এই যে আপনি আর আমি মুখোমুখি বসে আছি-
এই যে দুইজন আমরা এখন কথা বলছি...
আমরা এরকম আর থাকবো না, তাই না?
না কি, আমরা কোনদিনও এরকম ছিলাম না?
তাহলে এই যে বসে আছি, এ কেমন?
সাধুদের বথাগুলো এরকমই।
পথের ধারে ফুটে থাকা বুনো ফুলের মতন। এমনিতে চোখে ধরবে না কিন্তু যে এর রস পেয়েছে, তার জন্য পৃথিবীটা হয়ে উঠবে- মস্ত একটা ফুলের বাগান। সাধুর কথা মনে নিলে, গোটা মানব জীবন হয়ে ওঠে একটা রসের আধার।
কোন রসেতে আছে মানুষ মহা রসের ধনী
চন্দ্রে সুধা পদ্মে মধু জাগায় রাত্রিদিন জুগায় রাত্রিদিনী।
সুখ, দুঃখ, পূর্ণ আর অপূর্ণ কামনা- বাসনার মধ্যে নিমজ্জিত মন দেহকান্ডের সীমানা ছাড়িয়ে জগৎময় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু দেহটার বাইরে যে সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ড- তার অস্তিত্ব যে দেহের ভেতরেই- এরকম একটা অনুভূতি জেগে ওঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমরা টের পাই, “আমি যেন শুধু এই দেহের মধ্যে নেই।”
বায়ুমণ্ডলের মত সর্বব্যাপী হয়ে উঠতে শুরু করি আমরা।
মহাশূন্য- যা ধারণ করে আছে আমাকে, আপনাকে, এই মহাবিশ্বকে
টের পেতে শুরু করি- আমারই ভেতরেই তার বাস।
জেগে ওঠে সেই আমি।
মানুষের ভেতরে আরেক মানুষ।
সুখ পিয়াসী আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে অভিজ্ঞতাটা সহজ নয়। কারণ, এর ফলে যে কথাগুলো আমারা চিরকাল জানি, কিন্তু দৈনন্দিনতার ঘেরাটোপে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় ভুলে থাকি- তা প্রকাশিত হতে শুরু করে। সমাজ, রীতি, নীতি যেগুলো ঠিক বেঠিক না ভেবে নিজেরা মেনে চলি সেগুলো স্বরূপে প্রকাশ হতে শুরু করে।
যাদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে চলেছি
কিংবা যাদের পাশে বসে সিনেমাটা দেখছেন
আপনি একবার কি কখনও ভেবে দেখেছেন
আসলে ওরা আপনার কে? আপনিই বা ওদের কে?
বছর চারেক আগে বন্ধুরা মিলে একবার সিনেমা দেখতে যাচ্ছিলাম, গোঁসাই প্রশ্নটা করেছিলেন।
আমি হয়তো চিনি না, জানিনে, পথ ঘাট।
কিন্তু জীবনে যা জানলাম, তাকি মিথ্যে?
গোঁসাই সাধু মানুষ। লোকায়ত আচার নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। তার জীবনে একটি মজার অভিজ্ঞতা আছে। তার পিতামহী ছিলেন, তার শৈশবের সঙ্গী। শৈশবে তার ভাব আচার দেখে পিতামহী তার মধ্যে কৃষ্ণ চরিত্র দেখতে পেয়েছিলেন। পিতামহীর এই দেখা তার জীবনে এক সুদূর প্রভাব ফেলে।
গোঁসাই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ। ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির ইতিহাসে এই সম্প্রদায়ের লোকেদের সমাজের সবচেয়ে নিম্ন বর্গের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় । সুদীর্ঘ কাল ধরে সমাজে যে ছোট বড়, বৈষম্য চলে আসছে -তার নির্মমতা এই সম্প্রদায়ের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহভাবে এসে পড়েছিল। অস্পৃশ্যতার লজ্জ্বায় আক্রান্ত হয়ে, তারাও যে মানুষ- একথা ভুলে গিয়েছিল। এই রকম এক সামাজিক অবস্থায় চৈতন্যদেব আবির্ভূত হলেন।
বর্ণ ও ভেদপ্রথায় আবদ্ধ ভারতীয় সমাজের ইতিহাসে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকে একটি বিপ্লব হিসেবে দেখা যায়।
হরে কৃষ্ণ, হরে রাম...
তার মুখের বানী অমৃতের মত বৈষম্য নির্ভর বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থাকে একটি বাঁধনে এক করলেন। তিনি মানুষের মধ্যে প্রেম আর ভক্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
“আমরা মানুষ। আমরা জ্ঞাতি।”
শ্রী চৈতন্যদেবের সংস্পর্শে অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী নিজেদের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলো। মানুষ ভজনার অর্থ মানুষ হওয়া। মানুষকুলে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না, মানুষ হতে হয়। মানুষ হতে গেলে মানুষের রূপকে দেখতে দেখতে হয়। প্রেম আর ভক্তি নিয়ে মানুষের দিকে তাকালেই সেই রূপ চোখে ভেসে ওঠে। একেই মানুষ ভজনা বলে।
মানুষ ভজনার মাধ্যমে সেই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠাই মানুষের ধ্যান। ধর্ম।
লোকায়ত দর্শনের এই দিকটির প্রতি আগ্রহ ছিল আমাদের। অসীম গোসাঁইয়ের সংষ্পর্শে আগ্রহটা একটা রাস্তা খুঁজে পেল। কারণ তিনি শুধু সাধু নন, তিনি একইসঙ্গে একজন গবেষকও । আমরা যারা শহুরে শিক্ষায় ভাষা আয়ত্ত্ব করেছি, সাধুদের ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে তা অনেক সময়েই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অসীম গোঁসাইয়ের কারণে সেটা অনেকটাই দূর হলো। মানুষ বুঝতে হলে সাধুদের কাছে যেতে হবে। আমরা ঠিক করি আমরা নৃতত্ত্বের আলোকে ব্যাপারটিকে বোঝার চেষ্টা করবো। আমরা বিচার করবো না। বোঝার চেষ্টা করবো। আমরা ভাবি, কে সেই সাধু- যার কাছে গেলে আমরা সত্যটাকে জানতে পারবো।
‘ কোন সাধুর কাছেই আপনি সত্য পাবেন না। কারণ সাধুর কাছে সত্য থাকে না।’
‘ তাহলে কার কাছে যাবো?’
‘ সাধুর কাছে।’
আমরা বুঝতে পারি না। অসীম গোঁসাই খোলাসা করেন,
‘ সত্য কারো কাছে নেই। সাধুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার সঙ্গ সংস্পর্শে সত্য উদ্ভাসিত হয়। যেমন করে একটি প্রদীপ থেকে জ্বলে ওঠে আরেকটি প্রদীপ।’
মাঝেমধ্যেই আমরা অবসর বের করি। সাধুসঙ্গ যাত্রায় বের হই। সাধুদের সাথে থেকে মনে হলো- সাধুু আসলে কেউ নন, নৃতত্ত্বের একজন নিমগ্ন বিজ্ঞানী মাত্র। নৃবিজ্ঞানীর মতই গোটা জীবনভর তারা মানব প্রকৃতিকে অবলোকন করছেন। মানব জীবনের শত সহস্র বিচিত্র রূপকে আবিষ্কার করে চলেছেন। এই রূপের রসে মজেছেন।
জীবনে তাড়া আছে, কিছু একটা করতে হবে। তাই আমরা ঠিক করলাম, একটা বই লেখার চেষ্টা করবো। যে বইয়ে সরলভাবে লোকায়ত দর্শনের মূলভাবটি বোঝা যাবে। তার আলোকে আমরা আমাদের চারপাশ এবং নিজেদের দেখার একটা পথ পাওয়া যাবে। সাধু সঙ্গের অভিজ্ঞতা মানব সমাজকে যেভাবে উদ্ভাসিত করে তা অক্ষরে আনার চেষ্টা করবো। শুধু অক্ষরে কেন? আমাদের শফিউল ফারুক উজ্জ্বল, সে ছবি আকে। তার ইচ্ছে হলো, এই অভিজ্ঞতাকে চিত্রভাষায় নিয়ে আসবে। অক্ষরের পাশাপাশি সেই ছবিও থাকবে। আমরা আরেক রঙে ডুবে গেলাম।
অসীম গোসাঁই বলেন, “এই তাড়ার সাথে যদি জীবনের রসবোধ জয়ী না হয়, তবে এসকলই হবে অর্থহীন।”
বইয়ের কাজ শুরু করেছি একটু একটু করে। জানি, পথটা দীর্ঘ। এবং রসের।
বইটা নয়, বইয়ের পথে যাত্রার কথাই এই সিরিজে মাঝে মাঝে বলবো। সিরিজটা হবে, যাত্রাপথের খেরোখাতার মত। দানা না বাঁধা চিন্তার মত। খানিকটা অগোছালো। বাঁধনটা এলেবেলে। তবু আশা, এই খেরোখাতায় বিষয়গুলো বলার মধ্য দিয়ে পুরো বিষয়টা আরেক রকম রসের সঞ্চার করবে। এই যাত্রায় কারো চিন্তা আর উপলব্ধির যোগ ঘটবে- তাতে রসের যোগ ছাড়াও জীবনের যে তাড়া, সে বইয়ের খসড়া তৈরীর কাজটা সাথে সাথে আরেকটু এগোবেÑ এই রকম একটা ভাবনা থেকেই এই লেখার জন্ম।
যেমন, বইটার নাম কী হবে- এ নিয়ে একেকবার একেকটা নাম মনে এসেছে।
একটা নাম এসেছে- “আমি”।
‘আমি’কে সমাজ, সংসারে আবদ্ধ আমরা কতভাবে আবিষ্কার করতে পারি এই বই তারই একটি নমুনাচিত্র হয়ে উঠবেÑ বইয়ের নাম যাই হোক না কেন, এমন একটি লক্ষ্য আমাদের মধ্যে আছে।
আবার মনে হয়েছে-
বইটির নাম হতে পারে-
সংস্কারা
‘সংস্কারা ‘ লোকায়ত দর্শনে মানুষের একটি প্রতিশব্দ।
যারা রিপু ইন্দ্রিয়াদিগকে সাধনার ফলে সংস্কার করে নিজের প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন তারাই সংস্কারা। শুধুমাত্র মানুষেরই এই ক্ষমতা আছে। এই কারণে মানুষের আরেক নাম সংস্কারা।
সংষ্কারা নাম দিয়ে কয়েকটি পাতার প্রথম খসড়া লেখাও হয়েছিল। সেটার শুরুটা ছিল এরকম-
যদি কখনও দ্বিধা হয়
কখনও শংশয় আসে অথবা প্রশ্ন জাগে তোমার মনে
দিকহারা নাবিকের মত-
আকাশের চাঁদ, সূর্য যার চোখে ঢাকা পড়ে আছে মেঘের আড়ালে
প্রতিটা দিক যার কাছে মনে হয় ভ্রান্ত
অথচ জ্বলে আশার প্রদীপের মত-
কোরাণ বলে, “তুমি তোমার আত্মাকে জিজ্ঞাসা করো।
সে যা উত্তর দেবে তা করার জন্য
তুমিতো দায়ী নও।”
আমরা ভাবতে থাকি।
নিজের ভেতরে টের পাই আর এক আমি।
“কোন পথে যাবো?”
তাকে জিজ্ঞেস করে উঠি।
ভেতর থেকে কথা বলে ওঠে ও।
সরল পথ ঝলমল করে ওঠে উজ্জ্বল আলোর মত।
‘যে আমি’র সাথে কথা কই
‘যে আমি’ কথা কয় আমার সাথে
‘সে আমি’ কে?
‘মনের মানুষ’ শব্দটা আমরা অনেক শুনেছি। আধুনিক সিনেমা, সাহিত্যেও এই শব্দটি অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে। গৌতম ঘোষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই থেকে এই নামে একটি সিনেমাও বানিয়েছিলেন। কিন্তু গোটা সিনেমা দেখে মনের মানুষের বিষয়টি তেমনভাবে বুঝতে পারি নি। কুষ্টিয়ায় এক সাধুর ঘরে রাতভর সঙ্গলাভের সুযোগ হয়েছিল। তার সঙ্গ থেকে ‘আমার ভেতরের এই আমি’ জেগে উঠেছিল মনের মানুষ হিসেবে। সেই সাধু সঙ্গ স্মৃতি এইভাবে খসড়া লেখার একটা জায়গায় উঠে এসেছে,
মনের মানুষ
সাধু কয়...
“একটা ঘোড়া, কেশর উড়িয়ে লেজ দুলিয়ে
খালি ছুটে বেড়ায়। আর ছুটে বেড়ায়।
দ্বিবিদিক।
তার চোখে একটা সোনার হরিণ সারাক্ষণ দৌড়ে বেআচ্ছে।
‘সোনার হরিণ চাই- আমার সোনার হরিণ চাই।..
অমল ধবল চপল কোমল সোনার হরিণ চাই।’
নিশিদিন ধ্বনি তোলে আর কামনার সোনার হরিণের পেছনে ছুটে বেড়ায়।
আমাদের মন হলো- এই এক ঘোড়া।
যুক্তি নেই, নীতি নেই, বিচার নেই-
শুধু চাওয়া। বাসনা। আর রিপুর ঝলমলে হাতছানি।
সেই ঘোড়ার উপর বসে আছেন এক মানুষ।
মানুষটার হাতে একটা লাগাম।
জ্ঞানের তৈরী সেই লাগাম হাতে তিনি
এই মনঘোড়ার অশান্ত দিশাহীন পথচলাকে
নিয়ন্ত্রণ করছেন।
সেই হলো মনের মানুষ।
এই বাক্যগুলোর শব্দরীতি এবং বিন্যাস আমাদের মন ভরায় নি।
আমরা সাহিত্যের ভাষার বাইরে আমরা একটা সরল ভাষার সন্ধান করছি। যেটা যেকোন মানুষের বোধগম্য হবে, যদি তার মন এতে যুক্ত হয়। আমাদের ইচ্ছে, ভাষাটা এমন হবে যা পৃথিবীর যে কোন মানুষের মুখের ভাষায় অনুবাদযোগ্য। প্রতিটি ভাষার সাহিত্য এবং সংস্কৃতির একটা নিজস্ব আবহ আছে যা ভাষায় চলে আসে। তখন এই ভাষার অনুবাদ তার বলার কথার অর্থে নতুন অর্থ যোগ করে। এটা যে শুধু একটি ভাষার সাথে অন্য ভাষায় অনুবাদে ঘটে তা নয়, একটি মানুষের কথা যখন আরেক মানুষ শোনে তখনও এই অর্থ বিযুক্তি ঘটে। প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে। এর কারণেই এটি অনিবার্য হয়ে আসে। যে কারণে, ভাষাতত্তবিদেরা বলেন, মানুষের সমস্যা হচ্ছে- ‘ভাষার সমস্যা’। কত আগে চীনা দার্শনিক সান যু তার আর্ট অব ওয়ার বইতে বলেছিলেন,
“তুমি যদি তুমি কী চাও এবং তোমার শত্র“ কী চায় তা ভাল করে জানো-
তবে যুদ্ধ ছাড়াই যুদ্ধজয়ের সহস্র উপায় আছে।”
তার কথাও মানুষের ভাষা সমস্যার কথাই তুলে ধরে।
কিন্তু এরপরও আমাদের আশা, এমন ভাষা বের করা সম্ভব- যে ভাষা অর্থ বিচ্যূতি ছাড়াই অন্যের কাছে বোধগম্য হবে। এই আশার পালে হাওয়া লাগিয়েছে ছোট্ট একটা অনুভূতি-
‘আমরা সকলেই মানুষ।’
ছবি : শফিউল ফারুক উজ্জ্বল
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ভাষা কোনটা আসলে? যে ভাষায় কথা বলে সেটা ভাষা? উপলব্ধির ভাষা কী? শব্দ কি সবসময় তা ধারন করে? যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুজন মানুষের মধ্যে বাক্য বিনিময় হয়, কতগুলো শব্দ। একজন বলে, আরেকজন শোনে। শব্দগুলো চেনা, কিন্তু যে বলছে সে যে উদ্দেশ্যে শব্দটা বলছে ঠিক সেভাবে কি পৌঁছাচ্ছে শ্রোতার মনে? কানে হয়তো পৌঁছাচ্ছে, কিন্তু মনে?
নাহ্, প্যাঁচ লেগে গেছে মাঝরাতে। কালকে পোস্টটা ঠাণ্ডা মাথায় আবার পড়তে হবে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন