'ধর্মপ্রচার নয়, বিভিন্ন ধর্মমত সম্পর্কে যৎসামান্য জানার প্রচেষ্টা মাত্র'।
ইসলাম ধর্মের প্রচারক মোহাম্মদের প্রায় ন'শো বছর পরে ভারতে শিখ ধর্মের প্রচলন হয়। এই ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক ১৪৬৯ খ্রীষ্টাব্দে পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর শহর থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে 'রায় ভর দি তালবন্দী' (বর্তমান নাম, নানকানা সাহিব) গ্রামে একটি সাধারন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা : মেহতা কল্যান বেদী, তিনি কালু মেহতা নামে অধিক পরিচিত।
মাতা : তৃপ্তা দেবী।
স্ত্রী : সুলক্ষিণী।
পুত্রদ্বয় : শ্রীচান্দ ও লক্ষ্মীচান্দ।
কথিত আছে, একদিন নানক তাঁর মুসলমান বন্ধু মারকানার সাথে বাইন নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যায়না।
তিন দিন পর নানক সবার সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, 'আমি ঈশ্বরের দেখা পেয়েছি, তিনি আমাকে তাঁর প্রেরিত গুরু হিসাবে উল্লেখ করেছেন'।
নানক বললেন, "ঈশ্বর কেবল একজনই, তিনিই সত্য, তিনিই স্রষ্টা, তাঁর ভয় নেই, তাঁর ঘৃণা নেই, তিনি কখনও বিলীন হননা, তিনি জন্ম-মৃত্যু চক্রের উর্দ্ধে, তিনি অজ-অমর স্বয়ংপ্রকাশ। সাধনার দ্বারা প্রকৃত গুরুর মাধ্যমেই তাঁকে অনুধাবন করা যায়। তিনি আদিতে সত্য ছিলেন, তিনি কালের সূচনায় সত্য ছিলেন, চিরকালব্যাপী সত্য আছেন এবং তিনি এখনও সত্য।" (জপজী)। নানকের এই জাগরণ হয় ১৫০৭ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে আগষ্ট।
নানক তাঁর বানী প্রচারের জন্য, 'রাবাব' (এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) বাদক মুসলমান বন্ধু মারদানাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি কোনায়, আরবের মক্কা, মদিনা, বাগদাদ এমনকি শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি স্থানে স্থানীয় ভাষায় রাবাব বাদনের ছন্দে তাঁর বানী প্রচার করেছেন।
এই পরিভ্রমনকালে তাঁর ধর্মমত প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রচারকেন্দ্রও (মানজিস) স্থাপন করেন।
গুরু নানক তাঁর সময়ে লঙ্গরের প্রচলন করেছিলেন। সেখানে সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব লিঙ্গের, সমাজের সর্ব স্তরের মানুষেরা পাশাপাশি বসে আহার করেন।
দ্বিতীয় শিখগুরু অঙ্গদ দেবের সময় থেকে লঙ্গরে মাংসের ব্যবহার রদ করা হয়। তখন থেকে লঙ্গরে নিরামিষ আহার বিতরন শুরু হয়। ঐতিহাসিকদের মতে বৈষ্ণবদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্যই এই ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়।
বর্তমানে প্রতিটি গুরদুয়ারায়ই লঙ্গরের ব্যবস্থা আছে। ধারনা করা হয়, অমৃতসরের স্বর্নমন্দির বা হরিমন্দিরে প্রতিদিন ১ লক্ষ লোককে খাবার দেওয়া হয়। বিভিন্ন মানুষের দানেই এই লঙ্গর চলে।
এই লঙ্গরকে বলে, 'গুরু কা লঙ্গর'।
যাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমে এই লঙ্গরগুলো চলে, তাঁদেরকে বলা হয় 'সেবাদার'।
মোঘল সম্রাট বাবরের রাজত্বকালে গুরু নানক ও তাঁর মুসলমান বন্ধু মারদানাকে কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। কারা কর্মকর্তার মাধ্যমে গুরু নানক সম্পর্কে জানার পর সম্রাট বাবর নানককে ডেকে পাঠান এবং তাঁর বানী শুনে তাঁকে একজন বিশেষ ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি মনে করে তাঁকে মুক্ত করে দেন।
লেহনা নামক একজন দুর্গাভক্ত হিন্দু, নানকের সাথে দেখা করে তাঁর কাছে তাঁর বানী শুনতে চান। নানকের সংস্পর্সে এসে এবং তাঁর বানী শুনে লেহনা শিখধর্ম গ্রহন করেন এবং নানকের পরম ভক্তে পরিণত হন।
একদিন একটি ঘটনার পর নানক লেহনাকে বলেন, "লেহনা, তোমাকে পবিত্র খাদ্য দান করে আশীর্বাদপুষ্ট করা হয়েছে, কারন তুমি সেটা অপরের সাথে সহভোগ করেছ। যদি কেউ তার ভাগের সম্পদ শুধু নিজের জন্যই জমা করে রাখে তবে তা লাশের সমতূল্য। কিন্তু যদি সে তা অপরের সাথে সহভোগ করে তবে তা পবিত্র খাদ্যে (সম্পদে) পরিণত হয়। তুমি এই গুপ্ততত্ত্ব রপ্ত করেছ, তুমি আমারই প্রতিচ্ছবি।" (জনমসাক্ষী)।
গুরু নানক লেহনাকে তাঁর অঙ্গ (হাত) দ্বারা আশীর্বাদ করেন এবং তাঁর নামকরণ করেন, 'অঙ্গদ' (নিজ শরীরের অংশ বিশেষ) এবং অঙ্গদকে দ্বিতীয় গুরু হিসাবে অভিষিক্ত করেন।
হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই গুরু নানককে মান্য করতেন। হিন্দুরা বললেন, নানকের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ তাঁরা দাহ করবেন আর মুসলমানের বললেন তাঁরা নানকের মৃতদেহ সমাধীস্থ করবেন।
নানক উভয় সম্প্রদায়কে বলেন, 'তোমরা হিন্দুরা আমার শরীরের ডান পার্শে এবং মুসলমানেরা বাম পার্শে ফুল রেখে প্রর্থনা করবে। যে পার্শে বেশী ফুল অক্ষত থাকবে তাঁরা আমার মৃতদেহ গ্রহণ করবে। এরপর নানককে শায়িত অবস্থায় রেখে উভয় পার্শে প্রচুর ফুল দিয়ে একটি আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আচ্ছাদন উঠিয়ে আর নানকের দেহ পাওয়া যায়নি। ধারনা করা হয়, তিনি সকলের অলক্ষ্যে চলে গিয়েছিলেন।
নানকের ধর্মমতে এমন একটি সার্বজনীন সহনশীলতার আদর্শ ছিল যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। এই দুই ধর্মের গোঁড়ামি ও আচারপ্রিয়তাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। ধর্মবিশ্বাসে যে ঐক্য আছে তাই গ্রহন করে সামাজিক বাধা দুর করবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বললেন সৃষ্টিকর্তার নাম জপ করলেই তাঁর আরাধনা হয়।
তিনি একজন গুরুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে, তেমনি সাধারন মানুষ গুরুতে আত্মসমর্পন করে ঈশ্বরকে লাভ করে।
নানক, স্বর্গ, নরক ও কর্মফলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বললেন যে, ধর্মাচরণ করলেই সমস্ত পাপ ক্ষয় হয় এবং ঈশ্বরের নাম জপ করে স্বর্গের অধিকারী হওয়া যায়।
তিনি বললেন, পশুবলীর চেয়ে সত্যভাষণ ভাল, ঈশ্বরে অনুরাগ, তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মানুষ্ঠানের চেয়ে শ্রেয়। তাঁর মতে সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দিয়ে মানুষ সমাজে ভেদ-বুদ্ধি সৃষ্টি করেছে।
গুরু বাদ সম্পর্কে নানক বলেছেন যে বেদ-পুরাণে পরমেশ্বরের চেয়েও গুরুকে বড় বলা হয়েছে। তার অর্থ এই যে, ভগবানের ঘরে মুক্তি আছে, আর সেই ভগবান আছে গুরুর ঘরে।
শিখ সম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু রাম দাস, 'চক রাম দাস' নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এরই নামকরন হয় 'অমৃতসর'। এই অমৃতসরেই শিখদের প্রধান তীর্থস্থান স্বর্নমন্দির বা হরিমন্দির অবস্থিত। গুরু অর্জনদেব এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
গুরু অর্জন দেবের তত্ত্বাবধানে, ভাই গুরুদাস গ্রন্থসাবিহ সংকলন করেন যা আদিগ্রন্থ নামে পরিচিত।
দশম গুরু গোবিন্দ সিং, ১৬৭৮ খ্রীষ্টাব্দে আদিগ্রন্থের সাথে গুরু তেগ বাহাদুরের কিছু রচনা সংযোজন করে গুরুগ্রন্থসাহিব সংকলিত করেন। এই গ্রন্থে সন্ত কবীর, নামদেব, রবিদাস, শেখ ফরিদ এবং অন্যান্য আরও কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির বানী অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গুরু অর্জন দেব ও গুরু তেগ বাহাদুর মুসলমান শাসকদের হাতে নিহত হবার পর দশম গুরু গোবিন্দ সিং মোঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের আমলে শিখ জাতিকে এক নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৬৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ মার্চ তারিখে পাঞ্জাবের আনন্দপুর নামক স্থানে 'খালসা'র প্রবর্তন করেন। একে তিনি 'আকাল পুরখ দ্যে ফৌজ' অর্থাৎ ঈশ্বরের সেনাদল হিসাবে অভিষিক্ত করেন। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, কুল ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় না এনে ঈশ্বর সৃষ্ট মানব হিসাবে সকলকে আশ্রয় দেওয়া, পালন করা, রক্ষা করা এই সেনাদলের কাজ।
পাঁচ জন নির্ভীক বীরকে তিনি 'খালসা' বা পবিত্র ধর্মে দীক্ষা দেন। এই পাঁচজনকে বলা হল, 'পঞ্চ পিয়ারে'। পরে গুরু গোবিন্দ সিং এই 'পঞ্চ পিয়ারে'র দ্বারা দীক্ষিত হন। তিনি পরবর্তীতে আরও অনেক শিখকে 'খালসা' হিসাবে দীক্ষা দেন। এদেরকে পাঁচটি 'ক' দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। পাঁচটি প্রতীক হলো, (১) 'কেনা' অর্থাৎ গোঁফ-দাড়ি ও মাথায় অকর্তিত চুল, (২) 'কঙ্গ' বা কাঠের চিরুনি, (৩) 'করা' বা হাতে লোহার বালা, (৪) 'কচ্ছ' বা অন্তর্বাস এবং (৫) 'কৃপাণ' বা তলোয়ার। ভক্তিবাদী শিখজাতি এইভাবে ধর্মযোদ্ধায় রূপান্তরিত হল।
গুরু গোবিন্দ সিং, দীক্ষা গ্রহণকারী শিখ পুরুষদের নামের শেষে 'সিং' (সিংহ) এবং মহিলাদের নামের শেষে 'কাউর' (সিংহী) সংযুক্ত করেন।
শিখ সম্প্রদায়ের যাঁরা 'খালসা' হিসাবে দীক্ষা গ্রহণ করেন তাঁদেরকে বলা হয় 'অমৃতধারী'। আর যে সকল শিখগণ, শিখ গুরুদের বানী, শিখ ধর্মের সকল রীতিনীতি এবং গুরুগ্রন্থসাহিব মানেন কিন্তু 'খালসা' হিসাবে দীক্ষিত নন এবং পঞ্চ 'ক' ধারণ করেননা তাঁদেরকে বলা হয় 'সহজধারী'।
গুরু গোবিন্দ সিং বলেন, জাতি ধর্মের কোন ভেদ থাকবেনা। সব শিখ ভ্রাতৃবন্ধনে আবদ্ধ হবে, এক পাত্রে আহার করবে, পরস্পরকে ঘৃণা করবেনা। অসাধু উপায়ে কেউ জীবিকার্জন করবেনা, লোভ ত্যাগ করবে, সত্য কথা বলবে ও সকালে 'জপজি' মন্ত্রে প্রার্থনা করবে, বিপন্ন বন্ধুকে সাহায্য করবে ও সময়মত শিখ ধর্মমন্দির গুরদুয়ার দর্শন করবে।
গুরু গোবিন্দ সিং এর শেষ নির্দেশ হলো, আর গুরু নয়, তাঁর পর থেকে সকল ধর্মাদেশ গুরুগ্রন্থসাহিব থেকেই নিতে হবে।
শিখ ধর্মের বিশ্বাসমতে বিশেষভাবে ক্ষতিকর পাঁচটি মন্দ দিক রয়েছে। এগুলো হলো,
(১) কাম: দেহ সংসর্গ, দেহভোগ লালসা। শিখ ধর্মে কাম প্রবৃত্তিকে বশে রাখবার কথা বলা হয়েছে।
(২) ক্রোধ: রাগ, হিংস্রতা, ভয়ানক রোষ। ক্রোধ দমন করতে হবে।
(৩) লোভ: পার্থিব বিষয়-বস্তু অর্জন, অপরের অর্জিত সম্পদ কুক্ষিগত করার বাসনা। ধর্মে বলা হয়েছে, এতে মানুষ স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। লোভ পরিহার করতে বলা হয়েছে।
(৪) মোহ: বিভ্রান্তিমূলক মায়া দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়া। একে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। এবং
(৫) অহঙ্কার: যশ, প্রতিপত্তি, সম্পদ ইত্যাদির অধিকারী হওয়ার কারনে নিজেকে অপর হতে শ্রেয় মনে করা। অহংকার ত্যাগ করে বিনয়ভাব নিয়ে সমাজসেবা করতে হবে।
আর পাঁচটি সদগুণ হলো,
(১) সত: সৎ জীবন যাপন করা, অপরের প্রতি ন্যায় আচরণ করা, সকলকে সমান ভাবা।
(২) সন্তোষ: শিখ ধর্মানুযায়ী ব্যক্তিগত সুখ বা প্রাপ্তি কাম্য নয়। উদ্বেগ, ভয়, বিরক্তি ইত্যাদি থেকে মুক্ত থেকে ঈশ্বরে ভরসা রাখতে হবে।
(৩) দয়া: অপরের দুঃখকষ্টে তাঁদের প্রতি সহানুভূতি, করুণা, মমতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
(৪) নম্রতা: বদান্যতা, বিনয়ভাব। শিখ ধর্মে এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবং
(৫) পেয়ার বা প্রেম: মানব প্রেম, সকলের প্রতি ভালবাসা, সকলকে সমান ভাবে গ্রহণ করাকে ধর্মে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
শিখ ধর্ম তিনটি বিশেষ স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো,
(১) নাম জপো : প্রতিদিন সকালে স্নানের পর ছন্দে ছন্দে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করা।(নাম কীর্তন)।
(২) কিরাত করো : সৎভাবে জীবিকা অর্জন করো। সক্ষমতা অনুযায়ী পরিশ্রম করো যাতে পরিবার ও সমাজ উপকৃত হয়।
(৩) ভান্দ চাখো (ভাগে চাখো) : নিজের যা সম্পদ তা সবার সাথে সহভোগ করো। দান করো। সাহায্যপ্রার্থীকে সহযোগিতা করো। লঙ্গরে দান করো।
যদিও শিখ ধর্মে কোন ধর্মানুষ্ঠানের স্থান নেই বা গুরু নানক ধর্মানুষ্ঠানকে বর্জন করতে বলেছেন তথাপিও পরবর্তীকালে শিখ ধর্মালম্বীরা কিছু পরব বা উৎসব পালন করা শুরু করেন।
(১) গুরুপরব : সকল শিখ গুরুর জন্মদিনে গুরদুয়ারায় গুরুর নামে এই উৎসব পালিত হয়, তবে গুরু নানক ও গুরু গোবিন্দ সিং এর গুরুপরব উৎসব সব গুরদুয়ারায় বিশেষভাবে পালিত হয়।
(২) বৈশাখী : দশম গুরু গোবিন্দ সিং এর 'খালসা' প্রবর্তনের দিন হিসাবে বৈশাখী উৎসব পালিত হয়।
(৩) হলা মহলা : হিন্দুদের হোলি উৎসবের একদিন পর পাঞ্জাবের আনন্দপুরে খালসারা একত্রিত হয়ে তাঁদের নানাবিধ কলাকৌশল প্রদর্শন করেন।
বিবাহ : শিখ ধর্মে বিবাহকে 'আনন্দ করজ' বলা হয়। কেবলমাত্র প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীরই বিবাহ করার অনুমতি রয়েছ। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিবাহ শিখ ধর্মে নিষিদ্ধ।
বিবাহপূর্ব বাগদান অনুষ্ঠান হতে পারে কিন্তু কোন বাধ্যবাধকতা নেই। পাত্রপাত্রী বা তাঁদের পরিবারের সুবিধামত যে কোন দিনেই বিবাহ অনুষ্ঠান হতে কোন বাধা নাই। পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে অথবা পাত্রপাত্রী স্বেচ্ছায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে শিখ ধর্মগ্রন্থ, 'গুরুগ্রন্থসাহিব'কে সামনে রেখে পাত্রীকে পাত্রের বাম পাশে বসানো হয়। এ সময়ে 'সাবত'(মন্ত্র) পাঠ করা হয়। পরবর্তীতে সকলে দাড়িয়ে 'আর্দাস' প্রার্থনার মাধ্যমে 'ওয়াহ-এ-গুরু'( শিখ ধর্মে ওয়াহ-এ-গুরুকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি হচ্ছেন, নিরাকার, আকাল ও অলখ )র আশির্বাদ কামনা করা হয়। শিখ বিবাহের মূল সুর, 'দুই দেহ এক আত্মা'।
সন্তানের নামকরণ : শিখ পরিবারে সন্তান জন্মের পরপরই শিশুটির কানে মৃদুস্বরে মূলমন্তর পাঠ করে শোনানো হয় এবং শিশুটির মুখের মধ্যে এক ফোটা মধু দেওয়া হয়। শিশুর জন্মের চল্লিশ দিনের মধ্যে গুরুদুয়ারা দর্শন আবশ্যিক। গুরুদুয়ারায় উপস্থিতকালে, গ্রন্থি (যিনি গ্রন্থ পাঠ করেন) লক্ষ্যহীন ভাবে গুরুগ্রন্থসাহিবের পৃষ্ঠা উন্মুক্ত করে সেখান থেকে একটি অংশ পাঠ করেন। পরিবারটি পঠিত স্ত্রোস্তটির প্রথম অক্ষরটি দিয়ে একটি নাম নির্দিষ্ট করেন এবং গ্রন্থি সেই নামের সাথে সিং অথবা কাউর (ছেলে অথবা মেয়ে ভেদে) সংযুক্ত করে উপস্থিত জনসমক্ষে ঘোষণা করেন। সবশেষে পরিবারটির পক্ষ থেকে 'কারাহ পরসাদ' (মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্য্য) বিতরণের মাধ্যমে নামকরণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : শিখ ধর্মমতে মৃত্যুর পরে মৃতদেহ দাহ করা হয়। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে, 'কিরতান সোহিলা' ও 'আরদাসস' প্রার্থনা করা হয়। এই আচার-অনুষ্ঠানকে 'অন্তিম সংস্কার' বলে।
প্রার্থনা : একজন ধর্মপ্রাণ শিখ অবশ্যই ঊষালগ্নের তিন ঘন্টা আগে শয্যা ত্যাগ করবেন। স্নান সমাপন করে ঈশ্বরের আরাধনায় মনোনিবেশ করবেন। বারংবার 'ওয়াহ-এ-গুরুু'র নামোচ্চারণ করবেন। শিখদের জন্য প্রত্যুষে, সন্ধ্যায় এবং শয্যা গ্রহণের পূর্বে প্রারথনা করার রীতি প্রচলিত। শিখ ধর্মালম্বীরা গুরুদুয়ারায় উপস্থিত হয়েও সমবেত প্রার্থনায় যোগ দেন। সমবেত প্রার্থনা, তাঁদের কাছে েবিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সমবেত প্রার্থনা বা 'সঙ্গত' এর মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।
শিখ ধর্মের আদিগ্রন্থের মূল কথা হলো--- যোগসাধনা, পূজানুষ্ঠান, কৃচ্ছসাধন বা দীর্ঘ প্রার্থনাও নয়, এই প্রলোভনে ভরা জগতে পবিত্র জীবনই ধর্ম।
গুরুকে ভালবাসবে, সব মানুষকে সমান ভাববে, সবার জন্য থাকবে সমবেদনা,কোন গর্ব নয়, অহঙ্কার নয়, বিনয় ব্যবহারেই ধর্ম পালিত হবে।
এ প্রসঙ্গে সাধক কবীর তাঁর দোঁহায় বলছেন,
"ত্যাজো অভিমানা, শিখ জ্ঞানা,সৎগুরু সংগত তরতা হৈ।
কহই কবীর কই বিরলহংসা,জীবতোহি যো মরতা হই।"
অর্থাৎ, অভিমান (অহং) ত্যাগ করে জ্ঞান শিক্ষা করো। সৎ গুরুর সঙ্গ পেলেই পরিত্রাণ।
কবীর বলছেন, এমন কেউ কী আছেন, যিনি জীবিতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
নানক বলেছেন, 'ঈশ্বরই সর্বময় কর্তা, তিনি তাঁর দাস'।
শিখ ধর্মে সত্য হচ্ছে মহৎ গুণ, সত্যবাদিতা মহোত্তর।
চলবে
[url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42052 ]ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও'[/url]
ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও' এর বাকি অংশ
ধর্মসার- (২) কনফুসিয়াস ও তাঁর ধর্ম
[url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42163 ]ধর্মসার- (৩) বর্ধমান মহাবীর ও জৈনধর্ম[/url]
ধর্মসার- (৪) জরথুসত্র ও পারসীক ধর্ম
[url=http://www.sachalayatan.com/guest_writer/42499 ]ধর্মসার- (৫) গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম [/url]
"ঝাঁপি খুলে বহু পুরাতন একখানি নোটবই পেলুম। তখনকার দিনে আমাদের দেশে ইন্টারনেটের সুবিধা ছিলনা। বই-পুস্তক ঘেঁটেই যা কিছু পাওয়া। কখন, কোথায়, কিভাবে এগুলো পেয়েছিলাম, তা আজ আর মনে করতে পারিনা তাই সূত্র জানাতে পারবোনা, ক্ষমা করবেন।
মন্তব্য
চলুক চলুক
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ, উৎসাহ যোগাবার জন্য।
টু থাম্বস আপ
অনেক ধন্যবাদ এই মহামানবকে নিয়ে লেখার জন্য।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অসংখ্য ধন্যবাদ।
অসাধারন লেখা। প্রাঞ্জল আর সহজ করে লেখা জন্য ধন্যবাদ
ধন্যবাদ, সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
অনেক কিছু জানলাম। উইকিপিডিয়া বলছে,"Since 'Kaur' means 'Princess' it acts as a symbol of equality among males and females."
আর আপনি বলছেন, " মহিলাদের নামের শেষে 'কাউর' (সিংহী) সংযুক্ত করেন"
কোনটা সঠিক?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
ধন্যবাদ, সংযোজনের জন্য। দুটোই সঠিক। পুরুষদের সিংহ হিসাবে চিহ্নিত করেছি বলে মহিলাদের বেলায় শুধুমাত্র সিংহীই ব্যবহার করলাম।
এরকম অনেক কিছুই উহ্য রয়ে গেছে। যেমন, ব্যাপটিজম, শিখ সন্তানদের নামকরণ, শিখদের বিবাহ, খালসায় দীক্ষিত হওয়ার কালে চিনি গুলানো শরবত (অমৃত) পান করে অমৃতধারী হওয়া, অমৃতসরে অবস্থিত হরি মন্দির বা স্বর্ন মন্দিরের দীঘির পানিকে অমৃত জ্ঞান করা ইত্যাদি।
আশা করছি, আলোচনা ও মন্তব্যের মাধ্যমে আরও অনেক কিছুই উঠে আসবে।
মনযোগ দিয়ে পড়বার জন্য আবারও ধন্যবাদ।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ।
একজন দার্শনিকের নতুন উপলদ্ধি যদি প্রচলিত বিশ্বাস ও আচারকে আঘাত করে তখন সেটি নিবারণের সহজ উপায় হচ্ছে তাকে ঈশ্বরের অবতার বানিয়ে ফেলা ও তার উপলদ্ধিজাত শিক্ষাকে ধর্ম বলে প্রচার করতে শুরু করা। তারপর আস্তে আস্তে তার শিক্ষাগুলোকে নিজেদের সুবিধামত ব্যাখ্যা করে ধর্মগ্রন্থ, ধর্মীয় আচার গড়ে তোলা। ঈশ্বরের রাজকে চ্যালেঞ্জকরা দার্শনিক মতবাদও এভাবে একসময় নতুন ধর্মরূপে পরিচিত হয় অথবা প্রচলিত বৃহৎ ধর্মীয়গোষ্ঠীর নতুন মাযহাব হিসেবে পরিচিত হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এই প্রৌঢ় বয়সে এসে আপনার লেখাটা পড়ে মনে হল, এরকম একটা প্রয়োজনীয় লেখা আগে কখনও কেন যেন পড়া হয়নি। ভালো হয়েছে, লেখাগুলোর জন্য শুধু ধন্যবাদ না অনেককিছুই আপনার প্রাপ্য।
ধন্যবাদ, পড়বার জন্য।
আপনার মন্তব্যে অনেক প্রেরণা পেলাম।
আমার লেখাগুলোর বিভিন্ন পর্বে, আপনার মন্তব্যগুলো আমাকে কিছু বিষয়ে একটু অন্যভাবে ভাবার ধারনা যুগিয়েছে।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই ধর্মটা সম্পর্কে জানার ইচ্ছে ছিল। ভালো লেগেছে লেখাটা। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ, ভাললাগা জানাবার জন্য। আপনাদের ভাললাগাইতো আমার লেখার অনুপ্রেরণা।
এই ধর্মটা সম্পর্কে জানার ইচ্ছে ছিল। ভালো লেগেছে লেখাটা। ধন্যবাদ।
এই বিষয়ে তেমন ধারণা ছিলনা। আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। গুরু নানকের প্রচলিত দর্শন কিভাবে কৃপাণধারী ধর্মে পরিণত হলো সেটা লক্ষ্যণীয়।
ধর্মমতগুলোর গভীরে প্রবেশ করলে দেখবেন, প্রায় সকল ধর্মমতই আদিতে যেমনটা ছিল, পরবর্তীতে আর তেমনটা থাকেনি। অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থগুলো সংকলিত হয়েছে ধর্মমত প্রচারের অনেক অনেক পরে। পরিবর্তন, পরিবর্ধন কী হয়নি ? সনাতনধর্ম, জৈনধর্ম, পার্সীকধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শিখধর্ম, জুডাধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম এর প্রায় সবগুলিই বর্তমানে পরিবর্তীত রূপেই পাওয়া যায়।
ধন্যবাদ, মনযোগ সহকারে পড়বার জন্য।
আচ্ছা এই যে পরিবর্তিত ধর্মের তালিকা দিলেন, তাতে ইসলামের নাম নেই কেন? মুহাম্মদ(স) এর সময়ে কি শিয়া সুন্নি ছিল?
প্রায় সব ধর্মমতের অনুসারীদের মাঝেই এক ধরনের সহনশীলতা তৈরি হয়েছে, যেটা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে একেবারেই নেই। ধর্মবিষয়ে এরা এখনও যথেষ্ট উগ্র।
যাহোক, পর্যায়ক্রমে ইসলাম ধর্ম নিয়েও লেখার ইচ্ছা আছে। আশা করছি তখন বিশদে লিখবো।
যদিও আমার প্রশ্নের উত্তর পেলামনা, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সহনশীলতা নেই এই কথায় একমত হতে পারলামনা। ধর্ম মাত্রই শেখায় আমার ধর্মই সত্য বাকি সব অলীক। সুতরাং ধার্মিক হতে হলে সেটা মেনে নিয়েই হতে হবে।
না, মুহাম্মদের (স) সময় শিয়া, সুন্নি ছিলনা। এমনকি কাদিয়ানী, আহলে-হদীস, বাহাই ইত্যাদি বিভাজনও মুহাম্মদ (স) পরবর্তীকালেই হয়েছে। যদিও এঁরা বৃহত্তর মুসলিম সমাজেরই অংশ।
ইসলামে যে চার মাযহাবের উল্লেখ আছে, (১) হানাফী, (২) শাফায়ী, (৩) মালেকী, ও (৪) হাম্বলী, এগুলোও মুহাম্মদ (স) পরবর্তী সময়েই উদ্ভুত।
খুব ভাল লাগল। শিখ ধর্ম সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। অনেক কিছু জানা হল। আগের পর্ব গুলি পড়া হয়নি। পড়ে ফেলব।
ধন্যবাদ, ভাললাগা জানাবার জন্য।
ভাল লাগল লেখাটা পড়তে। শিখ ধরম সম্পরকে জানা গেল খুবই সহ্জ ভাষায়।
ধন্যবাদ, সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।
ধন্যবাদ, পড়ছেন জেনে ভাল লাগলো।
ভাল লাগল। গুরু নানককে নিয়ে আর বিস্তারিত লিখেন সময় পেলে।
মানব সমাজের এই সমস্যা, কেউ একটু ভাল কাজ করলেই হয়েছে, ঐশ্বরিক ধোঁয়া দিয়েই ছাড়বে। আদতে দেখা গেল নানক এমন কিছুই বলেন নি, চেষ্টা করেছেন সামাজিক বৈষম্য দূরের।
facebook
ধন্যবাদ, ভাল লাগা জানাবার জন্য।
স্বাস্থ্যগত কারনে উত্তর দিতে দেরি হল, ক্ষমা করবেন।
নতুন মন্তব্য করুন