সীমা বেচারিকে অফিস করে এসেই এয়ারপোর্টে ছুটতে হয়েছিল। আমি অফিসকে আগেই বাই বাই বলে লম্বা একটা ব্রেক নিয়েছি, তাই বাসা থেকে ধীরে সুস্থেই এয়ারপোর্টে এসছি। চেক ইন করতে গিয়ে দেখি দুজনকে দুজায়গায় সীট অ্যালোকেট, করে দিয়েছে, রিকোয়েস্ট করে সিঙ্গাপুর থেকে আবুধাবির সিট একসাথে পাওয়া গেলে ও আবুধাবি থেকে ডাশলডোর্ফের সীট একসাথে পাওয়া গেল না। এয়ারপোর্টে পায়েলি এসছিল বিদায় দিতে, বাসা থেকে খিচুড়ি, মুরগীর মাংস আর সবজি রেঁধে নিয়ে আমার বাসায় সোজা চলে এসছিল মেয়েটা, শেষ লাঞ্চটা ওর হাতের রান্না দিয়ে সেরে ফেললাম। তারপর দুজনে মিলে দুকাপ চা খেয়ে নিলাম। সাত বছরের সিঙ্গাপুর জীবনে এই বাসাতে প্রায় বছর দুই এর মত ছিলাম, ছেড়ে যাচ্ছি ভাবতেই কেমন লাগছে যেন। এটাই আমার সুইট হোম।দরজায় লক করার আগে আর একবার শেষ বারের মত দেখে নিতে ইচ্ছা হচ্ছিল খুব, পায়েলি সাথে থাকাতে সেই ইচ্ছাকে পাত্তা দিলাম না আর। বুকের ভিতর তীব্র একটা শূণ্যতা টের পেলে ও মাল পত্তর নিয়ে দুমদাম করে নিচে নেমে এলাম।
মাল-পত্তর চেক ইন করতে গিয়ে দেখি, ৩০ কেজি পর্যন্ত চেক ইন করা যাবে। চেক ইন লাগেজ ২৩ কেজি শুনে কত কিছু যে ফেলে এলাম। রংপুর থেকে ঢাকা হয়ে সিংগাপুর আসা একটা মাদুর ফেলে এসছি বলে খুব মন খারাপ লাগছিল। ওটায় বসে মাঝে মাঝেই বেহালা নাড়াচাড়া করতাম। সিঙ্গাপুর ছেড়ে যাবার সময় লোকজনের ওভার-ওয়েট হয়ে বিস্তর ঝামেলা হতে দেখেছি, একমাত্র আমিই বোধহয় নির্ধারিত, ওজনের চেয়ে কম ওজনের লাগেজ নিয়ে যাচ্ছি। আর অমন করে হাসতে হাসতে এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নিয়েছে কজন । দলবেঁধে ভাইয়া ভাবিদের এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে গিয়ে সেরকম ছলছল চোখ নিয়ে ফিরে এসেছি, সেটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। ইউনির বন্ধু আর অফিসের কলিগ থমাস এসছিল এয়ারপোর্টে। আগের সপ্তাহে ছোট্ট একটা সার্জারির কারণে দুদিন মেডিকাল লিভে থেকে বেচারার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছিল দেখতে। তবু সেই অফিস থেকে দেড়-ঘণ্টা ট্রেন জার্নি ঠেলে এয়ারপোর্টে এসছে গুডবাই জানাতে। ইমিগ্রেশন পার হয়ে বারে বার পিছু ফিরে দেখছিলাম পায়েলি আর থমাসকে, কেমন যেন চিনচিন করে উঠে ভিতরটা। জীবনে কত কিছু যে পিছনে ফেলে আসতে হয় ইচ্ছেই হোক বা অনিচ্ছায়।
প্লেনে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে বসতে বসতেই বুঝতে পারলাম আমাদের দুধারের সারিতে দুখানা মিষ্টি ছানা আছে, একজন তো বেশ শব্দ করেই যাচ্ছে উঠার পর থেকেই। সীমাকে বললাম বেবিসিটিং করতে করতে যাওয়া যাবে, যদি একটা ছানার সাথে ভাবসাব হয়ে যায়। টেক অফের ঠিক আগের মুহূর্তে এয়ারহোস্টেস এসে বললো, কিছু মনে না করলে আমি কি গিয়ে পিছনের সারিতে একটা বাচ্চার সাথে বসতে পারি কিনা, সে নাকি একাই ট্রাভেল করছে। শিউর বলেই উঠে গিয়ে ওর পাশে বসে গেলাম। নাম জিজ্ঞেস করতেই নীল চোখ মেলে বাচ্চাটা ভিভিয়ান বলে মিষ্টি করে হেসে দিল, নাইস টু মিট ইউ ও বলে সীট-বেল্ট বেধে নিলাম। একটু অবাক হলাম, ও একা যাচ্ছে শুনে, তবে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম্না কেন একা যাচ্ছে। নিজে নিজেই ভিভিয়ান বললো ও ব্রিজবেন থেকে আসছে, এখন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে যাবে। মাঝে আমার নাম ও জেনে নিল। ওর সাথে কি নিয়ে কথা বল্বো ঠিক বুঝতে পারছিলামনা। পছন্দ নিয়ে কথা উঠতেই জানালো বছর ছয়েকের মেয়েটা স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি এখন ও, তবে গান করতে, পপ-কর্ণ খেতে খেতে মুভি দেখতে ভালবাসে। নিজেই মুভি-গাইড খুলে একটা মুভি বের করে বললো এটা ছেড়ে দাওতো দেখবো। ওর হেডফোন ঠিক করে নিয়ে মুভিটা বের করে ছেড়ে দিলাম। মাঝে প্লেনে ড্রিঙ্ক দিয়ে গেলো, কিন্তু ভিভিয়ান পানি ছাড়া কিছুই নিলনা, স্ন্যাক্স ও না। আই ফিল সিক বলে আস্তে আস্তে আমার গা এর কাছে সরে আসছিল। বুঝতে পারছিলামনা কি করবো, বাংলাদেশি বাচ্চা হলে একটা কথা ছিল, ওর গায়ে হাত দিয়ে আদর করে দিলে মাইন্ড করবে কি না সেটা ও জানিনা, আমি ও মাঝের হাতলটা উঠিয়ে দিয়ে একটু ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বসলাম। আস্তে আস্তেই শরীরের ভারটা আমার উপর ছেড়ে দিল মেয়েটা। ওর মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম ওর কজন বন্ধু আছে। হাতে গুনে গুনে বন্ধুদের নাম বলতে লাগলো ভিভিয়ান। খানিকবাদেই ঘুমাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই আমার পায়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো।এত লম্বা জার্নি করে ব্রিজবেন থেকে এসে বাচ্চা মেয়েটা ভীষণ ক্লান্ত বোঝায় যাচ্ছে।
ওকে আমার পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরতে দেখে বিমানবালা বেশ কবার এসে দুঃখ প্রকাশ করে গেল। আমার বেশ ভালোই লাগছিল, অদ্ভুত মায়া লাগছিল বাচ্চাটার জন্য। মাঝেই বেশ কবার উঠে উঠে আমাকে দেখছিল মেয়েটা, বোধহয় বুঝতে চেষ্টা করছিল আমি বিরক্ত হচ্ছি কি না। এত সুইট একটা ছোট্ট বাচ্চার উপর বিরক্ত হবার ওত কঠিন হৃদয়আমার না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ও কেমন নির্ভরতায় ঘুমিয়ে গেল আবার। আমি ও সিট ঠিক করে নিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাংলো বিমানবালার ডাকে, আমার জন্য একটা কেক নিয়ে এসছে বাচ্চার টেক কেয়ার করছি বলে। ধন্যবাদ দিয়ে বললাম আমার ভালোই লাগছে ওর সাথে সময় কাটাতে তবে কেক এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। কেক ফেরত নিতে নিতে আমাকে জানালো মেয়েটা ব্রোকেন ফ্যামিলির, ওর মা অস্ট্রেলিয়াতে থাকে, এখন বাবার কাছে বেড়াতে যাচ্ছে একা। এমনটাই ভেবেছিলাম, নইলে এত ছোট্ট বাচ্চার একা যাওয়ার কথা না। প্লেন ল্যান্ড করলে জিনিস গুছিয়ে নামার আগে জিজ্ঞেস করলাম ভিভিয়ান তোমার কোন নাম্বার আছে, ফোন করে জেনে নিতাম তুমি ঠিকমত রিচ করেছো কিনা। নীল বিষণ্ণ চোখজোড়া মেলে মাথা নেড়ে বললো ও নাম্বার জানেনা। ওকে ফেলে যেতে এমন খারাপ লাগছে, এত অল্প সময়ে বাচ্চাটার জন্য কেমন যেন একটা মায়া পরে গেছে, ওকে একা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিলনা। তবু একরকম জোর করেই নেমে এলাম বিমান থেকে পরের ফ্লাইট ধরবো বলে। বাই বাই ভিভিয়ান বলতে যতটা কষ্ট হয়েছে সিঙ্গাপুরকে বাই বাই দিতে ও অতখানি কষ্ট হয়নি।
মন্তব্য
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
ক)
ভাঙা পরিবার, ভাঙা মন, ভাঙা জীবন..
খুব মায়া লাগল ছোট্ট ভিভিয়ানের কথা পড়ে।
নূতন দেশে গুছিয়ে বসে আবার লেখা দিও।
খ)
এয়ারক্ররা > এয়ারক্রুরা, নির্ধাতির > নির্ধারিত, স্টামিনা >স্ট্যামিনা, শুয়ে পরলো > পড়লো, এলোকেট > অ্যালোকেট, এসছিল > এসেছিল, খিচুরি > খিচুড়ি, বেবিসিটীং > সিটিং, স্নাক্স > স্ন্যাক্স, হ্রদয় >হৃদয়।
বানানগুলো ঠিক করে নাও।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ বানান ঠিকঠাক করে দেবার জন্য। খোমাখাতায় নাম্বার দিস, কথা হবেনে, গ্রান্ডক্যানিয়নের আশেপাশে আছি।
তেইশ কেজির চিপাচিপির মধ্যে ব্যালাটা কি ঢুকতে সক্ষম হইছিল?
..................................................................
#Banshibir.
এটা আবার কি জিনিস, ব্যালাটা মানে কি বেহালা নাকি?
হ, জায়গা কম (তেইশ কেজি) তাই চাইপা চুইপা লেখলাম "বেহালাটা" র জায়গায়।
আনতে পারছিলেন?
..................................................................
#Banshibir.
হুম , সেটা ফেলে আসা যায় নাকি!!
আপনার লেখা সেই আগের মতই চমৎকার। শেষের অংশটুকু মন খারাপ করিয়ে দিল যদিও।
ধন্যবাদ পিপিদা।
লেখাটা পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেল।
ভালো থেকো ভিভিয়ান
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
মন খারাপ করা লেখা, কিন্তু চমৎকার লিখেন আপনি।
- ইয়ামেন
ধন্যবাদ ইয়ামেন।
লেখাটা খুব ভাল হয়েছে।
ধন্যবাদ ফারুক ভাই।
লেখাটা বেশ ভাল লেগেছে।
ডিঙ্গি নৌকার নাবিক
ধন্যবাদ ডিঙ্গি নৌকার নাবিক।
আপনি বেহালা বাজাতে পারেন এটা শুনেই আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। লেখাটা অনেক ভালো হয়েছে।
ফাহিমা দিলশাদ
ধন্যবাদ ফাহিমা। সচলের প্রপিক দেখে নিন
অনেকদিন পরে লিখলেন।
ভিভিয়ানের জন্য মায়া লাগছে।
হুম।
অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম। লেখা ও বিষয় নির্বাচন দারুণ হয়েছে। হ্যাঁ, মন খারাপ হলতো বটেই।
ধন্যবাদ ভাবনাদা।
ভালো লাগলো ছোট্ট, বিষণ্ণ বিমানযাত্রা।
ভালো থাকুক ভিভিয়ান আর ভাঙা পরিবাররে সব বাচ্চারা!
ওরা যে কষ্ট পাচ্ছে/ পেয়েছে সেটার জন্য ওদের কোন দোষই নেই।
শুভেচ্ছা
ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ।
হুমম !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
হুম রণদা।
কেমন মায়ায় ভরা একটা লেখা!
বন্দনাকে আমি আপনি আজ্ঞে করতাম নাকি তুমি সেটাও ভুলে গেছি!
তার মানে বুঝলে তো কতদিন পর লিখলে? নাকি আমিই পড়লাম
ভিভিয়ানের কথা পড়েই তো মায়া মায়া, লাগছে তোমার কষ্টটা যেন বুঝতে পারছি।
উরি! তুমিও বেহালা বাদক? এতদিন আমি জানতাম বন্দনার অবস্হান ক্যানাডায়
আরো লিখো হে
আমার অবস্থান কানাডায় । বেহালা শিখছি আয়নাদিদি ,বাদক বলা ঠিক না।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন