি।

নীলা ঘাটায় নি আর। এটাই পৃথিবীর নিয়ম এ ধরনের সান্ত্বনাসূচক কথাও বলে নি।

সন্ধ্যা নেমে আসে গোরস্থানেও। পাখিদের কিচিরমিচির বন্ধ হয়ে যায়। মসজিদে আযানের শব্দ ভেসে আসে। পড়ন্ত বেলায় ডুবন্ত আলোতে রঞ্জু খেয়াল করে তার হাতে মার খাওয়ার দাগ। সচকিত হয়ে লাফিয়ে ওঠে। এদিক-সেদিক তাকায়। বাবাকে কোথাও দেখতে পায় না। পায়ে-জামায় মাটি, হাতে মারের দাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রঞ্জু আরো হতবিহবল হয়ে পড়ে।

সুর করে দোয়া শব্দ ভেসে আসে, সুরেলা কান্নার আওয়াজ-দোয়ার শব্দ মিলেমিশে অদ্ভুত আবেশের তৈরি করে। রঞ্জু ভাবে, এবার বুঝি ঢাকায় ফিরে যাওয়া উচিৎ। রাতের বাস ছুটে গেলে থেকে যেতে হবে রাতে কোথাও। এই শহরে তার থাকার কোনো জায়গা নেই। আশ্রয়দাতা মামা আছেন- তাদের কাছে হুট করে যাবেই বা কী করে?

শেষবার শহর ছেড়েছিল সেই কবে। আজ ছেড়ে যাবে আবার। এতদিন একটা পিছুটান ছিল। সেই পিছুটান রঞ্জুকে ফিরিয়ে আনতে পারে নি। এখন কোন পিছুটান নেই। রঞ্জু নিশ্চিতভাবেই জানে আর ফিরবে না সে ক্রমশ বদলে যেতে থাকা এই শহরে- বাতাস বদলে গেছে, আলো বদলে গেছে, অন্ধকার বদলে গেছে, যে নদীর ধারে ক্রিকেট খেলত সেই নদী হয়ত বদলে গেছে, রঞ্জু নিজে বদলে গেছে।

মা চাকরি জোগাড় করেছিলেন। রঞ্জু একটু বড় হতেই টিউশনি। ঢাকায় বাসা ভাড়া দেবার মতো টাকা অর্জিত হতে থাকল। বড় বোনের বিয়েটাও কিভাবে জানি হয়ে গেল। এই আর্থিক টানাপোড়ন দূর হলো, ওর বড় ভাই বিদেশ যাবার পর। রঞ্জু বিস্মিত হয়ে খেয়াল করে, দু একবার বাবার মৃত্যুদিন ছাড়া সে কখনো আর অনুভব করে নি বাবাকে। ঢাকার সোডিয়াম বাতি, আলোর ঝলকানি, গাড়ির হর্ন, দম বন্ধ করা বাতাস, জ্যাম, বাসের ভিড়, পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা, স্বার্থ- সবকিছু মিলে রঞ্জুর আইসক্রিম খাবার ইচ্ছেকে মেরে ফেলেছিল, বাবাকে লুকিয়ে ফেলেছিল হাওয়ার ভেতর।

ক’দিন আগে নীলা যখন নতমুখে এসে বলল, আমি কনসিভ করেছি তখন রঞ্জুর মনে হলো, আমিও তবে বাবা হচ্ছি। আমাকেও যদি হুট করে দূরে যেতে হয়, আমার সন্তান কি আমাকে এভাবে দূরে ঠেলে দিবে?

বাসে আসার সময় রঞ্জু দেখছিল কত স্মৃতি মুছে গেছে। চেষ্টা করছিল একের পর এক স্মৃতিকে বের করে আনতে। এমনকি বাবার রাশভারি চেহারাটাও কেমন ঝাপসা ঠেকছিল ওর কাছে।

রঞ্জু, সন্ধ্যার ভেতর বাসায় ফিরবি।

রঞ্জু, পড়ার সময় ঝিমাচ্ছিস কেন?

এই নে ধর, নতুন জামা- জন্মদিনের জন্য; কী চুড়ান্ত অবহেলায় কোটি টাকার স্নেহ বিলিয়ে দেয়া যায়! -রঞ্জু এখন বুঝতে পারে।

বাবার কথাগুলো মনে করতে পারলেও কন্ঠস্বর মনে করতে পারে না স্পষ্টভাবে। মনে করতে পারে না আরো অনেককিছুই। তাই গোরস্থান থেকে বের হবার মুখে রঞ্জুর মনে হয়- বাবা ঠিক করেছেন এখান থেকে চলে গিয়ে। এমন কুলাঙ্গার ছেলের মুখ দেখাও পাপ।

আপনি সারাদিন এই গাছের নিচে বসে থাকলেন, কেমন উদাস হয়ে। কোনো সমস্যা ভাইজান?

রঞ্জু চুপ করে থেকে কেবল মাথা নাড়ে। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে অচেনা লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই গত কয়েক বছরে
গোরস্থানের কোন পরিবর্তন হয়েছে?

হইসে তো, নতুন রঙ করা হইল, পেছনে সীমানা ছিল না- ওইখানে দেয়াল দেয়া হইল।

মানে, জানতে চাচ্ছিলাম নতুন কোন রাস্তা বানানো হইসে, কবরের উপর দিয়ে?

লোকটি হেসে ফেলে। কি যে বলেন! কবরের উপর নতুন কবর হয়, তাই বলে কী রাস্তা! আমি তো আগেই বলছিলাম, আপনার কোনো সমস্যা হইসে। এত প্রশ্ন বাদ দিয়া বলেন, কী হইসে?

রঞ্জু ধরা পড়ে নিজের সমস্যার কথা খুলে বললে, লোকটি অট্টহাসিতে আশপাশ থেকে মানুষ জমতে শুরু করে। গলা খাট করে লোকটি বলে, হাসাইলেন ভাই। মাইনষের মার খাওয়াবেন তো। এইটা তো চৌধুরী বাড়ি গোরস্থান না। নিজের বাপকে কোথায় রাইখে গেছেন, এইটাও জানেন না?

কিন্তু এখানেই তো ছিল, এখানেই- আমি নিশ্চিত। রঞ্জু গেটের কথা বলে, লোহার গেট, ভেতরের পরিবেশের কথা বলে, প্রার্থনা ঘরের কথা বলে- সবমিল আছে, এমনকি আসার রাস্তাটাও। রিকশা-ওয়ালা তাকে এখানেই নামিয়ে দিয়ে গেল। তবে?

অচেনা অভিব্যক্তিহীন লোকটির চেহারা কঠোর হয়ে যায়। তবে তার বক্তব্য কঠোরতার সঙ্গে মিল না রাখে বলে-চলেন, আপনাকে চিনাই দেই। সারাটা দিন নষ্ট করলেন হুদাই, আরো আগে বললেও অবশ্য কাজ হইত না এতক্ষণে। ওই গোরস্থান গেল বছর নদীর বুকে চইলা গেল। এইটাও জানেন না? যান, দেইখে আসেন। গোরস্থানের জায়গায় নদীর স্রোত দেইখে আসেন।

রঞ্জু বলে, আমি কোথাও যাব না। আমি ঢাকা চলে যাব। একটু পথ হেঁটে পার হয়, একটু পথ রিকশায়, অনেকটুকু পথ বাসে, কিছু পথ সিএনজিতে। যাত্রাপথে যতবার চোখ খুলেছে, ততবার দেখেছে একটি গোরস্থান বাসের সঙ্গে দৌঁড়ে চলছে। পুরো পৃথিবীটাই যেন গোরস্থান। এমনকি এই বাসে করে রঞ্জুর যাত্রাও সেখানে। রঞ্জু ভাবে, এখনো তার যাবার সময় হয় নি। এখন চলে গেলে তার সন্তান তাকে হারিয়ে ফেলবে ঠিক এভাবেই।

রঞ্জু নিজের বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপে।

নীলা দরজা খুলে দেয়। নিজের ঘরে ঢুকে নীলার কোলে মাথা রেখে, কাঁদতে কাঁদতে রঞ্জু বলে- আমার বাবা আর নেই নীলা। এত স্রোত, এত পানি, এত জল- বাবা কি ডুবে যাবে, নীলা? বাবা কি ডুবে গেছে?
---
প্রথম খসড়া


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

বাকরুদ্ধ, চোখে পানি -আর কিছু বলার নেই।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

এক লহমা এর ছবি

চলুক
লেখা ভাল ভাবে এগিয়েছে। কোথাও কোথাও গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে। যেমন, যখন লিখেছেন - "মাটি দে, রঞ্জু।"
শেষ প্যারাগ্রাফ-টি আরো ছোট করতে পারলে আমার কাছে গল্পের অভিঘাত আরো বেশী হত। কম কথা কিন্তু অনেক সময় বেশী তীব্রতা সৃষ্টি করে।
পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

মাঝে মাঝে অতিরিক্ত কথা বলার লোভ সামলাতে পারি না। আপনার মতামত মাথা পেতে নিলাম। যেহেতু এটা প্রথম খসড়া, তাই পরেও মাথায় থাকবে। আপাতত দু'টি লাইন বাদ দিলাম।

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

এক লহমা এর ছবি

হাসি চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এক লহমা এর ছবি

ভুল জায়গায় বসিয়েছিলাম। ঘ্যাচাং।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

কী চুড়ান্ত অবহেলায় কোটি টাকার স্নেহ বিলিয়ে দেয়া যায়! - ছুঁয়ে গেলো কথাগুলো।

আমার কাছে আগাগোড়াই ভালো লাগলো - ছিমছাম, নিটোল গল্প বলে যাওয়া।

একটা টাইপো ছিল - কাঁদা ->কাদা

____________________________

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

ধন্যবাদ।

ঠিক করে নিব

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

সুবোধ অবোধ এর ছবি
মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

মন খারাপ

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

তাহসিন রেজা এর ছবি

অপূর্ব ।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

হাসি মন খারাপ

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

তোমার গল্পে অনেক ধার আছে, ভাই!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

দুঃখিত, আগে খেয়াল করি নি হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।