প্রভু নামেই তাকে সবাই চেনেন। জানেন। পরিচয়ের প্রথম ক্ষণ থেকেই আমরা দেখেছি- ছোট বড়, প্রখ্যাত-অখ্যাত, জ্ঞানী-মূর্খ, রাজা-ভিখিরী সবাই তার সমান সঙ্গী। প্রভুকেও সবসময় কোলের শিশু থেকে বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে ‘প্রভু’ আর ‘আপনি’- বলে সম্মোধন করে সমান সম্মান করতে দেখেছি। তার সঙ্গ আমাদের কাছে ছিল চোখের ওপর থেকে একটা পর্দা সরে যাওয়ার অভিজ্ঞতার মতন। এর ফলে জীবন এবং প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। জগতের স্পর্শ আরও মজাদার লাগে। তুচ্ছতম মুহ‚র্তও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সুখের মতই দুঃখও সমান আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়। আমরা শব্দকোষ থেকে ‘প্রাজ্ঞ’ শব্দটা জেনেছিলাম। জীবনে প্রভুর সঙ্গলাভের মধ্য দিয়ে শব্দটাকে আমরা দেখতে পেয়েছি।
তার নাম কেন প্রভু হলো?
আমাদের ধারণা ছিল, অতুল্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার কারণেই তার এই উপাধি। আকাশের মত মানুষেরা- যাদের কাছ থেকে ভাবতে এবং স্বপ্ন দেখতে শিখেছি, তাদের অনেকেই প্রভুর সতীর্থ এবং বন্ধু হয়েও ছিলেন তার ভক্তজন। তারা যেভাবে প্রভুর সঙ্গে বা অন্যের সঙ্গে প্রভু প্রসঙ্গে কথা বলতেন- তা দেখে প্রভু নামের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে এই রকম একটা বিশ্বাস আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, কবি শামসুর রাহমানসহ বেশ কয়েকজন লেখকের লেখাতেও প্রভুকে আমরা পেয়েছি। কখনও গল্প বা কবিতার চরিত্র হয়ে, কখনও স্মৃতিকথার অনুসঙ্গ হিসেবে, আবার কখনও প্রকাশিত বইয়ের উৎসর্গপত্র অথবা ভূমিকার কেন্দ্র হয়ে প্রভু এসেছেন। সব লেখাগুলোতেই প্রভুর যে ছবিটি ফুটে উঠেছেÑ তা একজন জ্ঞানী এবং প্রাজ্ঞের প্রতিচ্ছবি।
একদিনের কথা। প্রভুর কাছে আমরা এসে বসেছি। বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির অন্ধকারে কথার পিঠে কথা, দৃশ্যের পর দৃশ্য, জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা, চিন্তার পর চিন্তা আলাপনের মত বয়ে যেতে লাগলো। ‘প্রভু’ প্রসঙ্গটিও এলো।
“প্রভু- আপনাকে সবাই প্রভু বলে কেন?” উত্তরে প্রভু স্মিত হাসলেন।
‘‘সবাই আমাকে প্রভু বলেন, আমার সঙ্গে সবার এ এক দুষ্টুমী দুষ্টুমী খেলা। কিন্তু আমি সবাইকে প্রভু জ্ঞান করি, এ আমার জন্য দর্শন- ফিলোজফি।” প্রভু বললেন।
কেমন প্রভু? তার দিকে চেয়ে থাকি।
“একবার একটা চোরকে প্রহার করেছিলাম...” প্রভু বলতে শুরু করলেন। “এত রাগ হয়েছিল - প্রহার না করে পারিনি। এই রাগটা কোথা থেকে এলো? সেই চোরের কারণেই। আর ‘রাগ’ আমাকে অন্ধ করে দিল। তাহলে কি আসলে চোরটাই আমাকে তাকে প্রহার করতে বাধ্য করলো না? এভাবেই যাকে আমি ভালবাসি বলে ভাবছি- আসলে কিন্তু তাকে আমি ভালবাসছি না। সে আমার মধ্যে একটা রূপের জন্ম দিচ্ছে। ঐ রূপই আমাকে তাকে ভালবাসতে বাধ্য করছে। এভাবে প্রতি মুহ‚র্তে আকাশ, বাতাস, প্রাণীকুল, বৃক্ষ, মানুষসহ যা কিছুর মুখোমুখি হচ্ছি তারাই আমার সকল চিন্তা, ইচ্ছা, ঘৃণা, কামনা এবং আচরণ নির্ধারণ করে দিচ্ছে। সকাল বলছে, ‘ওঠো।’ আমি উঠছি। রাত বলছে, ‘ঘুমোও।’ আমি ঘুমুতে যাচ্ছি। আগামী বলছে, ‘ভাবো’। আমি ভাবছি। এভাবেই রাস্তার কুকুর তেড়ে এসে বলে, ‘ভয় পাও।’ ভয় বলে, ‘ইট তুলে নাও।’ আমি ইট তুলে নেই। বর্ষার প্যাঁচপ্যাচে কাদা বলছে, ‘বিরক্ত হও।’ আমি বিরক্ত হচ্ছি। পথের ধারে ফুটে থাকা ফুল বলে, ‘আমায় দেখ।’ আমি দেখে আনন্দিত হচ্ছি। খাবার বলে, ‘লোভ করো।’ আমি লোভ করছি। আমি যার কথা শুনতে বাধ্য- সে কে? সেই তো আমার প্রভু। যেমন, এই যে আমি যে কথাগুলো এখন বলছি প্রভু, এই শব্দগুলো- তা আপনিই আমাকে দিয়ে বলাচ্ছেন। আপনি না থাকলে- এ শব্দগুলোতো বলাই হতো না। তাহলে কি, আপনি আমার প্রভু নন?
তাহলে কি ‘আমি’র কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই? জানতে চাই আমরা।
“ মানুষ নিজের সাথে কথা বলে। যখন সে নিজের সাথে কথা বলে তখন সে আসলে কার সাথে কথা বলে প্রভু?”
আমরা ভাবতে শুরু করি। জগৎ সংসারে রাত্রি কেটে গিয়ে অনেক নতুন প্রভাত এসেছে। কিন্তু আমরা সেই ভাবনা এখনও বয়ে নিয়ে চলেছি। আমরা বুঝতে পারিÑ আমরা ‘কাল’কে অতীত-বর্তমান-আগামীর খাঁচায় ভরে দেখি ঠিকই, কিন্তু ‘কাল’ আসলে একটাই। নিত্যকাল। আমরা অনুভব করিÑ প্রভুর উপস্থিতি স্মৃতি নয়, আমাদের এই নিত্যকালেই তিনি বিরাজ করছেন।
ছবির ডানদিক থেকে বসে থাকা দ্বিতীয় জন আমাদের প্রভু। খালেদ চৌধুরী। কিছুদিন আগে এক বন্ধু ছবিটি পাঠিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে তোলা এই ছবিটি কত বছর আগে তোলা হয়েছিল আর ছবিতে আর কে কে আছেন তা ছবির ছোট্ট ছেলে দুজন হয়তো বলতে পারবে। প্রভুর কোলে বসা প্রভুপুত্র সুমন চৌধুরী। তার পাশে সূজন চৌধুরী।
---
মন্তব্য
, ভাল লাগলো পড়ে। ছবিতে সুমন নেই।
যারা বসে আছেন বা দিক থেকে দ্বিজেন শর্মা, বিষ্ণুচরণ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, তোমার প্রভূর কোলে সুজন আর পাশে হায়াত মামুদের কোলে সৌম্য মামুদ। দাড়ানো বাদিক থেকে রথীন্দ্র মজুমদার, অরুণ সোম, কাদের কাকু (পুরা নাম মনে নাই ) তারপর ভালো দাদা ( দ্বিজেন শর্মার ছেলে, ডাক নাম টুটুল)।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
দেশিক দেখা যায় আপনার কপি
...........................
Every Picture Tells a Story
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
ভালো লাগলো স্মৃতিচারণ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কেন প্রভু বলা সেই ব্যাখ্যা আগে জানতে পারিনি। ধন্যবাদ কর্ণজয়! আরো অনেক ধন্যবাদ ছবিটার জন্য। ছবিটাতে একজনের অনুপস্থিতি টের পেলাম - ননী ভৌমিক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভাল লাগলো। প্রভুর কথা প্রথম জেনেছিলাম সচল রিটন ভাই'র কোনো এক স্মৃতিচারণে। সেখানেও এই নামের উৎস বলা হয়নি। বদ্দা/সুজন্দাও একদিন আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীর সমান ছিল দেখেই মজা লাগছে। (সুজন্দার ক্যাপশন দেখে যা ভাবছিলাম সেটা দেখি পান্ডবদা আগেই ভেবে ফেলেছেন।)
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
১৫ আগস্টে নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার পড়লাম, ২৫ মার্চ রাতে তিনি ৩২ নাম্বারে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। সাথে ছিলেন প্রভু
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এইটা?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কিংবদন্তির মানুষকে নিয়ে সুন্দর স্মৃতিচারণ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
চমৎকার, আরও দীর্ঘ হলে ভাল লাগত, ওনাকে নিয়ে দীর্ঘ লেখা পড়তে ইচ্ছা করে
facebook
নতুন মন্তব্য করুন