(এ অংশে রইলো বইটার নামকরণের কথা আর চরিত্রগুলো কোত্থেকে আর কিভাবে এলো সেই গল্প )
তবে বলতেই হবে,বিজ্ঞাপন আমায় নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছে,আর শিখতে বাধ্য করেছে আলসেমি ছুঁড়ে ফেলে আরব্ধ কজের জন্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে। সেদিন থেকে নিজেকে অন্যান্য সব (মানে,প্রায় সব) রকমের শৈল্পিক বিনোদন থেকে আত্মবঞ্চিত করে আমার লেখালেখিকে স্রেফ একটা কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছি,যা করতেই হবে। মনে পড়ছে ওগিলভিতে আমার কাজের ডেস্কে বসে আমার উদ্বেগের কথা কেননা আমি জানতাম না আমার নতুন বইটার নাম কি হবে! এ সমস্যা সমাধানে তখনকার জরুরী ক্যাম্পেইন ফ্রেশ ক্রীম কেক ( Naughty but Nice),আ্যইরো চকোলেট বার (Irresistibubble) এবং দ্য ডেইলি মিরর সংবাদপত্রের ( Look into the Mirror tomorrow- you'll like what you see ) কাজ থেকে আমি বহু ঘণ্টা দূরে থেকেছি। একদম শেষে আমার হাতে দু'টো শিরোনাম ছিলো এবং আমি সে দু'টোর মধ্যে থেকে কোন্ টাকে বেছে নেবো ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না ! "মিডনাইট'স চিল্ডরেন এবং "চিল্ডরেন অফ মিডনাইট" এই নাম দু'টো আমি টাইপ করতাম, বারবার, পরপর, একবার মুছে, তারপর আবার! একবার পুরো পৃষ্ঠা ছিঁড়তাম, তারপর আবারও সেই একই কাজ! এরকম করতে করতে একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতো হঠাৎ আমার উপলব্ধি হলো এটা কোনো প্রতিযোগিতা নয়, চিল্ডরেন অফ মিডনাইট অত্যন্ত একঘেঁয়ে কিন্তু মিডনাইট'স চিল্ডরেন সুন্দর একটা নাম! শিরোনামটাকে জানা মানে বইটাকে আরো একটু ভালো করে বুঝতে পারা। এর পরে বইটা লেখা সহজ,মানে একটু সহজ হয়ে গেলো।
অন্য জায়গায় আমি বলেছি ভারতে মুখে মুখে গল্প বলার যে সংস্কৃতি তার কাছে আমার ঋণের কথা, সেইসব মহৎ ভারতীয় সাহিত্যিকদের কথা, জেন অস্টিন আর চার্লস ডিকেন্স এর কথাও- অস্টিনের প্রতি ঋণ সমাজের বেড়াজালে আটকে পড়া সেইসব মেধাবী রমণীদের চরিত্রচিত্রণের জন্য যাদের "ভারতীয় সংস্করণ"দের আমি চিনি, ডিকেন্সের কাছে ঋণী আমি তাঁর বিশাল বম্বে-সম পচাগলা শহরের বর্ণনা আর অসাধারণ নৈপুণ্যে অতিমানবীয় চরিত্র আর পরাবাস্তব চিত্রকল্পগুলোকে একটা "প্রায়-অসম্ভব" পটভূমিতে গ্রথিত করতে পারার ক্ষমতার জন্য। সেখান থেকে তাঁর কৌতুকময় আর অসাধারণ উপাদানগুলো যেন আপনাআপনি বেড়ে ওঠে,বাস্তবের দুনিয়া থেকে পলায়ন নয়, বরং সেগুলো যেন বাস্তবতার পুঞ্জীভূত বহিঃপ্রকাশ। আমি সম্ভবতঃ এও অনেকবার বলেছি যে, আমার আগ্রহ ছিলো একটা সাহিত্যিক উপভাষা তৈরী করবার যেটি ভারতীয় ভাষার ছন্দ ও চিন্তাসূত্রকে সুন্দর করে মেশাবে নিম্নবর্গীয় "হিংলিশ"(Hindi +English= Hinglish) বা "বোম্বাইয়া" (Bambaiyya)র সাথে। বইটার স্মৃতি-বিকৃতি আর স্মৃতিময়তা থেকে বারবার ছিটকে পড়ার প্রতি আগ্রহও পাঠকের কাছে খুব স্পষ্টভাবে ধরা দেবে বলে আমার বিশ্বাস ছিলো। এইবেলা অবশ্য সেসব সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষগুলোকে ধন্যবাদ দেবার একটা উপযুক্ত সময় যাদের থেকে আমার চরিত্ররা ডালপালা মেলে বিস্তার লাভ করেছে- আমার পরিবার, আমার আয়া মিজ্ ম্যারি মেনযিস এবং আমার ছেলেবেলার বন্ধুরা।
আমার বাবা "আহমেদ সিনাই" এর চরিত্রটা নিয়ে এতোটাই ক্ষেপেছিলেন যে আমার সাথে বাক্য-বিনিময় পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর উনি আমায় "ক্ষমা" করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে আবার আমি এত ক্ষেপে উঠলাম যে এবার আমিই কথা বন্ধ করে দিলাম বহু মাসের জন্য। আমি বরং বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম মায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু খুব শিগগিরই তিনি বুঝতে পারলেন যে,"এটা শুধু একটা বই, তুই সেলিম নোস, আমি আমিনা নই, এরা শুধুই কতগুলো চরিত্র।" দেখলাম, প্রয়োজনের সময় কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইংরেজী শিক্ষা বাবার যতটা না কাজে লেগেছিলো, মাথা ঠাণ্ডা রাখার শিক্ষা মা'র কাজে লাগলো অনেক বেশি! বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে আমি চরিত্রগুলোকে যেমন করে গড়েছি তা নিয়ে বোন সামিনও ( যাকে ছেলেবেলায় "গেছো বাঁদর" বলে ডাকতাম )খুশি ছিলো, যদিও এই মালমশলার বেশ কিছুটা ছিলো তার নিজস্ব।
ছেলেবেলার বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই, স্কুলের বন্ধু আরিফ তায়্যিবালি, দারাব, ফাডলি তালইয়রাখান, কিথ ষ্টিভেনসন আর পারসি কারানজিয়া সবাইকে আমি অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার চরিত্র সনি ইব্রাহীম, আইস্লাইস, হেয়ার অয়েল, ফ্যাট পারসি আর গ্ল্যান্ডি কিথের চরিত্র চিত্রণে তাদের নিজেদের একটা অংশ ( যদিও সবসময় শ্রেষ্ঠ অংশটুকু নয় )দান করবার জন্য। ইভি বার্নস চরিত্রটার জন্ম হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে বেভারলি বার্নসের থেকে, এই সেই মেয়ে যাকে আমি প্রথম চুমু খেয়েছিলাম, সত্যিকারের বেভারলি অবশ্য বাইসাইকেল-নন্দিনী ছিলোনা কখনই, আর অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবার পর ওর সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চ্যাম্পিয়ন ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারু মাশা মিয়োভিচ কিছুটা বাস্তবের আ্যলেঙ্কা মিয়োভিচের আদলে গড়া, কিন্তু ক'বছর আগে সার্বিয়া থেকে আ্যলেঙ্কার বাবার লেখা একটা চিঠি পাই মিডনাইটস চিল্ডরেন এর ব্যাপারে যাতে তিনি সসঙ্কোচে জানিয়েছেন ছোটবেলায় বম্বেতে আমার সাথে পরিচিত হবার কথা তাঁর মেয়ের নাকি বিন্দুমাত্র মনে নেই। সুতরাং এটি বাদ। যাচ্ঞাপিয়াসী আর যাচিতের বিচ্ছেদের সুর বাজাতেই হলো।
আর বাকি রইলো মেরি মেনযেস, আমার দ্বিতীয় জননী, যে আসলে কোনদিনও বিপ্লবী নার্সিংহোম কর্মচারীকে ভালোবাসেনি বা জন্মমুহূর্তে কোনো বাচ্চাকে বদলে দেয়নি,শতবর্ষী জীবন পেয়েও যে আমৃত্যু কুমারী ছিলো আর আমাকে তাঁর ছেলে বলে ডাকতো; সাত আটটি ভাষায় কথা বলার দক্ষতা থাকলেও সে ছিলো নিরক্ষর। তাই সে বইটা পড়তে পারেনি। কিন্তু ১৯৮২ র এক বিকেলে বম্বেতে বসে আমায় জানিয়েছিলো কি ভীষণ খুশি সে এর সাফল্যে! ওঁর চরিত্রটা নিয়ে আমি যা করেছি তাতে যদি ওঁর কোনো আপত্তি থাকতো,ও এ কথা বলতো না।
**(চলবে)
২৬শে মে, মঙ্গলবার: দুপুর ১টা ৩৫মি
মন্তব্য
খুব ভালো হচ্ছে।
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ বি।র আর সু।পা।শি
দেখা যাক্ আর কদ্দুর এগোনোর ইচ্ছে থাকে, আসলে রুশদী পড়া যতটা সম্মোহনের অনুবাদ করা ততটাই নিদারুণ।
কৃতজ্ঞতা ।
সালমান রুশদীর নাম শুরু ইংরেজি এস দিয়ে আর এই অনুবাদকের নাম ডবল এস
দুইটার মধ্যে সম্পর্কটা কী?
লালমোহন গাঙ্গুলী আর সৌরভ গাঙ্গুলীর মধ্যে যে রকম সম্পর্ক, ঠিক সেরকম !
ভালো লাগলো গল্পের গল্প। চলুক।
তবে সবচেয়ে মজা পেলাম আপনি অ্যাডভার্টাইজিংয়ের মানুষ জেনে। তাও আবার ওগিলভি!
__________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!
___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি
আমি এখন একেবারেই রসকষহীন অংক আর সংখ্যার মানুষ। এখানে ছাত্রাবস্থায় স্বল্পসময়ের ওটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয় কিন্তু খুব মজার তো বটেই,পারলে রুশদীর কিছু কাজ দেখবেন, লোকটা সত্যিই ক্রিয়েটিভ, জাদু বাস্তবতার গল্প ও জন্যেই এত ভালো লেখে।
অনুবাদটা পড়তে বেশ ভালো হচ্ছে।
আমার প্রথম বই 'টমবয় নিশো ও তার বন্ধুরা'
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
আপনার বই ? টমবয় নিশো? ভাই পড়িনি তো, নিশ্চয়ই একসময় পড়বো। ভালো থাকবেন
আপনে তো দেখি কঠিন জিনিষ, ৩ বার পড়তে হইল, এরকম লেখা আগে পড়ি নাই, আপনার বাকি লেখা গুলাও পড়ে ফেলব আশাকরি খুব শীঘ্রি। অনাধারন আপনার লেখা।
সাইফ
আরেহ্ সাইফ আমি তো আপ্লুত আপনার মন্তব্য পড়ে :)। তবে , আমি সত্যিই কঠিন জিনিস, তাই "জিনিষ" বানানটা ভুল ধরে এক পয়েন্ট কামাইলাম
ভালো থাকবেন, বেশি বেশি পড়বেন, যে কারো লেখাই। পড়া খুব ভালো জিনিস।
আমি এমনিতেই নেগেটিভের ঘরে যাত্রা শুর করেছি, হা হা হা, বড়ই মজা পাইলাম আপনার জবাব পড়ে, ভাবতেছি, আরো কটা পয়েন্ট দিব কিনা আপনাকে? হা হা হা, এরকম লেখা পড়ার পর কারো কি আর বানান জ্ঞান থাকে? পয়েন্ট যোগাঢ় করা যদি আপনার উদ্দেশ্য হ্য়, তবে এইভাবে আপনাকে সাপ্লাই দিতে দ্বিধা করব না। কয়টা দিলাম, তাড়াতাড়ি গুনে ফেলেন, অন্য কেউ নিয়ে নেয়ার আগে, হে হে হে।
সাইফ
আয়-হায় হায়, এইটা কি করলেন, আমি "যোগাঢ়" করতে করতেই লাঠি নিয়ে একেবারে বাবামা স্যারকে নিয়ে তেড়ে আসলেন??? নিচে দ্যাখেন!! ( ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি - র আইকন কেমনে দেয়?)
Ms. S-S,
আপনার অনুবাদটি পড়া হলো। বেশ। পরের কিস্তিগুলোও পড়ব। চালিয়ে যান। জটিল ও দীর্ঘ অনেক বাক্যে বেশ দক্ষতার সাথে দম রেখেছেন দেখা গেল, যেটা সবাই পারেন না। তবে বানান, ভাষা ও বিন্যাসগত দিক থেকে আরো পরিচ্ছন্নতা আপনার কাছ থেকে আশা করা যায় সম্ভবত।
আপনার লেখাটায় শিরোনামসহ শব্দসংখ্যা ৭৩৬টি। বানান, ভাষা ও বিন্যাসজনিত ছোটবড়ো সমস্যার পরিমাণ ৬৪টি। সমস্যার হার ৮.৬৯ শতাংশ। হারটা খুব ভয়ানক অবশ্য নয়। অনেকের লেখায় এ হার আরো বেশি।
বা(বানানকে)বা(বাগ)মা(মানান) প্রকল্পের পোস্টটিতে কয়েক মিনিট পরে বিস্তারিত দিয়ে দেবো।
..................................................................................
সত্যকথন-স্বভাব
যুদ্ধঘোষণার মতো একটা ব্যাপার প্রায় কথাসভ্যতায়
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
ওবামা, থুড়ি বাবামা স্যার, আপনাকে উত্তর দিয়েছি ওই পোস্টে।
এইটা আমার খুব প্রিয় বই৷ "শেম'ও বেশ ভাল লাগে, কিন্তু এইটা একেবারে যাচ্ছেতাই রকমের ভাল৷ এই বই পড়েই প্রথম জাদুবাস্তবতার কথা জেনেছিলাম৷ আহা সেই প্রথম পাঠের বিস্ময়!
অনুবাদ ভাল হচ্ছে সেঁজুতি৷ হইহই করে চালিয়ে যান৷
-----------------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
নতুন মন্তব্য করুন