সে আমাদের সবারই জিনিসটা শুরু সেই শৈশবের ছোট্ট দিনগুলোতে, বলতে গেলে জন্মলগ্ন থেকে। কিছুটা বুঝবার আগে অথবা কিছুটা বুঝবার পরেই। সারা পৃথিবীতে তখন থাকতো একটা কুকুর । এই কুকুরকে দিয়েই শুরু হয়েছিল আমাদের প্রথম ভয়ের অনুভূতি।
বিনুদি ফেরিওয়ালার মত ভয় ছড়াতো - এই যে ঘে-উ। কামড় দিবে, কা-ম-ড়। উ বাবা... দৌঁড় দৌঁড় দৌঁড়। ভয়ের সাথে জন্ম নেয় কৌতূহল, নিষেধের মধ্যে হাতছানি। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বিনুদির কোলে চেপে আবার কুকুরটার একটু কাছে যাওয়ার জন্য শরীর দোলাতে শুরু করি। আবার একটু কাছে গেলেই, উল্টোদিকে ছুটে পালানোর জন্য বিনুদির গলা আঁকড়ে ধরি। এর মধ্যে চারপাশের ধ্বনি গিলে ফেলে সেটাকে নকল করে অবিকল আবার মুখ দিয়ে বের করবার চেষ্টা এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে কুকুরটা দেখেই ঘেউ ঘেউ করে উঠি। কুকুর হয়ে ওকে ভয় দেখাই। ওর সাথে এই ছিল আমার কথা। কুকুরের সাথে সাথেই ছিল একটা বিড়াল। পৃথিবীর সব বিড়ালই তখন একটা বিড়াল। বিড়ালের সাথে ম্যাও ম্যাও করে বিড়াল হয়ে কথা বলি। ঘেউ ঘেউ আর ম্যাও ম্যাও - বয়সের সাথে সাথে এটা হয়ে গেল বাঘের হালুম। হালুম হালুম করে চিৎকারে চারদিক মাতিয়ে নিজেকে বাঘ বাঘ ভাবার খেলাটা এরপর কত ঢঙেই না রঙ চড়ায়। মিহি সুরে ভিক্ষুকের একটা পয়সা চাওয়ার ভঙ্গি আয়ত্ব হয়ে গেছে তখন। আর বিনুদিতো তখন রীতিমত ডাকসাইটে একটা দজ্জ্বাল মা। বকুনীর চোটে তার ছেলেমেয়েদের জীবন প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এই সবের মধ্যেই একদিন বিয়ের সানাই বেজে উঠলো। বিনুদির ছেলের সাথে পুষ্পদির ছেলের বিয়ে হবে। হৈ চৈ আর ফুর্তির আনন্দে মাতোয়ারা চারদিক... রান্নার আয়োজন, অতিথি আপ্যায়নের ব্যস্ততা, এটা হয় নি, ওটা হয় নি, কত কি! সারি সারি মাটির ডেকচি উনুনে চড়েছে, তার কোনটাতে রান্না হচ্ছে ইটের মাংস, কোনটাতে বালির পোলাও, ছেঁড়া পাতার রোস্ট। জিবে জল আসে। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার আগে বিয়ের প্যান্ডেলে পড়লো ডাকাত। দুপায়ের ঘোড়ায় চেপে ভাইয়া ঠাঠাঠাঠা বন্দুক ফুটিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল বরবউ, মুক্তিপন হিসেবে দাবী করলো মাটির লাল ব্যাংকে বিনুদির একটু একটু করে জমানো টাকা থেকে ১০ টি চকচকে পয়সা। বায়োস্কোপওয়ালা এসেছে, সে এখন বায়োস্কোপ দেখতে যাবে। বাধ্য হয়ে বিনুদি সাধের পয়সাগুলো বের করে দেয় ভাইয়া। ঘোড়া ছুটিয়ে ডাকাত চলে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে পুতুল বিয়ের আয়োজন আবার শূরু হলো।
স্কুলে যেমন খুশি সাজো’র মেলা বসে। আমরা মাঠে এসে দাঁড়াই। আমাদের কেউ গায়ে কাদামাটি মেখে প্রাণময় মূর্তি হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছি- কেউবা নদীভাঙনের শিকার হয়ে সর্বশান্ত ভিক্ষুক হয়ে উজ্জ্বল শহরে সবার কাছে একমুঠো সাহায্য প্রার্থনা করছি - কেউ আবার কেউ লাঙ্গল কাঁধে ছুটে চলেছি, জমিতে চাষ দেবার বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ গ্রামের নবীন দম্পতি সেজে শহরে এসেছি লাল নীল বাতি দেখবে বলে, আবার বন্দুক কাঁধে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সেজে শত্র“র বিরুদ্ধে এক অসম সাহসী যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে চলেছি কেউ, আবার কেউবা সেজে এসেছে সুন্দর একটা মোরগ। কত রকম সাজ একক জনের, কত ধরনের সজ্জা। স্কুলের খেলা ফেলে এক সময় আমরা বড় হয়ে যাই কিন্তু আমরা যা না তা হয়ে ওঠার এই খেলা চলতে থাকে জীবনভর। এই খেলাগুলোর মধ্যে দিয়ে আমরা শিখতে থাকি এক জীবনে অসংখ্য জীবনের ভূমিকার গল্প। জীবনে- নতুন রঙ লাগে, নতুন গন্ধ যোগ হয়, নতুন শব্দ তৈরী হয়।
আবার চলার পথেও আমরা এর মধ্যে কখনও কখনও আটকেও যাই। এই যেমন ঝুমিতে আমি আটকে গিয়েছিলাম। একটা বৃত্তের মত। চাকরীতে আটকে গিয়েছিলাম। এটাও একটা বৃত্ত। বৃত্ত গুলো এমন - মনে হয় সবকিছু এখানে আছে। একটা নিরাপত্তা, একটা স্বস্তি। একটা একঘেয়েমী, একটা বন্দীত্ব। শূন্যতার বৃত্তও আসে কখনও কখনও। এটা সহ্য করা কঠিন। জীবনের অর্থগুলো শূন্য হয়ে যায়। মৃত্যু ডাকে। লাস্টবেঞ্চি উঁকি দেয়। জন ডেনভার তার ঈগলের ডানাটা দেয়ার পর অবশ্য আর আসে নি। আমি অবশ্য টের পাই লাস্টবেঞ্চি না আসলেও সে আসলে আছে। মানুষের মধ্যেই ওকে দেখি হেঁটে যেতে। কিন্তু আর ভয় করে না।
আগে বৃত্তগুলোকে বৃত্ত নয়- পৃথিবী মনে হতো। এখন বৃত্তগুলোকে শুধু একটা বৃত্তই মনে হয়। প্রতিটা বৃত্তের একটা নির্দিষ্ট রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ আর বর্ণ আছে। আমি এগুলো টের পেতে শুরু করি। কষ্টেরও একটা রঙ আছে। আমি বুঝতে পারি - কেউ যদি ব্যর্থতাটাকে দেখতে পারে সেটাও সুন্দর মনে হয়। বঞ্চনার পেছনেও একটা কারণ লুকিয়ে থাকে। কারণটা বুঝতে পারলে সেটা অভিজ্ঞতা হয়ে বাজনা বাজায়। তখন আবার সব রঙ ফিরে আসে। সেই ছোট্টবেলার চোখটা ফিরে আসে। বড় হওয়ার সাথে সাথে চোখটাকে যেই সানগ্লাসের আড়ালে ঢেকে ফেলি আমরা - সেই সানগ্লাসটা চোখ থেকে খসে পড়ে। নিজের সাথেই নিজের এক আজব খেলায় খেলায় মেতে উঠি আমরা।
খেলতে খেলতে খেলতে অভিজ্ঞতা বাড়ে। সে অভিজ্ঞতা অনুভূতিকে হত্যা করে না- অনুভূতিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। পৃথিবীর দশদিক জুড়ে রঙ রঙ আর রঙ। শব্দ শব্দ আর শব্দ। প্রাণময়। অর্থপূর্ন। মায়াভরা।
একটা ছোট্ট খুকি যেন গলা সাধতে বসেছে - জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রন হে। কিন্তু ছোট্ট খুকির গানের কথায় ছোট্ট একটু ভুল হয়ে গেছে যে। এ আনন্দযজ্ঞ আসলে নিজের ভেতরেই। জগৎ এই আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে। খুকি আবার গাইতে শুরু করে-- আমার এই আনন্দযজ্ঞে জগৎের নিমন্ত্রন।
সেই আনন্দযজ্ঞে কে আসে নি?
কান্না- হাসি, হিংসা - প্রেম, ঈর্ষা- ত্যাগ, ভালোবাসা- ঘৃণা, কষ্ট- ফুর্তি সবাই জোড়ায় জোড়ায় হাত ধরাধরি করে নেচে চলেছে। ঐ যে এক কোণে - পাপ আর পূণ্য বুকে বুক মিলিয়ে আছে - আমরা তাদের দিকে এগিয়ে যাই। মনে হয়- এতদিনে বুঝি আমরা পাপ এবং পূণ্যকে চিনতে পেরেছি। পেছনের জীবনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি - পাপ কিংবা পূণ্য কোনটাই ঠিক করা হয়ে ওঠে নি । একটা লোভ আর সংযমের দোলাচলের দড়িতে নিজের আত্মাকে বেঁধে রেখেছি কেবল। সেই আত্মাকে এখন মুক্ত আলোয় নতুন করে অনুভব করি, বুঝতে পারি - প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের নতুন করে জন্ম হয়। অনুভব করি-বোধহীন পূণ্যও মানুষকে বন্দী করে। পাপের অভিজ্ঞানও মানুষকে মুক্ত করে। বেচে থাকার আনন্দে যে মৃত্যু থেকে যে জীবন পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছে, আবার তিক্ততার যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে যে জীবন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে- সেই মৃত্যুকে আর অচেনা মনে হয় না। সে যেন জীবনেরই আর এক ছন্দ।
সেই ছন্দে নাচতে নাচতে নাচতে আমি হেঁটে চলি। প্রতিটি মুহূর্তে গোটা জীবনের স্বাদ মিশে থাকে। কোনকিছুই আলাদাভাবে ভাল কিংবা খারাপ নয়। ঐ যে, ছুরি হাতে মত্ত ছেলেটির নিষ্ঠুর চোখেও- ‘লুকিয়ে থাকা প্রেমিকের ছায়া’ আলো ফেলে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভদ্রলোকের খোলসের ভেতর থেকে গোপন গালির ফোয়ারা টগবগিয়ে ওঠে। গুলি আর বারুদের গন্ধে তাতানো নিষ্ঠুর লোকটাই তার পোষা বিড়ালটার সামনে এমন আদুরে লোক হয়ে যায়- তাকে আর চেনাই যায় না। স্বার্থপরতার খোলসে বন্দী মানুষটাই হয়ে ওঠে বন্ধুর বিপদে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়া বন্ধু। সিটি বাজানো বখাটে তরুণটার বুকে বাস করে রাজপথের সবচেয়ে সাহসী সৈনিক...
সবকিছুর মধ্যে একটা প্রাণ বেজে ওঠে। সেই প্রাণটিকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে। বিচার নয়, একটা বিবেচনাবোধ হৃদয়ের মধ্যে জন্ম নিতে শুরু করে। সবাইকে বুঝতে ইচ্ছে করে। একটা মানুষকে, একটা পাখিকে, একটা ঘাসকে বুঝতে পারলেও মনটা ভরে ওঠে - এক একটা পৃথিবী তখন সূর্যের আলোর মত বয়ে যায়। ভালবাসার মত। প্রেমের মত। কেউ কারো মত নয়। আবার সবার মতই সবাই। সবার মধ্যে আমি আছি, আমার মধ্যে সবাই। যেমন সব বন্দীত্বের মধ্যেই মুক্তির স্বপ্ন আছে। অত্যাচারের মধ্যে উঁকি দেয় ভালবাসার অঙ্কুর। স্বাধীনতায় বেজে ওঠে পরাধীনতার নিঃশ্বাস।
সেই কবে দেখা একটা কার্টূন চোখে লাফিয়ে ওঠে।
একটা জেলখানার প্রাচীর ডিঙিয়ে মুক্তির সবুজ মাঠে ছুটে চলেছে একজন কয়েদী। স্বাধীনতার আনন্দিত উচ্ছ্বাসে বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে জানে না ... এই যে মাঠ একটু পরে ফুরিয়ে গেলে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে একটা অতল খাদ। একটু পরেই সে আবার পরাধীনতার শেকলে বাঁধা পড়ে নতুন মুক্তির ভাবনায় বিভোর হয়ে উঠবে। একটা জানালা খুজবে। যেখান দিয়ে আলো আসে। বাতাস আসে। মুক্তি আসে। বন্দীত্ব আসে। স্বপ্ন জাগে। আবার। এরপর আবার। আবার।
মন্তব্য
খুব ভালো লাগলো।
আসলে কার ছেলে ? ভালো লাগলো।
নতুন মন্তব্য করুন