একজনের শৈশবকে বোঝা গেলে, মানুষটির মনের ভেতর বাহির ধরা যায়। কেননা বলা হয়ে থাকে, মানুষ মৃত্যু পর্যন্ত শৈশবকে বহন করে চলে। তাই নভেরাকে আমরা বুঝতে গেলে, তার শৈশবের ছবি সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। নভেরা আহমেদকে নিয়ে আলোচনার এটি একটি সীমাবদ্ধতা, আমরা তার কাছ থেকে কোন কথা শুনিনি। অন্যদের কাছ থেকে তার সম্পর্কে যতটুকু পাওয়া যায় তা খুবই খন্ডিত এবং সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত ধারণা প্রসূত। সমস্ত কিছুর মতো, নভেরা আহমেদের জন্ম নিয়েও মতান্তর আছে। একটি ভাষ্য অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৩৫ সালে, পিতৃ-আলয়ে, চট্টগ্রামে। এবং অন্য ভাষ্য মতে তার জন্ম চট্টগ্রামে নয়, কলকাতায়, ১৯৩৯ সালে। বিভ্রান্তি আছে তার সংসার জীবন নিয়েও।
সময়টা যেটাই হোক না কেন, গোটা পৃথিবী জুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মেঘ জমে উঠছে। ১৮৫৭ সালে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, সেটা তীব্র হয়েছে। কিন্তু সে সময় থেকে ইংরেজরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে দূর্বল করার জন্য বহুত্ববাদী ভারতের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে বিভেদের যে বীজ তৈরি করেছিল, তা মানুষের মনে ডালপালা মেলে দিয়েছে। হিন্দু আর মুসলমান এই দুই সম্প্রদায় যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল তারাই একে অন্যের ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে নতুন আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জেগে উঠেছে। নিজেদের আলাদা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। পাকিস্তান। হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে অবিশ্বাস, ঘৃণা, আক্রোশের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, দাবানলের মতন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে, ১৯৪৫ সালের পর থেকে এই আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল।
১৯৪৬ সালের অগাস্ট মাসে পাকিস্তানের দাবিতে ‘Action Day' পালনকে কেন্দ্র করে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে এক ভয়াবহ দাঙ্গা বেঁধে গেল। পুরো শহর জুড়ে চললো হত্যা লুঠ। পথ গুলো ভরে উঠলো মানুষের লাশে। বসতিগুলো হয়ে উঠলো হিন্দু আর মুসলমানদের এক একটা সেনানিবাসের মতো, শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিরোধ আর প্রতিশোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো পুরো বাংলা জুড়ে। শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষ জুড়ে এই একই ছবি।
দু ধর্মের উত্তেজিত মানুষদের অবিরাম দাঙ্গা আর লড়াইয়ের মধ্যে ১৯৪৭ সালের মধ্য অগাস্টে, বৃটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে গেল। ১৪ অগাস্ট মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান এবং পরের দিন ১৫ তারিখে ভারত স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। কোটি মানুষেরও বেশি মানুষ পিতৃপুরুষের ভিটামাটি, সম্পদ ফেলে উদ্বাস্তু হয়ে নতুন দেশে পাড়ি জমালেন। ভারতের মুসলমানদের একটা বড় অংশ পাকিস্তানে চলে আসলেন, নিরাপত্তা এবং স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্নে। আর একই ভাবে পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিরাট এক অংশ দলে দলে চলে গেলেন ভারতে। এটি মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক অভিবাসন। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর চাইতে বড় অভিবাসনের দেখা মেলে।
এরকম সময়ের ম্যধ্য দিয়ে নভেরার শৈশব কেটেছে।
দাঙ্গা বিক্ষুব্ধ শহরের ভয় আর আতঙ্ক একটা আট-দশ বছরের বালিকার মনের ভেতর-বাহিরে যে অভিঘাত ফেলবে তা তার জীবন দর্শনে স্থায়ি প্রভাব ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। নভেরার ভাবনার জগৎে এর প্রভাব কেমন ছিল?
আমরা ভাবতে পারি একটা বালিকার কথা। কলকাতার বিখ্যাত লরেটো স্কুলে পড়ে। নৃত্যগুরু সাধনা বোসের কাছে নৃত্যকলা শিখছে একনিষ্ঠ শিষ্যর মত। বাড়িতেও একটা সাংস্কৃতিক আবহ। মা মাটি দিয়ে নানা রকম পুতুল বানাচ্ছেন। পরিবার এবং প্রতিবেশির মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ওরকম বিভেদ নেই। এরকম এক উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে তার অনেক হিন্দু বন্ধু-স্বজন, শিক্ষক-গুরুজন থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। যে সমাজ বাস্তবতা ও মূল্যবোধ শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে প্রিয় স্বজন, বন্ধু এবং গুরুজনদের প্রতি হিংসাকে উসকে দেয়, তাদের হত্যা বা পরিত্যাগ করতে প্ররোচিত করে- সেরকম একটা সমাজের প্রতি অবমূল্যায়ন এবং উপেক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম নেয়া স্বাভাবিক। আমরা নভেরার জীবনে সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে তোয়াক্কা না করে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাকে সবেচেয়ে গুরুত্ব দেয়ার যে স্বাধীনচেতা মনোভাব দেখি। তার এই মনোভাবের একটি উৎস এখান থেকে হতেও পারে। যদি তাই ঘটে, নভেরা আহমেদের কাজের মধ্যে এর ছায়া আমরা খুঁজে পাবো। আসলে কি এমনটাই ঘটেছে।?
হয়ত একটু হয়তো বেশি, তবু এতটুকু অনুমান করা যায় চারপাশে ঘটে চলা দাঙ্গা, অবিশ্বাস, ঘৃণা, হত্যা, মৃত্যু এবং এর মধ্য দিয়ে ঘটে চলা অবিরাম দেশান্তর নভেরার জীবনে কোন না কোন ছাপ ফেলেছিল। তাকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল, তার চেনা পরিবেশকে- যে পরিবেশে সে বেড়ে উঠছিল। তাকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল, স্বজন-প্রতিবেশী, এক সাথে বড় হয়ে ওঠা বন্ধুত্ব, গুরু ও গুরুতূল্য শিক্ষক। নিজের স্মৃতি ফেলে তাকে চলে আসতে হয়েছিল অনেকখানি ভিন্ন একটা পরিবেশে। যদিও এই যাওয়া দেশান্তর নয়, বরং তারা ফিরে এসেছিলেন নিজেদের ভূমিতে। তার বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। দেশভাগের পর তিনি বদলী নিয়ে চলে আসলেন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায়। ১৯৫০ সালে অবসর নেয়ার পর সেখান থেকে চট্টগ্রামে, পৈতৃক শহরে... তখনদিনে শৈশব কৈশোর পার হয়ে নভেরা তারুণ্যে পা দিয়েছেন। এ সময় নভেরার যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তার ছিল স্বাধীন পাখির মত জীবন। ছেলেদের মতো একজটা মেয়ে একা একা ঘুরছে, শহরের সৃষ্টিশীল আড্ডাগুলোতে হাজির হচ্ছেন প্রজাপতির মত। সবার নজর কেড়ে নিয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে। তার চলন বলন, বৈষ্ণবীর রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, শাড়ি পড়ার ঢং-টায় সময়কে ছাপিয়ে আগামী ফ্যাশনের একটা উষ্ণতা। তাকে নিয়ে শহর জুড়ে গল্প গুজব জমে ওঠে। নানা কথা. মুখ থেকে মুখে ঘুরে বেড়ায় আড্ডায় মুখরোচক স্ক্যান্ডালের পানপাত্র হয়ে। সবকিছু পেছনে ফেলে নভেরা চলে গেলেন লন্ডনে- ভাস্কর্যকলায় পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে দেশে ফিরলেন। ৬০ সাল পর্যন্ত এই দেশে কাজ করলেন, তাপর সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেলেন লাহোরে। এটা ছিল তার অজ্ঞাতযাত্রার শুরু। সেখান থেকে বোম্বে বৈজয়ন্তিমালার কাছে আবার নাচ শিখতে, তারপর লন্ডন হয়ে প্যারিসের নতুন বলয়ে। যেন প্রবাস নয়, ভিন কোন গ্রহে। স্বদেশ-স্বজনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কেন? আমরা জানি না। কিছু কিছু কথা শোনা যায়, উড়ো কথার মতো- তার কোন প্রামাণ্যতা খুঁজো পাওয়া যায় না। কেন একজন শিল্পী এভাবে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে পারেন? আমরা কল্পনা করতে পারি, যতদিন না আগামীর কোন গবেষক এই রহস্যের উন্মোচন করেন। কিন্তু আমরাতো জানিই শিল্পীর মন এবং চিন্তা- তার কাজের ভেতর ইঙ্গিত রেখে যায়। নভেরার কাজের মধ্যে কি এমন কোন ইঙ্গিত, এমন কোন সূত্র লুকিয়ে আছে- যার মধ্যে এই নির্বাসনের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে?
শিল্পীর কাজ কী? এ নিয়ে বিস্তর কথা আছে। তার কোনটা তাত্ত্বিক, কোনটা অভিজ্ঞতা প্রসূত। অনুভূতির ভেতর থেকে উঠে আসা। তবে সকল আলোচনা একটা জায়গায় একমত হয়। শিল্প হচ্ছে শিল্পীর প্রকাশ। শিল্পীর জীবন দর্শন। এ কারণেই শিল্পীর জীবন আর কর্ম আলাদা নয়। নভেরা আহমেদের জীবন সম্পর্কে আমাদের তথ্য খুব কম আছে। এই সীমাবদ্ধতা আমাদের আরেকটি সুযোগ করে দিয়েছে। সেটি হলো, আমরা কাজের মধ্য দিয়ে তার জীবনকে আবিষ্কার করা। এ যেন সেই প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্য সন্ধানে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ইতিহাস তুলে আনা অভিযানের মতো...
মন্তব্য
- লরেটো একটা অল-গার্লস স্কুল। ১৮৪১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই স্কুলে সম্ভবত একজন পুরুষ অল্প কিছু দিন পড়েছিলেন - তিনি জ্যোতি বসু।
১৯৩৫ সালে জন্মালে ১৯৪৭ সালে কুমিল্লায় আসার সময় নভেরার বয়স ছিল ১২, আর ১৯৩৯-এ জন্মালে ৮। ৮ বা ১২ বছরের একটা শিশুর ক্ষেত্রে এমনকি ঐ আমলেও নারী-পুরুষ বা হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব, হিংসা ইত্যাদি কতটুকু ছায়া ফেলার কথা? নভেরার ইতিহাস যতটুকু আমরা জানতে পারি তাতে তার পরিবার কলকাতার মধ্য-চল্লিশের দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত নয়।
এটা কি 'স্টোরি' নাকি 'হি-স্টোরি'? ট্যাগ দেখে তো এটাকে 'হিস্ট্রি' বলে মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ঘটিত ইতিহাসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে লেখকের খুব বেশি স্বাধীনতা থাকে কি?
হ্যা,একটা শব্দ বাদ পড়েছিল- আর একটা কমা। তাতে ঐ বিভ্রাট।। ধন্যবাদ ধরিয়ে দেয়ার জন্য।
১২ বছর খুব কম নয়,এমনকি ৮-ও ওরকম এক পরিবেশের মনের ছাপ ফেলার জন্য। এটা ঠিক ঐ বয়সে কোন স্পষ্ট বা পরিষ্কার অবস্থান তৈরি হয় না। তৈরি হয় না,কিন্তু ছাপ ফেলে,গভীরভাবেই ছাপ ফেলে- যা পরের চিন্তাভাবনার গতি প্রকৃতি তৈরি করে।
আর নভেরার পরিবার ৪৭ এর দেশভাগের ঘটণায় ফিরে এসেছিল নিজেদেরই ভিটেয়- অত্এব তাদের ক্ষতির কথা আলোচনার বাইরে। কিন্তু একজন বালিকা বা কিশোরীর জন্য সবচেয়ে দামী হচ্ছে তার বন্ধুরা, প্রতিবেশিরা, যে পরিবেশে সে বড় হয় সেটা।
সেই নিরিখে দেশভাগ নয়, তার চারপাশের দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ থমথমে আবহাওয়া, বালিকাবেলার সাজানো পৃথিবী থেকে চলে আসলে
একজন মনের মধ্যে কী প্রভাব ফেলতে পারে তারই একটা ছবি দেখার হচ্ছে মাত্র।
আর তার কাজের বিষয়, উপস্থাপনা আর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে এই ভাবনাটার সম্ভাব্যতা (সম্ভাব্যতা শব্দটার ওপর জোর দিচ্ছি)দেখাই লেখাটার উদ্দেশ্য।
সবকিছুই ইতিহাসের অংশ, তারপরও এটি ইতিহাস নয়। কী ওয়ার্ডে ইতিহাস শব্দটা নেই এজন্য। আর ইতিহাসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখকের খুব স্বাধীনতা থাকে না, এটা ঠিক- কিন্তু ইতিহাসের প্রভাব একজন মানুষের মনে কীভাবে পড়ে সেটা খুঁজে দেখার ক্ষেত্রে একজন লেখক ইতিহাসের বাইরে গিয়ে মনোবিজ্ঞান বা সমাজ বিজ্ঞানের সূত্রগুলো ব্যবহার করতে পারেন, এবং যৌক্তিক কল্পনা (সীমার চেয়ে এক পা বেশি, দুই পা- সাহসী হয়ে যাবে)দিতে পারেন বলেই আমার মনে হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে।।। আমার নিজের ভাবনাগুলো আরও স্পষ্ট করে দেখার সূযোগ দেয়ার জন্য।
সিরিজ লেখা গুলোর পরের কিস্তিটা প্রায়ই আর পাওয়া যায়না। অনেকেরে ক্ষেত্রেই দেখেছি একটা বা দু’টো কিস্তির পরই লেখক সেটা পরিত্যাগ করে অন্য লেখা দিয়ে চলেছেন। শিল্পী নভেরাকে নিয়ে জানতে আগ্রহী, ভীষনভাবেই আগ্রহী। লেখাটা চালিয়ে যান, অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে। না জানার আড়াল থেকেও যদি কিছু ছায়াও বেরিয়ে আসে তাও কায়ার চেয়ে কম হবেনা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
রেজাউল করিম সুমনের লেখাগুলো পড়েছি বলেই মনে হয়েছে লেখায় সার বস্তু কিছু নেই।
নতুন মন্তব্য করুন