তোমার

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: রবি, ০৯/০৭/২০১৭ - ৪:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘আমি তোমার কে?’ চোখে চোখ রেখে ও জিজ্ঞেস করলো। আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। বরফের মত শান্ত গলায় বললো ও ‘চোখ সরাবা না। চোখে চোখ রেখে বল।’ ওর গলার স্বর এত শান্ত, ছুরির ধারের মতো।
আমি আমাকেই খূঁজে পাচ্ছি না। কতবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছি, তুমিই সব। কতবার ভেবেছি, তুমি ছাড়া আর আমার কিছুই নেই। কিন্তু চোখের দিকে চোখ রেখে এসব কোন কথাই মনে পড়লো না। মনে হলো, এসব কথার কোন অর্থ নেই। আমি কোন দিশা খুঁজে পাই না। যেন অথৈ সমুদ্র। এই অথৈ সমুদ্রে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।

‘তুমি কে?’ চোখের মণি না কাঁপিয়ে ও এবার জিজ্ঞাসা করলো। গোটা জীবন চোখের সামনে উঠে আসলো। কত স্মৃতি। কিন্তু এর মধ্যে আমি কোথায়? আমি পাথর হয়ে থাকি। চোখ নামিয়ে ফেলি। আমার কিছুই বলার নেই।
‘তুমি নিজেই জানো না তুমি কে, তাহলে কী করে বুঝবে আমি কে? আমাকেই যদি না জানো- তাহলে কীভাবে অনুভব করবে- আমি তোমার?’
আমি কোন কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। শুধু ভেতর থেকে কান্নারা এসে বলে যাচ্ছিলো, ‘আমি তোমার। তুমি আমার।’ কিন্তু কান্নাটা ছিল হৃদয়ের। মনের। বাইরে মূর্তির মতো শুকনো খটখটে চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। কোন কথা বলতে পারি না।
‘আমি চললাম। খাঁচায় বন্দি পাখিটার মতো- আমি তোমার হয়ে থাকবো কেন, উত্তর যদি খুঁজে পাও তাহলে আমার কাছে এসো।’
আমার কোন কিছু বলার ছিল না। আমি বাসায় ফিরে খাঁচা থেকে পাখিটাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘তোকে মিথ্যে আমার ভেবেছি।’ পাখিটা কোন কথা না বলে, একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে পাখা ঝাঁপটিয়ে উড়ে চলে গেল।

এরপর অনেক বছর কেটে গেল। ছেলেটা এখন আর ছেলে নয়। সে বড় হয়ে বুড়ো হয়ে গেল। সে আর কোনদিনই কাউকে তার আর তাকেও কারো ভাবতে পারেনি। সে একদিন ক্লান্ত হয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে ছিল। হঠাৎ কোথাও একটা কোকিল গান গেয়ে উঠলো। সে বাড়ি ফিরে গেল। পরদিন সে আবার পার্কে গেল। সেই বেঞ্চটায় বসে রইলো। কোকিলটা আবার গাইতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা নামা পরযন্ত সে কোকিলটার গান শুনলো। তারপর বাড়ি ফিরে গেল। এমনি করে অনেকদিন কেটে গেল। সে একদিন সারাক্ষন বসে রইলো কিন্তু সেদিন পাখিটা গাইলো না। সে বুঝতে পারলো, বসন্ত শেষ হয়ে গেছে। পাখিটা নিশ্চয় উড়ে চলে গেছে। তার একটু মন খারাপ হলো। পার্কটা ছেড়ে বের হয়ে আসতে গিয়ে, আর একবার পার্কের দিকে তাকালো। কিন্তু কোন গান ভেসে এলো না।
এরপর আরো অনেকদিন কেটে গেল। বছর ঘুরে আবার বসন্ত এলো। কৃষ্ণচুড়ার লাল ফুলগুলো বুড়োটাকে মনে করিয়ে দিল, বসন্ত এসেছে। বুড়োটা আরও বুড়ো হয়েছে। এখন সে ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না। লাঠি হাতে টুকটুক করে সেই বেঞ্চিটায় গিয়ে বসে রইলো। কিন্তু কোকিলটার দেখা নেই। অন্য পাখিগুলো হল্লা করছে। সে অনেকক্ষন কান পেতে বসে থাকে। কিন্তু সে যা শুনতে চাইছিল তা সে শুনতে পারলো না। সে ক্লান্ত হয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। ঘুমের মধ্যেই সে শুনতে পেল কোকিল গাইছে।
‘কে?’
‘আমি। তোমার কোকিল।’
বুড়োটা হাসলো।
‘আমার কোকিল।’ বিড়বিড় করে বলে আবার ঘুমিয়ে গেল।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে- এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।

[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পোস্টমাস্টার, ১২৯৮] পৃথিবীতে কেহই কাহারো নহে, নিজেই নিজের কিনা তাহাও ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ রহিয়াছে।

কর্ণজয় এর ছবি

সবই ভাবনা। দেখার একেকটি দৃষ্টিকোন। এই দৃষ্টিকোনগুলো পাল্টে গেলে রঙ পাল্টায়। এক জীবনেই সহস্র অনুভূতি জন্ম নেয়।
কখনও মনে হয়, আমি তার
কখনও মনে হয়- সে আমার
কখনওবা মনে হ- কে বা কার?

দেবদ্যুতি এর ছবি

বুড়োটার জন্য ভালবাসা।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

কর্ণজয় এর ছবি

জানিয়ে দিলাম- তাঁর চোখ তখন কাঁদছিল। হয়তো কারও কথা মনে করে- হয়তো আর কেউ তাঁকে একথা বলেনি বলে। অথবা আপনার ভালবাসাটাই তাঁকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিল-

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আহারে, বেচারারা!

কর্ণজয় এর ছবি

তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ানোই ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে তাঁরও এ কথাই মনে হতো যে -

বটবৃক্ষ  এর ছবি

ভালো ছিল ।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ
এ্যানি মাসুদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।