: ...তারপরে?
: ঐ বৃদ্ধলোকটা জীবনের শেষ সায়াহ্নে এসে বলে ওঠে, নারে- কিছু একটা করতে হবে।
: তখন কি আর সময় আছে।
: সময়! কখনই ফুরোয় না সে।
: তা ফুরোয় না।
: কিন্তু সে যে বুঝতে পারলো না রসের কাছে জীবনের তাড়া মূল্যহীন। কেউ যখন কোন কিছুতে মজেছে - তখন কি আর সময়ের জ্ঞান আছে! না মজলে তো সময়ই ভার মনে হয়।
: তুমি কি সে মজলে?
: দেখা। দেখা জিনিষ দেখা।
: কি রকম বুঝলে?
: সে যে কি এক কেলেঙ্কারী।
: কেলেঙ্কারী!
: যাকে দেখতে চাইছি সে যখন সামনে দাড়ায়, মনে হয় - পাগল হয়ে যাবো। কখন যে জড়িয়ে ধরবো। কিচ্ছু খেয়াল থাকে না। হটাৎ মনে হয়- যেন বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই রকম একটা ব্যাপার। এক কথায় - কেলেঙ্কারী।
: কিন্তু মানুষ শুনলে কিন্তু কত কথাই মনে করবে। মনে হয় এর সাথে কি হয়েছে তার সাথে কি করেছে।
: তাইতো হয়েছে। উচ্ছ্বাস। আর উচ্ছ্বাস। কেলেঙ্কারী এক। সে এক মহারসের ব্যাপার।
নীল জলে ঢেউগুলো সাতার কাটতে কাটতে তীরের দিকে এগিয়ে আসছে। নেচে নেচে লাফিয়ে উঠা ঢেউগুলোর ডগায় সাদা সাদা ফেনা বাতাসের বুড়বুড়ি তুলে ফুসে উঠে আবার ভেঙে পড়ছে - উচ্ছ্বাসটা যেন ওদের বুকেও লেগেছে। একটা অ্যালবাট্রস পাখি সাদা স্বপ্নের মত দূর আকাশ দিয়ে চক্রাকারে মাথার উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউগুলো বালুগুলো ভিজিয়ে দিয়ে - আবার ফিরে যাচ্ছে।
এই ভেজাবালুর উপরে আমরা বসে আছি।
আমরা মানে - আমি আর আমি।
প্রায়ই এরকম হয় আমার। এই আমিটাই অনেকগুলো টুকরোয় - টুকরো টুকরো হয়ে যাই।
আবার কখনও কখনও অনেক টুকরো মানুষ এক হয়ে এক আমি হয়ে যাই।
সকাল, সন্ধ্যা, রাত - সবসময় এইতো চলে।
পা ফেললেই পথ এসে দাড়ায়। নদীর মত বয়ে নিয়ে চলে কোথায় কোথায়। আকাশে রঙের খেলা। রোদের আলো। মেঘের ছায়া। বাতাসে মৃদু ঢেউয়ের শব্দ। পাখিদের ডাক। ফুলের মেলা। রঙ বেরঙের মানুষ। দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখি। ভাল লাগায় চোখ বন্ধ করি।
: চোখ বুজলে কি দেখছো তুমি? অন্ধকার? মনে হচ্ছে কি - তুমি নেই?
তাতো নয়। চোখ বন্ধ করলেও দেখা বন্ধ হয় না। দৃশ্যগুলো আবার জেগে ওঠে। ঠিক এক রকম নয়। একটু আলাদা।
: উহু! উল্টো। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলেই ‘আমি’টা টের পাচ্ছি।
: এই ‘আমি’টা কোথায় থাকে?
: এটাইতো মজার। ঘটনাটা ঐখানেই। এর অবস্থানটা যে কোন জায়গায়, এই কেলেঙ্কারীটাই বড় কেলেঙ্কারী।
হাটতে হাটতে আমরা কথা বলি। নিজের সঙ্গেই আমার সবচেয়ে বেশি কথা হয়। খুব মজা একা একা এই খেলা করা।
চেয়ে দেখ তুমি চেয়ে দেখ এই সেই আমি
আমারই সাথে একা বসে থাকে তোমারই ছলনায়।
: জীবন অভিজ্ঞতা বললো - সে একা। কিন্তু মানুষ ছাড়া সে থাকতেই পারলে না।
: যে একাকীত্ব বিকলাঙ্গ, কিংবা অজানার ভয় - সেটা মানুষকে একসাথে থাকতে বাধ্য করে।
: আবার সেই একাকীত্বই এত সুন্দর করে তোলে, যখন আমরা টের পাই - এই বহুর মধ্যে আমি একজন। এই পৃথিবীর আমিও একজন, জানতেই বুকটার ভেতর কেমন হয়ে ওঠে।
: সেটাও অবশ্য একাকীত্ব।
: কিন্তু সেখানে আমার কি হয় জানো? যা একটা তীব্রতা তৈরী হয় না - এই পৃথিবীর আমিও একজন, জানতেই বুকটার ভেতর কেমন হয়ে ওঠে।
এইতো ডায়েরীর পাতায় একটা চিঠি লিখছিলাম।
আমার একটা পৃথিবী আছে। কিছু মানুষ, কিছু অতীত, কিছু ভবিষ্যতের সাথে আমার একটা যোগ আছে। এই যোগগুলো নিয়েই আমার এই পৃথিবী আমি কোথায় আছি- সেই মানুষ , স্মৃতি, ভবিষ্যত থেকে কত দূরে কিংবা কত দিনের ব্যবধান - এই যোগসূত্রে এটা কোন প্রভাব ফেলে না। দেনা পাওনার হিসেবের বাইরের এই যোগসূত্রগুলোর অস্তিত্ব আমাকে আমার পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করে।
আর সবকিছুর সাথে - তুমিও আমাকে বাঁচিয়ে রাখো।
এই চিঠিটা ছিল ঝুমির জন্য। এই চিঠিটা ফ্রিদার জন্যও। ঝুমি বা ফ্রিদা কারও কাছেই চিঠিটা কখনোই পাঠানো হবে না জেনেও ডায়েরীর পাতায় ওর আর ওর জন্য চিঠিটা লিখি।
আসলে কাছে যাওয়া দূরে আসা কোনটাই ঘটে না। আমরা কেবল মনের ভেতরে একটা দূরত্ব আর একটা নৈকট্য তৈরী করে খেলতে থাকি। যখন আমি ভাবি - তুমি দূরের, তুমি তখন দূরের । আর যখন ভাবি কাছের - তখন তুমি কাছের। তুমি আমি মিলে - কেলেঙ্কারী একটা।
এখন না পরে।
জীবনের যে ব্যবধান।
এর কারন হলো দুটো।
এই জীবনে তুমি।
এর কারন মুলত আমি।
এই যে তুমি আর আমি...
জীবনের যে ব্যবধান। এর কারণ দেখলাম মূলত তুমি। আর সারাজীবন ধরে তুমি। এর মূলত কারন হলো আমি। তুমি আর আমি। এরপরে আর কোনকিছু বলতে পারলাম না। কেলেঙ্কারী একরকম।
এই রকম কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে আমরা বেঁচে আছি। Fly, fly, fly। প্রতি মূহূর্তে দেখা। নিত্যানন্দ। মিল যেখানে সেখানেই নিত্যানন্দ। ওখানে কোন সময় আর সুখ দুঃখের খেলা চলে না।
মিল এরই খেলা জগৎ জুড়ে। সে এক দারুন মজা।
মনের মধ্যে গুণগুণ করে উঠি।
ঠিক তখনই নদী থেকে বয়ে আসা বাতাস একটা গান বয়ে নিয়ে আসে।
আপনাকে চিনলে পরে
চেনা যায় পরওয়ার দেগারে।
খোদ খোদা নয়রে জুদা, আরশ সোদা দেহের ঘরে
বাহ্ ! কে গাইছে?
সামনে একটা বুড়ো বটগাছ - মহাকাল হয়ে দাড়িয়ে আছে। শব্দটা ওদিক থেকেই আসছে । হেটে যাই। বটগাছটার নিচে বটগাছের মতই সৌম্য চেহারার একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়ি, একহারা গড়ন। রবীন্দ্রনাথের মতই চেহারা, শুধু লম্বা চুলগুলো মাথার উপর চুড়ো করে বাঁধা। সাধু। পৃথিবীর সব সাধুদের চেহারায় একই ভাব। চোখ বন্ধ। নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে গান গাইছেন। আমি কাছে গিয়ে দাড়াতেই গান থেমে গেল। চোখ খূলে আমাকে দেখে হাসলেন। সরল। বাচ্চাদের মত দেখায় থাকে।
: আপনার গানটা খুব ভাল লেগেছে। সুন্দর।
: তোর মধ্যে এই কথাগুলো আছে তাই তোর ভাল লেগেছে।
তার কথাগুলো মনে হয় - চেনা চেনা। আগে কোথাও শুনেছি।
: চিরকালই দেখলাম আমার যা নেই, অন্যের ভেতর তা দেখলে কোন অনূভুতি হয় না। এটা বস্তুর স্বধর্ম। যদি আমার থাকে তবেই বাইরে তা টের পাবি। এটা একটা রসায়ন । Know thyself এর মত আদি কথা। শুরু থেকে ছিল। গুরু সক্রেটিসও কি এটা বলেছে? বলে নি। এটা সে পেয়েছে। সময়ে শুধূ সাধন করেছে। আর আমরা ভাবি এ বুঝি - তারই কথা। আমরা সবসময় ভাবি - আমরা বলি। কথা না পেলে - বলবে কেমন করে রে?
তিনি উঠে দাড়ালেন।
: এবার আমার যেতে হবে। পারানীর নৌকা এসে গেছে।
পাড়ে যে কখন নৌকা এসে ভিড়েছে, খেয়ালই করি নি। তিনি উঠে দাড়ালেন। কোন তাড়াহুড়ো নেই। তখনই মনে হলে এই মানুষটা আর আমি একই জন। ‘আরেক আমি’ নৌকায় উঠলেন। নৌকা ছেড়ে দিলে তিনি একবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমি হাসলাম। তিনিও হাসলেন। তখন আমার মনে হলো - এক মানুষে বহু মানুষের বাস যেমন, তেমনি বহু মানুষেও এক মানুষের বাস। নদী বেয়ে দৃষ্টির আড়ালে নৌকাটা হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি তাকিয়ে থাকি। নদী আর বাতাসের শব্দের হুটোপুটির মধ্যে দূরগামী নৌকো থেকে আমারই কণ্ঠ ভেসে আসে।
এমন মানব জনম আর কি হবে?
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই।।
দেব দেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে, পেয়েছো এই মানব তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায় তরী সুধারায়
যেন ভরা না ডোবে।
এই মানুষে হবে মাধূর্য্য ভজন,
তাইতে মানুষ রূপ গঠল নিরঞ্জন
এবার ঠেকিলে আর না দেখি কিনার
লালন কয় কাতরভাবে।।
লালন সাঁই। বুঝতে পারি। আরেক আমি তার মধ্যে বিরাজ করছে দেখে নিয়ে আমার ভাল লাগে। আমার মধ্যেও আকে লালন সাঁই বিরাজ কওে দেখতে পেয়েও ভাল লাগে। সন্ধ্যার ঘন ছায়ায় নৌকাটা তখন ডুবে গেছে।
আমি পা বাড়িয়ে ফিরে আসি। বেঁচে থাকার এই শহরটার রাস্তা ধরে হাটি। সন্ধ্যা নামে। নদীর কোল ঘেঁষে শহরটায় আলো জ্বলতে শুরু করেছে- এই সময়টা আমার খুব প্রিয়। এক এক করে বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করলে সন্ধ্যার অন্ধকার নদীর জ্বলে ছায়া ফেলে। নদীর বুকে আলোর আশ্চর্য্য সব কারুকাজ ফুটে ওঠে। ছোট ছোট ঢেউ এ লাল নীল সবুজ রঙ তির তির করে কাপে। নদীর বুকে আলোর আশ্চর্য্য সব কারুকাজ ফুটে ওঠে। ছোট ছোট ঢেউ এ লাল নীল সবুজ রঙ তির তির করে কাপে। এর মধ্যে একটা জাহাজ সিটি দিয়ে শহর ছেড়ে কোথাও চলে যায়। তারপর একটা একটা করে - ঠিক সন্ধ্যার পর অনেকগুলো সাদা সাদা জাহাজ বেরিয়ে যাবে বরিশাল, হুলারহাট, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর সহ কোথায় কোথায়।
জাহাজগুলো ভোর বেলার শিউলীর মতো মনে হয়। টুপ টুপ করে শহরের বুক থেকে খসে পড়ছে। তাদের সারা গায়ে শিশির বিন্দুর মতো মানুষ জড়িয়ে থাকে। চিরচেনা দৃশ্য। আমি শহর হয়ে মানুষ গুলোকে দেখি।
কত মানুষ। কত পৃথিবী। বেচে থাকার কত কায়দা। কত সহস্র আশা আর যন্ত্রণা - মৌনতার মধ্যে ওরা ধরে আছে। নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। বেলুনের মত ফুলিয়ে দেখাচ্ছে। সবার মধ্যে একটা বন্ধনহীন বন্ধন। কেউ কারো নয়। কিন্তু একসুতোয় গাথা। কেউ কিন্তু কারো নয়। এক সূতোয় মালা। মালা একটাই। ছিড়লে একবারেই ছিড়বে। থাকলে একসাথেই থাকবে।
সকাল। সন্ধ্যা। রাত। আবার সকাল। হেটে চলি।
ইতিহাসের মত।
একটা একলা মানুষ ভিড়ের গাদাগাদি ঠেলে সামনে এগুনোর চেষ্টা করছে- কিন্তু কিছুতেই এগুতে পারছে না। জ্যাম রাস্তার পাশেই পসরা সাজিয়ে সারি সারি হকার হাঁকডাক করে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। বিরাট বিরাট শপিং মলগুলো ফুটপাতের উপর পর্যন্ত উঠে এসেছে - হাঁটবার জায়গাটুকুও ওরা রাখেনি। ঝলমলে দোকানের পারদ লাগানো কাঁচে মিহিদানা সুরে ভিক্ষা চাওয়া বুড়ো লোকটার পাজরের হাড়ের ছায়া পড়েছে। উজ্জ্বল ছেলে মেয়েরা গল্প করছে, হাঁটছে, বসে আছে, নাচতে নাচতে চলছে।
এই শহরে কতশত রকম দৃশ্য বুদ্বুঁদের মতো উড়ে বেড়ায়।
সবকিছুই সময়কে সাথে নিয়ে হাটে। আমি ভাবি।
হাটতে হাটতে একটা ঝুপড়ি দোকান দেখে দাড়িয়ে পড়ি। এক কাপ চা খেলে মন্দ হবে না। চায়ের কাপ হাতে নিতেই দেখি -
শামসুর রাহমানের সঙ্গে তরুণ স্যান্যাল। সেই পুরনো দৃশ্য। একই রকম। তরুণ সান্যালের হাতে একটা চারাগাছ, বাচ্চার মত দুহাত দিয়ে ধরে আছেন। শামসুর রহমানের সেই একই গো -
: বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে কিছু বলুন না...
: আপনি কবি। কষ্ট পাবেন।
: কষ্ট পাবো না। বলুন।
তরুণ সান্যালের মুখ অপারগতার হাসি।
: আগে হয়তো পেতাম। কিন্তু এখন আর পাবো না।
তরুণ সান্যালের মুখে সেই একই হাসি। শামসুর রাহমান সেটা খেয়াল করে বললেন -
: কেন জানেন?
: কেন?
: আমি আমাকে জেনেছি।
শামসুর রাহমানের মুখে স্মিত একটা হাসি ফুটে ওঠে। শান্ত, সৌম্য, সুস্থির এক প্রতিমূর্তির মত।
: মৃত্যুর আনন্দের মধ্য দিয়ে।
: কি?
তরুণ সান্যাল একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
: ‘আপনার পরিনতি কি’- এটা জানার অনুভূতি আপনার জন্য কি বয়ে নিয়ে আসবে? আনন্দ না দুঃখ, কোনটা?
: আনন্দ।
: আমার পরিণতি টা কি? এটা যখন আমি জানতে পারি এটা কি সুখদায়ক নাকি দুঃখদায়ক?
: নিশ্চয় সুখদায়ক।
: মৃত্যু সেই বার্তা। আমি কে, আমি কি তার চূড়ান্ত রূপকে আমি আবিষ্কার করলাম। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমি তা জেনেছি।
একই কথা - তবু কত আলাদা। লাস্টবেঞ্চির কথা মনে হয়। ও আর কখনও ফিরে আসেনি। কিন্তু শামসুর রাহমানের মুখে তার মতই মৃত্যুর মহিমার কথা। তবু তা কত আলাদা।
: তাই বলছিলাম। আপনি এখন বলতে পারেন - বাংলাদেশের কবিতা কেমন লাগে?
তরুণ সান্যাল একফোটা হাসলেন। দুরে আকাশের দিকে তাকালেন।
: ঐ যে দেখুন। ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ।
তরুণ সান্যাল হাত আকাশে রাখলেন। তার হাত অনুসরন করে আমিও চোখ ফেরাই। কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। কিন্তু শামসুর রাহমানকে মনে হলো তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আমার সন্তের মত তার চেহারাটা মনে পড়ে। কিন্তু চোখে ভাসে শুধু নীল আকাশ, ডানা মেলে ভেসে থাকা চিল। আমি আরও ভাল করে দেখার চেষ্টা করি। বিন্দুর মত একটা প্লেন চোখে পড়ে। অনেক উপর দিয়ে সাদা-ছাই মেঘের পাশ ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে সে। তরুণ সান্যালের শব্দগুলো কেবল মগজে ঢেউ তোলে।
: অনেক খোলামেলা মানুষ ছিলেন তিনি। যা দেখতেন বিচার করে সেইটিই গ্রহণ করতেন। যখন তিনি পালি ও সংস্কৃত শিখতে গিয়েছিলেন তখন ওখানকার ব্রাহ্মন পণ্ডিতেরা তার সাথে কি রকম যে নিষ্ঠুর আচরন করেছিল, তা বলবার বাইরে! ব্রাহ্মণের বাইরে এই ভাষা জগতে কেউ বলবে - এটা চিন্তা করাও পাপ। তারপরও শিক্ষালয়ের নিয়ম, শহীদুল্লাহকে ভর্তি করাতে হয়েছিল। সেই সময় যিনি ওদের শিক্ষক, পণ্ডিতমশাই নলিনীকান্ত ভট্টশালী তাকে ক্লাসে বসতে অনুমতি দেননি। তিনি তাকে বাইরে বসতে আদেশ দিয়েছিলেন। ক্লাশের বাইরে বসে শহীদুল্লাহ শুনে শূনে পালি আর সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করতেন। কিছুদিন পরে পণ্ডিতমশাই ছাত্রদের একটা বিশেষ শ্লোক পড়তে দিয়েছিলেন। সব ক্লাসের ছেলেদেরকে সাতদিন পরে তাকে দেখিয়ে এবং মুখে শুদ্ধ উচ্চারণে বলতে হবে। সাতদিন পর দেখা গেল শহীদুল্লাহ সাহেবই একমাত্র ছাত্র যে সেটা সঠিক উচ্চারণ করে বলতে পারলেন।
এতক্ষনে দেখতে পাই। আকাশের মধ্যে স্পষ্ট ভেসে উঠেছে ছবিটা। ক্লাশের বাইরে দাড়িয়ে একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে। আর একজন ব্রাহ্মণ পন্ডিত প্রথমে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যেয় জায়গায় ক্রোধ ফুটে উঠলো। নিজেকে না সামলেই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন -
: তুই কি করে বললি, ম্লেচ্ছ?
পন্ডিতের ক্রোধান্বিত চিৎকারেও ছাত্রের চেহারায় কিঞ্চিৎ লজ্জ্বার আভাস ফুটে উঠলো।
: আমি প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে গঙ্গা স্নান করেছি। ঘি আর সন্দভ লবণ দিয়ে আতপ চালের ভাত খেয়েছি। শুনেছি এ গুলো করলে সংস্কৃত উচ্চারনের জন্য জিবটা পরিচ্ছন্ন হয়। গেল সাতদিন এভাবে আমি চর্চা করেছি।
ছাত্রের উত্তর শুনে পণ্ডিতের কঠোর চোখ জোড়া কোমল হয়ে আসে। একটু চুপ করে থাকলেন তিনি। নিজেকে সামলে বললেন
: আমি তোকে বলছি, এই ক্লাসে তুইই একমাত্র ব্রাহ্মণ। আর কেউ ব্রাহ্মণ নয়। তুই আমার বাড়িতে যাবি। কালকে দুপুরে খেতে তোকে নেমতন্ন করছি।
কিশোর শহীদুল্লাহ রাস্তা খুঁজে খুঁজে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর বাড়িতে গেলেন। রাস্তার মোড়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আগে থেকেই। তিনি হাত ধরে ছাত্রকে নিয়ে ঘরে আসলেন। ঘরটায় আগে থেকেই দুটো আসন পেতে রাখা। একটা আসন শহীদুল্লাহকে দেখিয়ে তিনি বললেন -
: তুই এইটায় বোস - আমি এইটায় বসি। যা - হাতটা ধুয়ে আয়।
ব্রাহ্মণের স্ত্রী দু’জনকে থালায় করে খাবার দিয়ে অশ্র“সিক্ত চোখ দুটি মুছতে মুছতে বললেন -
: বাবা আজকে আমার খুব পূণ্যের দিন। কারণ আমাদের পুত্র নেই- আমাদের দু’জনকেই সবসময় একলা খেতে হয়। আজকে আমরা একটা পুত্র পেলাম।
তিনি তাকে এটা কি করে খেতে হয় ওটা কি করে খেতে হয় - এসব বলতে বলতে পুত্রের মত ছেলেটিকে খাওয়ালেন।
সাথে সাথে দৃশ্যটি মিলিয়ে গেল।
আমি আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে দেখি তরুণ সান্যাল বলেই চলেছেন -
সংস্কার যেটা থাকে মানুষের মধ্যে - সেটা তৈরী হয় পরিবেশের জন্য। কিন্তু মানুষ যেটা সত্যিকারের যেটা জানে সেটি ঠিকই উত্তীর্ণ হয়ে যায়। সেই ব্রাহ্মণ শিক্ষক ক্লাসে ছিলেন সংস্কারচ্ছন্ন। কিন্তু একটা উপযুক্ত ছাত্র পাওয়া যাওয়ার কারনে তিনি সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারলেন।
নলিনীকান্ত ভট্টশালীর কাছে - জ্ঞানে বুদ্ধিতে যিনি পণ্ডিত মানুষ তার সাথে ব্রাহ্মণে কোন পার্থক্য নেই। তার কাছে শহিদুল্লাহ সাহেব ছিলেন ব্রাহ্মন আর শহীদুল্লাহ সাহেব এর কাছে নলিনীকান্ত ছিলেন বুজুর্গ।
যে কথা শামসুর রাহমান বেঁচে থাকতে তরুণ সান্যাল বলতে পারেন নি, মৃত্যুর পরে বলতে শুরু করলেন
শব্দের একটা উত্তরাধিকার আছে। শহীদুল্লাহ সাহেব সেটা জানতেন বলেই তিনি এটা অর্জন করতে পেরেছিলেন। প্রত্যেকটা শব্দই এক একটা আইডল বা একটা ইমেজ। একজন কবি হলো তার আইডোলেটর। অন্যরা যেভাবে শব্দ ব্যবহার করেন কবিতো সেইভাবে শব্দ ব্যবহার করেন না। আমি, ভারতবর্ষের কবি সেই পুরনো কাল থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত সবার উত্তরাধিকার। কিন্তু আপনারা বাংলাদেশের কবিরা তা নন। দেশ যখন ভাগ হয়েছিল আপনারা এই উত্তরাধিকারকে পরিত্যাগ করেছিলেন। তখন আপনাদের কাছে বড় কবি মনে হয়েছিল - বেনজির আহমেদ. কায়কোবাদকে। তাদেরকেই বড় কবি হিসেবে প্রচার করা হত। জীবনানন্দ না, বিষ্ণু দে ও না - এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ফলে আপনারা একটা আগ্রাসনের ভেতরে ছিলেন। আক্রান্ত মানুষ হিসেবে বারবার খুঁজে খুঁজে আপনাদের ভাষাকে আপনারা মুক্ত করেছেন। কিন্তু পুরোপুরি সেই উত্তরাধিকারের সাথে যুক্ত হতে পারেন নি।
তরুন স্যান্যাল একটু থামেন। শামসুর রাহমান গভীর মনোযোগ নিয়ে তরুণ সান্যালের দিকে চেয়ে আছেন।
ভাষার সঙ্গে অজস্র ইমেজ আছে যেগুলো রিলিজিয়াস ইমেজ হয়। রিলিজিয়াস বলতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বুঝাচ্ছি না - সাংস্কৃতিক ধর্ম বুঝাতে চাচ্ছি। হিন্দুরা নিয়েছে রামচন্দ্রকে- দেবতাসূলভ একটা নায়ক হিসেবে। সীতা, একটা এপিক হিরোইন- অর্জূন কর্ণ এরা সব হিরো হিরোইন। একটা জাতির এগুলো সব ইমেজ। ইলিয়াডে কাকে কাকে পাচ্ছি আমরা- আগামেমনন হেলেন। এরা ইউরোপীয় সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফরাসী পণ্ডিত সার্ত্রে যখন মাছি লিখছেন তিনি কিন্তু অরেষ্ট্রিসকে নিচ্ছেন। পুরনো গ্রীক কাহিনীতে ফিরে যাচ্ছেন। আর আপনারা - আপনাদের এমন জায়গায় ঠেলে আনা হয়েছে যেখানে আপনার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নাই। নিজের ঐতিহ্যকে টেনে ছিড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের যে অংশ এটা ছিড়তে গিয়ে যে কাণ্ডটা করেছে - ভারতবর্ষেও সংস্কৃতিতে আপনাদের যে স্বাভাবিক উত্তরাধিকার সেটাকেও বাতিল করে দিয়েছে। ফলে যে মুহূর্তে আপনারা এগুলো ভূলে গিয়েছেন, যখন আপনারা এতগুলো সম্পদচ্যূত হয়ে গেছেন - তখন যাদের সেই সম্পদটা আছে তাদের সঙ্গে তো তুলনা করলে চলবে না। মুশকিলটা হচ্ছে আপনাদের এইসব সম্পদ ফিরে পেতে হবে এবং আরো নতুন সম্পদ যুক্ত করতে হবে- যেটা পশ্চিম বঙ্গে নাই পূর্ববঙ্গে আছে। কী আছে? লোক জীবনের যে মহিমা- সেটা। পশ্চিমবঙ্গে জসিমউদ্দিনের মত কোন কবি নেই। কিন্তু পূর্ব বাংলায় ছিলেন। আসলে সোজন বাদিয়ার ঘাটই বলুন আর নক্সী কাথার মাঠই বুলূন সেখানেই আপনার লোকজ পরিচয় খুঁজে পাবেন। পশ্চিম বঙ্গে একজন লালন নেই। আপনাদের পূর্ব বাংলায় ছিলেন। একে ধরে রাখতে না পারলে ... যা কিছু হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে বের করতে না পারলে...
শামসুর রাহমান আকাশের দিকে তাকালেন। একটা লাল সূর্য ভসে আছে। যেন শহীদ মিনারের রক্তিম সূর্যটা আকাশে উঠে এসেছে। এত লাল। পতাকার লাল বৃত্তটার মত। সেই চিলটা এখনও ডানা মেলে শূন্যে দাড়িয়ে আছে। স্থির। শিকারীর একাগ্রতা তার চোখে। আমি চোখ নামিয়ে আনতেই দেখি ঝুপড়ি দোকানটায় আমি একা। কেউ নেই। আমার মনে পড়লো, এই দোকানটাতেই তরুণ সান্যাল আর আমি বৃষ্টির তোড় থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম। চায়ের দামটা মিটিয়ে আবার রাস্তায় নেমে আসি। নির্জনতার লোভে রাস্তা ছেড়ে আমি পার্কে নেমে আসি। অনেক গাছ এখানে। উড়ে যাওয়া নিশূতি মানুষদের কথা মনে হয়। আমি উঁকি দিয়ে গাছের ডাল গুলোতে কোন বাদুর ঝুলে আছে কিনা দেখার চেষ্টা করি। দেখতে পাই না। একটা দামাল হাওয়া ওঠে। সরসর শব্দ তুলে ঝরাপাতাগুলো উড়তে থাকে। একটা গান সেই ঘূর্ণি হাওয়ায় দোল খায়। গলা শূনেই বুঝতে পারি। কফিল ভাই। রাজপথের নিঃসঙ্গ গায়ক। এই পার্কে তিনি মাঝেমধ্যে আসেন। চুপচাপ হেটে যান অথবা দুদন্ড বসে কারো সাথে নিচু স্বরে গল্প করেন। খেয়াল হলে দু একটা গান গান। গম্ভীর মুখে এক চিলতে হাসি সবসময় লুকিয়ে থাকে। তাকে খুঁজি, কিন্তু গাছের ফাঁক গলে কোথাও তাকে দেখতে পাই না। কিন্তু গানের মধ্যে তার চেহারাটা জেগে থাকে। আমি ঝিরঝির বাতাসের মধ্যে গানের মধ্যে ডুবে যাই।
গান হলো নিরাপদ
তাই বসে থাকো
ফুলগুলি পলাতক
তাই শুয়ে থাকো।
কোন সুর বাশির মত বাজে নাকো
কোন বাশি সানাইয়ের মত কাঁদে নাকো
প্রতিক্ষণে দেহ গড়ো
প্রতিক্ষণে শৈশব সাজিয়ো
দেহরূপ রত
প্রতিক্ষণে দেহ গড়ো
প্রতিক্ষণে শৈশব সাজিয়ো
দেহরূপ রত
কোন বাশি সানাইয়ের মত কাঁদে নাকো
কোন সানাই তোমার মত একা নয়তো
ওগো গান হলো নিরাপদ
তাই বসে থাকো
ফুলগুলি পলাতক
তাই ছবি আঁকো।
গানের শব্দগুলো ধীরে ধীরে সবকিছু স্তব্ধ করে দেয়। সুরটা বিষন্ন, গভীর। নিজের হৃদপিন্ডের ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। আমি সেখানে ঝিম মেরে পড়ে থাকি। হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনি। মনে হয় আমার নিজেরই গর্ভের ওমের ভেতরে আমাকে দেখছি। গানের সাথে সাথে রক্ত প্রবাহের ভেতর দিয়ে আমি ভেসে যেতে থাকি। সেখানে কণায় কণায় স্মৃতি, কল্পনা, স্বপ্ন, সুখ, দুঃখ, অভিমান, নিস্পৃহতা, ক্ষোভ, দ্রোহ মিশে আছে। স্মৃতি বিস্মৃতির সবমুখগুলো ওখানে কলরব করে জেগে ওঠে। নিজেকেই সময় মনে হয়। সময় এই দেহের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। আলো আর অন্ধকার একসাথে নেচে ওঠে।
কেমন আছেন প্রভূ? ভালোতো।
নিজের একেবারে ভেতর থেকে প্রভূর উদার কণ্ঠ শুনি। মহাকালের সমান বয়সী মানুষটা সেই কৈশোরবেলা থেকেই আমাকে আপনি বলে সন্মোধন করতেন। শূধু আমাকে নন। সবাইকেই। আমার চেয়েও যারা ছোট তাদেরকেও তিনি ‘আপনি’ করে বলেন। পিতার সমান একজন মানুষের মুখে আপনি সন্মোধন শুনে আমি লজ্জ্বা পেতাম।
: আমাকে আপনি বলবেন না প্রভূ।
: আমার যা আছে - তা কি আপনার আছে না? আপনার যা আছে তা কি আমার আছে? তাহলে ছোট বড় কি করে মাপবেন প্রভূ? আর বয়স? ‘কাল’তো একটা। কাল যদি একটা হয়, তাহলে ছোট বড় বলে কিছুতো থাকে না।
তিনি ফোকলা মুখে পানের কুচি পুরে একগাল হাসি ছড়িয়ে দিলেন। সেই হাসির মুখে নিজের সংকুচিত শৈশবের খোলশ খসে পড়ে। নিজেকে বড় বড় মনে হয়। প্রভূ আর ‘বড় আমি’ আমার মধ্যে হেটে হেটে বেড়াই। শিরা উপশিরা ধরে হাটতে হাটতে আমরা কথা বলি।
: নিজেকে নিজের বন্ধু ভাববেন প্রভূ।
আমি হাসি। কিছু সরল কথা থাকে, শূনলেই মনে হয় - জানি তো। অনেকদিন মনে হওয়া একটা কথা আমি প্রভূকে জিজ্ঞাসা করি। সবাই তাকে প্রভূ বলে ডাকেন। কেন? এবার জিজ্ঞাসা করি।
: প্রভূ, আপনাকে সবাই প্রভূ বলে কেন?
: সবাইতো আমাকে দুষ্টুমী করে ডাকে।
: দুষ্টুমী?
: আমি সবাইকে প্রভূ বলি এই জন্য সবাই আমাকে প্রভূ বলে।
মনে পড়, প্রভূ সবসময়ই সবাইকে প্রভূ বলে সম্মোধন করেন। আমরা তাকে প্রভূ - ভাবতে ভাবতে বিষয়টা খেয়ালই করা হয় নি। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি-
: কেন আপনি সবাইকে প্রভূ বলেন?
: এটা এই পৃথিবীতে আমার নিজের অবস্থান।
আমি প্রভূর কথাটা ভাল বুঝতে পারি না। আমি তার দিকে চেয়ে থাকি। আমার এই না বোঝাটা প্রভূ বুঝতে পারেন।
: দেখুন প্রভূ - আমি যা কিছূ করি তা কিন্তু আমি করি না। আমি যা কিছু করি তা করতে আসলে বাধ্য হই। ধরুন - একটা চোরকে আমি প্রহার করছি। আপনি দেখছেন আমি চোরটাকে প্রহার করলাম। আসলে কি তাই? চোরটা চুরি করে আমার মধ্যে এমন একটা সংবেদন তৈরী করলো যা আমাকে বললো - প্রহার কর। ফলে তাকে আমি প্রহার না করে পারলাম না। ব্যাপারটা তাহলে কি দাড়ালো? চোরটাই আমাকে তাকে প্রহার করতে বাধ্য করলো। আবার ধরুন আমি আপনি এমন একটা কিছু করলেন যাতে আমার মন প্রসন্ন হলো। আমি আপনাকে ভালবাসলাম। আসলে কি আমি ভালবাসলাম? নাকি আপনার ঐ কাজের মাধ্যমে আপনি আমাকে বললেন - ভালবাসো। ভাল না বাসার কোন উপায় ছিল কি? ছিল না। আমি বাধ্য হয়ে আপনাকে ভালবাসলাম। রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি। একটা কুকুর আমার সামনে এসে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। আমি ভয় পেলাম। একটা ইটের টুকরো হাতে নিয়ে ওকে ভয় দেখাতে শুরু করলাম। কুকুরটা আমাকে বাধ্য করলো ইটের টুকরোটা হাতে নিতে। এভাবেই আমি কি করবো কি করবো না, কি ভাববো অথবা ভাববো না, আমি কি চাইবো অথবা কি চাইবো না - আমার সমস্ত আচরন, চিন্তা - সব কিছুই অন্য কেউ, অন্য কিছু আমাকে নির্দেশ করে। সকাল বলে - ওঠো। আমি উঠি। রাত বলে - ঘুমোও। আমি ঘুমুতে যাই। আমি যার কথা শুনতে বাধ্য - সে কে? সেই তো আমার প্রভূ। এই কারনে যার সান্নিধ্যে আমি আসি - সকলেই আমার প্রভূ। এই আকাশ, বাতাস, প্রাণীকুল, বৃক্ষ, মানুষ। সবাই।
প্রভূর কথাগুলো আমার নিজেরই মনে হয়।
প্রত্যেকের কিছু না কিছু আছে বলে ভাবি। কিন্তু আসলে কি তা তার? আমার যা বলে ভাবি তা কি আমার?
কফিলভাইয়ের গলা আর শোনা যায় না। আমিও ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসি। কিন্তু প্রভূর মনের মধ্যে আমার সাথে হাটতে থাকেন।
আমি মাথার মধ্যে জমে থাকা প্রশ্নটা আবার করি।
: এই ‘আমি’টা কি তাহলে?
: এটাইতো মজার। ঘটনাটা ঐখানেই।
প্রভূ গান গেয়ে ওঠেন।
বুঝতে পারি আমি আর প্রভূ এক হয়ে গেছি। চারদিকে তাকাই। সন্ধ্যা নামছে। হটাৎ নিচে চোখ পড়ে যেতে থমকে যাই। পায়ের কাছে একটা বুনো ফুল ফুটে আছে। খুব সুন্দর। দেখেই ছিড়তে ইচ্ছে করে। এত সুন্দর। ছিড়তে গিয়ে থমকে যাই। হেসে ফেলি। আমার মধ্যে এই একটা জিনিষ কাজ করে। খূব দেখেছি। সুন্দর বলে যেটা মনে হয়েছে সেটা ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। আর না হয় খেতে ইচ্ছে করে । তাতে ‘আমি’ ব্যাপারটা বেশ টের পাওয়া যায়। আমি ভাবি - আমি নেই। ফুলটা ফুলের জায়গায় হাসতে থাকে। আমি ফুলটাকে একটু স্পর্শ করে চলে আসি। হাতে ফুলের স্পর্শ লেগে থাকে। ফুলের স্পর্শ নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসি। সন্ধ্যার অন্ধকারের সাথে সাথে ওখানে ঘরমুখো মানুষের স্রোত উঠেছে। মানুষের স্রোতের মধ্যে হেটে যেতে যেতে হটাৎ মনে হয় - আমি নেই।
এরকম আমার অনেকবার মনে হয়েছে - আমি নেই। অসংখ্যবার।
: আমি আছি আর এই যে আমি নেই এর মাঝখানে যে জায়গাটা সেটা কি?
: এখানে অভিজ্ঞতা থাকে।
: অভিজ্ঞতা?
: অভিজ্ঞতা তোমার মধ্যে ‘তুমি নেই’ এই অনুভূতির জন্ম দেয়।
: অভিজ্ঞতা মানে - আমি নেই?
: তুমি আছো অথচ নেই। আকাশে হেলান দিয়ে নিচের দিকে একটু তাকানোর মত। ঈশ্বরের মত। শুধু দেখা। অভিজ্ঞতা তোমাকে অপারগ করবে। সুখ কিংবা দুঃখ তোমাকে চঞ্চল না করে স্থির করবে। প্রশান্ত করবে। কারন তুমি বুঝতে পারবে - ‘সেখানে আমার কোন কিছু করার নেই, আমার কোন কর্তৃত্ব নেই’।
: এটা কি দূর্বলতা নয়?
: এটা একটা আনডারস্ট্যান্ডিং।
: এটাই কি নির্বাণ?
: ছিল সবই। আছে সবই। আসল ঘটনা হলো যুক্ত হওয়া। আমি শুধু যুক্ত হলাম। আমার মুক্তি ঘটলো।
: যুক্ত হওয়া আর মিল। মিল আর যুক্ত হওয়া। যুক্ত হওয়া আর মিল। নিরন্তর।
গালের উপর একটা বড় বৃষ্টির ফোটা পড়তেই কথা ভেঙে গেল। চারপাশটা যে কখন ফাঁকা হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। আকাশে ঘন ছাই বর্ণের মেঘ জমেছে। পুরু মেঘের অনেক ভেতরে বিজলী চমকাচ্ছে - আকাশটা ক্ষণে ক্ষণে সাদাটে হয়ে জ্বলে উঠছে। ঠান্ডা বাতাস ছুটেছে। শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসে। এখনই ঝুম বৃষ্ঠি নামবে। ভাবতে না ভাবতেই - বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি নামে। পাশেই একটা যাত্রী ছাউনী। আমি ছাউনীর নিচে দাড়াই। বৃষ্টিটা জাকিয়ে নামে। ছাউনীর নিচে দাড়িয়ে একা একা আমি বৃষ্টি দেখি। অনেকক্ষন। মনে হয় বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি থামছে না।
বৃষ্টির ছাটের মধ্যে ছুটে চলা হেডলাইটের আলোয় নির্জন রাস্তায় হটাৎ হটাৎ ভেসে ওঠে বৃষ্টিমাথায় একটা দুটো আবছা মানুষের প্রতিচ্ছবি। কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। আকাশের দিকে উকি মারি। খালি বিদ্যূতের চকমকানী।
হটাৎ পায়ের শব্দে ঘোরটা ভাঙে। একটা মাঝবয়সী তরুন। বৃষ্টির পানিতে তার শরীরের বেশিরভাগই ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছে। গা দিয়ে টুপটুপ করে জল ঝরছে।
: ভিজে গিয়েছেন মনে হয় পুরোটা?
: হ্যা- যা বৃষ্টি। যাচ্ছেতাই।
লোকটা বলে ঠিকই ‘যাচ্ছেতাই’, কিন্তু গলায় খুশী খুশী একটা আমেজ জড়িয়ে থাকে।
: অবশ্য এই ভিজে যাওয়াটাও ভাল লাগছে।
: কেন?
: অনেকদিন পর, বুঝলেন বাড়ি ফিরছিতো...
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে।
: সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। স্বপ্ন গায়ে মেখে বাড়ির ফেরাটাও একটা স্বপ্নের মত, তাই না?
উত্তরে আমিও ওর দিকে তাকিয়ে হাসি। লোকটা ভেজা প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে। পানিতে- পকেটের চাপে দুমড়ে মুচড়ে ভিজে গিয়েছে প্যাকেটটা। একটা সিগারেট বের করে কয়েকবারের চেষ্টায় ধরাতে পারে একটা। আগুনের আঁচে লালচে হয়ে ওঠে ওর মুখটা আমি বুঝতে পারি সিগারেট খাওয়ার জন্যই থেমেছে লোকটা। কষে একটা টান দেয় সে- ধোঁয়ায় ফুসফুস ভর্তি হয়ে বুকটা ফুলে ওঠে। নাক মুখ দিয়ে শরৎের মেঘ ছুটিয়ে তৃপ্তিতে ভেঙে পড়ে সে।
: আপনি বোধহয় অনেকক্ষণ দাড়িয়ে?
: হ্যা। অনেকক্ষণ।
: তাহলে আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আপনাকে- না ভিজতে চাইলে।
লোকটা আবার হাসে। সিগারেটে কষে আরেকটা টান দেয়। কী করেন আপনি?- ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করে সে।
কী উত্তর দেব বুঝতে পারি না। আসলে আমি কী করি? কিযে উত্তর দেব সত্যিই বুঝতে পারি না। কোনদিন কিছু সত্যিকারের করা হয়ে উঠলো না। মাথার মধ্যে ডেনভারের ঈগল পাখিটা ডানা মেলে উড়াল দেয়। অস্ফুট স্বরে বলি-
: খুজছি।
লোকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
: খুজছেন?
: হ্যা- খুজছি।
: কী খুজছেন?
: আমাকেই।
লোকটার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে আমি এবার বৃষ্টি মাথায় নেমে পড়ি। অন্ধকারের মধ্যে সাদা কুয়াশার মত বৃষ্টি আমাকে জড়িয়ে থাকে। সূচের মত বৃষ্টির ভেতরে নিজেকে গাথতে গাথতে আমি হেঁটে চলি। সেই বৃষ্টির ভেতরে রুনু, ফ্রিদা, বিনুদি, বঙ্গবন্ধু, আজফারভাই, শিমুল, তাজউদ্দিন, আব্রাহাম লিঙ্কন, খোকা ভাই, ফিদেল কাস্ট্রো, ঝুমি ঝরে ঝরে পড়ে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। ঘোরের মধ্যে টের পাই না বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে সেই কখন। যখন টের পেলাম তখন আকাশটা রাত শেষে সকালের একদম নীল, বৃষ্টিশেষের সোনালী রোদে - সেই নীল অনেক উচুঁতে মনে হয়। ঠিক তখন ও আমার পাশে এসে দাড়ায়। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।
: হিসেব বোঝ?
আমি ঠোট উল্টাই। ও কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
: অংক. অংক?
: নামতা আমার ভাল লাগে না।
: যোগে যোগে যোগ হয়।
বিয়োগে বিয়োগেও যোগ হয়।
কিন্তু বিয়োগে যোগে বিয়োগ হয়।
অংকটা শেখো। কাজে লাগবে। এসো এখন...
কংক্রীটের পাথুরে কালো পিচঢালা রাস্তায় নেমে পড়ে। ভিড়ের হৃদয় খুঁড়তে খুঁড়তে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে সে হাত নেড়ে আবার আমাকে ডাকে।
দুই মলাটের স্মৃতির ভেতরে আপনাকে রেখে ঈগলের ডানা পাখা ঝাপটায়। বাস্তবতার রুক্ষ প্রান্তরে এবার ডানা মেলে উড়াল দেবে। ঘরের উঠোন থেকে বেরিয়ে যাওয়া পথ ধরে পৃথিবী জুড়ে খুঁজে খুঁজে বেড়াবে শৈশবের লুকোচুরি খেলার মত লুকিয়ে থাকা নতুন ফ্রিদাকে... নতুন ঝুমিকে... নতুন খোকাভাইকে... নতুন আজফারভাইকে... নতুন কলম্বাসকে... নতুন নুর হোসেনকে... প্রভূকে ... হারানো স্মৃতিকে... প্রগাঢ় কোন বিশ্বাসকে... যার উপর ভর করে আবার স্বপ্ন স্মৃতি কল্পনার দুই মলাটে বন্দী হয়ে আবার অমল হয়ে আপনার জন্য জানালা ধরে অপেক্ষা করবে। কফিল ভাই রাজপথে রাজপথে শব্দ উড়িয়ে সবাইকে নিজের মধ্যে টেনে আনবে...
ছিড়ে নিলো
ছো মেরে ছিড়ে নিলো ছো মেরে ছিড়ে নিলো
ঘাস ফড়িঙের চোখটা
একটা পাখি এসে ছো মেরে ছিড়ে নিলো
ঘাস ফড়িঙের চোখটা
কবি ও কবি তুমি দেখেছো কি
এমনই ছিলো এমনইতো ছিল সকালের শুরুটা
একটা ঘাড়ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
একটা ঘাড়ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
ওরা বললো
আমার মা আমাকে পাঠিয়েছে তোমার কাছে
আমার মা আমাকে পাঠিয়েছে তোমার কাছে
এখন তুমি কি করবে কি করবে
পৃথিবী বল পৃথিবী
এখন তুমি কি করবে কি করবে
কেবলি রূপকথাটা ছড়িয়ে দিলাম চোখের সামনে
একটা ঘাড়ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
একটা ঘাড়ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
ঘোড়ার ক্ষুরের গানে গানে
তুমি এলামেলো হবে কি ধুলাবালি হবে কি
মাটি বলো হে বলো মাটি
হে তোমার ন্যাংটা বাচ্চাটা কই
হাতে হাতে খোলা দা তুলে দি দা তুলে দেই মাটি
হে বলো মাটি হে তোমার ন্যাংটা বাচ্চাটা কই
রাতভর ছিল তোমার মুখে যে সূর্যটা বাধানো
সূর্যটা জাগানো সূর্যটা ছড়ানো
একটা সকাল এসে ছো মেরে ছিড়ে নিল
ছো মেরে ছিড়ে নিল
মুখের সূর্যটা তোমার মুখের সূর্যটা
এই কবি
তুমি দেখেছো কি তুৃমি দেখেছো কি
এমনই ছিলো এমনইতো ছিল সকালের শুরুটা
এমনই ছিলো এমনইতো ছিল সকালের শুরুটা
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি উড়াল দিল
পাখি গাইলো আমার মা
আমার মা আমাকে পাঠিয়েছে তোমার কাছে
এখন তুমি কি করবে কি করবে - পৃথিবী
বলো পৃথিবী এখন তুমি কি করবে কি করবে
কেবলি রূপকথাটা ছড়িয়ে দিলাম চোখের সামনে
কেবলি রূপকথাটা ছড়িয়ে দিলাম চোখের সামনে
একটা পাখ ভাঙা পাখি উড়াল দিল
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি উড়াল দিল
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া উঠে দাড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি উড়াল দিল।
কই এলে না? বাস্তবতা যেন নাড়ি ধরে টান দেয়।
আসছি।
আমি দ্রুত পা ফেলি।
ওখানে কি অপেক্ষা করছে- আপাতত টগবগে কল্পনাতেও ধরা যাচ্ছে না।
মন্তব্য
কর্ণজয়,লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগলো।
_________________________
সর্বাঙ্গ কন্টকিত-বিধায় চলন বিচিত্র
খুব দরদ দিয়ে লিখেছ কর্ণজয়!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সত্যিই এঁর লেখাগুলো মনের খুব গভীরে দাগ কেটে যায়।
বাস্তবতা হলো, এত বড় লেখায় পাঠকেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
নতুন মন্তব্য করুন