মার্চের ২৫। মধ্যরাত।
গোলাগুলির শব্দে ঢাকা শহর কেঁপে উঠলে আলী আসগর সাহেব বিছানা থেকে উঠে বসলেন। একটানা গুলির শব্দের সাথে অস্পষ্ট শোরগোল শোনা যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করে অস্পষ্ট শব্দগুলো থেকে জয় বাংলা শব্দটি তিনি উদ্ধার করতে পারলেন। সমস্ত জোর গলায় এনে কেউ চিৎকার করে শব্দটা উচ্চারণ করেছে। কিন্তু গুলির শব্দের তীব্রতায় সেটা ঢেকে যেতে সময় লাগে না। এর পরে সময় কতটা কিভাবে যায় বোঝা যায় না। মাঝে মধ্যে গাড়ির শব্দ পাওয়া যায়। ভো শব্দ তুলে দ্রুত চলে গেল। আলী আসগরের কাছে মনে হলো - তিনি এর মধ্যে অনন্তকাল ধরে বসে আছেন। এর মধ্যে অবশ্য অবিরাম গুলির শব্দের মধ্যে থেমে থেমে কয়েকবার মানুষের শব্দও তিনি শুনতে পেয়েছেন। আর্তনাদের মত। আসগর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকে আর তার ঘুম হবে না। কত কয়েকদিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। ঘুম আসছে না। রাত যত বাড়তে থাকে মন খুব অস্থির হয়ে ওঠে। জায়নামাজে বসলে অস্থিরতাটা একটু কমে আসে। মানুষ সব সময়ে বিপদে পড়লে আল্লাহ্র কাছে ফিরে আসে। আলী আসগর সাহেব অবশ্য তা নন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজতো আদায়তো করেনই - নিয়মিত তাহাজ্জুত নফল নামাজও তিনি পড়েন। আলনা থেকে তিনি জায়নামাজটা তুলে নেন। গোলাগুলির আওয়াজটা একটু থেমেছে মনে হচ্ছে। সাথে সাথেই আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। বুকের মধ্যে একটা চাপ তাকে কাবু করে ফেলছে। তিনি জায়নামাজ মাটিতে পেড়ে নামাজে দাড়িয়ে পড়লেন। জায়নামাজে বসলেই তার মনে হয় কোন ওজন নেই। তার শরীর বাতাসের মত হালকা হতে শুরু করে। কিন্তু অনেকক্ষন জায়নামাজে বসে থাকার পরও তার আজকে মনের অস্থিরতা দুর হচ্ছে না।
হিন্দুদের হাতে আব্বাজান, আম্মাজান আর একমাত্র ছোটবোনের মৃত্যুর পর হিন্দুস্তান ত্যাগ করে আলী আসগর সাহেব যখন পাকিস্তানে পা রাখলেন তখন তার পুরো কপর্দকশূন্য অবস্থা। শূন্য থেকে তাকে আবার সবকিছু তৈরী করে নিতে হয়েছিল। ছোটখাট চাকরী দিয়ে শুরু, পরে চাকরী ছেড়ে একটা কাপড়ের ব্যবসায় যোগ দিয়ে এই পচিশ বছরে মোটামুটি অবস্থায় এসে পৌছেছেন। বিয়ে করেছেন। এক ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে মোটামুটি গুছিয়ে উঠলেও ঠিক শান্তি বলে যেটা বলে সেটা তিনি পান নি। তাকে এতিম করে দেয়ার জন্য সবসময়ই হিন্দুস্তান আর হিন্দুদের প্রতি একটা চাপা ক্রোধ তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। এই কারনে পশ্চিম পাকিস্তানের শত দোষ সত্ত্বেও শেখ মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার আন্দোলনের তিনি ঘোর বিরোধী। গত কয়েকদিনে যা ঘটে চলেছে তাতে তিনি ক্রমশ শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। অবশ্য ভুট্টো আর ইয়াহিয়া এসেছেন। তার মধ্যে খানিকটা আশার আলো জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু মধ্যরাতে গোলাগুলির আওয়াজে তিনি বুঝতে পারলেন সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নিশ্চয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা আর সেনাবাহিনী মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িত হয়ে পড়েছে। আজকে সন্ধ্যায় তিনি জয় বাংলা ব্যাজ পরা ছেলেদের রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে দেখেছেন। হিন্দুদের জন্য যে আগুন জ্বালিয়েছিল তা এখন মুসলমানদের নিজেদের ঘরেই হানা দিয়েছে। এর থেকে মুক্তির কোন আশা তিনি দেখতে পেলেন না।
হে পরম করুণাময়। পৃথিবী এবং আখেরাত এই দুই জীবনের তুমি সকল কিছুর মালিক। তোমার ইচ্ছায় সকল কিছুর সৃষ্টি - ধ্বংশও তোমার ইশারায়। জীবন এবং মৃত্যুর মালিক তুমি। আমাদের সকল বিপদ থেকে তুমি রক্ষা কর। আমাদের ভুল পথ থেকে রক্ষা কর।
আল্লাহর দরবারে আলী আসগর সাহেব হাত তুলে মোনাজাত ধরলেন। ঠিক সেই সময় ঘরের দরজাটা লাথির শব্দে কেঁপে উঠলো। তিনি মোনাজাতের হাত তুলে বসেই রইলেন। তার কি করা উচিৎ - তা তিনি ভেবেই পেলেন না। পচিশ বছর আগের ঠিক এরকম এক মুহূর্তের মতই তিনি শূন্য, স্থবির। তিনি জায়নামাজে বসেই শুনতে পেলেন দরজা ভেঙে বুটের খটখট শব্দ তুলে কেউ তার ঘরে এসে ঢুকলো। মিলিটারি! তিনি বুঝতে পারলেন। কিন্তু তার এখানে কেন? তিনি মুখ তুলে তাকালেন। ততক্ষনে মিলিটারীদের বন্দুকের নল থেকে একঝাক তপ্ত শীসা বের হয়ে তার দিকে ধেঁয়ে আসছে। তাকে ঝাঝরা করে দিতে সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময় লাগে ওদের। কিন্তু এই ভগ্নাংশ সময়টুকুতেই তার চোখে পচিশ বছর আগের স্মৃতি ভেসে ওঠে।
গোটা কলকাতা তখন দাঙ্গার আগুনে পুড়ছে। আশেপাশের অনেক মুসলমান পরিবারই নিরাপত্তার খোঁজে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। যাওয়ার আগে তাদের অনেকেই তার আব্বাজানকে বলেছে - ‘পাকিস্তানে চলে যান। সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচতে পারবেন না। হিন্দুরা আপনাদের কেটে ফেলবে।’ আব্বাজান তাদের কোন কথাই শোনেন নি। আসলে এই জায়গা ছেড়ে দেয়ার কথা তার পক্ষে চিন্তা করাও কঠিন ছিল। এখানে তিনি জন্ম নিয়েছেন। বড় হয়েছেন। তখন তাদের অবস্থা এত ভাল ছিল না। দাদজানের আমলের ছোট্ট টিনের দোচালা বাড়ি - আলী আসগর সাহেবের চোখের সামনেই আব্বাজানের শ্রমে একটু একটু করে স্বচ্ছল রূপ নিয়েছে। দাদাজান তখনও বেঁচে। প্রথমে টিনের চালের বাড়ির জায়গায় পাকা দালান, তারপরে কয়েক বছরের মধ্যে পাশেই জায়গা কিনে নতুন দুই তালা বিল্ডিং তুললেন আব্বাজান। কিন্তু দাদাজান ঐ নতুন বাড়িতে কখনই উঠেন নি। দাদাজানের মৃত্যুর পরে আব্বাজান ঐ পুরনো বাড়িতে ধর্মকর্মের জন্য একটা বড় সময় কাটাতেন। শূধু তাই নয়, মাসের শেষ দশদিন বাড়ির সব কাজ কর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পুরোপুরি ধর্মচর্চার জন্য ঐ বাড়িতে এতকা’ফ পালন করতেন। তিনি একবারের জন্যও নতুন বাড়িতে আসতেন না। বাড়িটার সামনে একচিলতে জমিতে তিনি নিজের হাতে শাক সবজি লাগিয়েছিলেন। নানা জাতের কয়েকটা গোলাপ গাছও লাগিয়েছিলেন আব্বাজান। এতেকা'ফের দিনগুলোতে ধর্মচর্চা ছাড়া নিজের হাতে গাছগুলোর যতœ নেয়ার কাজটিই শুধু করতেন। নিজের হাতে গড়া এই সমস্ত কিছু ফেলে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
আলী আসগর তখন বাইশ বছরের যুবক। গোটা পৃথিবী তার সামনে পড়ে আছে। চারদিকের ভাবগতিকে সে কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছিল - পরিস্থিতিটা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। হিন্দুদের চোখের মধ্যে এক ধরনের বিদ্বেষ সে টের পায়, আগে এটা ছিল না। এখানে মুসলমানদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। কি হবে কিছুই বলা যায় না। আর যদি কিছূ নাও হয়, এই ভীতি আর ত্রাস থেকে তারা কিভাবে বাঁচবে? তার এই শঙ্কা আম্মাজানকেও স্পর্শ করে। তিনিও আসগর আর তার নয় বছরের মেয়ে কুলসুমের কি হবে এই ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আম্মজান আব্বাজানকে সন্তানদের কথা ভেবে হলেও পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য জোর করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি।
এক দুপুরে আসগর বাড়ি থেকে বাইওে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে দেখলো - দলা পাঁকানো একটা কাগজের টুকরো তার দরজার সামনে পড়ে আছে। উপরে তার নাম লেখা। সে কাগজের টুকরো নিয়ে খূলে দেখলো তার জন্য একটা চিরকূট লেখা আছে।
সাবধান-
আজ রাতে হামলার কথা চলছে।
সে বুঝতে পারে না। এটা কতটুকু সত্যি। বাইরে ঘোঁষেদের দোকানে তাকে দেখে কয়েকজনের ভাবভঙ্গি দেখে তার সন্দেহ হয় -হয়তো ঘটনাটা সত্যি। পরে নিমাই ঘোঁষের ছেলে মন্টু তাকে না দেখার ভান করে পাশ দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় ও মন্টুর গলা শুনতে পারলো - চিঠিটা পেয়েছিস? সে মন্টুর দিকে তাকাই, কিন্তু মন্টু তার দিকে না তাকিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেল সে ব্যাপারটা নিশ্চিত হলো। সে দৌড়ে বাড়ি চলে আসে। আম্মাজানকে বলার আগে সে দাদাজানের ঘরে এসে ঢুকে।
আব্বাজানের তখন এতকা’ফ চলছিল ।
: আব্বা আজকে আমাদের এখানে হামলা করবে ওরা।
হাঁফাতে হাঁফাতে বলে আসগর।
চিন্তা করো না। জীবন দেয়ার মালিক আল্লাহ্। মরণের মালিকও আল্লাহ্। তিনি যদি হায়াৎ রাখেন - তাহলে কেউই কোন কিছু করতে পারবে না। আর তার যদি ইচ্ছে হয় - পাকিস্তান গিয়েও কেউ বাঁচতে পারবে না।
ধর্মে সুগভীর পান্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেন নি। তিনি বলতেন - এটা হলো রাজনীতি। প্রখ্যাত ইসলামী আলেম আর কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদের সাথে এ নিয়ে তার তিনবার পত্র বিনিময়ও ঘটেছিল। পাকিস্তান যদি মুসলমানদেরই হবে তাহলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র মত একজন মানুষ - ধর্মের সাথে তার জীবন যাপনের কোন যোগ নেই - তিনি কিভাবে মুসলানদের নেতা হন এটা কোন যুক্তিতেই তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। শোনা যায় তিনি নাকি নামাজ পড়তেও জানেন না। আরা খুব মদ খান। আর তাকেই মুসলমানরা কায়েদে আযম উপাধি দিয়েছে। এসব নিয়ে তিনি খুবই বিরক্ত। মুসলমানরা যে আসলে ধর্ম না জেনে ধর্ম নিয়ে মেতে উঠেছে এই উপলব্ধি থেকে তিনি কোরআন এর তরজমা আরম্ভ করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলন শ্রেফ একটা কতিপয় স্বার্থান্বেষী মুসলমান রাজনীতিবিদের ক্ষমতার রাজনীতি, এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই - এটাই ছিল তার ধারণা।
প্রতিদিনের মতই সেদিনও বিকেলবেলায় বাগানের কাজ শেষ করে - তিনি মাগরিবের নামাজ পড়লেন। তারপর পুরনো বাড়িতে দাদাজানের ঘরে গিয়ে কোরআন নিয়ে বসলেন। সুরা আনআমের তরজমাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
: আব্বাজান
পুত্রের ডাকে তিনি মুখ তুললেন।
: আজকে বিশ্রাম নিলে হয় না?
তার মুখে স্নেহার্ত হাসি ফুটে উঠলো।
: আল্লাহ্র কাজে কোন বিশ্রাম নেই।
: আজকের রাতটা একসাথে থাকি।
: আমি এতকা’ফ করছি আসগর। তুমি এসো।
আসগর বুঝতে পারে আব্বাজান শত অনুরোধেও এই জায়গা থেকে উঠবেন না। বড় বাড়িটায় থাকলেও একটু স্বস্তি ছিল। দালানটার দরজাটা শক্ত, ওরা যদি আক্রমণও করে কিছুক্ষন ঠেকিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু এই ঘরে বাঁচার কোন উপায়ই নেই। তার কিছুতেই আব্বাজানকে একা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না।
: আব্বাজান, আমি আজকে আপনার সঙ্গে থাকি।
: আমার সঙ্গে নয়। তুমি যদি ধর্মের সঙ্গে থাকতে পারো - তাহলে থাকতে পারো।
আব্বাজান বললেন। আসগর আম্মাজানকে বলে রাতের খাবার নিয়ে পুরনো বাড়িতে ফিরে এলো। আব্বাজান তখন গভীর একাগ্রতার সাথে তরজমা করে চলছেন। সে চুপচাপ বসে আব্বাজানকে দেখতে থাকে।
আব্বাজান এক এক অংশ তরজমা করছেন আর নিজে নিজে সেই তরজমার অংশ আবৃত্তি করছেন।
‘যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টিলাভের জন্য প্রার্থনা করে তুমি তাদের তাড়িয়ে দিও না। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয়, আর তোমার কোন কর্মের জবাবদিহির দায়িত্বও তাদের নয় যে তুমি তাদের তাড়িয়ে দেবে। তাড়িয়ে দিলে তুমি সীমালঙ্ঘনকারীদের শামিল হবে।’
কোরআনে এই কথা বলা আছে! আসগরের অবাক লাগে। নিজেরা যখন ধর্ম নিয়ে আলোচনা করে তখন নিজেদের ধর্ম নিয়ে কথার চাইতে অন্যধর্মগুলোকে আক্রমণ করেই বেশি কথা হয়।
‘আর তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকে তাদেরকে তোমরা বাজে নামে ডাকবে না, তাদেও নিয়ে কটুক্তি করবে না। তাহলে তারা না জেনে আল্লাহ্কে কটূক্তি করবে। এভাবে প্রত্যেক জাতির চোখে তাদের কার্যকলাপ সুন্দর করে তৈরী করেছি। তারপর তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে। তখন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সন্মন্ধ্যে জানিয়ে দেবেন।
আসগরের মনে হয় সে এক নতুন ধর্মের কথা শুনছে। সে যেই ইসলাম চেনে এই ইসলাম সেই ইসলাম না।
আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য স্পষ্ট পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। ইচ্ছা করলে আল্লাহ্ তোমাদেরকে এক জাতি হিসেবে তৈরী করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য তা করেন নি। তাই সৎকর্মে তোমরা প্রতিযোগিতা কর। সৃষ্টিকর্তার কাছেই তোমরা একদিন ফিরে যাবে। তখন তিনি তোমাদের মধ্যকার যে মতভেদ সে বিষয়ে তোমাদের জানিয়ে দেবেন।
আব্বাজানের তরজমা শুনতে শুনতে আসগর উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে আব্বাজানকে জিজ্ঞাসা করে উঠে
: অনেকে যে বলে মুসলমান ছাড়া আর কেউ বেহেশতে যাবে না, এটা কি সত্যি?’
আব্বাজান ছেলের কথা শূনে হাসলেন।
: কে বেহেশ্ত পাবে আর কে পাবে না, সে কথা শুধু আল্লাহ্ বলতে পারেন। কারন একমাত্র তিনিই সব জানেন, তিনিই সব দেখেন। তিনিই অন্তরের কথা জানেন। কোন মানুষ বলতে পারে না - কারা বেহেশত প্রাপ্ত হবে কারা হবে না। তিনিই একমাত্র ন্যায় বিচারক।
: তাহলে যে মৌলানা আর মৌলভিরা বিধর্মীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার কথা বলেন।
: আল্লাহ বলেছেন - ‘তোমরা মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা, মন্দির, কোন উপসানালয় ধ্বংশ করো না। কারন এখানেই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়।’
আসগরের জন্য এ সব কথাই ছিল নতুন। মন্দিরে আল্লাহ্কে স্মরণ করা হয়। কিভাবে? এই সব চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়ে আসন্ন বিপদের কথা খেয়াল থাকে না।
ঠিক এই সময়েই ওরা এলো। ‘জয় মা কালী’ - ‘বন্দে মাতেরম’ ধ্বনি তুলে ওরা যখন ছোরা, বল্লম, রামদা, লাঠি নিয়ে নড়বড়ে সদর দরজা ভেঙে বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়েছিল তখন আব্বাজান লেখা না থামিয়েই তাকে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে আম্মাজান আর ছোটবোনের কাছে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। আসগর সাহেব থমকে দাড়িয়েছিলেন, কিন্তু আব্বাজানের স্থির চোখের কঠোর নির্দেশ অমান্য করতে না পেরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আম্মাজান আর ছোট বোনের কাছেও পৌছাতে পারেন নি। তার আগেই হিন্দুদের আর একটা দল বড় দালানে উঠে ছোট বোন আর আম্মাজানের উপর চড়াও হয়েছে। দুর থেকে তাদের আর্তনাদ আর চিৎকার ভেসে এসেছিল। আসগর সাহেবের মাথায় কোন কিছুই কাজ করছিল না তখন। না পালিয়ে যাওয়ার কথা, না তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার কথা। একটা শূন্যতা এসে তাকে স্থবির করে দিয়েছিল। পেছনের গোয়াল ঘরের কাছে তিনি কিসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনিও জানেন না। ওরা যখন চলে গেল, তখন তিনটি ছিন্নভিন্ন লাশ ছাড়া বাড়িতে তারজন্য আর কিছুই ছিল না। তার মাঝে মধ্যে মনে হয় তিনি বেঁচে না থাকলেই ভাল হতো। এই অসহ্য অক্ষমতার কষ্ট আর ঘৃণা নিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হতো না। আব্বাজানের শেষ গোঙানির শব্দ, আম্মাজান আর ছোটবোনের আর্তনাদ তার মাথার মধ্যে জমা হয়ে গিয়েছিল। যখন তখন তিনি এই শব্দ শূনতে পান। তখন মনে হয় বেঁচে থেকে তিনি অপরাধ করেছেন। তারপরও তিনি বেঁচে আছেন। এই বেঁচে থাকাটাও তার কাছে অবাস্তব মনে হয়।
আব্বাজান- আম্মাজান- ছোট বোনের মৃত্যু তার মধ্যে হিন্দুদের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা আর বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল। গোটা হিন্দুস্তানকে পুড়িয়ে ছারখার করার বাসনা তার মনের মধ্যে ছটফট করতো। তার কল্পনা প্রতিদিন অসংখ্য হিন্দুর রক্তে লাল হয়ে উঠতো। কিন্ত এসব প্রতিহিংসাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মত সাহস কিংবা প্রকৃতি কোনটাই তার ছিল না। চারপাশে হিন্দুদের আস্ফালন দেখার যন্ত্রণা এড়াতে শেষ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানে চলে আসলেন। পাকিস্তানে চলে আসার পথটাও ছিল বিপদ শঙ্কুল। জায়গায় জায়গায় হিন্দুরা সীমান্তমুখী বাস-ট্রাকগুলোকে থামিয়ে মুসলমানদের জবাই করছে, প্রতিদিনই এইসব শত শত খবর বাতাসে উড়ছে। কিন্তু এর মধ্যেই দলে দলে মুসলমানরা নিরাপত্তার খোঁজে পাকিস্তানে রওনা দিচ্ছে। একবার ওখানে পৌছুতে পারলেই প্রতিমুহূর্তের ভয় আর আতঙ্ক থেকে মুক্তি মিলবে। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মুসলিম পরিবারের সাথে একটা ট্রাকে চেপে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যশোরের দিকে রওনা দিলেন। সেদিনই তাদের মৃত্যু হতে পারতো। ট্রাকের শিখ ড্রাইভারের কারণে সেদিন তারা বেঁচে পাকিস্তানে ঢুকতে পেরেছিলেন। ট্রাকের পেছনে গাদাগাদি করে ঠাই নেয়া ছয় পরিবারের জনা পঞ্চাশেক নারী পুরুষ শিশুকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। বাইরে থেকে যেন এটাকে মালবাহী মনে হয়। আসগর সাহেব ছিলেন একা। তিনি আর পেছনে উঠেন নি, ট্রাকের কেবিনে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসেছিলেন। এইজন্যই ঘটনাটা তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। রাতের বেলা। অন্ধকার চিরে ট্রাক ছুটে চলেছে। হটাৎ হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল কৃপান, ছোরা আর লাঠি হাতে হিন্দুদের একটা দল রাস্তায় উঠে তাদের ট্রাকটা থামানোর জন্য ইশারা করছে। তাদের দেখেই উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। আসগর সাহেবের ভয় তার আত্মা ধ্বক করে উঠলো। কিন্তু শিখ ড্রাইভার না থামিয়ে ট্রাকটা নির্বিকারভাবে তাদের উপর দিয়ে সোজা চালিয়ে দিয়েছিল। ট্রাকের তলায় লটকে যাওয়ার আগে একজনের বিস্ফোরিত ভয়ার্ত দৃষ্টি তার চোখের উপর এসে পড়েছিল। অদ্ভুত একটা আনন্দ তার মধ্যে বয়ে গিয়েছিল। ঠিক হয়েছে। উচিৎ শিক্ষা হয়েছে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে পড়তে আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যেও গুলি ছুড়তে থাকা মিলাটারীদের চোখে সেই একই আনন্দ তিনি দেখতে পেলেন। তিনি মাথার কাছে স্পষ্ট আব্বাজানের কথাটা শুনতে পারলেন - ‘ আর তার যদি ইচ্ছে হয় - পাকিস্তান গিয়েও কেউ বাঁচতে পারবে না।’
অনেক কষ্টে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে তিনি আব্বাজানকে ডাকলেন - ‘আব্বাজান...’ তারপরই চিরনিদ্রার মধ্যে তলিয়ে গেলেন।
জায়নামাজের উপর আসগর আলী সাহেবের রক্তাক্ত দেহ মাড়িয়ে সৈন্যদের দল বাড়ির ভেতর ঘরে ঢুকে গেল।
ঠাঠাঠাঠা।
মন্তব্য
যে যেখানেই থাকুক সঙ্খ্যালঘুদের কোন নিজের দেশ নেই। আর ধর্মের চেয়ে বড় রাজনীতি কিছুই নেই।
অসাধারন।
..................................................................
#Banshibir.
বাহ ,
নতুন মন্তব্য করুন