অ্যাঞ্জেলা'স অ্যাশেস এর লেখক মারা গ্যাছেন। খবরটা শুনে আজ কেমন যেন একটা শূন্য অনুভূতি হলো ভেতরে। আমার কেবল ওই বাচ্চাটার ছবি চোখে বারবার ভেসে ওঠে আর খুব একটা মমতায় ভেতরটা ভরে যায়। ছবিটা দেখিনি, কিন্তু এই বইটা আমার জীবনে যে কী ভীষণ প্রভাব ফেলেছে, আমাকে মানুষ হিসেবে অনেকটাই অন্যরকম করে দিয়েছে, সেটা না বললেই নয়। বেঁচে থাকা যেহেতু অর্থহীন একটা রিচুয়ালে পরিণত হচ্ছে, মারা যাওয়াটাও সেরকম নৈর্ব্যাক্তিকভাবে দেখতে পারলে মন্দ হতোনা, কিন্তু কোনো একভাবে সেই নির্লিপ্তি এখনও অর্জন করে উঠতে পরিনি। সেটা ভালো কি খারাপ তা বিতর্কসাপেক্ষ, আমার পুরো বেঁচে থাকাটাই ভালো বা খারাপ এর তালিকায় ফেলে দিতে পারলে একরকম বেঁচে যেতাম, অথবা ওই বোধিপ্রাপ্ত নির্লিপ্তিও হয়তো কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ দিতো। তাই কয়েকটা মৃত্যুর সাথে আমার সংযোগ,আমার সংসর্গ আমাকে কিছুটা ভাবায়। হেনাদাস আন্টি মারা গ্যাছেন। ছোটবেলায় ঊর্মির আম্মা যখনই মহিলা পরিষদের মিটিংয়ে আসতেন ঊর্মির অবধারিত দ্বিতীয় ঠিকানা ছিলো আমাদের বাড়ি। আয়শা খানম আন্টির সাথেই হেনা আন্টিকে প্রথম দেখা। সত্যি বলতে কি, আমার প্রথম দর্শনে মহিলাকে ভালো লাগেনি। আরো অনেক কিছুর আগে হয়তো আমার যা ইন্সটিংক্ট, তাতে রুক্ষ, চশমা চোখের ওই নারীকে আমার আর সবক'টা "নারীবাদী"র মতোই ক্লিশে লাগতে শুরু করেছিলো। আরও একটা বিতৃষ্ণার কারণ বোধ করি ছিলো মহিলা পরিষদের উঁকিঝুঁকি মারা মিটিংগুলোতে একেবারেই মেয়েলি কুটনামি আর কূটকচালির একটা আধিক্য বা প্রাবল্য দেখতে পাওয়াটা। হেনা আন্টির সাথে প্রথম মিষ্টতার সূচক কিন্তু একটা ঝাল খাবার দিয়ে। মহিলা পরিষদের মেয়েরা, মানে আশ্রিত মেয়েরা ওখানে দারুণ সব সিঙ্গাড়া আর চপ আর পুরি তৈরি করতো। বারো কি তের বছরের বুদ্ধি ওদের দুর্দশায় কাতর হবার থেকে সিঙ্গাড়ার মৌ মৌ গন্ধে যে অনেক বেশি উদ্বেলিত হবে তাতে আর সন্দেহ কি! হেনা আন্টি এরকমই কোনো একটা মিটিংয়ে আমাকে সিঙ্গাড়ার আর তাঁরও ভক্ত বানিয়ে ফেলেন। তারপর ওখানে মেয়েদের দিয়ে জামা বানাতে দেয়া, ঊর্মি আর আমার পেয়ারা গাছে উঠে লাফানো--সব মনে আছে। আমি নেচেছিলাম একবার ওদের একটা বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে। আমার নাচ দেখে বোধ করি ডলি জহুর- তখন নাটক করতেন না কি' যেন- তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন এইসব দিন রাত্রি করে -- জোবার খাড়া নাক আর আমার সুন্দর চেহারা এই দুই নিয়ে অনেক মজার মজার ঠাট্টা করতে করতে হেনা আন্টি আবারও অনেক অনেক মিষ্টি আর সেই চপ না সিঙ্গাড়া কি যেন মুখে তুলে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের। এখনও মনে আছে। কি করে যেন মগজের ভেতর থেকে অনেক স্মৃতি টুক করে ইরেজার দিয়ে ঘষে কেউ মুছে ফেললেও এই আদরের টুকরো স্মৃতিগুলো এখনও রয়ে যায়। নির্লিপ্তি তাহলে কি শুধুই একটা দশা? তাও কিছুদিন বা কিছুকালের জন্য? কে জানে!
তাও এতদিন পর কেমন যেন একটা শূন্যতা বোধ করছি ভেতরে। সেটা কি হেনা আন্টির মৃত্যু না'কি তাঁর সাথে আমার টুকরো স্মৃতির সহবাস -- সেটা বুঝতে পারছিনা। পুরনো মানুষগুলো চলে গ্যালে এরকম ফাঁকা লাগে, অনেক দূরদেশে, ওই বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বসেও লাগে। জড়ভরত একটা জীবন, জরদ্গ ব একটা ভবিষ্যত আর অসীম একটা অনিশ্চয়তার মাঝেও মৃত্যু বড় নাড়ায় মাঝে মাঝে।
ভালো থাকুন হেনা আন্টি।
ভালো থাকুন।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন