আমার একটা পৃথিবী আছে। কিছু মানুষ, কিছু অতীত, কিছু ভবিষ্যতের সাথে আমার একটা যোগ আছে। এই যোগগুলো নিয়েই আমার এই পৃথিবী আমি কোথায় আছি- সেই মানুষ , স্মৃতি, ভবিষ্যত থেকে কত দূরে কিংবা কত দিনের ব্যবধান - এই যোগসূত্রে এটা কোন প্রভাব ফেলে না। দেনা পাওনার হিসেবের বাইরের এই যোগসূত্রগুলোর অস্তিত্ব আমাকে আমার পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করে।
আর সবকিছুর সাথে - তুমিও আমাকে বাঁচিয়ে রাখো।
এই চিঠিটা ছিল ঝুমির জন্য। কিন্তু ঝুমি এই চিঠিটা কখনই পাবে না।
হৃদয় চাকমা। সেই সকালে ওর নৌকা নিয়ে এখানে এসেছি। সকাল থেকে দুপুর নৌকার ছাদে বসে থাকি। ঝুমির দেওয়া সেই পুরনো টুপিটা ছায়া দিচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে পড়ে। আসলে কাছে যাওয়া দূরে আসা কোনটাই ঘটে না। আমরা কেবল মনের ভেতরে একটা দূরত্ব আর একটা নৈকট্য তৈরী করে খেলতে থাকি। যখন আমি ভাবি - তুমি দূরের, তুমি তখন দূরের । আর যখন ভাবি কাছের- তখন তুমি কাছের।
টংঘরের শীতল ছায়ায় এইসব ভাবতে ভাবতে খাবারের ঠোঙার উপরে লাল কালিতে লেখা চিঠিটা আসলে ঝুমিকে উপলক্ষ্য করে আমারই জন্য লেখা।
চোখের সামনে দু এক টুকরো ধানী জমি, তার পরে যতদূর চোখ যায় নলখাগড়ার ঝোপ। তার তল দিয়ে পানির চোরা স্রোত বইছে। তারও ওপাশে দিগন্ত ঢেকে ফেলে একটা পাহাড় - নীল হয়ে আছে। দু এক টুকরো মেঘ তার চুড়ার আশেপাশে কানামাছি খেলছে। পাহাড়টা ভাল করে দেখি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেন জানিনা- একটা শিশুর মুখ ভেসে ওঠে। মনে হয় ওখানে শিশুটা বসে আছে। ও সেখানে খেলা করে। ও সেখানে কান্না করে। ও সেখানে হাসি করে। আহা! ওখানে যদি যাওয়া যেত!
ঘুরতে ঘুরতে খাগড়ার চরে চলে এসেছি । পানির মধ্যে ভেসে থাকা এক টুকরো জমি। আসলে এটা ছিল এক উর্বরা পাহাড়ী উপত্যকা। এবার পানি একটু কম বলে উচুঁ অংশটাই কেবল ভেসে আছে। পায়ের নিচে কুলকুল করে পানি বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব জলের মতোই এই জলের নীচেও মাছেরা বসতি গড়েছে। আগে ছিল মানুষের। বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ, লোকালয়, হাসি, স্বপ্ন, কান্নায় মাথা এই অঞ্চলটুকুও বিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাই বাধ দেয়ার পর পানিতে ডুবে গেছে। তার আগে এইখানেই ছিল বিলাইছড়ি শহরটার মূল অংশ। আর এখন কি পুরুষ্টু নলখাগড়া জন্মে এখানে। বাতাসে সরসর শব্দ তোলে।
‘একসময় বিলাই ছড়ি শহরটা এই জমির উপরে ছিল’- হৃদয় এই কথাটা এই নিয়ে তিনবারের মত বললো। ‘অনেক পুরনো সেটেলমেন্ট। কাপ্তাই বাধ হওয়ার আগের সেটেলমেন্ট। ছয়টা পাড়া ছিল।’
হৃদয়ের চলাফেরায় সবসময় একটা গুটিশুটি ভাব লেগেই থাকে। ভীতু একটা লোক। খালি ভয় পায়। এত ভয় ওর জীবনে। ছোট্ট একটা জীবন। বিলাইছড়ি ব্রীজের মুখে ছ্ট্টো একটা দোকান নিয়ে বউকে নিয়ে বসেছে। ব্রীজটা নামেই, দিব্যি বড়সড় একটা অবকাঠামো কিন্তু আসলে এর কোন অস্তিত্বই নেই। ব্রীজের না এমাথা - না ওমাথা - কোন মাথাতেই কোন রাস্তা নেই। হয়ত হবার কথা আছে কাগজে কলমে - কবে হবে কে জানে। এনজিওর একটা প্রাইমারী স্কুল আছে, পেছনে টিএনও’র কোয়ার্টার, একটা রেষ্ট হাউজ- এই ক’টি বিল্ডিংকে ঘিরে আরও কয়েকটা ঘর - এইটুকুই, জায়গাটার হৃদপিণ্ড। সেখানে হৃদয় তার ছোট্ট দোকান নিয়ে আছে। তার সবসময় ভয় - এই দেশে ছোট্ট একটু জায়গা সে করে নিয়েছে রাষ্ট্র যদি তা কেড়ে নেয়?
কেন কেন? রাষ্ট্র কেড়ে নেবে কেন?
না, বাঙালী বাবুদের যদি মনে হয় এ জায়গাটায় আবার চাকমা পাহাড়িটা কেন বসেছে? এটাতো আমার জায়গা।
বাঙাল চাপরাশিটাও তার বনের বাঘ, পানির কুমির। কথায় কথায় চোখ রাঙ্গানি, চোটপাট আর হুমকির ঘোরপ্যাচে সে চুপ করে বসে আছে। পাহাড়ের মতো।
আমিও পাহাড়ের মত নীরবে শুনে যাই।
দূরে পাহাড়ের কোণটা হটাৎ ঝাপসা হয়ে আসে। বৃষ্টি নামছে হৃদয়দা- আমি বলি।
হৃদয় মাথা দোলায়।
আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। বৃষ্টি আসার শব্দটা শোনার চেষ্টা করি। শব্দ শুনে মনে হয় চলে আসছে। নাকি বাতাসের শব্দ। তখনই বৃষ্টির প্রথম ফোটাটা পড়ল। আমি ঝাকি দিয়ে উঠি। পাহাড়ী বৃষ্টি। নৌকায় ফিরে যেতেই বৃষ্টি শেষ।
: ত্রিশ বছর আগে এখানে একটা খিয়াং ছিল - হৃদয় বলে।
নৌকার ভেতরে বোতলভর্তি পাহাড়ী মদ চোখে ঝাপটা মারে। আমি হৃদয়ের থেকে বোতলটা নিয়ে গলায় ঢালি। এই দুপুর বেলায় পাগলা নিশিরাত ভর করে। মাতাল গলায় বাতাস ঘুরপাক খায়।
ত্রিশ বছর আগে
একটা খিয়াঙ ছিল এখন লেকের তলে...
হরারারাহো .... হো হো হো একটা কিয়াঙ ছিল-
একটা লাল রঙের ফরিঙ জলে ছায়া ফেলে ফরফর করে বাতাসে পাক খেতে থাকে। সূর্যটা তখন ডুবতে বসেছে। বৌদ্ধসূত্র পাঠ ভেসে আসে। শ্রমনের গলায় কোন গম্ভীর ধ্বনি বাজে না, মাইকের ফ্যাড় ফ্যাড় আওয়াজ মিশে থাকে সেখানে। আমি হৃদয়ের দিকে তাকাই, মাইক নাকি?- জিজ্ঞাসা করি।
: হ্যা
: মাইক কেন?
: সবাই যেন শুনতে পায়।
শহরের মসজিদগুলোর কথা মনে পড়ে। বেশিরভাগ মসজিদের নিচে জমজমাট ব্যবসা গড়ে উঠেছে। সোনা থেকে শুরু করে হাউকাউ সিডি পর্যন্ত কি না পাওয়া যায়। ছোট চাচার কথা মনে পড়ে। সে মসজিদে যায়না। এমনকি ঈদের দিনেও। এক ধার্মিক বন্ধু তাকে এই নিয়ে অুনযোগ করতে তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন
‘ধর্ম আসলে মসজিদে নাই। ওখানে আছে কমিটি। রাজনীতির লোক। ধর্ম আছে আমার মায়ের মধ্যে। চতুর্দিকে যা দেখছি আমার জীবনে অবশ্যই বলতে হবে ধর্ম ব্যর্থ। ধর্মতো প্রেম। কোথায় প্রেম? প্রতিষ্ঠানে ধর্ম নাই। ব্যবসা আর ব্যবসা। পবিত্রতার জায়গা কই? ধর্ম পরিবারে আছে - আমার বাবার মধ্যে আছে, মায়ের মধ্যে আছে।’
ন্ধদয় নৌকা ছেড়ে দেয়। জলের উপর কোণাকুনি একটা দাগ তুলে নৌকা চলতে শুরু করে। আকাশে সূর্যাস্তের রঙ মাখানো উৎসবে কালি মেখে দিয়েছে মেঘ। তবু তার ফাক গলে আবির রঙে আর সোনা রঙে আকাশটার তন্বী শরীরটা যে কেমন মাখামাখি তা বেশ বোঝা যায়। নৌকার একটানা ভটভট শব্দে চারদিকটা আরো চেপে এসেছে। বৌদ্ধ সূত্র পাঠের শব্দ এখনও শোনা যায়। আমি সামনে তাকাই। নলখাগড়ার মাথাগুলো অনেক উচুঁতে, আন্ধকার নামা রাত্রির গায়ে আরো নিকষ কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভুল করে সারি সারি সৈন্যের উদ্ধত বর্ষার ফলার মত মনে হয়। তার পায়ের কাছে বিজেতা নদীটা আনত হয়ে আলুলোয়ায়িত বেশে পড়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রের মত।
এর মধ্য দিয়ে নৌকা চলতে থাকে। হৃদয় আবার কথা বলা শুরু করে।
: আমার বাবা, এই পানির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্ধ হয়ে গেল।
: মানে? - আমি অবাক হই।
: এই খানেতো আমাদের সবকিছূ ছিল। পানির তলে সবকিছু তলিয়ে গেল যে। এরপর থেকে সবসময় পানির দিকে তাকিয়ে থাকতো। শেষ পর্যন্ত অন্ধই হয়ে গেল। এখন এই অন্ধ চোখেও পানির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ন্ধদয় এইটুকু বলে চুপ করে যায়। একমনে নৌকা চালাতে থাকে। আমরা ফিরে আসি। হৃদয়ের দোকানে বসি। ওর বৌ রাতের রান্নার আয়োজনের ফাকে চা দিয়ে যায়। কয়েকটা চাকমা ছেলে বুড়ো গুটিশুটি মেরে থাকে। নিজেদের মধ্যে কিসব বলে। কান পাতলে শোনা যায়। বোঝা যায় না। একটা শিক্ষিত চেহারার চাকমা যুবক চা খাচ্ছে। যেচে পড়ে আলাপ জমাই। সঞ্জয় চাকমা। এন জি ও’র হেলথ প্রোগ্রামে কাজ করে। চেহারায় একটা বিষন্নতা ঝুলে আছে।
: আমি একসময় আপনাদের ওখানে ছিলাম কিছুদিন।
: চলে এলেন যে?
: অনেক কষ্ট।
: কোথায় না? আমি হাসি। আমার কথায় সে কান দেয় না।
: শহরে একটা লাইব্রেরী ছিল। সুযোগ পেলেই ওখানে যেতাম। অনেক বই পড়েছি সেখানে।
: তাই। এখানে বই পান? আসে এখানে বই?
: এখন আর পড়া হয় না- ছেড়ে দিয়েছি বলতে পারেন।
: কেন?
: আগ্রাসন বলে একটা ব্যাপার আছে।
: আগ্রাসন- আমি চোখ কুঁচকাই। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢোকে না।
: মায়ের ভাষার জন্য একটা চেতনা, এটা কি আমি আগে অনুভব করতে পারতাম? পারতাম না। বই পরেইতো এসব মনে হলো। আগে তো এত কষ্ট হত না।
: আপনি আপনার ভাষায় লেখেন। আমি বলি
: আমি আমার মাতৃভাষা জানি না। এর জন্যতো আমি দায়ী না। আমিতো সংখ্যালঘু। কোথাও আমি নাই। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি চারদিকে তাকাই। কে আমার মাথা ঠিক করে দেবে? তাকে তো দেখি না।
অন্ধকারে একটা যান্ত্রিক শব্দ করাতের মত নৈঃশব্দের বন তছনছ করে দিয়ে যায়। শব্দেই বোঝা যায় - একটা আর্মি বোট যাচ্ছে। রাত নামলে আর্মির ছাড়া কোন সাধারন নৌকো সাধারণত এখানে চলে না।
: এই যে এত আয়োজন , কেন বলতে পারেন। এখন তথ্য দিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে, বিদ্যা দিয়ে লড়াই হচ্ছে, আবিস্কার দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব আনছে- এই সেকেলে যুদ্ধের আয়োজন এখনও কেন বলতে পারেন? এই পাহাড়তো কেউ নিয়ে যাবে না। এই পাহাড়তো পাহাড়ের জায়গাতেই থাকবে। তাহলে এই পাহাড়ে যে আয়োজন করা হলো তার এক শতাংশ যদি মানুষের পেছনে করা হতো এই পাহাড় অন্য রকম হতো। আরও গাছ হতো।সম্পদ হতো। আমরা হতভাগারাতো আগেও ছিলাম এখনও তাই আছি- আর তা থাকবোও। তা না হলে, নিজের ভূমিতে কেউ বলে - কেন তোমরা এখানে কেন?
সঞ্জয় হাসে। হারিকেনের আলোয় তাকে হলুদ দেখায় ।
: সেই জন্যই বলি আমার অনুভূতিগুলো মরে যাক। দুঃখটা আরও বাড়–ক, এটা চাই না।
আমি বুঝতে পারি না এই কথার উত্তরে ঠিক কী বলতে হবে। একটু অস্বস্তি হয়। লোকটা কি আমাকে দায়ী করছে?
: কী চান?- বোকার মত বলে ফেলি।
সঞ্জয় আমার জিজ্ঞাসায় কান দেয় না। কিংবা দেয় - বুঝি না।
: আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আমিও বৃষ্টিতে ভিজি।
আমি হাসি। কিছু বলি না। বৃষ্টিটা আমাদের আরও কাছে এনে দেয়।
সঞ্জয় সাজিয়ে গুছিয়ে কয়েকটা শব্দ বলে। কথা না কবিতা ঠিক বুঝতে পারি না।
আমি জানি সেই চর বসে গেছে
সেই চরে আর নদী জাগবে না।
সেই নদীতে আর পাল তোলা নৌকা ভাসবে না।
আমি তার মুখের দিকে তাকাই। নিষ্কম্প, ভাবলেষহীন, নির্বাক পাথরের মতো চেহারা। শুধু মুখে একটা খুবই আবছা মৃদু হাসি - আমি ভাল করে দেখি- হাসিটা তাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে।
: চণ্ডি দাশ পড়েছিলাম। নৌকার মাঝিকে কবি প্রশ্ন করেছিলেন, কী চাস! মাঝি বলেছিল - আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।এইতো চাওয়া। এর বেশি কেউ কি চেয়েছে কখনও।
সঞ্জয় একটু সহজ সুরে বলে ওঠে-
: তার থেকে আর বেশি কি, এইটুকুই চাই।
সঞ্জয়ের কথার মধ্যে মনীষদার বাশির সুর ভেসে আসে। আমি দৃশ্যটা এখনও চোখে দেখতে পাই।
মনীষদা বাশি বাজাচ্ছেন। একটা ঘোরের মধ্যে তার আঙ্গুলগুলো বাশির খাজে খাজে নাচতে থাকে। হঠাৎ বাশি থেমে গেলে আমরা চমকে উঠে দেখি মনীষদা বিভ্রান্তের মতো বসে আছেন। চোখ দুটি যেন কোথায় কোন এক অলীক দৃশ্য অবলোকন করে। আমরা তারদিকে চেয়ে থাকি। কী দেখে, কে জানে তিনি ফিসফিস করে বলে উঠেন - আমি এক অতৃপ্ত পাহাড়ী আত্মা। আমরা কিছু বুঝি - কিছু বুঝি না।
মনীষদা জাতিতে চাকমা। পাহাড়ী। পড়াশোনা করে শিক্ষিত হবার জন্য আমাদের শহরে এসেছিলেন। চাকমা বলে অনেকেই তাকে নিচু চোখে দেখতো। কিন্তু এরপরও আমরা কেউ কেউ তাকে ভালবাসতাম। কারণ তিনি বাশি বাজাতে পারতেন। তার বাশির সুরে পাহাড়ের মৃদু সুবাস ভেসে আসতো। আমরা যারা পাহাড় ভালবাসতাম তার কাছে গিয়ে বসে থাকতাম। রাত যত গভীর হত তার বাশি থেকে কান্না ভেসে আসতো। মনীষদা বলতেন এগুলো নাকি তাদের হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ী আত্মার বর্ণমালার কান্না।
সেই অনেক অনেক আগে পাহাড়ের কোলে তাদের সবার মধ্যে এই বর্ণমালা বেঁচে ছিল। সেই বর্ণমালাকে ঘিরে ওরা হাসি আনন্দে কান্নায় ভালই ছিল। দিনের পরে দিন যায়। পাহাড়ের সৌন্দর্য্যে একজন দু’জন করে সমতলের মানুষেরা আসে। ওরা পাহাড় চেনে। পাহাড়ের গল্প শোনে। নিজেরা পাহাড়ের গল্প বলে। নিজেরা পাহাড়ের গল্প হয়। তাদের আর পাহাড়ী সবার কাছে সেসব দিন ছিল কি সুখের। আহা!
তারও পর আরো দিনের পরে আরো দিন যায়। সমতলের মানুষরা আসছে তো আসছেই।*১ কিন্তু তখন আর একজন দু’জন নয়। দলে দলে। হাজারে হাজারে। তারা আর পাহাড়ের ভাষা চেনে না। নিজেরা পাহাড়ের অংশ হয় না। পাহাড়কে চোখ রাঙায়, বলে- তোমরা আমরা হও। আমাদের ভাষায় স্বপ্ন দেখ। পাহাড় কী করে সমতলের স্বপ্ন দেখবে? পাহাড়ের কোলে কোলে কান্নার আগুন জ্বেলে কোথায় কোথায় তার বর্ণমালাকে লুকিয়ে রাখে। শুধু দূর থেকে তার এই কান্না শোনা যায়। মনের মধ্যে ৫২ ভেসে ওঠে। ভাষার জন্য লড়াই। ৫২ এখনও শেষ হয় নি। আসলে লড়াই কখনও শেষ হয় না। নতুন নতুন রূপে চলতেই থাকে।
সেই একই কষ্টের বর্ণমালার কথা। আমি কথা ঘুরানোর জন্যই বলে উঠি -
: বাচ্চা আছে আপনার?
: হ্যা, ফুটফুটে পুতুলের মতো একটা মেয়ে আছে আমার। নাম কী জানেন?
: কী?
: ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা।
আমি চমকে উঠি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা মনে পড়ল। ঐ নামে একটা দেশ ছিল, এখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে দেশটি উধাও হয়ে গেছে। আকাশে প্রথম পাড়ি দিয়েছিল যেই মেয়েটা, সে ছিল ঐ দেশের মেয়ে। আমি নামটা উচ্চারণ করি।
: ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা!
আমার মনে পড়ে সেই কবে নামটা শুনেছিলাম। ছোট্টবেলায়। ক্লাশ ফোর কি ফাইভে - কোন বইয়ের পাতায় হাতে আঁকা ভেলেন্টিনা তেরেসকোভার একটা ছবি। নভোচারীর পোষাকে হাসছে। সঞ্জয় বলেই চলে-
: এই নামটা রেখেছি যেন বড় হয়ে অন্তত এই নামটার মানে জানবে।
ওর মনের আকাশটা তাতে যদি একটু বড় হয়।
মেয়েকে ঘিরে ও স্বপ্ন বাচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেই স্বপ্নের মধ্যেও ওর কষ্ট তিরতির করে কাঁপে।
সঞ্জয় আসবার আগে বললো - আসবেন। আমি বললাম - আসবো। দুজনেই জানি কথাটা মিথ্যে। দুজনেই জানি ঐ মুহূর্তে কথাটা - আসলে সত্যি।
আবার নৌকা। আমি জলের উপরে মুখ রাখি। নদীর জল না। হ্রদের জল। হ্রদটা প্রকৃতির তৈরী না। হ্রদটা মানুষের তৈরী। তাতে কি? জলের মতই মানুষেরও স্থিরতা নেই। আমি অন্য কিছু ভাবি না। জলের ভেতরে একটা মাছ দেখার জন্য মুখ ডুবিয়ে থাকি। কিন্তু কোথাও মাছটার কোন চিহ্ন নেই। শুধু একরাশ জেলে নৌকা মাছটার অপেক্ষায় মৃদু দুলতে থাকে। হটাৎ একটা দৃশ্য দেখে আটকে যাই। একটা মাছ। মাছের মুখটা অবিকল হৃদয়ের মত, শুধু বয়সটা একটু বেশি। হৃদয়ের বাবা. বুঝতে পারি। মায়ের কথা মনে পড়ে। মা একবার জোঁনাকীপোকা হয়ে এসেছিলেন। আর হৃদয়ের বাবা মাছ হয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন জলের তলায়।
জলের নিচটা একেবারে অন্যরকম একটা জগৎ। জলের উপরে যে ঢেউ নাচে, নীচে তার কোন ছোঁয়াই নেই। শীতল পাটির মত শান্ত নিবিড় সবকিছু। সূর্যের রশ্মিটুকু যতটুকু পৌছায় জলের রঙ ততটুকু শ্যাওলা সবুজ। মাছটা তির তির করে এগিয়ে যেতে থাকে। লেজ নাড়িয়ে জলের আরো গভীরে ডুব দেয়। কি যেন খুঁজছে সে। ‘একটা সবুজ মাঠ ছিল, ঠিক এখানে’- মাছটা মানুষের গলায় বলে ওঠে। ‘ছোট থাকতে এই মাঠটায় অনেক খেলেছি। মাঠের পাশে পাহাড়েরর কোলে কয়েকটা বুনো ফুল গাছ ছিল। খুব ফুল ফুটতো সেখানে। আহা! কি আশ্চর্য্য রঙ তাদের! ’ বলতে বলতে মাছটা ঘুরপাক খায়। একেবেকে পানির তলায় উচু নিচু পাহাড়ী বাকগুলো দিয়ে ঘুরতে থাকে সে। কোত্থেকে পাখনা নাড়িয়ে হাজির হয় কয়েকটা রঙীন মাছ। লাল, নীল, বেগুনি, কমলা রঙা মাছগুলো একটা বিরাট পাথরের কোল ঘেষে লুকোচুরি খেলতে থাকে। হৃদয়ের বাবাকে দেখে তাদের একজন বুড়বুড়ি কাটে।
সাথে সাথে হৃদয়ের বাবা মাছটা তাদের সাথে খেলতে শুরু করে। পাক খেয়ে পাথরের আড়ালে চলে যায়। আর দেখা যায় না। একটু পরে পাথরের আড়াল থেকে আশ্চর্য্য ভোজবাজীর মত হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে বারো বছরের এক কিশোর। চেহারা দেখে বুঝতে পারি - হৃদয়ের বাবাই হবে নিশ্চয়। মাছের খোলশ থেকে ছোট্টবেলার সেই কিশোর ছেলেটা বের হয়ে এসেছে। সে দৌড়াতে শুরু করে। যেন পায়ের নিচে জল নয়, সবুজ একটা মাঠ। দৌড়াতে দৌড়াতে সে এক জায়গায় এসে থমকে দাড়ায়। একটা পাহাড় তার পথ আটকে দাড়িয়ে আছে। পাহাড়টাকে এক নজর তাকিয়ে দেখে, তারপর তরতর করে পাহাড় বেয়ে সে উপরে উঠতে শুরু করে। আমি যেন আর নৌকায় নেই। ঐ কিশোর বালকের মধ্যে ঢুকে গেছি। আশ্চর্য্য। মাথার উপরে সুনীল আকাশ। মেঘের রাজ্যে পাখা ঝাপটে বার্গী পাখির দল ঝাক বেধে উড়ে যাচ্ছে। ওরা যে কোথা থেকে উড়ে আসে কে জানে। অবাক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি।
বার্গি পাখির মতো আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে। আকাশ আড়াল করা পাহাড়ের ওপাশে একবার গিয়ে দেখে আসি সেখানে কী আছে। নিজেকে বার্গী পাখি ভেবেই ডানা মেলি। কিন্তু ওড়া হয় না। ডানার বদলে সেখানে মাছের পাখনা তিরতির করে কাঁপে। ঢেউ এর পরে ঢেউ। ঢেউ ভেঙে ভেঙে উঠে আসি বর্তমানের সন্ধ্যার আধো আলো অন্ধকারে। মাছ ধরা নৌকার বাতিগুলো এক এক করে জ্বলে উঠছে। নীলচে হলুদ আলোয় চকচকে মুখগুলো ভেসে ওঠে। আমি আবার আমার মধ্যে ফিরে আসি। তাকিয়ে দেখি হৃদয়ের বাবার শরীর থেকে স্মৃতি কাতরতার জল ঝরছে। তার জীবন নিংড়ানো ফোটা ফোটা সেই জলের লোভে একটা হাঙর এসে হাজির হয়েছে। হৃদয়ের বাবার চোখে ভয় জেগে ওঠে। অথবা কষ্ট। একটা ঢোক গিলে সমস্ত কষ্টটুকু হজম করে নিতে চান তিনি। তার এই বৃদ্ধ শরীরে সময়ের হাঙরকে আটকানোর শক্তি অবশিষ্ট নেই। কেবল অক্ষম প্রতিহিংসায় হাঙরের দিকে জ্বলন্ত ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে দেন তিনি। সাথে সাথে দেখি হাঙরের মুখ পাল্টে গিয়ে সেখানে ফুটে ওঠেছে রজব আলী, কোরবান, নুর আলী, আক্কাস শেখ, নিবারন পোদ্দার, রুস্তম আরো কত চকচকে হাভাতে মুখ। বাস্তুহারা ক্ষুধার্ত সব মুখ। ওদের দেখে চিনতে পারি। এই কয়দিনে পাহাড়ে ওদের সাথে দেখা হয়েছে কয়েকবারই। মনীষদার কথা ভেসে আসে।
দেশটাতো সবারই। যে যেখানে যেতে চায় যেতেই পারে। কিন্তু এটাতো স্বাভাবিক আসা নয়। যাদের শেকড় ছিল না, যারা শেকড় বোঝে না - যাদের কোনকিছু নেই, লোভ দেখিয়ে তাদের ভাসিয়ে এনে এনে এখানে ফেলে দেয়া হয়েছে। ওদের বলে দিয়েছে - এই পাহাড়, এটা তোমার। ওরা শেকড় তৈরী করে নি, ওরা পাহাড়ের সাথে মিশে যায় নি। ওরা পাহাড়টাকে শূধু গ্রাস করতে চেয়েছে। এজন্যই আজ পাহাড় কাপছে। ওদের আর কি দোষ। ওরাতো আসলে অপরাধ করেনি। জ্ঞানী মানুষরাই অপরাধ তৈরী করে।
স্মৃতির মনীষদার মুখে হৃদয়ের বাবার ছায়া পড়ে। আমি কোন কথা বলি না। অপেক্ষা করি। কিসের জন্য অপেক্ষা, সেটা না জেনেই অপেক্ষা করি। অপেক্ষার এই মূহূতর্গুলো এত অনন্ত মনে হয় যে, যেন পৃথিবী তার ইতিহাসের সমস্ত পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে আটকে গেছে। কলম্বাসের কথা মনে হয়। আমে আর আমিতোর কথা মনে হয়। সেই একই গল্প। মনীষদা হঠাৎই মুখ তোলেন,
: আচ্ছা, আমি একটা স্বপ্ন দেখতে চাচ্ছি। আমি এই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবো।
বলতে পারো - এই স্বপ্নটা কি সত্যি সত্যি আমি দেখতে পারি?
মনীষদার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভার কথা মনে হয়। মায়া মায়া। ছোট্ট মেয়েটার না দেখা মুখ মনে পড়ে। ও একদিন বড় হয়ে তার বাবার দেয়া নামের ইতিহাস খুঁজবে। এই মধ্য দিয়ে আগামী বেড়ে উঠবে। স্বপ্নের মত। হয়তো সেখানে মনীষদার উত্তর লেখা থাকবে। সেই উত্তরের মধ্যে মিশে থাকবে অতীত। এগুলো ভাবতে আমার ভাল লাগে। একটা বাতাস ভেসে আসে এইসব ভাবনার মধ্যে। বৃষ্টির কণা মিশে থাকে তাতে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।
রাতভর বৃষ্টি নেমেছিল দূরে..
অথবা নামে নি কোথাও ..
আমি জানালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্ন ভেঙে যেতেই একাকীত্বের কষ্ট জেঁকে বসে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়? লক্ষ্যবিহীন, আশাবিহীন, স্বপ্নবিহীন। বিভ্রান্তির মাকড়সা মাথার মধ্যে ঝুল বুনতে থাকে। সবকিছুতে কুয়াশা ছড়ায়। আমিও নিজেকে সেই কুয়াশায় হারিয়ে ফেলি। কুয়াশায় ডুবে যাওয়ার এই বিভ্রান্তির শুরু যেন আমার জন্ম থেকেই। নিয়তির মতন।
স্কুলে থাকতে মেট্রিক পরীক্ষার আগে ফর্ম পূরণ করতে হয়। ওখানে জন্মতারিখ বসানোর সময় স্যাররাই জন্মতারিখ সাল এমনভাবে দিয়ে দেন যে সবচেয়ে কম বয়সে মেট্রিকটা দিয়ে দেয়া যায়। তাতে চাকরীর জন্য বয়সের যে ব্যাপার থাকে সেখানে এক বা দুই বছরের সুবিধা পাওয়া যাবে। সেই ফরম পূরণের দিনটায় কী একটা ডামাডোলের মত অবস্থা। সেই ডামাডোলের মধ্যেই অন্য একটা তারিখে আমার জন্ম হয়ে যায়। এখন আমার জন্ম কবে? সার্টিফিকেটের তারিখটা নাকি যেদিন আমি আমার জন্ম বলে জানি সেটা? সভ্যতার এই পৃথিবী দলিলে বিশ্বাস করে। সেই হিসেবে পৃথিবী যা আমাকে জানে, আমি জানি- তা মিথ্যা। আমি যা জানি পৃথিবী জানে - তা মিথ্যা।
আমি একসাথে দুটো মিথ্যা আর দুটো সত্য নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
আমি যেখানে ঘুরে বেড়াই সেই জায়গাটাও আমার নিজের মতই বিভ্রান্তিময়।
আনুভাই স্মৃতি থেকে উঁকি মারে।
আনুভাই এমনিতে কর্পোরেট অফিসে চাকরী করেন। কিন্তু কর্পোরেট ফিটফাট বাবুদের মত নন। কর্পোরেট দুনিয়ার কেক পেস্ট্রির মত ক্রিম মাখানো থরে থরে কেতাদুরস্ত মানুষদের মাঝখানে তাকে মনে হয় সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিতে একজন গ্রাম থেকে উঠে আসা কালচেহারার চাষাভূষো মানুষ। আপনি তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই সময়ে চলে যাবেন - চাষা তখনও গালি হয় নি, চাষারা তখনও আমাদের বাপ দাদার দল। আপনার মনে পড়বে ভাসানীর চেহারা। আপনার চোখে ভেসে উঠবে শেখ মুজির সোফায় পা তুলে ফিদেল ক্যাষ্ট্রোর পাসে বসে আছেন - হাস্যোজ্বল একটা ছবি। তারা যেন ইতিহাসের স্মৃতি থেকে আনুভাই এর উপর ভর করে কর্পোরেট চেহারার সাহেব সুতরো সবাইকে খুচিয়ে যাচ্ছেন
‘আচ্ছা এই যে -তুই , তুইই ক - বাংলাদেশের জন্ম কবে - ক ..’
সবাই আচমকা একটা ভাবনার মধ্যে পড়ে তখন। খালি রতন গিটার নিয়ে টুংটাং বাজিয়ে যায়। ও একটা এ্যালবাম বের করবে। সারক্ষণ সে আছে - তার পৃথিবীতে।
‘এই মাসুদ কও’। মাসুদ চুপ। মনু আমতা আমতা করে উঠবে, সুজা নখ খুটতে থাকবে, নিপ্পন কোন তারিখটা বলবে বুঝতে পারবে না, চন্দন প্রথমে বলার ঝুকিটা নিতে চায় না। তারু ভাই অবধারিতভাবে যা মনে আসে তাই দিয়ে শুরু করবে - ‘কত ১৬ তারিখ। ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস - ঐ দিনে বাংলাদেশের জন্ম?’। ‘না, না...’ - পিপলু চেঁচিয়ে ওঠে - ‘২৬ মার্চ, নাকি ২৭..’. সে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। মুশফিক সুর তোলে - ‘১৭ ই এপ্রিল- রাষ্ট্র বিজ্ঞান বইতে লেখা আছে সরকার ছাড়া রাষ্ট্র হয় না- সেই হিসেবে ১৭ তারিখেই দেশের জন্ম ...’। ‘৭ই মার্চ’ -তারেক গম্ভীর স্বরে বলে । অদ্ভুত কাণ্ড। ঠিক কেউই নিশ্চিত হতে পারে না বাংলাদেশের জন্মটা কবে। রিপনটা মৃদু স্বরে বলে- ‘আপনে কন ...’। ও এরকমই, সবকিছুই অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ লোক।
‘আমি কমু ক্যান? আমি প্রশ্ন করছি। তোমরা উত্তর দিবা’ - আনুভাই মুখ টিপে টিপে হাসে। শিপলুর সিগারেটের প্যাকেটটা টেবিলে পড়ে ছিল। আলমগীর প্যাকেটটা তুলে নিয়ে দেখে - মাত্র একটাই অবশিষ্ট আছে। অলস ঢঙে ম্যাচের কাঠিটায় আগুন ধরিয়ে সিগারেটটা জ্বালায় সে। আয়েশ করে অনেকক্ষণ ধরে একটা টান দিয়ে বুক পর্যন্ত ধোঁয়া নিয়ে ভুস করে ছেড়ে দিয়ে খুব সিরিয়াস ঢঙে বলে-
‘আচ্ছা বলতো, আমাদের জাতীয় ফুলে গন্ধ নাই কেন?’
‘এ জন্যই কি এটা আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, খাওয়া যায় বলে?’- ফোড়ন কাটে টিটু।
এলোমেলো কথার সাথে তাল মিলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় চারদিক সাদাটে অন্ধকার হয়ে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য।
সেই সাদাটে অন্ধকার আমাদের ঘিরে থাকে।
হটাৎ বিমানের শব্দ ভেসে আসে। প্রচণ্ড শব্দ। কানে তালা লেগে যায়। যুদ্ধ বিমান হবে সম্ভবত - ওরাই এত শব্দ করে উড়ে। আওয়াজটার তীব্রতার মধ্যেই প্রচণ্ড একটা শক্তি টের পাওয়া যায়। দেশ টিকে থাকার জন্য এই শক্তি। কিন্তু যেই দেশে জনগণ নিজেই দূর্বল, একটা নিষ্পেষিত হতাশার প্রতিবিম্ব - শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে সেই দেশটা টিকে থাকতে পারবে? শুধু যন্ত্রতো আর যুদ্ধ করতে পারবে না। তার পেছনে মানুষ চাই। কোন দেশ যদি তার মানুষকে অন্ন দিতে না পারে, সুস্বাস্থ্য দিতে না পারে, শিক্ষা দিতে না পারে, সন্মান দিতে না পারে, স্বপ্ন দিতে না পারে, দেশের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা দিতে না পারে তাহলে সেই মানুষ কি - সেই দেশকে ভালবাসতে পারবে? পাড়ার বাহাউদ্দিন ভাই একবার অনুযোগ করছিল, শুধু বেঁচে থাকার জন্যই সবকিছু এত কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে দেশটাকে আর ভালবাসতে পারছি না। বিজ্ঞাপনের জ্বলজ্বলে পণ্যগুলো আর সৈন্যবাহিনীই শুধু দেশকে ভালবাসে। কিন্তু শুধু সুশৃঙ্খল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী কী পারে দেশকে মুক্ত রাখতে? তাই যদি পারতো তাহলে ৭১ কী? পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রবলে তো অনেকগুনে শক্তিশালী ছিল। ওরাতো পারলো না। এটাতো ঘটা ঘটনাই। দেখা ঘটনা। তাহলে কী করে একই ঘটনা ঘটতে থাকে?
মায়ের শব্দগুলো মনে পড়ে আবার। সেই কথাগুলো।
: এই যে যুদ্ধ - কখনও যুদ্ধ ভুলে যাব না। যুদ্ধকে ভুলে যেতে হয় না।
যুদ্ধ ভুলে গেলে কেন যুদ্ধ হয় এটা আমরা ভুলে যাব। তখন বারবার যুদ্ধের কারণ ফিরে আসবে।
বারবার যুদ্ধ শুরু হবে। যুদ্ধ থামবে তারপর আবার শুরু হবে - তারপর আবার- আবার বারবার ...
মাথার মধ্যে একটা জোনাকি জ্বলে নিভে জ্বলে নিভে যায়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টুপ করে বের হয়ে পড়ে।
আনুভাই আবার শুরু করেন।
আমগো হিস্টরী ক্যামুন ছোট হয়্যা গ্যাছে- এই যে সাওতাল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ,- কয়বছর আগের কাহিনী মিঞা .. এখনও খুজলে ঐ সময় বাইচ্যা থাকা লোক খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু মনে হয়না কত হাজার বছরের কাহিনী।
একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে খুব। টিভিতে দেখেছিলাম, কবে যে- সেই কোন ছোট্টকালে সেটা মনে নেই। শুধূ দৃশ্য আর ধ্বনিটা এখনও কানে আর চোখে লাফিয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনী পরাজয় মেনে তার থাবা গুটিয়ে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে ট্রাক বোঝাই হয়ে ছুটে আসছে- নিজের মাটিতে। হাতের রাইফেল - পতাকার মত আকাশে উড়ছে। চলমান ছবির সাথে সাথে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান বেজে চলেছে। গানের তিনটি শব্দই শুধু মাথার মধ্যে গুণগুণ করে বেজ চলে। আয় আয়... বন্যার বেগে আয়...।'- ওরা আসছে। আনন্দে মাতাল হয়ে। উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখগুলোতে নিষ্পাপ আনন্দের ছটা। মনের মধ্যে যতবার ওদের ছবি ভাসে কেন জানি এখনকার কথা মনে হয়। আশ্চর্য্য একটা কষ্ট মগজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হু হু কান্না আসে। জীবনকে উৎসর্গ করে ছিনিয়ে আনা ওদের মুখের হাসিটাকে খুব প্রতারিত মনে হয়। মানুষ। আমার মানুষ - ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিভিত্তিক। নদীমার্তৃক এই দেশ, মাটি, জল, মাছ আর সে।
এই ৮০ ভাগ মানুষ ঘুমায় জাগে। আবার ঘুমানোর আগ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। এই তো ওর কাজ। কী করবে সে?
যারা এই দেশ চালায়- প্রতি মূহূর্তেই বুঝতে পারি যাদের হাতে ক্ষমতা, সবসময় বলছে- জনগণই আমাদের শক্তি। আদৌ কী তাই? জনগন যদি শক্তি হয় তাহলে জনগণ জীবন জীবিকার শক্তি। সতি সত্যি কী তা?
শুধুমাত্র যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দূর্ভিক্ষ পীড়িত দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথায় মুধুমাত্র নিজের শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ এমন দাসত্ব করে?
আজফার ভাইয়ের পাগলামোটা খুব সুন্দর মনে হয়। গুড়ো গুড়ো করে ফেলতে ইচ্ছে করে - ভদ্রতা, সভ্যতা, ভব্যতা সবকিছু। সৌধ, অঙ্গীকার, আলিঙ্গন সব। প্রকৃতির ধর্মতো এই, প্রয়োজন আইন মানে না। যখন ৮০ ভাগ মানুষের প্রয়োজন মেটে না- কী করবে সে?
অন্ধকার । অন্ধকার। এই অন্ধকারটা ভাল লাগে না। অন্ধকারের মত। ভয় লাগে। অন্ধকারে মাকে আঁকড়ে ধরি। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যেতে চাই।
জ্যোৎস্নারাতে পৃথিবীর বুকে পরীরা নেমে আসে, তোমার মত মিষ্টি চেহারার ছোট্ট বাবুসোনাদের ওরা উড়িয়ে তারাদের দেশে নিয়ে যায়। ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা বলেন।
ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। মনে হত এই বুঝি ডানা মেলা পরী এসে মায়ের বুক থেকে ছোঁ মেরে আমাকে নিয়ে যাবে। অনেকক্ষন মায়ের বুকের ওমের ভেতরে থেকে তবে সাহস ফিরে আসে। মায়ের বুকের মধ্যে আরো ঘন হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করি,
: তারার দেশটা কোথায় মা?
: আকাশে, মায়ের গলা এত আদরমাখা!
: কেমন দেশ ওটা মা? বাবুসোনা মাকে আরো জড়িয়ে ধরে বলে।
: ওটা একটা আলোর দেশ , মার গলায় স্বপ্ন মাখা থাকে।
: আমাদের দেশের মত?...
মায়ের উত্তর শোনার আগেই ছোট্ট বাবুসোনা ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ের উত্তর শোনা হয় না।
মায়ের উত্তরটা অন্ধকার হয়ে এখন ফিরে আসে।
শূন্য মনে হয় সবকিছু।
প্রাপ্তিবিহীন আমার যত শূন্যতা চারপাশের শূন্যতার সাথে মিলে ঢেউ তোলে। সবকিছু থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধ হয়। জীবনানন্দের মত। লাশকাটা ঘরের ঠান্ডা বাতাস শরীর জুড়ে একটু পরপর বয়ে যায়। ঝুমির কথা মনে পড়ে। ফ্রিদার কথা মনে হয়। দেশটার কথা মনে আসে। আমার কথা মনে হয়। খুব কষ্ট লাগে। আমি চোখ তুলে সামনে তাকাই। মৃত্যু সেখানে জীবনের জন্য একটা প্রকান্ড - ‘না’ ঝুলিয়ে বসে থাকে। জীবনের ধ্যান ভাঙানো শয়তান অথবা দেবতার মত লাগে ওর মুখটা।
মন্তব্য
আপনার লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়লাম। আমার ধারনা মতে পৃথক দুটি পোস্ট হতে পারতো। 'পাহাড়ের কান্না' বা 'পাহাড়িদের মর্ম যাতনা' বিষয়েই একটি সম্পূর্ণ পোস্ট হতে পারতো। গুরুত্বও বহন করতো বটে। পোস্টের আকারও অনেকক সময় মানুষকে নিরুৎসাহিত করে। ।
লেখার ভাব ও ভাষা চমৎকার। হৃদয়ের গভীরে অনুরনন তৈরি করে। খুব, খুব ভালো লেগেছে।
চমৎকার একটি লেখা, মনকে নাড়িয়ে দেয়, জাগিয়ে দেয়, আবিস্ট করে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন