রোদটা একেবারে ঝলসে দিচ্ছে। এতবড় আকাশ। কিন্তু একফোঁটা ছেঁড়া খোড়া মেঘও নেই। কোথাও।
ঘেমে গিয়ে শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। পিঠের কাঁছটায় সারাক্ষন ভেঁজা ভেঁজা। বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি। সবকিছু, মনে হচ্ছে সব কাঁপছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় কয়েকটা বাড়ি। কিন্তু ছায়া নেই। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর। চায়ের কথা মনে হয়। চা খেলে গরমটা কমতো। একটা হোটেলে ঢুকবো ভাবি। কিন্তু পকেটে মাত্র এগারো টাকা আছে। এক কাপ চায়েই অর্ধেক হয়ে যাবে। এখনও পুরোটা দিন পড়ে আছে।এবং তার পরের দিনগুলোও। টাকা হয়তো আসবে। কিন্তু কোথা থেকে, এখনও জানি না।
এই সময়ই ফোনটা আসে। আজকাল তেমন কেউ ফোন করে না। তাই মাঝে মধ্যে হটাৎ হটাৎ ফোনটা বেজে ওঠে খুব ভাল লাগে। মনের মধ্যে একটা অজানা মুখ ভেসে ওঠে। মনে হয় কেউ আছে। তাড়াতাড়ি ফোনটা বের করতে যাই। ঘেমো হাতে ফোনটা ঠিকমত পকেট থেকে বের করতে পারি না। ক্রিং। ক্রিং। অস্থির লাগে। ভয় লাগে। ফোনটা কেটে গেলে যদি আর না করে। ফোনে দুই টাকা চার পয়সা আছে। কল ব্যাক করে কথা বলা যাবে না। ফোনটা বেজে যাচ্ছে। পকেটে অনেক টুকরা টাকরো কাগজ ছিল। ওগুলোর সাথে জড়িয়ে গেছে। ফোনটা বের করতে পারি। সাথে সাথে ওরাও বের হয়ে রাস্তায় ঝরে পড়ে। কেটে যাওয়ার আগেই ফোনটা ধরি। গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। অচেনা গলা। গলাটা শুনে মনে হয় বয়স্ক মানুষ।
- আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই।
- আমার সাথে, কেন?
মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় কথাটা। আমার এরকম ফোন কখনও আসে নি।
- সেটা সামনাসামনিই বলি।
- ঠিক আছে। কোথায় আসবো?
তিনি একটা চীনে রেস্তরার নাম বললেন। ভিড় থাকে না বলে, আর খাবার সার্ভ করতেও অনেক সময় নেয় বলে চীনে রেস্তরাগুলো আমার সবসময়েই প্রিয়। আমি বললাম, ঠিক আছে।
- কখন পারবেন? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
- আমার সবসময় সময় আছে। যখনই বলবেন আমি আসতে পারবো।
- তাহলে এখনই চলে আসুন।
- জ্বি, আসছি।
তিনি ফোনটা কেটে দিলেন। অথবা কেটে গেল। তখনই মনে পড়ে গেলো - রেস্তরাটা কোথায়? এটাই জানা হলো না।
নাম দিয়ে চীনে রেস্তরা খুঁজে বের করা অসম্ভব একটা ব্যাপার। সব চীনে রেস্তরার নাম একইরকম লাগে। ঠিকানাটা নেয়ার জন্য ফোন করতে যাবো - দেখি মোবাইলের রিসেন্ট কল লিস্টে একটা ০ ভেসে আছে। আশ্চর্য্য তো! কি আর করা। রেস্তরায় পৌছে আমাকে নিশ্চয় আবার ফোন করবেন। তারপর আমি রওনা দিতে পারবো। তাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। এই আর কি।
পকেট থেকে পড়ে যাওয়া কাগজগুলো রাস্তাময় ছড়িয়ে আছে। ঝরা পাতার মত। এর মধ্যে একটা বাতাস বয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়। টের পাই নি।কাগজগুলেকুড়িয়ে মাথা তুলতেই দেখি আজব কান্ড। রাস্তার ঠিক উল্টোপাশে একটা রেস্তরা দাড়িয়ে আছে। বিরাট একটা সাইনবোর্ড ঝলানো। তাতে ভদ্রলোক যে রেস্তরার কথা বললেন তার নাম লেখা। এই রাস্তাটা আমার পরিচিত। অনেকদিন ধরেই। কবে যে এই রেস্তরাটা হলো্ চোখেই পড়েনি।। মনটা ভাল হয়ে ওঠে। চীনা রেস্তরার পরিচিত ঠান্ডা আধো অন্ধকারটা দেখতে পাই। যাক! অসহ্য গরমটা থেকে বাঁচা যাবে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি। রেস্তরাটা যে এত বড়, বাইরে থেকে একটু বোঝা যায় না। সারি সারি টেবিল। ফাঁকা ফাঁকা। জন করে বসে আছে। কয়েকটা টেবিল খালি। একটা ফাঁকা টেবিল দেখে এগিয়ে যেতেই থমকে যাই। কে জানি আমার নাম ধরে ডাকছে। ঘুরে দেখি, অনেক দুরের একটা টেবিল থেকে একজন আমাকে ইশারা করছে। মাথায় হ্যাট, অন্ধকারে চেহারাটা ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অবয়ব দেখে অপরিচিতই মনে হয়। কিন্তু ডাক দেয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হলো তিনি আমাকে চেনেন। আর জানেন- আমি আসছি। একটু অবাক হলাম। তাহলে কি তিনি আমাকে রাস্তায় দেখেই ফোনটা দিয়েছেন? সবকিছু মিলিয়ে ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারি না।
টেবিলের কাছে আসি। তিনি ইশারায় বসতে বললেন। নাকে টমিয়াম স্যূপের গন্ধ ভেসে আসে। জিবের ডগা এক মুহূর্তে ভিজে ওঠে । আমি আড়চোখে তাকাই। লালচে স্যূপের মধ্যে বড় বড় সাইজের চিংড়ি ভেসে আছে। মাত্র দিয়ে গেছে বোধহয়। ডিশটা ধরাই হয় নি। ধোঁয়া উড়ছে এখনও। কিন্তু খাওয়ার বাটি দেখলাম একটাই। তিনি খালি বাটিটা টেনে নিয়ে স্যূপভর্তি করতে থাকলেন। আমি তাকে লক্ষ্য করি। ষাটের কোঠায় বয়স। চেহারাটা খুব চেনা চেনা। আগে কোথাও তাকে দেখেছি, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। তিনি বাটিটা ভর্তি করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। না না। আমি তাকেই শুরু করতে বলি। তিনি হাসলেন।
- স্যূপটা আপনার জন্যই। আমি স্যূপ খাই না।
চাইনিজ রেস্তরায় খাবারের অর্ডার দিলেও কমপক্ষে বিশ মিনিট লাগে খাবার পেতে। আর তার ফোন পাওয়ার পরে পাঁচ মিনিটও যায় নি। সেই হিসেবে আমার সাথে কথা বলার আগেই তিনি আমার জন্য খাবারের অর্ডার দিয়েছেন। তাও আবার টমিয়াম স্যূপ! টমিয়্যাম স্যূপ আমার প্রিয় খাবার। স্যূপের মধ্যে ঝাল ঝাল। খেতে মজা লাগে। পেট পুরে খাওয়া যায়। আবার একটু পরেই ক্ষিধে লাগে। কিন্তু ভদ্রলোক জানলেন কি করে এটাই আমি খেতে চাই? আমি খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। তিনি হ্যাটটা খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে হাসতে থাকলেন। এটা কি করে সম্ভব? আমি ভয়ে জমে গেলাম। আমার সামনে হুমায়ূন আহমেদ বসে আছেন।
- অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্যূপটা নাও। গরম গরম ভাল লাগবে।
কিন্তু আমার হাত পা নাড়ানোর মতও শক্তি নেই। হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। অথচ তিনি এখন আমার সামনে বসে আছেন। গোটা শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করে। - এরা টমিয়াম স্যূপটা খুব ভাল করে। একবার খেয়ে দেখ, এত ভাল স্যূপ ঢাকা শহরে আর কেউ বানায় না। আর তুমি বলছি বলে রাগ করো না। আমি বয়সে তোমার চেয়ে বড়ো।
কথাবার্তা, তাকানো, শরীরের ভঙ্গি সবকিছুতেই খুব আন্তরিক লাগে তাকে। হটাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি মনে মনে লজ্জ্বা পাই। শুধুমাত্র চেহারার মিলের কারণে তাকে হুমায়ূন আহমেদ ভেবে ভয় পেয়ে যাওয়াটা খুব বোকার মত হয়ে গেল। বাচ্চাদের মত। তবে তার মুখের মিটিমিটি হাসি দেখে মনে হলো, এরকম ভুল আরও অনেকেই করে। আর মানুষের এইসব ভুলগুলো দেখতে তার মজাই লাগে।
- কি হলো, নাও। তিনি তাড়া দিয়ে ওঠেন।
স্যূপটা মুখে দিয়েই বুঝলাম ভদ্রলোক বাড়িয়ে বলেন নি। আসলেই এত মজার স্যূপ আমি আগে কখনই খাই নি।
- কি ভাল না, ওদের রান্না ?
- খুবই। খুবই মজার।
এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। ভদ্রলোক বললেন। আমি স্যূপ মুখে নিতে নিতে তার দিকে তাকায় ।
- এটা একটা বিশেষ ধরণের কাজ। মাত্র দুজন মিলে কাজটা করতে হবে। একজন আমি। আর একজনকে দরকার। আমি অনেককে যাচাই করেছি। শেষ পর্যন্ত তোমাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছে। তুমি করলেই কাজটা সবচেয়ে ভাল হবে।
আমি! আমি করলে কাজটা সবচেয়ে ভাল হবে!! আমার গলায় আস্ত চিঙড়িটা আটকে গেল।
আমি বলতে গেলে একটা অপদার্থ গোছের মানুষ। কাজ বলতে যা বোঝায়, তার কোন কিছুই হয় নি আমাকে দিয়ে। ফলাফলশূন্য অতীত, বেকার বর্তমান আর আশাহীন ভবিষ্যত। নিজের সম্পর্কে আমার এরকম ধারণা। অন্যরাও তাই মনে করে। জীবনে এত আশার গল্প শুনেছি, এখন আর নিরাশ হই না। সুখ কিংবা দুঃখ একই রকম লাগে। ব্যর্থতা বলে কিছু অনুভব করি না। সফলতা সেটা মানুষের নিজের তৈরী করা কাল্পনিক বিষয় মনে হয়। ভুল ঠিক বলে কোন কিছু আলাদা করতে পারি না। পাপ আর পূণ্য মনে হয় একই জিনিষের এপিঠ ওপিঠ। জীবন বলতে আমার কাছে - বেঁচে থাকা।
- এই যে বেঁচে আছো, কি উপার্জন করেছো তুমি? অনেক সময় আমি নিজেকে নিজে বলি।
- আচ্ছা উপার্জন কাকে বলে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি।
- যা আসলে তোমার।
আমি ভাবি। কি আমার? যা আসলে আমার। আমি স্মৃতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। টুকরো টুকরো। সারা জীবন ধরে প্রতি মুহূর্তে আমি সঞ্চয় করেছি। বেশিরভাগই মনে পড়ে না। কিছু কিছু মনে পড়ে। সেগুলোই আমার মনে হয়। সেগুলো আর কারো নয়। মুহূর্ত। আমি খুশি হয়ে উঠি। এই মুহূর্তগুলোই আমার উপার্জন। যত রকম মুহূর্ত আছে। যে মুহূর্তগুলো আমি ভাবতে পারি, সেটাই আমার উপার্জন।
যার কোন কিছুতেই কোন কিছু যায় আসে না, আজকের দুনিয়ায় এই রকম একজন মানুষকে কোন কাজে লাগবে? আমি ভেবে পাইনা।
- কি কাজ?
- কাজটার মূল বিশেষত্ব হলো, যে দুইজন এই কাজটা করবে তাদের একজনকে মৃত হতে হবে।
কথা শুনে একটু ধাক্কা খেলাম। লোকটার মুখে ছেলেমানুষী দুষ্টু হাসি। লোকটা যে মজা করছে বুঝতে বাকি থাকে না। আসলেই মজার লোক। আর স্যূপটা, সেটাও সত্যি মজার। লোকটার নাটুকে কথাবার্তায় দেখে আমারও ভাল লাগতে শুরু করে।
- এখন তুমি যদি কাজটা কর তাহলে আমরা দুজনে কাজটা করে ফেলতে পারি। করবে নাকি কাজটা ?
- আমার কাজটা কি ? আমিও একটু সিরিয়াস হওয়ার ভান করি।
- তার আগে একটু বলে নেই কাজটার জন্য তোমাকেই কেন বলছি। তাহলে তোমার কাজটা আরও সহজ হয়ে যাবে।
আমি তার দিকে তাকাই। আমার সম্পর্কে কি বলেন, শুনতে আগ্রহ হচ্ছে।
- তোমাকে বলার এক নম্বর কারণ - তুমি আমার ভক্ত নও। আর দুই নম্বর - তুমি একজন লেখক।
লোকটা আসলে কি চায়?
এটা ঠিক, তার চেহারা অবিকল হুমায়ূন আহমেদের মত। তবে তার শেষ দিনগুলোর মত নয়। শেষদিনগুলোতে কেমোথেরাপির কারনে তার চেহারাটা একটু এলিয়েন এলিয়েন হয়ে গিয়েছিল। আরো দশ বারো বছর আগের প্রাঞ্জল চেহারার মত চেহারা এই ভদ্রলোকের। খ্যাতিমান মানুষের সাথে চেহারায় মিল থাকলে এক ধরনের অসুখ হতে পারে শুনেছি। সে নিজেকে ঐ খ্যাতিমান মানুষ বলে ভাবতে শুরু করে সে। ইনার হয়তো সেরকম একটা রোগ হয়েছে। নিজেকে হুমায়ূন আহমেদ ভাবতে শুরু করেছেন।
আমার বন্ধুদের একজনের এরকম একটা রোগ হয়েছিল। তার অবশ্য কোন খ্যাতিমান মানুষের সাথে চেহারার মিল ছিল না। এই হুমায়ূন আহমেদেরই একটা গল্পের চরিত্র আছে হিমু। সে নিজেকে হিমু ভাবতে শুরু করেছিল। এই ভদ্রলোকের বেলায়ও এরকম একটা কিছু হতে পারে। পরিচিতরা সবসময় তাকে হুমায়ূন ডাকতে ডাকতে নিজেই হুমায়ূন হয়ে গেছে। আবার শ্রেফ মজা করার বাতিকও থাকতে পারে। মানুষকে চমকে দেবার একটা মজা আছে। তবে এটা ঠিক। ভদ্রলোক আমাকে যথেষ্ট চমকে দিয়েছেন। একেবারে শুরু থেকেই।
বলা যায় শেষ পর্যন্ত তার সবকিছুই ঠিকই ছিল। শুধু ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছেন। কিন্তু বড় ভুল। আমাকে ফোন করার আগে আমার সম্পর্কে তিনি নিশ্চয় খোঁজ নিয়েছেন। সেখানেই ভুলটা হয়েছে। অথবা আমাকে অন্য কারো সাথে মিলিয়েছেন।
যদিও এক নাম্বার তথ্যটা ঠিক আছে।
আমি হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত নই। কিন্তু খুব একটা অপছন্দ করি তাও না। আসলে তাকে নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। তার বইগুলো কখনও আমি হাতে তুলে নেই নি। বলা যায়, বইগুলো আমার হাতে লাফিয়ে উঠেছে।আর তারপর কিছুক্ষন পর বইটা রেখে ফেলে উঠে চলে গেছি। এভাবে তার কত বই যে পড়েছি নিজেও বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলা যায় আর কারো এত বই পড়ি নি।
তারপরও যখন কোনো বই এর কথা মনে পড়ে তার কোন বই এর কথা মনে পড়ে না। সব বইগুলো একই রকম লাগে। অনেকবার এরকম হয়েছে, তার একটা বই হাতে নিয়েছি। দুই চার পৃষ্ঠা পড়ার পর মনে পড়লো - বইটা আগে পড়া। তবু পড়ি। ভাল লাগে। এক টানেই শেষ হয়ে যায়। শেষ করার পর বুঝতে পারি- বইটা নতুন। আগে পড়া হয় নি। আবার উল্টোটাও হয়েছে। নতুন বই ভেবে পুরোটা শেষ করার পর মনে পড়েছে- বইটা আগে পড়েছি।
তার সব বইগুলোই একই সাঙ্গে আগে পড়া এবং নতুন। আধা চেনা আধা অচেনা। এর জন্য পড়তে ভাল লাগে। মাথা ধরা সেরে যায়। মন ভাল হয়ে যায়। ঘুমের ওষুধ কিংবা স্টেরয়েডের কাজ করে। তারপর শেষ। টিভি দেখার মত।
কিন্তু দুই নম্বরটা পুরোপুরি ভুল।
আমি লেখক নই। লেখার সাথেও কোনরকম সম্পর্ক নেই। কোনদিন লেখক হওয়ার কথা মনেও হয় নি। কোন লেখক বন্ধু নেই। । অবশ্য প্রথম প্রেমে পড়ে বন্ধুদের কেউ কেউ দু একটা আস্ত কবিতা লিখে ফেলেছিল। আমি সেই চেষ্টাটাও করি নি। তিনি ভুল করেছেন। অথবা... তিনি আন্দাজে ঢিল ছুড়েছেন। আমি হটাৎ বুঝতে পারলাম... তিনি আসলে মজা করছেন। আমি আবার টমিয়াম স্যূপটা মুখে নেই। আসলেই মজার। খুবই ভাল রাধে ওরা।
- দেখ তুমি যা ভাবছো তা ঠিক নয়। তুমি একজন লেখক। এবং বেশ ভাল একজন ডায়েরী লেখক।
ডায়েরী লেখক! আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। কিছু কিছু হাসি আছে কান্নার মত। আমার ভেতরে ভেতরে ওরকম একটা হাসি পায়। ডায়েরী লেখক। আমি একজন ভাল ডায়েরী লেখক। এটা যে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে উঠবে, এটা আমি কল্পনাও করি নি কখনও।
এটা ঠিক আমি ডায়েরী লিখি। ডায়েরী লেখাটা আসলে লেখা না। একটা অভ্যাসের মত। দাঁত ব্রাশ না করলে যেমন অস্বোস্তি হয়, ডায়েরী না লিখলে আমার সেরকম হতে থাকে। একবার পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদম ভেতরে। হটাৎ কলমের কালি শেষ। আর লেখার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত গুহা মানবের মত একটা চোখা পাথর হাতে তুলে নেই। পাথুরে পাহাড়ের গায়ে সেই পাথর ঠুকে ঠুকে দেখি অক্ষরের মত ফুটে উঠছে। তিন ঘন্টা লেগেছিল মাত্র দুটো লাইন লিখতে। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। টুক করে ছবি তুলে নিতেই ডায়েরী বন্দী হয়ে গেল।
কিন্তু আমার ডায়েরী লেখার কথা কেউ জানে না। এই লোকটা জানলো কি করে? বুঝতে পারি না। ডায়েরী লেখক... শব্দটা আবার মাথায় ধাক্কা দেয়। আমি একজন ডায়েরী লেখক!
- আমরা কেউই কিছু করি না। আমরা - স্রেফ আমরা হয়ে উঠি। এটাতো তুমি জানোই। তাহলে শ্রেনী বিচার করছো কেন?
আমি লোকটার দিকে তাকাই। চশমা খুলে ফেলেছেন ভদ্রলোক। মুখের হাসিহাসি ভাবটা চলে গেছে। একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে ওনাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার একটু শীত শীত করতে লাগলো। আবার অস্বোস্তিটা ফিরে আসলো। কেন জানি মনে হতে শুরু করলো - লোকটা সত্যি সত্যি হুমায়ূন আহমেদ।
- তোমার ধারণা ঠিক আবার ঠিকও না।
আমি তার দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। আমার দিকে তাকাও। তার কথা অগ্রাহ্য করতে পারি না। আমি চোখ তুলি।
তার মুখে মৃদু হাসি। আমি কখনও হুমায়ূন আহমেদকে সামনাসামনি ভাল করে দেখি নি। দুর থেকে একবার বইমেলায় দেখেছিলাম। মধুভর্তি চাককে যেমন চারদিক থেকে মৌমাছিরা ঘিরে ধরে, উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের দল তাকে সেভাবে ঘিরে ধরেছিল। তাদের ফোকর ফাকর দিয়ে এক চিলতে তাকে চোখে পড়েছিল। এটাকে দেখা বলে না। তাকে যা দেখেছি তা ছবিতেই। বইয়ের ফ্ল্যাপে। সংবাদপত্রের পাতায়। টিভির পর্দায়। আমার সামনে বসে থাকা মানুষটার সাথে সেই সব ইমেজের তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না। একই মনে হয়।
- দেখ, আমি হুমায়ূন আহমেদ নই। কিন্তু হূমায়ন আহমেদ আমি ছিলাম।
- মানে?
তার কথা বুঝতে পারি না। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারি। লোকটা মনের চিন্তা পড়তে পারেন।
- ধরো, একটা সময় ক্লাশ এইটে পড়তে। ক্লাশ এইটে যখন পড়তে তখন সেটা তুমিই ছিলে। কিন্তু ক্লাশ এইটের তুমিটাই তো তুমি নও। এর আগেও আছে পরেও আছে। এটাও তেমনি। যখন বেঁচে ছিলাম। তখন আমি হুমায়ূন আহমেদ। জন্মের আগে বলে একটা ব্যাপার আছে। মৃত্যুর পরও আছে। সেটা কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ না।
আমার মাথায় কিছুই ঢুকে না। একটা ঘোরের মত লাগে সবকিছু। আপনি কে, তাহলে? আমি যন্ত্রের মত বলে উঠি।
- শূন্য।
- শূন্য!
- আমিও শূন্য। তুমিও শূন্য।
- আমিও শূন্য!
- সকলেই। যা দেখছো। শুধু মানুষই না। গোটা ব্রহ্মান্ডটাই।
- তাহলে কিছুই নেই।
- সবই আছে। সবই শূন্যের এক একটা এক্সপেরিয়েন্স। এই এক্সপেরিয়েন্সের টোটাল রেজাল্ট হচ্ছে শূন্য। সকল অভিজ্ঞতার সমষ্টি। একটা অভিজ্ঞান।
আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটার কথাগুলো ফেলে দিতে পারি না। আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়।
- তুমি একটু ধৈর্য্য ধরলে সবকিছুই বুঝতে পারবে। তবে তোমাকে আমার সাথে কাজটা করতে হবে।
- কি কাজ?
- কাজ বলতে কিছু নেই। তুমি তোমার মত থাকবে। এখন যা করছো তাই করবে।
- তার মানে কিছুই না।
আমার হতাশ লাগে কেন জানি। ম্যাজিকটা শেষ হতে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা একটা ম্যজিক শো’র মত মনে হয়। ভদ্রলোক এখন শো’টা শেষ করতে চলেছেন।
- হ্যা। কিন্তু তোমার চোখে থাকবে হুমায়ূন আহমেদের চোখ।
- মানে!
- আমি তোমাকে দুটো চোখ দেবো। বেঁচে থাকতে এই দুটো চোখ দিয়ে আমি দেখতাম। তুমি চোখের জায়গায় ওই চোখ দুটো ওটা পরে নেবে। তারপর তুমি তোমার মত থাকবে।
- আমি হুমায়ূন আহমেদের চোখ পরবো!
আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি।
- হ্যা। বেঁচে থাকতে এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবতাম। আমি মরে গেলে আমার চোখ দুটো আরকেজনের শরীর দিয়ে দেখবে। তখন কি সে তার চোখের তই দেখবে? ব্যাপারটা জানার জন্য আমি মরণোত্তর চক্ষু দানও করেছিলাম। অবশ্য মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি কাজটা এভাবে হবে না। তাই মৃত্যুর আগে নিজেকে নিয়েই একটা নাটক তৈরী করতে হলো। তুমি যদি মেঘের ওপারে বাড়ি বইটা পড়ো, তাহলে কিছুটা ইঙ্গিত পাবে। নাটকটা সত্যি বেশ জমে গেল। মৃত্যুর পর নিজের দেহের উপর অধিকার থাকে না। পরিজনরাই তার মালিক হয়ে যায়। তাদেরই দায়িত্ব থাকে চোখ দুটো সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করার। কিন্তু ওরা তখন দুই পক্ষ হয়ে কোথায় আমার কবর হবে, কোথায় হবে না এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। গোলমালে অবস্থার মধ্যে কারো চোখের কথা মনে থাকে না। চোখদুটো আমার কাছে থেকে গেল। এখন তুমি যদি রাজী হও আমার সেই চোখ দুটো...
বলে চুপ করে আমার দিকে তাকালেন। তার কথা শুনে আমার রক্ত পানি হতে শুরু করেছে। মাথার মধ্যে ভো ভো একটা আওয়াজ। ঢোক গেলার চেষ্টা করতে গিয়ে টের পাই জিব গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। তিনি আমার দিকে একটা কোকের বোতল এগিয়ে দিলেন।
- কোকটা খাও। ভাল লাগবে। - বললেন তিনি।
ঠান্ডা একটা বোতল। গায়ে শিশির বিন্দুর মত পানি জমে আছে।
আমি বোতলটা নিয়ে মুখে দি। তখনই মনে পড়লো বোতলটা একটু আগেও ছিল না। গলার ভেতর বরফ ঠান্ডা কোক ঢালতে ঢালতে হটাৎ বুঝতে পারলাম, উনি যে হুমায়ূন আহমেদ - সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। এবং আমার ভয়টা কেটে যাচ্ছে।
- না জানার মধ্যে ভয়, আকর্ষন সবকিছু। জেনে ফেললে ভয়টাও থাকে না। আকর্ষনটাও থাকে না। এ জন্য আমরা মৃত্যুকে ভয় করি। আবার টানও অনুভব করি।
আমি শূন্য হুমায়ূনের দিকে তাকাই। তিনি হটাৎ হাসিতে ভেঙে পড়লেন।্ আমি চমকে তার দিকে তাকাই।
- ভালই নাম দিয়েছো। শূন্য হুমায়ূন। বেশ।
তার কথায় আমি লজ্জ্বা পাই।
- তাহলে কাজটা করছো?
তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি আসলে কাজটা বুঝতেই পারি নি, আমি সরাসরিই বলি। তিনি যে হুমায়ন এটা মেনে নেবার পর সবকিছু সহজ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমার কথা শুনে তিনি হাসলেন।
- দেখ। পুরোটা বললে বুঝতে পারবে না। তবে কাজটা শুরু করলে কিছু কিছু বুঝতে পারবে। তারপরও সহজ করে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি। শূন্য ব্যাপারটা বুঝেছো তো? ঠিক আছে, আর একটু সহজ করে বলি। মনে কর তুমি। তুমি হলে একটা চোখ। তুমি নিজেই একটা চোখ। কার চোখ? শূন্যের চোখ। শূন্য শব্দটা ঝামেলা মনে হলে - একে ঈশ্বর হিসেবেও ভাবতে পারো। তুমি, আমি, গাছপালা, পশুপাখি, নদী, পাহাড়, সবাই, আকাশের তারা, আমরা যা কিছু চিন্তা করি - সবকিছু হচ্ছে এক একটা ঈশ্বরের চোখ। এখন চোখ দিয়ে কি হয়? আমরা দেখি। তার মানে আমাদের দিয়ে ঈশ্বর দেখছেন। তার অভিজ্ঞতা বাড়ছে। সমস্ত কিছুর কাজ হচ্ছে ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তোলা। তুমি যাই করবে সেটাই অভিজ্ঞতা। তুমি কিছু না করলে সেটাও একটা অভিজ্ঞতা। এভাবে আমরা সকলে ঈশ্বরের সমগ্র অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তুলছি। যেটা হচ্ছে শূন্য। আবার এই শূন্য হচ্ছে তুমি। একটু একটু করে তুমি আরও বুঝতে পারবে। কিন্তু এখন তোমাকে যেটা করতে হবে-
তিনি তার চোখের মধ্যে হাত দিয়ে চোখের মণিদুটো বের করে আনলেন। আমার হাত পা জমে যেতে থাকলো আবার। তিনি অবশ্য খেয়ালই করলেন না। তিনি বলতে শুরু করলেন। যেন ক্লাশ নিচ্ছেন। আমি বেঞ্চিতে বসে আছি।
- এই চোখদুটো যদি তোমার চোখের জায়গায় থাকে তাহলে শূন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা পাবে। কি অভিজ্ঞতা? তোমার মধ্যে দ্বৈত অবস্থা তৈরী হবে। একটা অংশে মৃত হুমায়ূন দেখছে। আবার চিন্তা করছো জীবিত তুমি। এর ফলে তুমি যেটা তৈরী হবে সেটা হবে তুমি আর মৃত হুমায়ূনের কম্বিনেশন। কেন আমি নাটকটা তৈরী করলাম বুঝতে পারলে তো?
আমার চিন্তা করার কোন ক্ষমতাই নেই। আমি বোকার মত মাথা নাড়ি। বুঝি নি।
- মরার পরে যদি চোখ দুটি তুলে নেয়া হতো তাহলে সেটার খালি ফিজিক্যাল এনটিটি ট্রান্সমিট হতো। একটা ক্যামেরা যেমন ক্যামেরাম্যানেরই হয়ে দেখে, তেমনি। তখন এই চোখ দিয়ে দেখলেও তাতে হুমায়ূনের কোন ছাপ থাকতো না। এটা যার দেহে লাগানো হতো শুধু তার চোখই হয়ে যেত। এই চোখ জোড়া দেখ -
তিনি হাতের মধ্যে চোখ জোড়া আমার মুখের কাছে এগিয়ে দিলেন। আমি বুঝতে পারছি যে আমি আসলে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। ঘোর ঘোর। আমি তার হাতের দিকে তাকাই। জ্যান্ত দুটো চোখ। টলটলে। যেন হাসছে। কথা বলছে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
- এই চোখদুটোর মধ্যে হুমায়ূনের কনসাসনেস ঢুকিয়ে দিয়েছি। তুমি তখন তার দেখাটা বুঝতে পারবে। কিন্তু তুমি তোমার দেখাটাও দেখতে পাবে। কারন মস্তিষ্কটা তোমার। তুমি একটা জিনিষকে দুইভাবে দেখতে পাবে। একটা হুমায়ূনের মত। আর একটা তোমার মত। এখন তুমি যদি রাজী থাকো তোমাকে এই দুটো চোখ পড়িয়ে দেবো।
আমি বুঝতে পারি না বলার শক্তি নেই। কিন্তু হ্যাও বলি না।
- আর একটা জিনিষ। এর বিনিময়ে তুমি কি পাবে। প্রথমত এই যে রেস্তরায় তুমি বসে আছো তুমি এই রেস্তরায় আসতে পারবে। তুমি বোধহয় বুঝতে পারছো এটা সাধারন কোন রেস্তরা নয়। কোন জীবিত মানুষ এই রেস্তরা দেখতেও পাবে না। এখানে তুমি অনেকের সাথে কথা বলতে পারবে যাদের সাথে জীবিত মানুষ কথা বলতে পারে না। ঐ যে দেখ..
তিনি ইশারায় একটা টেবিলের দিকে দেখালেন। আমি তাকিয়ে দেখি দুজন লোক কথা বলছে। একজনকে আমি চিনতে পারি। হুমায়ূন আজাদ। কার সাথে কথা বলছেন তাকেও চেনার চেষ্টা করি। চিনতে পারি না। চেহারাটার ধরনটা একটু যেন কেমন। আমি অনেকক্ষন মনে হয় তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। হাসির শব্দে চমকে তাকাই। শূন্য হুমায়ূন হাসছেন।
- ওর নামও কিন্তু শূন্য হুমায়ূন, তাই না?
আমি হাসি।
- উনি যার সাথে কথা বলছেন তিনি কে?
- ওম। ওম কে জানো?
- কে?
- সে তোমার থেকে অনেক ছোট। তার এখনও জন্মই হয় নি। ৩৯৮১ সালে সে চিন্তায় নোবেল পুরস্কার জিতবে। ২৫২৪ সাল থেকে চিন্তার নোবেল দেয়া শুরু হবে।
- ভবিষ্যতের মানুষ।
- হ্যা ভবিষ্য। তুমি ওদের সাথেও কথা বলতে পারবে। কি রাজী?
কিছু না ভেবেই মুখ দিয়ে বের হয়ে যায় - রাজী।
শূন্য হুমায়ন আমার চোখ দুটো চেপে ধরলেন। একটা তীব্র শীত আমার কোটর বেয়ে শরীরের ভেতরে হারিয়ে গেল।
কৈফিয়ত :
এই প্রচেষ্টাটি ভাবনার নিরীক্ষা সরোবরে উপন্যাস হিসেবে জমা হওয়া নানা বর্ণ, গন্ধ, ঘনত্বের শব্দ আর বাক্যের জল। এই সরোবরে, ভাবনার কোন কোন নদী ধরে কত সহস্র কল্পনার জলধারা যে এসে মিশবে তার ভূগোলটা এখনও জানা নেই। নানা ধাঁচের জল - মিলমিশ খেয়ে শেষ পর্যন্ত কোন রূপে দাড়াবে নাকি আদৌ কোন রূপই সে পাবে না - এই জলের কোন অংশটি থাকবে আর কোন অংশটি থাকবে না - নাকি পুরোটাই বাতিলের খাতায় জমা পড়বে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এই উপন্যাস এমন একজন চরিত্রকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাবে - যিনি বাস্তব পৃথিবীতে অনেকগুলি বছর কাটিয়ে গেছেন। যার একটি জীবনি পঞ্জী আছে। যে পঞ্জীর অনেকখানি আমাদের জানা। অনেকখানি অজানা। এই নশ্বর জীবনে তার কিছু সুনির্দিষ্ট কীর্তিমালা আছে। এই কীর্তিমালাগুলো আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের অংশ। স্মৃতি এবং যাপনের অংশ হিসেবে তার সাথে আরও অসংখ্য মানুষ জড়িয়ে আছেন। তাদের কাছেও মানুষটির এক একটি সুনির্দিষ্ট ছবি আছে। কোন বাস্তব মানুষকে ভিত্তি করে কোন উপন্যাস রচনা করতে গেলে সেখানে ইতিহাসের মত একটা দায়বদ্ধ ব্যাপার চলে আসে। চরিত্রটি লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
এই লেখাটি অন্য কিছুও হতে পারতো। বা কিছু নাও হতে পারতো। তবু এই নিরীক্ষার ক্ষেত্রে উপন্যাস শব্দটি কাঠামোগতভাবে গ্রহণ করার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। ঠিক যেভাবে চরিত্র হিসেবে হুমায়ূন আহমেদকে বেছে নেয়ার একটা বিবেচনা আছে। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে উপন্যাস লেখার চিন্তার পেছনে যা কাজ করেছে তা হলো - এই দায় থেকে মুক্তি হুমায়ূন আহমেদ নিজেই দিয়ে গেছেন। ‘উপন্যাসের প্রয়োজনে - (সেই উপন্যাসটি সত্য ইতিহাসনির্ভর হলেও) ইতিহাস, ঘটনা এবং চরিত্রের জ্ঞাত বাস্তবতা পরিবর্তিত হতে পারে, পুনঃকল্পিত হতে পারে এবং পুণনির্মিত হতে পারে’ - এমন দৃষ্টিকোণের কথা হুমায়ূন আহমেদ বলে গেছেন। আমরা তার শেষতম উপন্যাস দেয়াল সম্পর্কিত আলোচনায় তার এই মত দেখেছি। যেহেতু তিনি এই দৃষ্টিকোণটিকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়ে গিয়েছেন - তাহলে এই দৃষ্টিকোণটি ব্যবহার করে তার জীবন এবং কীর্তিকেই একটি নিরীক্ষার মধ্যে ফেললে কি দাড়ায় এটা দেখার চেষ্টা থেকেই এই লেখার শুরু। উপন্যাসের শুরু। এই লেখাতে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সকল সকল কিছুই বিবেচিত হবে উপন্যাসের আলোকে, উপন্যাসের প্রয়োজনে। তার জীবনের সকল তথ্য যা আমরা জানি - পাল্টে দেয়া যাবে গল্পের প্রয়োজনে। আসলে গল্পের প্রয়োজনেই এই হুমায়ূন আহমেদের জন্ম, যিনি একদা এই পৃথিবীতে একদিন এসেছিলেন। কিন্তু সেই পৃথিবীর সত্য এই উপন্যাসের বিবেচ্য নয়। সেই পৃথিবীর সত্য উপন্যাসের বাস্তবতায় শুধুমাত্র শোনা কথা মাত্র। আবার পুনরুল্লেখ করা হলো -
পৃথিবীর সকলকিছুই পরিবর্তিত হবার অধিকার রাখবে গল্পের প্রয়োজনে- সত্যের নয় - এটাই এই নিরীক্ষনের মূলনীতি ]
মন্তব্য
এর আগে হুমায়ূন আহমেদের চোখ : ১ নামে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম। পুরনো একটা আবছা ভাবনা হটাৎ করে মাথায় গেড়ে বসলে অনেকটা এলেবেলে করেই লেখাটা লিখেছিলাম। খুব বেশি অন্তর্জালে ঢোকা হয় না। সেদিন সেখানে থাকার কারণেই হয়তবা লেখার সাথে সাথে প্রকাশ করে ফেলেছিলাম । পরে দেখি লেখাটা আসলে অনেকটা অগোছালো, এলোমেলো এবং সঙ্গতিবিহীন। এর মধ্যে অনেকে মন্তব্য করে গেছেন। কামরুজ্জামান স্বাধীন, বাপ্পীহায়াত, চরম উদাস, মাহিনা, অবনীল এবং শাব্দিককে তাদের মন্তব্যের জন্য ধন্যবা্দ।
লেখাটা যে একটা উদাসীন মনের প্রকাশ - সেটি চিনিয়ে দিয়েছেন রোমেল চৌধুরী। যাদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী ভাবতে ভালবাসি রোমেল চৌধুরী তাদের মধ্যে একজন। তার কাছে আমার বেশি কিছু বলবার নেই।
]আমার বিরক্তি লেগেছে। আপনি মাঝখানে কাহিনী না বলে অতীতে চলে গেলেন কেন! বরং যদি এমন হত,,,
যাই হোক। আমার ভাল লাগে নি। বাট ক্যারি অন। সুনার অর লেটার।,,,,,,
মেম্বর সাব সত্যিই মেম্বর সাবের মত কাজ করেছেন। সৎ মেম্বর অর্বাচীন গ্রাম বাসিকে যেমন তাদের অবিবেচক পদক্ষেপ এর ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সাবধান করেছেন। কি করতে হবে পথ বাৎলে দিয়েছেন। এবং সাহস দিয়েছেন,,,
তাকে আমার কৃতজ্ঞতা।
ঐ লেখাটিকে বাতিল করে লেখাটির কাহিনী বা প্লট এবং বিন্যাস - পুরো পাল্টে নতুন করে দাড় করালাম।
তারেক অণু আগের লেখায় হুমায়ূনের চোখ বিষয়ে একটি তথ্যের অবতারণা করেছিলেন। তার তথ্যটি ঠিক আমার জানা ছিল না। তবে এই বিষয়ে তার প্রশ্নটির উত্তর জানার চেষ্টা করেছি। নতুন গল্পের কাহিনীর অংশ হিসেবে ঐ তথ্য, প্রশ্ন আর তার উত্তরটি এনেছি।
সময়ের অভাবে অন্তর্জালে খুব বেশি আসতে পারি না দেখে সবার মন্তব্যের উত্তর আমি দিতে পারি না। এর জন্য আমিও বেদনা অনুভব করি। অপরাধবোধে মন বিষন্ন হয়ে যায়। কারণ আপনাদের মন্তব্য এবং নিরবতা - দুটোরই মূল্য আমার কাছে অনেক।
আপনার লেখার কথোপোকথনের মধ্যে কোথাও মনে হয় একটা হুমায়ূনীয় টান আছে বলে আমার মনে হয়েছে, সেটা কি হুমায়ূন আহমেদ নিজে উপস্থিত ছিলেন বলে? বাস্তবের হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাসের ঢঙ্গে কথা বলতেন কি? আমি ঠিক জানিনা।
আপনার লেখায় , তবে প্যারাগুলো আরেকটু ছোট করলে আমার জন্য ভাল হত আরো।
চলুক
--বেচারাথেরিয়াম
প্যারাগুলো ছোট করলে আসলেই ভাল হত।
আপনি যে আবার গুছিয়ে লিখলেন সেজন্য আপনাকে
-- ঠুটা বাইগা
এই লেখাটিতে কাহিনী বিন্যাসে শৃঙ্খলা এসেছে তবে আগের লেখাটায় সাবলীলতা ছিল বেশী।
সুসম্পন্ন হোক, এই কামনা করি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন