শব্দ, জলের মত। প্রবাহমান। শব্দ যে অর্থ তৈরি করে তা প্রায় ঢেউয়ের মতো, আরেক ঢেউয়ের ভেতর হারিয়ে যায়। আরেক অর্থ নিয়ে হাজির হয়। আর প্রতিটা অর্থ একটা ছবি হয়ে মনের মধ্যে ধরা দেয়। এই ছবিটা প্রায়ই পৃথিবীতে থাকে না। মনের পৃথিবীতে এর জন্ম। মনের মধ্যে জেগে থেকে ছবিটা একজন মানুষকে সারাজীবন তাড়া করে। নিয়ন্ত্রন করে। এই ছবি কখনও তার কাছে স্বপ্নের মতো, (দেশ প্রেম, কাঙ্খিত প্রেম, আকর্ষণের বস্তু) যা সে পাওয়ার জন্য সে ছুটে বেড়ায় অথবা সেই রূপকথার রাক্ষসের মতো (শত্রু, দারিদ্রতা, ঘৃণার মুখ) , যার হাত থেকে সে পালিয়ে যেতে চায়।
ইমেজ কীভাবে আমাদের পথ ঠিক করে দেয়?
লরেঞ্জ সাহেব হাঁসের ডিম ফোঁটা সদ্যজাত ছানাদের একটা পরীক্ষা করেছিলেন।
ডিমগুলো ফুঁটে বাচ্চাগুলো বের হবে, ঐ মুহূর্তে মা হাঁসকে সরিয়ে সেখানে এক জোড়া ওয়েলিংটন বুট রেখে দিলেন। প্রথম চোখ খুলে হাঁসের ছানাগুলো বুটগুলোকে দেখলো, ভাবলো.. এই বুঝি তাদের মা। বুটগুলো পরে হাঁটা শুরু করলে বাচ্চা হাঁসগুলো বুটের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলো। আমাদের জীবনেও আমরা এই রকম ওয়েলিংটন বুটের দেখা পাবো, যার ইমেজের কাছে বন্দি হয়ে পেছন পেছন আমরা ছুটে চলেছি।
ইমেজ, এভাবে প্রভূ হয়ে ওঠে- আমরা তার বন্দি হয়ে উঠি। রাজনীতিতে এই ইমেজ তৈরির খেলা চলে, বিজ্ঞাপণের তৈরি ইমেজে আমরা আটকে যাই, আর ভালবাসার ক্ষেত্রে- সেই ইমেজেরই খেলা যা আমাদের ভৃত্য বানিয়ে তুলেছে।
ইমেজের প্রভূত্বের বিরুদ্ধে আমাদের কৌশল কী হবে, সেই প্রশ্নের সন্ধানে লাকা সক্রেটিসের জীবনের কাছে গেছেন।
সক্রেটিসকে বলা হলো, তিনি প্রাজ্ঞতার রাজা। কিন্তু সক্রেটিস নিজে এই ইমেজ ভেঙে দিয়ে বললেন, প্রাজ্ঞতার একটাই অর্থ.. আর সেটা হলো তিনি যে প্রাজ্ঞ নন- এটা তিনি জানেন।
এর অর্থ হচ্ছে, ইমেজ যে প্রাতিষ্ঠানিকতা তৈরি করে, যে প্রভূত্ব আরোপ করে তাকে অস্বীকার করে নিজেকে মুক্ত করা।
এই মুক্তির পথ কী?
সজ্ঞানতা। সক্রেটিস যাকে বলেছেন, know thyself।
যার অর্থ সকল প্রাতিষ্ঠানিকতাকে প্রশ্ন করা। আর প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় নিজের থেকে। নিজের ভেতরের সেই ইমেজ থেকে যা আমাদের চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়।
আমাদের কে চালায়? যা আমরা জানি বলে জানি। যা ইমেজ হয়ে আমাদের ভাবনা আর চলাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই জানাকে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের এই প্রভূকে আমাদের ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি।
যা জানি, আসলে তা কী?
কেমন করে জানি?
আমার জীবনে এই জানাটা কতটুকু কাজে আসে?
আমি যা জানি তা কেমন করে প্রকাশ করি?
এই প্রকাশ শব্দটি আসলে আমাদের সামাজিক ইমেজ। আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের ভাষা।
ডেকার্তে বলেছেন Thanks to Language: Man became man
ধন্যবাদ ভাষা। তোমার কারণেই, মানুষ মানুষ হতে পারলো।
লাকার ভাষায়, আমাদের ভাষাই আমরা।
আমরা আমাদের ভাষা দিয়ে আমরা যা বলতে চাই তা নয়, আমরা নিজেরাই প্রকাশিত হই। আরেকভাবে কথাটা বলা যায়, আমি তোমার কাছে যা, তা হলো আমার ভাষাকে তুমি যা বুঝলে। কিন্তু এই যে বোঝা, তার মধ্যেই রয়েছে বহু পথ। শুধু ধ্বনিময় শব্দ অথবা ইশারা যে বহু অর্থ তৈরি করে তা নয়, একটা ছবিও একেক জনের কাছে বিভিন্ন অর্থ তৈরি করে। একটা গাড়ি নিয়ে ছুটে চলা তরুণের ছবি দেখে একজন বেকার যুবক যে অর্থ করবে, একজন এ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার জন্য উন্মুখ ছেলেটি সেই অর্থ করবে না।
ভাষা বিজ্ঞান যে কারণে শব্দ বা ইমেজের এক সাথে দুটো অর্থ আছে বলে থাকে। তার একটি সার্বজনীন সুনির্দিষ্ট। আরেকটি পরিবর্তনশীল বহুরূপী। সার্বজনীন সুনির্দিষ্ট অর্থটা না থাকলে কোন ভাষাই ভাষা হয়ে ওঠে না। কিন্তু বহুরূপীয় অর্থটার মধ্যেই পৃথিবীর সমস্যা আর সম্ভাবনা। পৃথিবীর সমস্যা ভাষার সমস্যা, তোমার আমার সমস্যাও ভাষার সমস্যা। তেমনি যাবতীয় ভালবাসা যার কারণে আমরা একাত্ম বোধ করি, তার কারণও ভাষা। যার লক্ষ্য ইমেজ জন্ম দেয়া, যার পরিণতি ইমেজের মধ্যে পড়ে যাওয়া। যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত আমরা হারিয়ে ফেলি। আমরা অনেকগুলো ইমেজের তৈরি পুতুল হয়ে উঠি। তুমিই আমার কাছে কত রূপে, তারই ঠিক থাকে না। আমি যে তোমার কাছে কত রূপে তার সন্ধান কীভাবে পাবো?
প্রচীনকাল থেকে আমরা বলি, এর সমাধান সজ্ঞানতার মধ্যে।
এই যে সজ্ঞানতা তা থেকে আমরা কী পাই?
ফ্রয়েড বলেন, আমিত্ব (Ego)। সজ্ঞানতা (Consciousness) আমাদের আমির কাছে পৌঁছে দেয়। যেই আমি’র ভেতরে বাস করে ইচ্ছের দৈত্যরা- যাদের আমরা ভালভাবে চিনি না, কিন্তু আমরা ভাবি- তাদের আমরা চিনি। তারা আমাদের পৃথিবীকে ভুল ভাবে উপস্থিত করে। আমরা সুন্দর পোশাকেই আমাকে আমি মনে করি। পোশাকটা পছন্দ না হলে, আমাকে মনে হয় আমি নই। ফর্সা না হলে, নিজেকে ঠিক মানুষ মনে হয় না। মনে হয়, হীনতর কোন প্রাণী।
লাকা একে বলেছেন, misknowing।
এর থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি, যে ইমেজগুলো আমাদের চালাচ্ছে- তা নিয়ে চিন্তা করা।
চিন্তা মানেই প্রশ্ন। প্রশ্ন মানেই দেখা।
কখন আমরা প্রশ্ন করি না?
যখন সুন্দর লাগে। ভালো খারাপ এই নিয়ে আমাদের নানা প্রশ্ন। কিন্তু আকাশে পূর্ণিমার চাঁদকে ঘিরে ছুটে চলা মেঘ আমাদের চুপ করিয়ে দেয়। সূর্যাস্ত, আকাশে তার রঙ ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের মৌন করে তোলে। সমুদ্র আমাদের নির্বাক বানিয়ে দেয়। কারণ সুন্দর ওরা। আর আমরাতো সেই আদ্যিকাল থেকে জেনে আসছি,
ভাবলে মানুষকে সুন্দর দেখায়।
তাই আপাতত সব কথা থামিয়ে, ভাবনারত মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী সুন্দর ওরা।
যদিও ঠিকই কেউ ফিসফিস করে উঠেছে
এও এক ইমেজ। যার কাছে তুমি বন্দি..
আমি হাসি.. হয়তো বা। এটাও এক চিন্তা।.. সুন্দর...
মন্তব্য
জা জাক লাকা'র ইংরেজী বানান কী?
Jacques Lacan / Jean-Jacques Lacan
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ফরাসীতে অবশ্য ওরা উচ্চারণ করে 'জঁ জাক লাকঁ' বলে।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
নামটা "লাকঅঁ" লিখলে কি ধরতে বেশি সুবিধা হবে? নাহলে লোকে টাইপো ভাবতে পারে।
বড় অল্প হইল যে! আরও বিস্তারিত আসুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন