১৯৭৫ এ আমার প্রথম বই গ্রিমাস বেরুলো। তা থেকে কামানো সাতশো পাউণ্ড দিয়ে যত কম খরচে আর যদ্দিন পারি ভারত ঘুরে দেখবার একটা পরিকল্পনা করলাম। সেই ১৫ ঘন্টা বাস ভ্রমণ আর গরিবি কেতার হোস্টেল বাসের ভেতরই মিডনাইটস চিল্ডরেন এর জন্ম। এটি সেই বছর যখন ভারত আত্মপ্রকাশ করলো পরমাণু পরাশক্তি হিসেবে, মার্গারেট থ্যাচার কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব পেলেন আর বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিব খুন হলেন; স্টুটগার্টে বাদের মেইনহফ গ্যাংয়ের বিচার শুরু হলো, বিল ক্লিনটন বিয়ে করলেন হিলারী রডহ্যামকে, সায়গন থেকে শেষ আ্যমেরিকানটিকে বের করে দেওয়া হলো আর মারা গেলেন জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো। কম্বোডিয়াতে খেমার রুজের সেটি ছিলো রক্তাক্ত ইয়ার জিরো। ই এল ডক্টরো এ বছরই প্রকাশ করেন "ragtime", ডেভিড ম্যামেট আ্যমেরিকান বাফেলো লেখেন, আর ইউজিনো মন্টেল নোবেল পান। আমি ভারত থেকে ফেরবার পরপরই ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচন কারচুপির দায়ে অভিযুক্ত হন এবং আমার আঠাশতম জন্মদিনের ঠিক সাতদিন পর জরুরি অবস্থার ঘোষণা দিয়ে স্বৈরাচারী ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন। এটি ছিলো দীর্ঘমেয়াদী এক অন্ধকার সময়ের শুরু যেটি ১৯৭৭ অবধি শেষ হয়নি। আমি বুঝতে পারলাম, কোন একভাবে শ্রীমতী গান্ধী আমার হলেও-হতে -পারে লেখালেখির মূল ভাবনায় জড়িয়ে গেছেন।
বেশ অনেকদিন যাবত শৈশব নিয়ে আমার কিছু লেখার ইচ্ছে ছিলো, বম্বেতে আমার নিজের ছোটবেলার স্মৃতি থেকে উদ্ভূত ঘটনাগুলো নিয়েও। এখন, ভারতের কূয়োয় আকণ্ঠ পানান্তে, পরিকল্পনায় আরেকটু উচ্চাভিলাষী হলাম। স্মরণ করলাম ভারত স্বাধীন হবার মধ্যরাত্রির সন্ধিঃক্ষণে জন্মানো, আমার এক পরিত্যাক্ত খসড়ার অপ্রকাশিত বই "দ্য আ্যন্টাগনিস্ট" এর একটা ছোট চরিত্র সেলিম সিনাই এর কথা, যে বহুবার আমার কল্পনায় কড়া নেড়ে গেছে।
সেলিমকে নিয়ে পরিকল্পনার শুরুতে বুঝতে পারলাম ওর জন্মের সময়টা এমনই যে লেখার পটভূমিকে আরও বিস্তৃত করতে বাধ্য হবো। ওকে আর ভারতকে যদি জোড় বাঁধতে হয় তো দুই যমজের গল্পই বলতে হবে। তখন আমার মাথার ভেতরে সদা-মানে-খুঁজতে-থাকা সেলিম যেন কথা বলে উঠলো: আধুনিক ভারতের ইতিহাস যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তার পুরোটাই ওর কারণে; ওর জাতি-যমজের সেই পালাবদল, যে কোনোভাবে হোক, পুরোটাই ওর দোষে! সেইটেকে মাথায় রেখে বইটা কথকের [সেলিমের] ভাষ্যে বর্ণিত, বর্ণনাশৈলী ওর মতই - কখনও রসিকতাচ্ছলে জোর খাটিয়ে কখনওবা যারপরনাই বকবকানির মতো বলা, আবার আমার ভেতরে ওর করুণ পরিণতির জন্য একটা কেমন সহানুভূতির বিস্তার, এ সব কিছু মিলিয়েই এর জন্ম।এর ওপর আমি আবার ছেলেটি আর দেশটিকে আইডেন্টিক্যাল টুইনস বানিয়ে দিলাম। ভূগোল শিক্ষক এমিল যাগালো যখন মানবদেহের ভৌগলিক বিবরণ দিতে গিয়ে সেলিমের নাককে দাক্ষিণাত্যের উপদ্বীপের সাথে তুলনা করে নির্মম রসিকতা করে, সে নিষ্ঠুরতাটুকুও অত্যাবশ্যকীয়ভাবে আমারই নিষ্ঠুরতা।
পরিকল্পনা মাফিক এগোতে গিয়ে অনেকগুলো সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। সিংহভাগই লেখালেখি জনিত, কিন্তু কোনো কোনোটা ছিলো রূঢ় বাস্তব । ভারতফেরতা আমি ছিলাম কপর্দকহীন নিঃস্ব। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকা বইটা হবে লম্বা, খানিকটা অদ্ভুতও, এবং লিখতে অনেক সময় নেবে - এদিকে আমার পকেটে ফুটো কানাকড়িও নেই! অতএব অনেকটা বাধ্য হয়েই আমার বিজ্ঞাপন জগতে প্রত্যাবর্তন। যাবার আগে বছরখানিক ওগিলভি আ্যণ্ড মাথের এজেন্সীর লণ্ডন অফিসে কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেছিলাম, যার প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড ওগিলভির অবিস্মরণীয় উক্তি "দ্য কনজুমার ইজ নট আ মোরন, শি ইজ ইয়োর ওয়াইফ" মাথায় গেঁথে নিতে হয়েছিলো। এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর (এবং আমার বস) ছিলেন ড্যান এলেরিংটন। কানাঘুষোয় শোনা ওঁর পূর্বপুরুষ রোমানিয়া থেকে এসেছিলো। তাঁর ইংরেজি, উফ্!! এক কথায় বলা যেতে পারে পাগলাটে। অফিসের কিংবদন্তীসম রসিকতা গুলোর একটা ছিলো যখন একবার বিখ্যাত " Drinka pinta Milka day" এর উত্তরসূরী ক্যাম্পেইন হিসেবে উদ্ভট এবং অতি অবশ্যই রোমানিয়ান স্লোগান " Milk goes down like a dose of salts" মিল্ক মার্কেটিং বোর্ডের কাছে পেশ করা থেকে ওঁকে রীতিমতো জবরদস্তি করে নিরস্ত করতে হয়েছিলো !
তখনও ওগিলভি এতটা নাক উঁচু হয়নি, ওরা কিছু আলটপকা কিন্তু স্মার্ট লোককে খণ্ডকালীন ক্রিয়েটিভ রাইটারের চাকরি দিতে রাজি ছিলো। এই সুযোগে আমিও দিব্যি খোসামুদি করতে লাগলাম, ফলাফলে "হাসছি মোরা আহ্লাদী" দলের একজন হিসেবে আমার পুনঃ নিয়োগ। সপ্তাহে দু'তিনদিন কাজ করতাম আরেক খণ্ডকালীনের সাথে ভাগেজোগে, জোনাথন গ্যাথর্ন হার্ডি- দ্য রাইজ আ্যণ্ড দ্য ফল অফ ব্রিটিশ ন্যানি’র লেখক। এজেন্সী অফিস ওয়াটারলু ব্রিজ থেকে শুক্রবার রাতে ফিরতাম কেন্টিশ টাউনের বাড়িতে, লম্বা গরম একটা চান করতাম, সারা সপ্তাহের জঞ্জাল সরিয়ে- জন্মাতাম (অন্ততঃ তখন নিজেকে তো তাই বোঝাতাম ), লেখক হিসেবে।
এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই, আমার যৌবনের "আমি" কে দেখে কেমন যেন একটা গর্ব হয়। সাহিত্যের প্রতি এই নিষ্ঠা যাকে শক্তি জুগিয়েছিলো লেখক হবার শপথ নেবার, শত প্রলোভনের তোষামোদি সত্ত্বেও। বিজ্ঞাপন জগতের সুললিত আর সম্মোহনী ক্ষমতার হাতছানি ছিলো ঠিকই , কিন্তু আমি ভাবতাম ওডিসিউসের কথা, জাহাজের মাস্তুলে তার আছড়ে পড়া, তারপরও দিগ্ভ্রষ্ট না হওয়ার কথা।
**[চলবে]
***[মিডনাইট'স চিল্ডরেন উপন্যাসটি লেখা শুরু হয় ১৯৭৫ এ, তার প্রায় ত্রিশ বছর পর ২০০৫ এ লন্ডনে বসে রুশদী লেখেন এর মুখবন্ধ, যেটি মূল উপন্যাসের মতই চমকপ্রদ,চিত্রকল্পময় আর কৌতূহলোদ্দীপক।১৯৮১ তে বুকার পাবার পর নজরে এলেও বইটি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে ১৯৯৩ ও ২০০৮ এ "বুকার অফ বুকার" বা অলটাইম গ্রেট বুকার হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই। টাইম ম্যাগাজিনও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০টি বইয়ের তালিকায় এই উপন্যাসকে রেখেছে। প্রিয় উপন্যাসটি আবার পড়া শুরু করেছি অনেকদিন পর, দেখলাম গল্প লিখবার গল্পটিও কম চমৎকার নয়। এই ভেবেই প্রস্তাবনাটুকুর অনুবাদের চেষ্টা, রুশদীতে দাঁত ফোটানোর দু:সাহসের মূল্য অনেক বেশী তা জেনেও। ]***
১৯শে মে ২০০৯, মঙ্গলবার: রাত ৩.২৫ মিনিট
মন্তব্য
আপনাকে ধন্যবাদ জরুরী পোস্টটার জন্য । আপনার ঝরঝরে ভাষান্তরের সুবিধা নিয়েই এতো দ্রুত পড়া গেলো ভুমিকাটুকু । পেছনের গল্পও কখনো অনেক মুল্য রাখে ।
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
"বুকার অফ বুকার" স্বীকৃতির ঠিক আছে।
তার গল্প বলার ঢংই অসাধারণ। এক টানে কোথায় যে নিয়ে গেলো...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
পড়তে হবে তো! অনুবাদ ভাল লাগলো - যদিও আরো ভাল করার পরিসর আছে!
তুমি বলছো? আছে? বেশ, তবে :)। অনেক ধন্যবাদ সিরাত।
হা গণেশ
শেষ লাইনের দিকে আসার আগে আমি তো ভাবছিলাম এটা আপনারই আত্মজীবনী
চিমটি@ লীলেন ভাই।
লেখাটি ভালো লাগলো। অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
আপনারা কি আমাকে হাড় হাভাতে বুড়ো না বনিয়ে ছাড়বেন না? ১৯৭৫ এ আমি জন্মাইইনি- লেখা টেখা দূরে থাক্ !
অনেকদিন পর! বাকিটা তাড়াতাড়ি ....
খুব চমতকার কাজ
চলুক
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
বাহ। গল্পের পেছনের গল্প কি চমৎকার গল্পময়।
অনুবাদ দারুন সহজাত। একটু ও ক্লেশ নেই।
বাকীটুকুর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। অপেক্ষা যেনো দীর্ঘতর না হয়।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
পড়লাম...
আর এমন নির্মেদ অনুবাদের জন্য প্রচুর ঈর্ষা করলাম...
জলদি আসুক পরের পর্বগুলি
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
অনুবাদ খুব ভালো লাগলো।
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...
পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় রইলাম।
শাহিদুর রহমান শাহিদ
খুব ভালো লাগলো আপনার অনুবাদ। শেষ করুন তারাতারি।
আগ্রহ নিয়ে বসে রইলাম।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
এমন ঝরঝরে অনুবাদ,এমন তরতর করে কতদিন পড়িনি।
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
রুশদী তাহলে ওগিলভি মামার ওখানে কাজ করতেন!
সসঙ্কোচে জানাই অতীব সল্পমেয়াদে ওই মাতুলবাটীস্থ এই অধমও ছিলো, ইশ্ যদি আর দশ বিশটা বছর আগে জন্মাতাম তো নির্ঘাত নোবেল না হোক বুকার টুকার অন্ততঃ -- কি সব বাঘা বাঘা লোকজন কাজ করতো রে!
জীবন্ত অনুবাদ হয়েছে।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
সকলকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ উৎসাহ ও উদ্দীপনার জন্য। আপনাদের উৎসাহ অনেক মনে জোর দেয়, ভালো লাগে, সত্যি সত্যি লাগে। আমি লিখতে চেষ্টা করছি বাকিটা, কিন্তু রুশদীর মতো বৈচিত্র্যময় লেখকের সাথে তাল মেলানো টা বড় একটা চ্যালেঞ্জ, দেখি কি করা যায়। তবে যেহেতু চা কফি পানের অভ্যাস নেই, সুতরাং --- ------- ----
দারুণ অনুবাদ। অপেক্ষায় আছি পরের অংশের জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন