খন্দকার মোশতাক আহমেদের আয়নায়

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/১১/২০১৫ - ৭:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খন্দকার মোশতাক আহমেদের চোখে ঘুম নেই।
জীবনটাকে মাঝেমধ্যে অসহ্য মনে হয়। মনে হয় সারা দেহে আগুন জ্বলছে। কেন এমন হয়? দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ঝিম মেরে বসে থাকেন মোশতাক আহমেদ। কত বছর! ত্রিশ বছরের উপর হয়ে গেল। কুটকুট কুটকুট করে যন্ত্রণাটা তার মাথার ভেতরটা খুঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না। বয়স হয়েছে বলেই বোধহয়, ইদানিং যন্ত্রণাটা বেশি ফণা তুলছে। এর ওষুধ একটাই। বঙ্গবন্ধুর ছবিটা তার চোখে ভেসে ওঠে। তার কামনা বাসনাগুলো সাপের মত ছবিটার উপর ছোবল মারতে মারতে যতÿণ ক্লান্ত হয়ে যাবে ততÿণ তার এই যন্ত্রণাটা বাড়তে থাকবে।
বাইরে থেকে এটা অবশ্য খুব একটা বোঝা যায় না। বরঞ্চ যে কেউ মনে করবে তার সাথে প্রধানমন্ত্রীর সখ্যতা অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী তার ছেলে মেয়েদেরও বলেন, “আমার কিছু হলে তোরা মোশতাক চাচার কাছে যাবি। ওই তোদের দেখবে।” সবাই ভাববে এ তার সৌভাগ্য। কিন্তু এত বিষ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
ঈর্ষা! ‘আহ্ মাবুদ! কেন আমাকে এই শা¯িÍ দিলে?’ তার চোখ দিয়ে জল নামে।
তাকে বেশিরভাগ সময়েই শেখ মুজিবের সঙ্গে থাকতে হয়। তাকে নেতা হিসেবে মানতে হয়। সারা শরীর তখন কিলবিল কিলবিল করতে থাকে। তার নিজেরই মাঝে মধ্যে মনে হয়, তার শরীরে কোন রক্ত নেই। শরীরের সম¯Í রক্ত বিষ হয়ে গেছে। মুজিবের চরম পরিণতিই তার শরীরের বিষ ঝাড়তে পারবে। এর আর কোন ওষুধ নেই। এর জন্যই তিনি বেঁচে আছেন। তিনি মুজিবের সর্বনাশ দেখে অট্টহাসি দিয়ে মুজিবকে বলবেন, “দেখলি। সারা জীবন তোর পেছনে থেকেছি শুধু এইদিনটার জন্য। দেখ আমার সাথে লাগতে আসার পরিণতি।”
এই চেষ্টাটা তিনি সবসময়েই করে এসেছেন। শুরুর দিকে ছিল প্রতিযোগিতা। এরপর প্রতিদ্ব›িদ্বতা। দুজনের মনের পার্থক্য থেকেই এর শুরু। দুজনে মুসলিম লীগ করলেও মুজিবের অসা¤প্রদায়িক মন তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না।
“আহ্ তিনি যদি ফিরে আসতেন।” নেতাজীর জন্য মুজিবের অনুরাগ ঝরে। “তিনি ফিরলে পাকি¯Íান কিভাবে হয়?” মোশতাকের কথায় মুজিব চুপ করে থাকেন। কথাটা মুজিবও জানেন। কিন্তু যেন মেনে নিতে পারেন না। মুজিবের কী অস্থির পায়চারী তখন। নেতাজীর অমঙ্গল বা পরাজয় কোনটাই মুজিব মানতে পারছে না। “দেশের জন্য যিনি স্বর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি সা¤প্রদায়িক হতে পারেন না।” মুজিব জোরে জোরে কথাটা বলেন। মোশতাক বুঝতে পারেন, এটাই মুজিব। মুজিবের প্রতি তার একটা রাগ তিরতির করে জেগে ওঠে। ‘মুজিব মুসলমানদের স্বার্থ রÿা করার জন্য কাজ করে ঠিক কিন্তু নিজে অসা¤প্রদায়িক কীভাবে হয়? হিন্দুদের ঘৃণা করার মধ্যেই পাকি¯Íানের বীজ। এই ঘৃণা না থাকলে পাকি¯Íানের হয়ে সে কীভাবে কাজ করবে?” মোশতাকের মনে হয়, “পাকি¯Íানের কর্মী হয়ে সে কীভাবে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে যেই সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার ফসল পাকি¯Íান?” মোশতাক মুজিবকে কিছুতেই বুঝতে পারেন না।
এই দূরত্ব বিরোধের পর্যায়ে চলে গেল পাকি¯Íানের জন্মের পর। ভারত আর পাকি¯Íান হয়ে গেলেও দাঙ্গার আগুন থামেনি। চারদিক অশান্ত। পাকি¯Íানে মুসলমানরা হিন্দুদের উপর উপর আর ভারতবর্ষে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার খেলায় মত্ত। ভারতবষের কোটি কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার কথা ভেবে সোহরাওয়ার্দী পাকি¯Íানে আসলেন না। ভারতবর্ষের মুসলমান মহাত্মা গান্ধী আর তিনি মিলে দাঙ্গার আগুন যেন প্রশমিত হয় সেই চেষ্টা করতে লাগলেন। পাকি¯Íান সরকার সোহরাওয়ার্দীকে ভারতের চর ঘোষণা করে পাকি¯Íানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। মুসলিম লীগ আসলে সরকার গঠণ করেই সাধারণ মানুষের বদলে জমিদার ও ধণিক শ্রেণীর স্বার্থকেই গুরুত্ব দিল। মুসলিম লীগের গণবিরোধী অবস্থান দেখে সাধারণ মুসলমান যারা পাকি¯Íানের জন্য রা¯Íায় লড়াই করতে নেমেছিল তারা মুসলিম লীগ থেকে একে একে সরে আসতে থাকলো। নতুন একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরীর প্রয়োজনীয়তা থেকে পূর্ব পাকি¯Íান আওয়ামী মুসলিম লীগ তৈরী হলো। ভাসানী সভাপতি হলেন। মুজিব এই দল গঠণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখায় তাকে ‘জয়েন্ট সেক্রেটারী’ পদ দেয়া হলেও মোশতাক এটা মেনে নিতে পারেন নি। তার ইচ্ছে ছিল এই পদে মুজিবকে না দিয়ে তাকেই দেয়া হোক। কিন্তু মুজিবের সাথে তিনি পেরে উঠলেন না। বিরোধটা আরও জমাট বাঁধলো আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ নামটি বাদ দেয়া হলো। তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। এখানেও তিনি মুজিবের ইচ্ছার কাছে পরাজিত হয়েছেন। তিনি এর প্রতিবাদে দল থেকে ঐ সময় বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু বেরিয়ে গিয়েই তিনি বুঝেছিলেন কেউ তার সঙ্গে নেই। তিনি একা কিছুই করতে পারবেন না। তিনি মুজিবের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু মনে মনে তিনি কখনই এটা ভুলতে পারেন নি। এই তিক্ত স্মৃতি অপমানের মত সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন।
সময়ের সাথে সাথে পূর্ব পাকি¯Íানের রাজনীতিতে অসা¤প্রদায়িক চেতনা যত বাড়তে থাকলো শেখ মুজিবর রহমান প্রভাব বাড়তে থাকলো। ৬ দফা তুলে তিনি বাঙালীর প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় পূর্ব পাকি¯Íানকে পাকি¯Íান থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনার দায়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্টদ্রোহ মামলায় জড়ানোর পর শেখ মুজিবুর রহমান শুধু আওয়ামী লীগের নয়, বাঙালীর একমাত্র নেতা হয়ে উঠলেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে সবাই তাকে বরণ করে নিল আর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পড়ে থাকলেন তার একজন অনুগামী কর্মী হিসেবে।
আহ! কি নির্মম বা¯Íবতা।
খন্দকার মোশতাকের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান তার এই পরাজিত প্রতিদ্ব›দ্বীকে সবসময়ই নিজের কাছে রেখেছেন, অনুগ্রহ দেখিয়েছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু খন্দকার মোশতাকের কাছে শেখ মুজিবের এই প্রশ্রয় ছিল দুঃস্বপ্নের মত। গভীর রাতে কিংবা নির্জন দুপুরে তিনি যখন একা থাকতেন তখন শেখ মুজিবের এই অনুগ্রহ তাচ্ছিল্যের হাসি হয়ে ফিরে আসে, ‘কিরে, পারলি না তো! ঠিক আছে চিন্তা করিস না। আমি আছিতো। আমি তোকে দেখে রাখবো।’ অন্ধকারের ভেতরেও মোশতাক শেখ মুজিবের বিজয়ের হাসি শুনতে পান। অপমানের বিষে তার শরীর নীল হয়ে যায় মোশতাক আহমেদের। আহ! সারা শরীরের বিষ তিনি যদি ঢেলে দিতে পারতেন মুজিবের ওপর। প্রায়ই ঘুম ভেঙে ছটফট করে ওঠেন তিনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় আত্মহত্যা করেন। পালিয়ে যান কোথাও। যেখানে নিজের ছায়াও নেই। কিন্তু তাতে কি লাভ? তার প্রতিশোধতো নেয়া হবে না। প্রতিশোধ নেবার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে।
তার মনে হচ্ছে সেই দিন সমাগত। তার আলামত তিনি দেখতে পাচ্ছেন। তাজউদ্দীনের সাথে মুজিবের গাটছড়াটা ভাঙা গেছে। তার সুদিন আসছে। তিনি উন্মুখ হয়ে সেইদিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

অগাষ্টের প্রথম সপ্তাহে মেজর তার সাথে দেখা করতে আসলেন।
অগাষ্টের ১৩ অথবা ১৪ তারিখে এটা ঘটতে পারে। মেজর মোশতাক আহমেদকে বললেন। মোশতাক দাঁড়িয়ে মেজরের হাত জড়িয়ে ধরলেন। মেজরের মনে হলো একটা ইদুরের সাথে তিনি করমর্দন করলেন। সবকিছু ঠিকঠাক করে তিনি যখন বেরিয়ে আসলেন তার চিন্তার পথ জুড়ে অনেক রক্ত কমল ফুটতে শুরু করেছে।

ক্রিং। ক্রিং। ক্রিং ক্রিং।
১৫ অগাস্ট সকালে জিয়াউর রহমানের বাসায় ফোন বেজে উঠলো। জিয়াউর রহমান ফোনটা ধরলেন। “বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন” অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে আসে। “ উপরাষ্ট্রপতি আছেন, তাকে খবর দিন।” জিয়াউর রহমান ফোনটা রেখে দিলেন।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গভবনে বসে আছেন। মেজর তারপাশে এসে দাঁড়ালেন, “Congratulation, Mr. President.” মেজরের দিকে মোশতাক কৃতজ্ঞতার হাসি দিলেন। তার মনে হলো, মুজিবের লাশ তখনও সিঁড়িতে পড়ে আছে। এক এক করে অনেকগুলো মুখ তার মনে হলো। তারা এখন আর কেউ নেই। তার প্রতিশোধের আগুনে সবাই আত্মহুতি দিয়েছে। তার একটু অস্বোস্তি হলো। “লাশগুলো সরিয়ে ফেললে...” মোশতাকের কথা শেষ হওয়ার আগেই মেজর তার দিকে ফিরলেন। তার চোখ বরফের মত। শীতল। মোশতাক চুপ করে গেলেন। “আপনি আপনার কাজ করুন প্রেসিডেন্ট। আপনার সরকার গঠণের ব্যবস্থা করুন।” মোশতাক সাথে সাথে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদ ডাকলেন।
আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ সাংসদেরা আসলেন। বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে রেখে মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সমর্থন দিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের চার প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীসহ অল্প কয়েকজন নেতা আসেন নি। মোশতাক একটু আশাহত হলেন। তিনি মনে মনে তাজউদ্দীনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে মন্ত্রীসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এই ক্ষোভ থেকে তাজউদ্দীনের আসার কথা। সে আসে নি। খন্দকার মোশতাকের প্রতিশোধের আনন্দটা পূর্ণাঙ্গ হলো না। মুজিব মারা গেছেন। সব প্রতিশোধের বাইরে চলে গেছেন তিনি। যদি সম্ভব হতো তাহলে হত্যা না করে সারা জীবন নিজের অনুচর হিসেবে রেখে সারাজীবন তাকে যে কষ্ট দিয়েছেন- তা মুজিবকে ফিরিয়ে দিতেন। তা যখন সম্ভব না, মুজিবের হয়ে তাজউদ্দীনকে সেই কষ্ট ভোগ করতে হবে- এটা মনস্থির করেছেন। বড় একটা পদ দিয়ে তাজউদ্দীনকে অনুচর হিসেবে তার পাশে পাশে রাখবেন। আর সারাজীবন যে কষ্ট নিজে ভোগ করেছেন তা তাকে ফিরিয়ে দেবেন। এই লোকটা মুজিবের হয়ে তাকে সারাজীবন হারিয়ে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান রক্ষর একটা বন্দোবস্ত পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন। প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে গিয়ে একটা আপোশ ফর্মূলা তিনি পেশ করবেন। শেষ মুহ‚র্তে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাজউদ্দীন তাকে সেখানে যেতে দেননি। এবার তাকে নিজের পায়ের তলায় রেখে তার প্রতিশোধ নেবেন, মোশতাকের মুখ আবার শক্ত হয়ে ওঠে। তাজউদ্দীন আসে নি। ঠিক আছে, তিনি ভাবলেন- কারাগারে আটকে রেখে মনের তেজ কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। এতদিন অপেক্ষা করতে পেরেছেন। এতটুকু অপেক্ষা তিনি করতে পারবেন। তাদেরকে কারাবন্দী করা হলো। মানুষের অবস্থান চিরকালীন নয়। মোশতাক ভাবলেন। বন্দীজীবন যে কাউকেই পাল্টে দিতে পারে।
শুধু একাত্তর সালের একজন বীর যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী এই সরকারকে অবৈধ ঘোষণা কওে হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। এরপরের দীর্ঘ পনেরো বছরের বেশি সময় যতদিন বাংলাদেশে সেনাশাসন চলবে ততদিন তিনি এই যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।
খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েই বাংলাদেশবিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালেন। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রচলন করলেন। ‘বাংলাদেশ বেতার’ নাম পাল্টে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হলো। পাকিস্তানও পরের দিনই মোশতাকের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিল। পাকিস্তানের মিত্র দেশগুলোও দ্রুত বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলো। সামরিক বাহিনীতে দ্রুত গুরত্বপূর্ণ রদবদল করলেন। সেনাপ্রধানকে অব্যাহতি দিয়ে উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে অবস্থানকারী এরশাদকে সেনাউপপ্রধান বানানো হলো। মেজর নিজে সেনাবাহিনীর এই রদবদলগুলো দেখভাল করলেন। তিনি নিজে নিজেকে তার এই কাজের জন্য ছোট্ট একটা উপহার দিলেন। সেনাবাহিনীর কোন কর্মকর্তার সুপারিশ ছাড়াই কর্নেল তকমা নিজের আগে ঝুলিয়ে দিলেন।
সেনাবাহিনী তখন শান্ত। খুব শান্ত। ঝড়ের আগে যেমন হয়। সিনিয়র অফিসারদের অনেকে ভেতরে ভেতরে রেখে যাচ্ছেন। বঙ্গভবনে ছায়া রাষ্ট্রপতিকে সামনে রেখে কর্নেল আর তার সহযোগী মেজর কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন এটা অনেক সিনিয়র অফিসার মেনে নিতে পারছেন না।
নভেম্বর মাসের শুরুতে সেনাবাহিনীতে আরেকটি অভ্যূত্থান হলো।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্ব দিলেন। খন্দকার মোশতাক অভ্যূত্থানের খবরটা পেয়ে গেলেন একটু আগেই। তিনি মনে মনে এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তার বুক চিরে একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল। তাহলে অবশেষে সময়টা এলো...
এরকম একটা কিছু যে হবে তা তার প্রতিটা মুহূর্ত মনে হচ্ছিল। একটা ভয় সর্বক্ষণ বুকে চেপে বসে আছে। বাতাসে ভ্যাপসা কটূ একটা গন্ধ। হাসপাতালের মর্গের মত। প্রত্যেককে মনে হচ্ছিল ষড়যন্ত্রের সঙ্গী। গোপনতার কফিনে বন্দী। তিনি এর থেকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু কোন পথই তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। তার কাছে মনে হলো এই খেলার মন্ত্রী সেনাপতি সবার মুখোমুখি হলে হয়তো এর থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে চা চক্রে আমন্ত্রণ জানালেন। কর্নেল এবং তার সঙ্গীদের কেউ থাকতে পারবে না, এই শর্তে তারা আসতে রাজী হয়েছিল। কর্নেলকে তিনি এই শর্তের কথা কীভাবে বলবেন? কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। কর্নেল নিজে থেকেই বুঝে নিয়েছিলেন সবকিছু। রাষ্ট্রপতিকে তিনি বললেন, আপনি ওদের আসতে বলুন। ওরা এসেছিল। এরকম নিঃসঙ্গ চা চক্র পৃথিবীতে আর কখনও হয় না। সবাই বসে আছেন। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি অবস্থাটা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কাওকেই তিনি একফোটাও দেখতে পেলেন না। গাম্ভীর্যের মুখোশে সবার মুখ ঢেকে আছে। তার কাছে মনে হলো, ঘরের বাতাস জমে বরফ হয়ে গেছে। সেই জমাট বরফের মধ্যে তারা সবাই মমি হয়ে বসে আছেন। কোন শব্দ নেই। কথা নেই। যেন সবাই ইস্রাফিল। কথা বলে উঠলেই প্রলয়ের শিঙায় ফুঁ দেয়া হয়ে যাবে। জানালায় একটা ছায়া দেখে তিনি চমকে উঠলেন। মৃত্যু! কর্নেলের মুখ তিনি দেখতে পেলেন। তার চোখে চোখ পড়তেই সরে গেলেন তিনি। সেদিনই বুঝেছিলেন তার আর কোন কিছু করার নেই। এমনকি কর্নেলেরও।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। নিজের হাতের দিকে তাকালেন। হাত দুটো তিনি এবার স্পষ্ট দেখতে পেলেন। এতদিন নিজের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেকে দেখতে পান নি। মনে হয়েছে এটা অন্য কারও ছায়া। ছায়ার খেলা তাহলে শেষ হলো। তখনই তাজউদ্দীনের মুখটা তার মনে পড়লো। তিনি ক্ষমতাচ্যূত হয়েছেন জেনে, তাজউদ্দীনের মনের আনন্দটা কল্পনা করে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। তার মনে হলো, এখনও একটা কাজ বাকী আছে তার। যে খেলায় তিনি জড়িয়েছেন তা শেষ করে যেতে হবে।
তিনি হিসহিস করে ডাকলেন, “কর্নেল।”

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একদল সশস্ত্র সেনা এসে ভেতরে ঢুকতে চাইলে কারারক্ষীরা বাধা দিল। “আমরা প্রেসিডেন্টের হুকুম নিয়ে এসেছি।” তারা জানালো। জেলার অধিকর্তা বঙ্গভবনে ফোন করলেন। খন্দকার মোশতাক ফোনের অপেক্ষয় বসে ছিলেন। “ওদের যেতে দাও। ওরা আমার নির্দেশেই গেছে।” তিনি ফোনটা রাখা মাত্র একদল সৈন্য বঙ্গভবনে এসে ঢুকলো।
জেলখানার ভেতরে বন্দী প্রবাসী সরকারের চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং মনসুর আলীকে হত্যা করা হলো। প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করার পর বঙ্গভবন ছেড়ে যেতে যেতে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে খন্দকার মোশতাক চোখ বুঝলেন। এই জীবনে তার আর কিছুই করার নেই। তারপরও তার ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠরো। প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেছে। তিনি একটা প্রজাপতি দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দিগন্ত বিস্তৃত বিরান প্রান্তর তার চোখে ভেসে উঠলো। প্রচণ্ড রোদে ঝলসে যাওয়া কিছু কাঁটা গুল্ম ছাড়া কোথাও কিছু নেই।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

মাঝে মাঝে মনে হয় খন্দকার মুশতাককে কবর থেকে তুলে পিটাই।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

১৬ই অগাস্ট, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সরকারঃ

রাষ্ট্রপতিঃ খন্দকার মোশতাক আহমেদ
উপরাষ্ট্রপতিঃ মোহাম্মদউল্লাহ্‌

অর্থ মন্ত্রীঃ ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীঃ মনোরঞ্জন ধর
কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রীঃ আবদুল মোমিন
গণপূর্ত, নগর উন্নয়ন ও গৃহায়ণ মন্ত্রীঃ সোহরাব হোসেন
ত্রাণ, দুর্যোগ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীঃ ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল
পরিকল্পনা মন্ত্রীঃ অধ্যাপক ইউসুফ আলী
পররাষ্ট্র মন্ত্রীঃ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
বন্দ্র, জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন মন্ত্রীঃ আসাদুজ্জামান খান
ভূমি, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রীঃ শাহ্‌ মোয়াজ্জেম হোসেন
শিক্ষা মন্ত্রীঃ ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী
স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ণ মন্ত্রীঃ ফণীভূষণ মজুমদার
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীঃ আবদুল মান্নান

যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীঃ সৈয়দ আলতাফ হোসেন
ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীঃ কে এম ওবায়দুর রহমান
তথ্য, বেতার, শ্রম, সমাজকল্যান ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীঃ তাহের উদ্দীন ঠাকুর
পানি উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ ও শিল্প প্রতিমন্ত্রীঃ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী
বাণিজ্য, তৈল ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীঃ মোমিনউদ্দিন আহমদ
বিজ্ঞান, কারিগরী গবেষণা ও আণবিক শক্তি প্রতিমন্ত্রীঃ দেওয়ান ফরিদ গাজী
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীঃ রিয়াজ উদ্দীন আহমদ ভোলা মিয়া
রেল যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর

প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাঃ জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী

বিশেষ দূতঃ মহিউদ্দিন আহমদ

স্পীকারঃ আবদুল মালেক উকিল
শপথ বাক্য পাঠ করান মন্ত্রী পরিষদ সচিবঃ হোসেন তওফিক ইমাম

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই তালিকার মধ্যে ওসমানীর ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে আমার। জিয়ার সামরিক আমলের এক নির্বাচনে ওসমানীকে বাকশাল বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। ওসমানীর রাজনীতির হাওয়া কখনোই বুঝিনি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ওসমানী গণতন্ত্র রক্ষার্থে বাকশালে যোগ না দিয়ে সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করেন। অতঃপর বাংলাদেশের প্রথম সামরিক সরকারের উপদেষ্টা হন। তারও পরে আওয়ামী লীগের টিকিটে জিয়ার বিপরীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন। এই পেঁচকি মিলবার নয়।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বাংলার আকাশে খন্দ. মুশতাকের মতো মধুলোভী নষ্ট রাজনীতির কৃষ্ণ নক্ষত্রেরা শত শত বছর ধরে টিকে আছে তেলাপোকার মতো। বর্তমান সময়ের মুশতাকরাও হয়তো বহাল তবিয়তে সভাসদ আলোকিত করে অন্ধকার সময়ের অপেক্ষায় আছে। আমরা একদিন তাদেরকেও দেখতে পাবো রাজনীতি বর্গীর আগমনকালে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আয়নামতি এর ছবি

গতকালই পড়েছি এটা। হাড়ে হারামজাদা লোক এই মোশতাক।
মেজর থেকে কর্ণেলে উন্নীত হওয়া লোকটার নাম(ফারুক) উল্লেখ না করাটা লেখাটায় অন্যরকম একটা মাত্রা দিয়েছে।

উমর ফারুক এর ছবি

কোন ফারুক চিনলাম না।
একটু ক্লীয়ার করবেন?

ঝরাপাতা এর ছবি

একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আমাদের সংকটময় মুহুর্তে কখনো মীরজাফরদের অভাব হয়নি। এদেশ পালে পালে সেই আদিকাল থেকেই তাদের জন্ম দিয়ে আসছে।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।