বিছানা ছেড়ে ব্রিগিতার আগেই উঠে গেলাম। এই মেয়ে দেখি এলার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমুচ্ছে। সুযোগ পেয়ে আমি ও শাওয়ার নিয়ে ফেললাম ছোট্ট একটা, বের হয়ে ডেকে দিলাম ওকে,নইলে দেরী হয়ে যাবে আবার। শেষবারের মত আশপাশ দেখে নিয়ে লাগেজ বাইরে দিয়ে এলাম, পোর্টার এর জন্য। ব্রিগিতা রেডি হয়ে গেলে দুজনে মিলে নাস্তা করতে বের হয়ে গেলাম। বাফেট নাস্তা, মেলা খাবার, কেমেরা বের করে আলসেমির ঠেলায় ছবি তোলা হলনা। নাকেমুখে কোনরকমে কিছু খাবার গুজে নিয়ে একটা আপেল হাতে বের হয়ে এসে বাসে উঠে গেলাম। তানিয়া হেড-কাউন্ট করে দেখল, সবাই আসতেই বাস ছেড়ে দিল। আজকের গন্তব্য টলেডো শহর, সেখান থেকে বিকেলে গ্রানাডাতে যাওয়া হবে।
জানালার পাশে বসতে পারায়, বাইরের কিছু ছবি তুলার চেষ্টা করছিলাম, সাথে তানিয়ার মুখ থেকে অল্পবিস্তর স্পেনের ইতিহাস, এদের অভ্যাস, খাবার, কালচার সম্পর্কে জেনে নিচ্ছিলাম। ওর মুখেই শুনলাম, ইউনেস্কো নাকি টলেডোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ঘোষণা করেছে, মুসলিম, জিইউস আর খ্রিস্টানদের ঐতিহাসিক সহবস্থানের জন্য। রাজকীয় এই শহর মাদ্রিদ থেকে প্রায় ৭০ কিমি দক্ষিণে। ঘণ্টা দেড়েকের মত লেগে গেল টলেডোতে পৌঁছতে। শহরে ঢুকার জন্য যে রাস্তা নিতে হয়, সেটা মুটামুটি এঁকে-বেঁকে শহরের চারিদিক দিয়ে ঘুরেফিরে ভিতরে চলে গেছে। দূর থেকেই আল-কাজার প্যালেস দেখা যাচ্ছিল। টাগুস নদী দিয়ে চারপাশ ঘেরা পাহাড়ের উপর শহরটাকে দূর থেকে অদ্ভুত মায়াময় লাগছিল। বাস শহরে ঢুকতেই, আমাদের লোকাল গাইড বাসে এসে উঠল। কিছুক্ষণ পর আমাদের একটু উঁচু-জায়গায় নিয়ে গেল, যাতে শহরের বেশ ভাল ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। নেমেই চটপট কিছু ছবির মত ছবি তুলে ফেললাম।
শহরের আর ও একটু ভিতরে এসে, বাস ছেড়ে দেয়া হল। এইবার সবাইকে হেড-ফোন দেয়া হল ওয়াকিং টুর এর সময় যাতে ঠিকমত শুনতে পায়। কানে হেড-ফোন গুঁজে নিয়ে গাইড ফ্রাঙ্ককে ফলো করা শুরু করলাম। চিপা-চাপা গলি গুপচি দিয়ে ফ্রাঙ্ক আমাদেরকে নিয়ে চলল গোথিক ক্যাথেড্রালের দিকে। চিপা গলিতে যেতে যেতে আশেপাশেই কিছু দোকান পরলো, কারুকার্য খচিত তলোয়ার, ছুরি আর ও অনেক কিছু বিক্রি করছে। কোন একসময় টলেডো নাকি ব্লেডেড উইপেন বানানোর জন্য বিখ্যাত ছিল, এখন সেসবের স্যুভেনিরই দোকানগুলাতে বিক্রি হচ্ছে বেশি। বাইরে থেকে গির্জা দেখে নিয়ে আর একটু সামনে গিয়েই আমাদেরকে কফি প্লাস টয়লেট ব্রেক দিল ফ্রাঙ্ক। কফি খেলে পরে ফ্রিতে টয়লেট করা যাবে, বিধায় সবাই গিয়ে ক্যফেতে লাইন দিল। আমার কফি টয়লেট কোনটারই দরকার ছিলনা, তাই আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করছিলাম।
কফি-ব্রেক শেষ হলে এইবার ফ্রাঙ্ক আমাদেরকে নিয়ে চললো, সান্টো তোম চার্চের দিকে। সেখানে দেখা মিলল, এল গ্রেকোর বিখ্যাত পেইন্টিং দ্য বিউরাল অফ কাউন্ট অরগায এর। কিন্তু ছবি তোলার অনুমতি ছিলনা, তাই দেখেই সাধ মিটালাম, লেখায় ছবিটা গুগল থেকে ধার করা। পেইন্টিং এর বিশেষত্ব হল পৃথিবীতে কাউন্টের মারা যাবার পর কি হচ্ছে, আর স্বর্গে সেন্টরা কিভাবে তাকে বরন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে একইসাথে উপরে নিচে ধারণ করা হয়েছে এই ছবিতে। লিজেন্ড বলে, মহৎ এই কাউন্ট এর মৃত্যুর সময় সেইন্ট স্টেফেন আর সেইন্ট অগাস্টিন স্বর্গ থেকে নেমে আসে নিজ হাতে তাকে সমাহিত করেছিল।
এরপর আবার ও হন্টন। জিইউস কোয়াটার এর ভিতর দিয়ে যাবার সময় ফ্রাঙ্ক আমাদেরকে রাস্তায় আঁকানো কিছু জিউস সাইন দেখাল, যদি ও সেগুলা অরিজিনাল নয়, তবে রিজেনেরেইট করা। এরপর এল সিনাগগ দেখার পালা। গাইডের পিছু পিছু জোরসে পা চালালাম। এর মাঝেই কথা হচ্ছিল, বোস্টন থেকে আসা জো আর ওল্গার সাথে। ইটালিয়ান এই কাপল বোস্টনে আছে মেলা-দিন ধরে । বুড়াবুড়ি ঘুরতে দারুণ ভালবাসে, কই কই গেছে গরগর করে বলে চলল। মেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে, তাদের আবার নাতিনাতনি ও আছে পাঁচখানা। ওদের গল্পে আবার পরে আসবো। এর মাঝে ফ্রাঙ্ক সিনেগগের কিছু ইতিহাস আমাদেরকে জানিয়ে দিল ভিতরে ঢুকার আগেই। এই ঐতিহাসিক বিল্ডিং এর প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল ছিলেন সেই সময়কার কাস্টেলিয়ান রাজাদের কোষাধ্যক্ষ যার পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে কাস্তিলিয়ান্দের সার্ভ করেছে। এন্টিজিউস রায়টে জিউসদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল সেই অপরাধকে কিছুটা হাল্কা করার জন্য রাজা পিটার এই সিনেগগের প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেন বলেই কথিত আছে। যদি ও পরে রাজার রোষানলে পরে স্যামুয়েলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তার ও বেশ আগে অষ্টম শতাব্দীতে মুসলিমরা যখন ইবারিয়ান পেনিন্সুলা দখল করেছিল, সেই সময় মরিস রাজাদের জুইসদের প্রতি সহনশীলতার জন্য জুইসদের অবস্থা বেশ ভালো ছিল, অনেক জুইস মাইগ্রেট ও করে এসছিল থাকবার জন্য।। কিন্তু মুসলিমদের পতনের পর কেথেলিক আগ্রাসনের পর থেকেই জিউসরা অত্যাচারিত হতে থাকে।
জুইস এই প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর সিনেগগকে চার্চে রূপান্তরিত করা হয়। মূলত চৌদ্দ-শত শতাব্দীর দিকে যখন রাজা ফার্দিনান্দ আর রানী ইসাবেল বিয়ে করে কাস্তিল আর এরাগন একত্রিত করে কেথেলিক মনার্কো মানে স্পেন পুনর্গঠিত করে, সেই সময়ই জিউসরা জনরোষে পরে যায়। আলহাম্রা ডিক্রি জারি করে, জুইসদেরকে ক্রিশ্চান হবার জন্য বলা হয়, নতুবা দেশ ছেড়ে চলে যাবার জন্য আদেশ দেয়া হয়। চলে যাবার শর্ত থাকে সবকিছু সাথে নিতে পারবে শুধুমাত্র টাকা, সোনা আর রূপা বাদে। এমন অবস্থায় অনেক জুইসই কনভার্ট হয়ে ক্রিশ্চানিজম গ্রহণ করে। এইকারনেই সিনেগগে একইসাথে এরাবিক আর হিব্রু ইনস্ক্রিপশন পাশাপাশি সহবস্থান করছে।
ভিতরে ঢুকতেই আলো-আধারিতে দেয়াল-জুড়ে ছড়ানো সব ইনস্ক্রিপশন গুলার দেখা মিলল।উপরের সিলিং পর্যন্ত বাদ নাই। প্রিজার্ভ করার জন্যই বোধকরি খুব উজ্জ্বল আলো নেই ভিতরে। তবে দেয়ালের ইনস্ক্রিপশনের রঙই এমন যে অল্প আলোতেই মারাত্মক সুন্দর লাগছিল দেখতে। ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি নেয়া যাবে বিধায় দেয়ালকে কেমেরা-বন্দি করে ফেললাম। সিনেগগ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের রৌদ্র-উজ্জ্বল দিনের আলোতে চোখকে সইয়ে নিতে হল কিছুক্ষণ।
এরপর বাসে ফেরার পালা। এপথ ও পথ দিয়ে আল-কান্তারা ব্রিজ এর উপর হেঁটে গিয়ে বাসের কাছে ফিরে এলাম।লোকাল গাইডকে ধন্যবাদ আর টিপস দিয়ে বাসে চড়ে বসলাম। এইবার বাস যাবে গ্রানাডার দিকে। পথমধ্যে লাঞ্চ বিরতি দেয়া হল। সাদা একতলা কোন একটা রেস্টুরেন্টে নামলাম খাবার জন্য, নামটা মনে পড়ছেনা এই মুহূর্তে। পেস্তো নিলাম সাথে রুটি। পেস্তো যে আমাদের টমোটো ভর্তার আঝাইলা একটা ভার্সন মুখে দিয়ে টের পেলাম। অনেকেই দেখলাম পটোটো টরটিলা নিল, যেটা ছিল ডিম আর আলুভর্তার ফ্রাই এর মত। খেয়ে দিয়ে আর কিছু ফটো তুলে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু হল। বাস ছুটে যাচ্ছে গ্রানাডার দিকে, দুপাশে মাইলের পর মাইল অলিভের বাগান পেছনে ফেলে।
১।দ্য বিউরাল অফ কাউন্ট অরগায(গুগল)
২। টলেডো শহর
৩। জিইউস সাইন
৪। সিনেগগে
৫।পেস্তো
৬।আমাদের লোকাল গাইড ফ্রাঙ্ক
৭। রানী ইসাবেল
৮।কারুকার্য খচিত তলোয়ার
৯।কেথেড্রালের দরজায় টুরের তিন কিউট পিচ্চি
১০।আল-কান্তারা ব্রিজ
১১ টলেডোর পথে
১২।কেথেড্রাল
১৩।সিনেগোগের বাইরের ভিউ
১৪। আল-কাযার পেলেস
মন্তব্য
Nice post, nice picture,
ধন্যবাদ অতিথি লেখক। নামটা জানা গেলনা।
আল-কাযার প্যালেস!! হার্জে মশাই কি এখান থেকেই জেনারেলের নাম নিয়েছিলেন নাকি?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কুনু আইডিয়া নাই, আমি টিনটিনের ফ্যান না সত্যানন্দ ভাই।
পেস্তো-র ছবি খাসা এসেছে, মনে হচ্ছে খেতে বসে যাই।
গল্প-ছবির যুগলবন্দী ভাল চলছে। চলতে থাকুক।
আর ১৩ দিন, তারপর আমিও বিমানে চাপব, তারপর জাহাজে, এবারে আলাস্কা
- একলহমা
পেস্তো খেয়ে মনে হয়েছিল আহা একটু ভাত থাক্তো যদি আর ও ভাল হত। আর আপনার আলাস্কার গল্প শুনতে চাই, একদিন আমি ও যাবো হু হু।
অনেক অসাম
-আরাফ করিম
ধন্যবাদ আরাফ ।
মারাত্মক
৮ নম্বরে তলোয়ারের ছবিখান ব্যাপক।
..................................................................
#Banshibir.
এত পছন্দ হইছে কেন, কার পেট ফুটা করার প্লান করেন শুনি পীরসাহেব।
তলোয়ারের থেকেও পা দুইটআ !
আপনি বলার পর লক্ষ্য করলাম।
ভালো লাগলো।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
ধন্যবাদ রাজুভাই।
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
ওহ্, দারুণ !
আহা, দারুণ দারুণ সব পোস্ট আর ঘটনাও।
ধন্যবাদ ভাবনাদাদা।
ভাল লাগলো, গ্রানাডার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম!
ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই।
বারবার তলোয়ারগুলোয় চোখ চলে যাচ্ছে
রাসিক রেজা নাহিয়েন
আমার তো একটা কিনেই ফেলতে মন চাইছিল, এত সুন্দর দেখতে তলোয়ারগুলা।
ভালো লাগছে ভ্রমন কাহিনী। গ্রানাডা ভ্রমণ লেখার সময় ইতিহাসটা ধরে একটু টান দিবেন না কি? খুব ভালো হয় তাহলে।
ভালো থাকুন খুব।
-নিয়াজ
ধন্যাবাদ নিয়াজ ভাই, চেষ্টা করব ইতিহাসের কিছুটা ফ্লেবার রাখতে।
ভাল্লাগলো
ধন্যবাদ রায়হান।
মানুষ কতো জায়গায় যায়!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনি জানি কই থেকে ঘুরে আসছেন কিছুদিন আগে নজুভাই।
তারেকাণু ভাইরাসের নিরাময় কী?
নিরাময়যোগ্য নহে।
ছবিগুলো ভালো লাগসে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
নে নে।
জলপাই বাগানের ছবি কই?
-সাইফুজ জামান
পরের পর্বে দিব জামান ভাই।
কি সুন্দর
ইসরাত
ধন্যবাদ ইসরাত।
খুব ভালো লাগলো! আপনার লেখা চমৎকার! আগামী পরবের অপেকখায় রইলাম
লেখা পড়া হইল না। ছবিতে
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
খুবই চমত্কার লাগল। চালিয়ে যান।
নতুন মন্তব্য করুন