নিরুদ্দেশায়িত পথে গল্প শিকারীর স্ট্যাচু

কারুবাসনা এর ছবি
লিখেছেন কারুবাসনা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০৩/২০০৯ - ১:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গল্পেরা
পড়ন্ত নভেম্বরের কোন এক শীতে ঘামি, মাইকের ঘোষনা মেশে অন্য মাইকে, চন্দননগর জুড়ে জগদ্ধাত্রী পুজো। কত লোক হারিয়ে যায়। বিশেষত ছোট ছোট বাচ্চারা। পুকুর পারে আলোর ভেল্কিতে সুকুমার রায় আর বেন লাদেন। আর কচি মুখগুলি থেকে উড়ে যাওয়া সিগারেটের ধোঁয়া তখনও শোনেনি মিশেল ফুকোর কথা। আর আমি কয়দিন ধরে ক্রমাগত ভাবছি আমার যে গল্পগুলো হারিয়ে গেল তাদের কথা। হালকা চেহারা ভাসে। কেমন খাতাটা দেখতে ছিল, এক ঝলক দেখতেও পাই যেন।

অথচ কলকাতার বাসায় এমন অনেক গল্পই পাওয়া যাবে যেগুলো মাত্র এক-কি দু পাতামাত্র লেখা। তারা হারায়নি, হারিয়েছে গোটা গল্পেরা। দিল্লী থেকে যখন এলাম, তখন ভাবটা ছিল এই তো ফিরে এলাম বলে, কিন্তু আর এলাম না, রাগে অভিমানে। হলুদের মলাটের খাতায় যতদুর মনে পড়ে পাঁচটা গল্প ছিল। জীনানান্দের বিড়াল আর ইলিশের ব্রতকথার কথা মনে পড়ছে, বাকি গুলো মনে নেই, কিম্বা মনে পড়বে কিছুদিন পর। এখন তো ক্রমাগত সেগুলোই ভাবছি, কি দুর্ভোগ।

একটা গল্প কি দুইবার লেখা যায়? আমি পারিনি। উত্তরমানুষ গল্পটা তো আবার লেখার ছিল। তাই হলো না। পত্রিকায় বেরোনোর পরও মনে হয়েছিল, যাঃ এটা আবার কি? গল্পটাই তো লেখা হয়নি। রক্তের ছিটে বা ধর্মের কল বাতাসে নড়ে লিখে তো বহুদিন ফেলেই রেখে দিয়েছিলাম। নিউজপ্রিন্ট দেখলাম আস্তে আস্তে লাল হয়ে গেল। ২০০০ সালের গোড়ার দিকের গল্প গুলো ভেতর সিস্টেমান্তর কেবল বেঁচে। অথচ ছেঁড়া চার টুকরো পাতায় লেখা হয়েছিল গল্পটা। কি করে যে বেঁচে গেল! তখন রাত্রি ছিল ভয়ানক মাতাল। বেশিরভাগ দিন রাত দুইটা-তিনটার দিকে যেতাম দীপকের বাসায়। আর লেক গার্ডেন্সের বাসায় কখন বৃষ্টি নামত টেরই পেতাম না। সকালে দেখতাম হ্য়ত পানীর ট্যাঙ্কের ওপর শুয়ে। আর পানীর ভেতরে গিয়ে পড়েছে আঁড় টানা সাদা পাতারা। হ্যাঁ , এই রকম বেশ কয়েকবার ঘটেছে। কাফকা হলে বলতেন, আমি গল্পগুলো লিখছিলাম ঐরকম ভাবেই।

মোবাইলজীবি আর টিনিয়াসোলিয়ামের স্বপ্ন লেখা হয়েছিল এমনই কোন মাতাল রাত্রে। কিন্তু একনিঃস্বাসে যদি লেখা হবে তবে এতবার কালি বদল কেন? ছেড়া-খোঁড়া সেই খাতা আমি গত বছরেও দেখেছি। খুব অদ্ভূত ভাবে এই দুটো বোধ হয় আজও কোথাও ছাপা হয়নি। সিস্টামান্তরের পার এই দুটি গল্পই আমি সবচেয়ে বেশিবার জনসমক্ষে পাঠ করেছি, ছাপাতে দিইনি কেন কে জানে, মনে পড়ছে না।

পুনেতে থাকতে লেখা দুটো গল্পের কথা মনে পড়ছে খাতাটাও ভেসে উঠল আচমকা। কষৃক বিদ্রোহ নিয়ে লেখা মিউজিক ভিডিও আর প্রোবাবিলিটির উপর লেখা পরীক্ষিতের উপপাদ্য সেসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত ছাত্রদের মধ্যে। এই দুই গল্পের মধ্যে মজার মিল আছে। দুই সম্পাদক এই গল্প দুটি চেয়ে নিয়ে প্রকাশ করতে পারেন নি। একজনের পত্রিকা উঠে যায়, দ্বিতীয় জনের সাথে আমার আর জীবনে দেখা হয়নি, তিনি ডাক যোগে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, গল্পটি ছাপতে অপারগ বলে। গল্প দুটি খুবই জটিল ভাষায় লেখা। প্রথমটিতে রাজনৈতিক দর্শন ছিল প্রবল, যাতে পরবর্তীকালে আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। অন্যগল্পটিতে ইরিডপের কতগুলো জটিল অঙ্কের সমাধান ছিল। শুধু এই গল্পের জন্যেই আমি সম্পূর্ণ এক বোতল মদ উপহার পেয়েছিলাম। বলা যায় গল্প লিখে প্রথম রোজগার। এই গল্প দুটিও অপ্রকাশিত আছে।

২০০৩ সালে বাংলাদেশে বসে গোলাপের আ্যনাটমি বলে একটি গল্প লিখি। যেটি হারায় সম্ভবত দিল্লীতে। একটা বাঁধানো খাতায় উল্টো করে গল্পটা লেখা ছিল। ওই খাতাতেই লেখা ছিল গ-ল-প, যা ছাপা হওয়ায় এ যাত্রা প্রাণে বেঁচেছে। এই সময় থেকে ঐশ্বর্য রাই পাকাপাকি গল্পের চরিত্র হয়ে উঠতে থাকে, আর অঙ্ক হয়ে উঠটে থাকে গল্পের বিষয়, তার ওপর জাস্ট কিছু ইমেজ চাপিয়ে দিলেই হল। ইউক্লিডকে ছিঁড়ে ফেলা হল জীবনানন্দের বিড়ালে। গ্রাফ থিয়োরি নিয়ে লেখা হয়ে গেল একটা গল্প কালো দেওয়াল সাদা বিড়াল। এখন খুব মন খারাপ লাগছে গল্প দুটোর জন্য। বেশ কিছুক্ষণ টাইপিং বন্ধ করে বসে রইলাম। অথচ আমার দিল্লী প্রবাসের শেষদিকে বিধ্বস্ত সময়ে উত্তরকাশী ও হরিদ্বারে বসে পতনের শব্দ বলে একটা বড় লেখার খসড়া করি সেটা ভাল তবিয়তে বেঁচে। এমন কি এই দীর্ঘ সফরেও আমার সাথে আছে। কী যে ঘটে কিচ্ছু টের পাই না।

মন খুব ভার হয়ে গেল। যেন এক কবরস্থানে দাঁড়িয়ে আমি। সূর্য ঢলে পড়ছে। ডিমের কুসুমের ভতর থেকে কতগুলো পাখি উড়তে উড়তে আকাশে মিশে যাচ্ছে। আকাশ নিউজপ্রিন্টের মত ফ্যাকফ্যাক করছে। আমার লেখা সব মুছে যাচ্ছে, পুকুরে যে ছায়া দেখছিলাম সেটাও ঢেকে গেলে সবুজ কচি পানায়। নিরুদ্দেশের ঘোষণাও নিরুদ্দেশে যায়, সিলেট রেলষ্টেশনে পাখিরা ঘোষণা করছে কে কে হারাল এইবারের শীতে।


মন্তব্য

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

নিরুদ্দেশের ঘোষনাও নিরুদ্দেশে যায়, সিলেট রেলষ্টেশনে পাখিরা ঘোষনা করছে কে কে হারাল এইবারের শীতে।

আগেও টপিকান্তরে আপনার গল্প-হারানোর টুকরো-গল্পে মন-ভার হয়েছিল সুমেরুদা'। আজ আবার এই সবিস্তারে নীরব হয়ে গ্যালো মনের ভেতরবাড়ি! শোক হচ্ছে রীতিমতো। অ(ল্প)চেনা আমিও যেন কবরস্থানটায় দাঁড়িয়ে গেলাম আপনার সাথে। অনেক ক্ষুদ্রতর এই অপাংক্তেয় লেখক-জীবনে আমিও ছোট একটা-দু'টো হারিয়েছিলাম গল্প, সেইটেই আজো দীর্ঘ-হুহু হয়ে ওঠে মনে হ'লেই। আর, আপনার তো এতগুলো বিচিত্র গল্পের অন্তর্ধান! জানি এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। কতোগুলো শব্দ-বাক্য-ভাবনা-ক্রীড়া-চর্চা-উপনয়ন-অপনয়ন... কতোগুলো কতো কী ... ! মন খারাপ
ইশ্, এইভাবে হারায় বলে এমন ঐশ্বর্য (রাই না!)?! মন খারাপ

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লেখা হারানোতে আপনি তো দেখছি ওস্তাদ মানুষ! গত বৎসর আমি হারিয়েছি ল্যু সূনের চারটি গল্পের অনুবাদ। আসলে কবে হারিয়েছি ঠিক বলতে পারব না, গত বৎসর হঠাৎ খুঁজতে গিয়ে দেখি উনারা গায়েব। অথচ ছাত্রজীবনে লেখা পাঠের অযোগ্য প্রেমের গল্প ঠিকই রয়ে গেছে। ঠিকই বলেছেন, একটা গল্প দ্বিতীয় বার আর কখনোই লেখা সম্ভব হয় না। হয়তো অন্য গল্প হয়ে যায়, কিন্তু সেই গল্পটা আর কখনো হয়ে ওঠে না।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

শোক অনুভব করছি। এসব ক্ষেত্রে সান্ত্বনার কোনো ভাষা আমার জানা নেই। কী বলব তাই-ই বুঝে উঠতে পারছি না।

কারুবাসনা এর ছবি

শনিবার তাহলে আইসেন।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

অনীক আন্দালিব এর ছবি

নিরুদ্দেশের ঘোষণাও নিরুদ্দেশে যায়

বড়ো সত্য অবলীলায় বলে দিলেন! ....
===
অনীক আন্দালিব
http://www.jochhonabilashi.blogspot.com

কারুবাসনা এর ছবি

সত্য এমনই হয়। তার লীলা কম।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

মধ্যসমুদ্রের কোলে এর ছবি

নিরুদ্দেশের ঘোষণাও নিরুদ্দেশে যায়, সিলেট রেলষ্টেশনে পাখিরা ঘোষণা করছে কে কে হারাল এইবারের শীতে।
=====ভালো লাগা জানাচ্ছি।
অভিযোজিত সময়ে হারানো খেরোখাতা গুলোর গল্প

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।