ধোয়া উঠা চায়ের মগটা হাতে নিয়েই মেইন ডোরটা খুলে বাইরের টানা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। প্রায় তিন বছর তিন মাস হয়ে গেছে এ বাড়িতে এসেছি, কখন যে কোথা দিয়ে এত লম্বা সময় পেরিয়ে গেলো দেখতে দেখতে, টেরই পাইনি। আর মোটে পাঁচ দিন মাত্র, তার পরেই আবার অন্য ঠিকানায়। ডিসেম্বরের মেঘলা দিন, সাথে মন উতলা করা ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা আমার স্বভাব না মোটে ও। তবু ও আজকে কোন নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে গেছি। এগার তলার উপর থেকে সামনের হিল-সাইড ভিউটা দেখতে বরাবরি বেশ ভালো লাগে, আর আজকে আর ও অসামান্য লাগছে যেনো, হয়তো চলে যাবো এজন্যই। বারান্দায় রেলিং এর উপর দিয়ে ঝুঁকলেই নিচের লেক দেখা যায়, আর তার পাশে দিয়ে একেবেকে চলে যাইয়া পায়ে চলার পথ। কত কত দিন ঘুম না আসা রাতে এই রাস্তায় হেটে বেড়িয়েছি তার হিসেব কষে শেষ করা যাবেনা। কোন কোন বৃষ্টির দিনে হুট-হাট ভিজতে ইচ্ছে হলে এই রাস্তার চেয়ে ভালো কোন জায়গা ও খুঁজে পাইনি। আর সাথে আমার মত এক দুখান পাগলী জুটে গেলোতো কোন কথাই নেই, হই-হুল্লোড় করে পাগলামির চূড়ান্ত করতে বাকী রাখতামনা। সন্ধের সময় হাল্কা-পাতলা দৌড়ানোর জন্য ও আমার প্রিয় ছিলো এই রাস্তাই। এখানকার মানুষগুলা ও বেশ আন্তরিকই বলতে হবে, আসতে যেতে অচেনা অনেকেই হায় হ্যালো বলে, যারা ওটুকু ও করেনা তারা ও মুখের একটু খানি হাসি খরচ করতে ভোলেনা দুএক জন ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া। দৌড়াতে গিয়ে অনেকের সাথেই মৌখিক আলাপ হয়ে গেছে। টানা বৃষ্টি হওয়াতে কদিন দৌড়ানো হচ্ছেনা, বাসা ছাড়বার আগে আর হবে ও না হয়তো। দৌড়ানোর ফাকে ফাকে কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে পাতা বেঞ্চিতে জিরোবার জন্য আর বসা হবেনা কখনো। এসব ভাবতেই কেমন ভোঁতা একটা যন্ত্রণা হতে থাকে মাথার ভিতরে। এই ধরা মাথা সারাতেই তো চা নিয়ে বারান্দায় আসা।
মাস দুয়েক আগেই চুল ছেঁটে কান পর্যন্ত নিয়ে এসেছি, তীব্র বাতাসের ঝাপটায় তবু ও ছোট ছোট চুলগুলা আমার কপাল, গাল ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হাল্কা শীত শীত করছে। আমার দৃষ্টি এবার বাইরে ঘুরে সেরে বারান্দায় ফেরত আসে। বারান্দায় সার বেধে রাখা আছে বেশ কিছু গাছের টব, আমার হাউজওনারের মায়ের আবার গাছের ভীষণ শখ। আজ বেশ কদিন হয় উনি পা ভেঙ্গে বিছানায় পড়েছেন, কিছু কিছু গাছ অযত্নে তাই শুকিয়ে গেছে। আমার কেন জানি হুট করে মায়ের কথা মনে পড়ে, উনার ও গাছপালার শখ। ঢাকায় আমাদের টানা এল শেইপ বারান্দায় তাই পাতাবাহার থেকে শুরু করে শিম, টমেটো, বেগুন এমনকি পেয়ারার গাছ ও বাদ যায়না।
বাড়িওয়ালী আন্টী কেন যেনো আমাকে বেশ পছন্দ করেন। সকালে বের হবার মুখেই উনার সাথে দেখা হলে টুকটাক গল্প না করে ছাড়েন না। মাঝেমাঝেই খাবারদাবার ও রেঁধে পাঠিয়ে দেন আমারদের জন্য। ঈশ কী ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে, উনাকে একবার দেখে এসেছি যে এরপর আর যাওয়া হয়নি। দেখতে গেলে উনি বেশ খুশী হতেন, কথা বলতে পছন্দ করেন ভদ্রমহিলা। যাওয়ার আগে একবার মনে করে উনাকে দেখে আসতে হবে। গাদা-খানেক কাজ জমেছে হাতে, তার উপর প্যাকিং শুরু করিনি এখন ও। আমার কেমন আলসেমি লাগে, নড়তে ইচ্ছে করেনা বারান্দা থেকে, চা শেষ করে ও ঠায় একভাবে দাঁড়িয়ে থাকি।
গবেষণার বিরক্তি কাটাতে কিংবা বস এর ঝাড়ি খেয়ে এসে সমস্ত মন রান্নায় সন্নিবেশ করে স্ট্রেস রিলিফ করা আমার অন্যতম ভালো লাগার একটা কাজ ছিলো। এই তিন বছরে তাই রান্নাটা বেশ রপ্ত করা হয়েছে। জন্মদিনের পার্টি, গেট টুগেদার এর দিনগুলাতে রান্না বান্না করে সিনিয়র, জুনিয়র আর বন্ধুদের নিয়ে হই-হুল্লোড় করে সেগুলা সাবাড় করার মুহূর্তগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যেনো। রান্না নিয়ে বন্ধুদের টিটকারি, আর সিনিয়রদের প্রশয়মাখা উৎসাহ, রাতভর মেলা তর্কবিতর্ক, গানের সন্ধ্যা, সব মিলিয়ে ছাড়াছাড়া কিছু ছবি কখনোই ভোলার মত নয়। হাওয়ার তেজটা কি একটু বাড়লো মনে হচ্ছে। দুরন্ত হাওয়ার দাপটে এলোমেলো চিন্তার সুতা ছিঁড়ে গেলো চট করেই। ঠাণ্ডা লাগাবার আগেই স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ করে বারান্দা থেকে ত্রস্ত পায়ে হেটে ভেতরে চলে আসি তাই। মগটা সিঙ্কে রেখে নিজের রুমের দিকে হাটতে হাটতে প্যাকিং এর হিসেব কষতে থাকি নতুন করে।
আমার রুমের ঠিক বাইরেই বই রাখার একটা কা-বার্ড। বছরে দুবার করে দেশে যাওয়ার সুবাদে অল্প অল্প করে অনেক কটা বই আনা হয়ে গেছে। আবার একে তাকে ধরে ও মাঝে বই আনিয়েছি, মানুষের ফেলে যাওয়া বই ও মায়ায় পড়ে নিজের বাড়িতে এনে জমিয়েছি। এবার বোঝো ঠেলা, এতগুলা বই নিয়ে মুভ করার বিপদটা এখন ভালোই টের পাওয়া যাবে। কিন্তু কি করা, প্রাণে ধরে বই ফেলে যেতে পারবোনা, ধাতে সইবেনা আমার। অগত্যা রুমে গিয়ে আলমিরা খুলে বসি। জানি জামাকাপড়ের ওজন তেমন কিছু হবেনা, তবু ও গাদা-খানিক জামাকাপড় ফেলার সঙ্কল্প করে ফেলি মনে মনে। কিন্তু এখন আর কিছু গুছাতে ইচ্ছে করছেনা, আলমিরা ছেড়ে তাই জানালা দিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। এখান থেকে নিচে একটা গ্রাউন্ড-মত দেখা যায়, সকালে আর সন্ধেয় মানুষজন এরোবিক্স করে ওখানটায়। দেখতে ভালোই লাগে। আজকে ও বেশ কজনকে দেখা যাচ্ছে। মন খারাপ হতে থাকে আবার, এই জানালায় আর দাঁড়ানো হবেনা। কত কতদিন মন খারাপের হাওয়ায় মন ভাসিয়ে জানালায় এসে দাঁড়িয়েছি। নিচে লাফিয়ে পড়লে কি কি হতে পারে এমন হিসেব ও করেছি মেলাই। মাঝে মাঝেই রাতের বেলা জানালা গলে আসা মাতাল করা চাঁদের আলোয় আমার ঘর ভেসে যায়। চাঁদের আলোয় ঘর ভাসিয়ে কাঁদতেও কেমন অদ্ভুত ভালো লাগে। নতুন বাসায় নতুন চাঁদের আলো একি ভাবে আমার রুম ভাসাবে কিনা, কে জানে। চাঁদের আলোয় ভাসা মেলাদিনের স্মৃতিবিজড়িত আমার এই ছোট্ট রুমটার জন্য আমার মন কেমন করতে থাকে।
মন্তব্য
এই রে, সকালবেলা মন খারাপ করিয়ে দিলেন,
তবু ভালই লাগল।
অনেক ধন্যবাদ শাব্দিক।
ভীষন রকম মন-কেমন-করা লেখা---ঠিক আমার মনের মত লেখা!!
নতুন জায়গায় স্থান-বদল মসৃণ হোক, দিন কাটুক আনন্দে!
শুভেচ্ছা অহর্নিশ!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অনিকেতদা, আপনার শুভেচ্ছা আমার জীবন চলার পাথেয় হোক।
গত ছয়বছরে বহুবার বাড়ি বদলাতে বদলাতে আমার কাছে এটা মোটামুটি পান্তাভাত হয়ে গেছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বিগত তের বছরে আটটা বাড়ী বদল করেছি। আমার কাছেও পান্তাভাত। সামনে মনে হয় আরেকবার করতে হবে।
ছয়বছরে বহুবার কেম্নে সম্ভব নজুদা, বাড়িওয়ালার সাথে কি খালি কেচাল করেন নাকি
আমার ঘরটা পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ঠিক তিথী , আমার ও একি অনুভুতি। এইজন্যেই এত বেশী কষ্ট লাগছে।
দিলেন মনটা খারাপ করে। এই লেখা দিয়েই আজ সচলের পড়াশুনার পর্ব শুরু করলাম...
তবে ভীষণ টাচ করে এই লেখা...
আসলে আমারও এই অভিজ্ঞতা আছে। এবং বলতে হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে আছে। তবে এই জ্বালা যে কি ভীষণ জ্বালা তা আমিও হাড়ে হাড়ে টের পাই।
কোন কোন সময় প্রয়োজনে বদলাতে হয় আবার কোন কোন সময় পরিস্থিতির জন্য... আর পাড়ি জমাতে হয় আরেকটা নতুনের জন্য...
ভালো থাকুন। নতুন বাড়ি যেন ঠিক চাঁদের আলো বয়ে আনে আপনার জন্য... । শুভকামনা রইলো।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ তাপসদা, কিন্তু এই বাড়িতে চাঁদের আলো দেখলাম্না এখন ,ও আজকে দুদিন হোল্ নতুন বাড়িতে এসেছি ।
বাড়ি বদলানোর অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা নেই। তবে একটা ছোট শহরে আমর অনেক বছর ছিলাম।ওখান থেকে যখন চলে আসি তখন আমি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম আর আমার ছোট ভাই সেতো রীতিমতো হাত পা ছুড়ে চিৎকার চেচাঁমেচি করে আশেপাশের সবাইকে জড়ো করে ফেলেছিল।আর বারবার বলছিল,ওখানে আমি এই মাঠটা কোথায় পাব?
আমার বাইরের সাড়ে চার বছর জীবনের সাড়ে তিনবছরি এই বাড়িতে ছিলাম, তাই অনেক খারাপ লাগসে রিমা আপু।পরাতঙ্কে আমরা সবাই ই বোধহয় আকড়ে থাকতে চাই ।
দীর্ঘদিন ধরে একই বাড়িতে থাকার কারনে বাড়ি বদলের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। আপনার লেখাটি পড়ে, শেষবারের বাড়ি বদলের ঝক্কি ও কিছু মন খারাপ হওয়া কথা মনে পড়ে গেল।
ঝক্কি তো আছেই প্রৌঢ় ভাবনা, তবে মন খারাপের কাছে সেটা বোধহয় কিছুই না।
facebook
হলে যখন সবার সাথে থাকতাম, আমাদের রুমের সাথে বিরাট চওড়া একটা বারান্দা ছিল। ওটার নাম দিয়েছিলাম গোঁসাঘর। কারুর মন খারাপ হলেই রাতবিরেতে ওইখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। কত কত রাত কেটেছে ওই বারান্দায়। কত রাগ অনুরাগ মান অভিমানের সাক্ষী ওটা। এত বছর পরেও এক একটা রাতে ওই বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে খুব...
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ইস আমার এমন কোন স্মৃতি নেই কেন হলজীবনের।
নতুন মন্তব্য করুন