সেই কবে তুমি
দুঃখের সূতোয় বোনা
সুখের চাঁদরটা হাতে দিয়ে বলেছিলে-
‘গায়ে জড়িয়ে নাও, যে শীত পড়েছে
ঠাণ্ডা লেগে যাবে।’
সে চাঁদর শরীরে মেখে আমি হাঁটতে হাঁটতে
পেরিয়ে এলাম অনেকটা পথ।
উঁচু নিচু আাঁকা বাকা পথগুলো
আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলো
আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।
আমি থামতে পারতাম, কিন্তু থামি নি।
পথের মধ্যে অনেকেই ছিল, যাদের জিজ্ঞাসা করা যেত
কিন্তু করি নি।
আমি শুধু এগিয়েই গেছি , পায়ের পর পা ফেলে এগিয়েই গেছি শুধু
কেননা এগিয়ে যাওয়া যাওয়া ছাড়া
আর কী করার থাকতে পারে
আমি তা জানতাম না।
যেতে যেতে যেতে যেতে
অবশেষে এসে পৌঁছালাম এক রেল ষ্টেশনে।
ছোট্ট একটা নিঃসঙ্গ রেল ষ্টেশন,
কোথাও কাওকে দেখা যাচ্ছে না।
পুরো ষ্টেশনে আমি একা। সন্ধ্যা।
শেষ বিকেলের রোদ ছায়া ফেলেছে অন্ধকারে।
মনে হচ্ছে, পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে শেষ ট্রেন চলে গেছে সেই কবে
আর কখনই হুইশেল বাজিয়ে কোন ট্রেন এই ষ্টেশনে এসে দাঁড়াবে না।
মনে হলো এই পৃথিবীতে
আমিই শেষ যাত্রী, যার ট্রেন আর কখনই তাকে নিতে আসবে না।
কিন্তু আমরা যাই ভাবি না কেন তা সম্পূর্ণ সত্য নয়।
আমরা যা আশা করি তার কোনটাই অলীক নয়।
আমরা যা অলীক ভাবি তাও অবাস্তব নয়।
হঠাৎ চমকে দিয়ে একজন হাজির হলেন,
পোশাক দেখে বুঝলাম, ষ্টেশন মাস্টার।
কোথায় যাবেন? তার প্রশ্নের উত্তরে আমি কথা খুঁজে পেলাম না খানিকক্ষণ।
সত্যি তো কোথায় যাবো?
কোথাও যাবো বলে বেরিয়েছি, কিন্তু কোথায় যে যাবো সেটাতো ভাবি নি।
বলুন কোথায় যাবেন,
ঠিক জানি না।
ষ্টেশন মাষ্টার বললেন, ট্রেন আছে। অজানপুর এক্সপ্রেস। রাত ৯.৪৫ এসে সোজা অজানপুরে চলে যাবে। তারপর ওর ছুটি। নিন টিকেটটা আর টিনের বাক্সে জীবনের বারো আনা ফেলুন।
টাকা পয়সার হিসেব চুকিয়ে অজানপুরের টিকিট হাতে ধরিয়ে মাষ্টার বললেন
ওদিকে ওয়েটিং রূম… অপেক্ষা করুন।
ওয়েটিং রুমের কথায় মনটা চাঙা হয়ে উঠলো। বেশ খানিকটা সময় আছে। একটু বিশ্রাম মন্দ হবে না।
এই ভেবে ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখি পাঁচ ভদ্রলোক বসে আছেন।
ভরসা পেলাম মনে মনে। একা একা কোথাও বের হলেও সঙ্গী লাগে মানুষের। আমি হেসে বেঞ্চির খালি জায়গাটায় বসে পড়লাম।
আমরা তো সবাই একই জায়গায় চলেছি।
হ্যাঁ, ট্রেনের গন্তব্য একটাই। ভদ্রলোকও হাসলেন।
এতজন অজানপুরের যাত্রী, ভাবতেও পারি নি।
শুনে একজন চোখ খবরের কাগজ থেকে চোখ তুললেন।
তাহলে আর আপনার অজানপুর যাওয়া হচ্ছে না।
কেন কেন? আজকে একটাই ট্রেন আছে। আর সেটা যাচ্ছে নিশ্চিন্তপুর। রাত ৯টা ৪৫ মিনিট।
তা কি করে হয়!! আর্তনাদ করে উঠলেন একজন। এই ট্রেনেরতো যাওয়ার কথা সংশয় গাঁও। এর পর না কি ওর ছুটি। না কি আমি ভুল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। তার ভেতরে একটা বিভ্রান্তি ভর করে। যেন কোন কিছু মেলাতে পারছেন না।
ট্রেনতো যাচ্ছে আনন্দ নগর। পাশের ভদ্রলোক সবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা পুলকে ভেসে গেলেন।
ট্রেনতো নিশ্চিন্তিপুরের। নিশ্চিন্তিপুরের ট্রেন কী করে সংশয় গাঁও যাবে। অথবা অজানপুর। ট্রেন নিশ্চিন্তপুরেই যাচ্ছে। ট্রেনের নাম এই দেখুন না টিকেট, নিশ্চিন্তিপুর। সময়, রাত ৯ টা ৪৫।
কিন্তু ট্রেনতো দুখীগাঁও-য়ের।
সংশয় তবে কি এটা আসলে সংশয় গাও যাবে, নিশ্চিন্তিপুরে যাবে। না কি অজানপুর। না কি আনন্দ নগর.. অথবা দুখীগাঁও?
ভদ্রলোক নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকেন।
এতক্ষন এক ভদ্রলোক বেশ হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। সবার কথার হৈ চৈ এ ঘুমটা ভেঙে যাওয়া বিরক্ত কথায় বলে উঠলেন, আরে কী হলো সবাই বাচ্চাদের মতো কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন করছেন কেন? এই ট্রেন তো কোথাও যায় না… বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
যাবে না মানে কি? না গেলে টিকেট দিলো কেন? সবাই নড়ে চড়ে বসে।
আসলে কি আমরা টিকেট কেটেছি? সংশয় গাঁও যাত্রীর কথা শুনে বুক পকেটে হাত দেই। এই তো টিকিট। পরিষ্কার লেখা আছে। অজানপুর। সাথে সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। যেখানেই যাক, সেটা আমার কাছে অজানপুরই। তা সে নিশ্চিন্তিপুরই হোক আর সংশয় গাঁওই হোক। আআনন্দ নগর হোক আর হোক দুখীগাঁও।মার কাছে সবই অজানা অচেনা। যেখানে যাবো সেটাই গন্তব্য।
প্রত্যেকেই টিকিট বের করে দেখি। প্রত্যেকের টিকিটের গায়ে যার যার গন্তব্যের নাম লেখা।
আসবে না তাতো বলি নি। ট্রেন আসবে।
তাহলে সেই ট্রেন এসে বসে থাকবে?
বসে থাকবে কেন। ট্রেন আসবে, ট্রেন ছাড়বেও।
তাহলে যে বলছেন, ট্রেন কোথাও যাবে না..
আমরা লোকটার কথায় একটু বিভ্রান্ত হয়ে উঠি।
যাবে, গিয়ে কোথায় যাবে, এই জায়গাতেই আসবে- প্রত্যেকে যেখানে ছিলে
কেউ কোথাও যায় না। বলে, ভদ্রলোক আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
কেউ আর কথা বললো না। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
নিজের নিজের ট্রেনের।
ট্রেনটা ঠিক সময়েই আসলো। আমরা উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করলাম, সেই ভদ্রলোকের ঘুম এখনও ভাঙে নি।
উঠে পড়ুন। ট্রেন এসে গেছে।
তাতে কি হয়েছে। কেউই কোথাও যায় না।
তাই। ভদ্রলোক উঠে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে আমাদের সঙ্গে প্লাটফর্মে আসলেন। ট্রেনটা ততক্ষনে হুইশেল দিচ্ছে। ছোট্ট ষ্টেশন, বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না।
আমরা সবাই ট্রেনে উঠে পড়েছি। ট্রেন চলতে শুরু করেছি।
দেখি সেই ঘুম কাতুরে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা চিৎকার করে ডাকি, উঠে পড়ুন। ট্রেন এসে গেছে।
ভদ্রলোকের গা নেই। উদাস গলায় বললেন, ট্রেন তো আসবেই। কিন্তু যায় যে কোথাও তা কি কেউ জানে? জানে না। জানলে ট্রেন কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা থাকতো। ট্রেন আসলে কোথাও যায় না।
ভদ্রলোকের কথা শুনে একটু কেমন যেন লাগে। মনে হয় কথাটার মধ্যে কী জানি একটা আছে। ঠিক কী, তা ধরা যাচ্ছে না।
তাকিয়ে দেখি, সবাই ট্রেনের দিকে চলে গেছে। দ্রুত বের হই।
ট্রেনটা চলছে। সবাই মনে করছি, আমরা যে যে ষ্টেশনে যাবো, ট্রেনটা সেখানেই যাচ্ছে। এমন সময় দেখি, ট্রেনে না ওঠা যাত্রীটা তাকিয়ে আছেন।
ট্রেনে উঠলেন শেষে? যাচ্ছেন তাহলে কোথাও?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। না কোথাও যাচ্ছি না। আসলে কেউই কোথাও যায় না। আমরা ভাবি কোথাও যাই। একেকটা নাম দেই। আসলে আমরা কোথায় যাই জানেন?
কোথায়?
যেখানে ছিলাম।
ট্রেনটা তখন ছুটে চলেছে। আলো আর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে… ছুটে ছুটে..
মন্তব্য
আলো-অন্ধকারে, আলো অন্ধকারে, আলো অন্ধকারে ঘুরে বেড়াই সবাই। কেউ জানার মাঝে, কেউ অজানায়, কেউ বিশ্বাসে, কেউ সংশয়ে, কেউ দুঃখে, কেউ সুখে, কেউ আনন্দে, কেউ বেদনায়...
ভারী ভালো লাগল লেখাটা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ-
বাহ্ !!
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
চমৎকার।
দারুণ!
কবিতার মত ছোটো ছোটো লাইনে শুরু হওয়া গল্পটা এভাবে গভীর একটা ভাবনায় টেনে নেবে পাঠককে ভাবিনি। অন্য রকম সুন্দর।
**
শুনে একজন চোখ খবরের কাগজ থেকে চোখ তুললেন। দু'বার 'চোখ' হয়ে গেছে ভাইয়া।
এখানে একটু গোলমাল ঠেকছে যেন।
কৃতজ্ঞতা- ঠিক করে নিলাম-
ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন