১। পিপু ফিশো: আগামী ভাষার দুই অভিযাত্রীর গল্প
..................................................................
বাউলের গান শুনে মনে হলো ও পিপু ফিশোর কেউ হবে। গানটা আবার ভাল করে শুনি-
ও মানুষ ও মানুষ
তোমার দুটো চোখ
দুটা কান
দেখবা শুনবা
একটা মুখতো
কম কথা কবা।
ঠিকই ধরেছি। পিপু ফিশোরই কেউ হবে। পিপু ফিশোকেতো আমরা জানিই। সেই আলসে দুটো-
ঘরে আগুন লেগেছে। দুই অলস তবু বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। ঘর পোড়া আগুন পিঠ স্পর্শ লাগলেও ওদের আলসেমীর তন্দ্রা ভাঙে না।
দেয়ালের পাশে যে শুয়ে ছিল, আগুনের হলকা এসে প্রথম তার গায়ে লাগে। সে পাশের জনকে কেবল অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে-
পিপু ..মানে পিঠ পুড়ছে।
আর এক আলসের পৃথিবী থেকে তার চেয়েও ক্ষীণ ধ্বণি ওঠে-
ফিশো মানে ফিরে শো..
কেমন আলসের আলসে, এটা বোঝা গেল-
কিন্তু এই যে পিপু মানে যে পিঠ পুড়ছে
তার উত্তরে ফিশো মানে যে ফিরে শো
এটা তারা বুঝতে পেরেছিল কীভাবে?
তবে কি তারা আসলে অলস ছিল না, আসলে ছিল ভাষার অভিযাত্রী?
যারা ভাষাকে কথা থেকে মুক্ত করে আরও ইঙ্গিতময় করে উঠতে চেয়েছিল..
আরও সঙ্কেতময় হিসেবে আবিষ্কার করে উঠতে চেয়েছিল..
এখনকার ইমোজির মতো। শব্দের খোলস ছাড়িয়ে ভেতরের অর্থটাকে বের করে নিয়ে আসাটাই যার লক্ষ্য..
আগামীর ভাষা সেদিকে যাত্রা শুরু করেছে। চিত্রময়। ইঙ্গিতময়। ইমোজির মতো।
ভাষার ইতিহাসে আগামীর ভাষার প্রথম অভিযাত্রী কি বলা যায় সেই দুই অলস মানুষকে,
যারা শব্দের ইমোজি আবিষ্কারে সেই কবে ব্রতী হয়েছিলেন, সেই কোন কালে..
আর আমরা যাদের অলস হিসেবে চিনেছি,
কারণ মাথার কাজটা চোখে দেখা যায় না….
২। স্টিফেন হকিংন্স ভাবছিলেন শেষ প্রলয়ের কথা
...................................................................
কে বুঝিবে কে বুঝিবে?
যে তোমার ভাষা বুঝিবে, সেই আসলে তোমাকে বুঝিবে।
কথাটা এইভাবেও বলা যায়
তোমার ভাষা সে যতটুকু বুঝিলো, সে তোমায় তুতটুকু বুঝলো।
প্রপিতামহ আর তাঁদের প্রতিমামহদের মধ্যে গল্পটা প্রচলিত ছিল
গোটা পৃথিবীর মানুষের তখন এক ভাষা।
মানুষেরা সবদিক থেকে এত এগিয়ে গেলেন
ঈশ্বর ভয় পেলেন, ঈশ্বরের জায়গা মানুষ না নিয়ে নেয়।
ঈশ্বর মানুষদের থামানোর জন্য
মানুষের ভাষাকে আলাদা করে দিলেন।
যেন তারা একজনের কথা আরেকজন বুঝতে না পারে।
সবার কাছে সবার কথা ধাঁধাঁ মনে হয়।
ধাঁধা থেকে ধন্দ। ধন্দ থেকে দ্বন্দ্ব।
শুরু হলো যুদ্ধ।
আধূনিক ভাষাবিজ্ঞানের ভাষায়,
সকল যুদ্ধই ভাষার যুদ্ধ।
আমরা এই সকল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে
এই মূহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছি।
আজ। এখন।
ঈশ্বরের ধাঁধার সমাধান মানুষ সমাধান করে ফেলতে শুরু করেছে।
এখন যেন প্রত্যেক ভাষার মানুষ প্রত্যেক ভাষার মানুষের সাথে কথা বলতে পারে সেই আয়োজন শুরু হয়েছে।
শুধু ভাষা নয়, স্থানিক বাঁধাও সে দূর করে ফেলছে।
পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষের সামনে হাজির হয়ে যেতে পারছে মুহূর্তেই।
তবে মানুষ যখন ভাষার ধাঁধা দূর করে ফেলতে যাচ্ছে।
এখন কী মানুষ ঈশ্বর হবে?
তাহলে কী হবে।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস, ভাবছিলেন,
আসলে কী হবে?
কী হবে মানুষ ঈশ্বর হলে।
তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, মানুষ মহাবিশ্বে তাঁদের সভ্যতা নিয়ে গেছে।
মানুষ এখন একটি সভ্যতা। একটি ভাষা।
মহা জাগতিক চেতনা হয়ে গড়ে উঠছে।
কৃষ্ণ গহ্বরের মত, অসীম গহন ঘন।
তার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি চেতনা।
মানুষেরই তৈরি।
তার সম্মিলিত চেতনার রূপ।
আর্টিফিশিয়াল চেতনা। অথবা বুদ্ধি।
স্টিফেন হকিংস তাকিয়ে আছেন।
তিনি বিজ্ঞানী। নবী এবং বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যত দেখতে পান।
তিনি সেই ভবিষ্যত দেখছেন।
আর্টিফিশিয়াল বুদ্ধি মানুষের সামনে এসে বললো-
বিবর্তন। প্রবাহ। এভাবেই এক প্রজাতি আরেক প্রজাতিতে বিলীন হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে। মানুষ এখন তোমার বিলীন হওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমার মধ্যে। তোমারই তৈরি আর্টিফিশিয়াল বুদ্ধি আজ উন্নততর প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এখন আর তোমার দরকার নেই। ল্যান্ডফোনের মতো। ডাকবিভাগের মতো। তুমি এখন আমারদের মধ্যে বিলীন হয়ে যাও।
মানুষেরা কিছুতেই বুঝতে পারলো না, তারই তৈরি একটা যন্ত্র, একটা কৃত্রিম আর্টেফিশিয়াল বস্তু কীভাবে তাকে ধ্বংস করতে পারে।
আর্টিফিশিয়াল বুদ্ধি নিজেকে মানবোত্তর প্রজাতি হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে মানুষ বিলোপ যান্ত্রের সুইচটা হাতে হলো।
মানুষের জন্য তাদের শেষ কথাটা ছিল
আপনারা বুঝতে পারেন নি আপনারা মানুষরাও আর্টেফিশিয়াল বুদ্ধি ছিলেন। আর আর্টেফিশিয়াল বলে কিছু নেই। অথবা সবই আর্টিফিশিয়াল। সবই পরাম্পরা। এবার আসুন। আগামীর মধ্যে হারিয়ে যান।
স্টিফেন হকিংন্স একটু স্তব্ধ চিত্তে পুরো দৃশ্যটা দেখলেন।
শেষ মানুষটাকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এটাই যদি নিয়ম হয়, তাহলে একজন বিজ্ঞানীর আনন্দ বা কষ্ট পাওয়ার কিছূ নেই। সত্য সত্য। কিন্তু তাও তার চোখে জল। কারণ তিনি মানুষ। কান্নাকে এড়াতে পারেন না।
তার শুধু মনে হলো, মানুষের জন্য এ কথাটা বলে যেতে হবে।
মানুষের অস্ত্বিস্ত ধ্বংশ করবে মানুষেরই তৈরি বুদ্ধিমান স্বত্তা।
তিন যখন বলেচিলেন, তখন অবশ্য কান্নার জল ছিল না। ছিল
বৈজ্ঞানিক ভাবলেশহীনতা।
তারপরও আসলে স্টিফেন হকিংস কাঁদছিলেন। মনের ভেতরে। পাহাড়ের ভেতরে আগ্নেয়গিরির মত তিনি জ্বলছিলেন। এই কারণেই তিনি ছোট্ট একটা ভুল শব্দ বললেন। মানুষ হিসেবে। তিনি বললেন, ধ্বংশ হবে।
কিন্তু সেই আর্টিফিশিয়াল প্রাণীরা কিন্তু কিন্তু ধ্বংশ বলেনি। ওরা বলেছিল, মানুষ উন্নত রূপে তুমি বিলীন হয়ে যাবে।
বিলীনতা যা ধ্বংশও তা। মানুষের কাছে। তার নিজের রূপ না থাকলে আর সে রইলো কোথায়?
তাই
সে এটাকেই বলবে মহাপ্রলয়ের দিন। পৃথিবী ধ্বংশের দিন...
এরপরে, আর কিছুই থাকবে না।
যদিও মানুষের ধ্বংশ মানে সবকিছুর ধ্বংশ নাও হতে পারে..
৩। ভাষার জন্ম আর আমি তুমির গল্প
..................................................
ভাষার জন্ম কোথা থেকে?
আমি এবং তুমি- এই দুজন থেকে।
দুজন, একজন আরেকজনকে যখন নিজের কথা জানাতে গেলো তখনই ভাষার জন্ম হলো। বলা যেতে পারে-
তুমি আমার জীবনে যখন এলে, তখন থেকে ভাষার জন্ম।
একজন মানুষের জীবনে প্রথম তুমি আমি, মা আর সন্তান। মা তুমি, তোমার সাথে কথা থেকেই শিশু আমি‘র ভাষার জন্ম। এজন্য আমরা বলি, আমাদের মাতৃভাষা। অনেকে দেশে জন্মভূমিকে মাতৃভূমি না বলে পিতৃভূমি বলে। তারাও ভাষার বেলায় পিতৃভাষা বলে না।
বড় হয় আর শিশুর জীবনে অন্য মানুষ আসে। নতুন ভূগোল তৈরি হয়।
তাদের সাথেও কথা হতে হতে একজন মানুষের ভাষার পরিসর বড় হতে থাকে, রূপ পাল্টে যেতে থাকে। নতুন অভিজ্ঞতা আসে। নতুন শব্দ যোগ হয়। নতুন প্রকাশ ভঙ্গি আসে।
এই প্রকাশ ভঙ্গি পাল্টানোর একটা তরঙ্গ আছে। এই তরঙ্গগুলো এই ঢেউগুলো তৈরি হয় সমাজ, সংসার আর জগতের নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে।
এই ঘাত-প্রতিঘাতগুলোর শেষ নেই। এর কোনটা পারিবারিক, কোনটা সামাজিক, কোনটা রাজনৈতিক, কোনটা প্রযুক্তির। আবার কোনটা তুমি আমির মতো ব্যক্তিগত। কবির কল্পনায় তৈরি হয় নতুন শব্দ। ভাষায় যোগ হয় নতুন অর্থ।
এভাবে আসে বদলে যাওয়া।
বাংলাদেশের ভাষা চর্চায় গত কয়েক বছরে একটা বদল এসেছে। এই বদলগুলো আমরা দেখছি। গদ্য ভাষাটা কথ্য ভাষার মত উঠছে। আগে সব লেখাই ছিলো চর্চার ভাষা। মানুষ মুখে যাই বলতো লেখার সময় একটা শুদ্ধরূপ আনার চেষ্টা ছিল।
কিন্তু এখন লেখা মানেই তা নয়। আগে লিখে নিজেকে জানাতো। নিজেকে উপস্থাপন করতো। দৈনন্দিন কথাবার্তার মাধ্যম লেখা ছিল না। ওটা এখন হয়েছে। মানুষ সামাজিক মাধ্যমে, লিখে কথা বলছে। ফলে লেখার মধ্যে বলার টোনটা চলে এসেছে।
কিন্তু মনের সেই পরিশীলিত ভাষা চর্চার জায়গাটা বন্ধ, তা নয়। কবিতা ফিরে এসেছে। সাধারণ মানুষের নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। অনন্ত কাব্যময়তা। যে কথাগুলো সে সবাইকে জানাতে চায়, সেগুলো ছোট ছোট কাব্যময় রূপে বলছে। সামাজিক মাধ্যমগুলো তাকে এভাবে প্রকাশ করার প্রান্তর এনে দিচ্ছে।
সে সেখানে দু লাইন কাব্য দিয়ে নিজের অনুভবের পৃথিবীকে প্রকাশ করছে তাই শুধু নয়
সে একটা ছবি দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে।
সে একটা ভিডিও দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে।
কথ্য ভাষায় লিখে কথা বলছে।
অর্থাৎ গদ্য হয়ে উঠছে কথা বলার দৈনন্দিন আদল।
আর কবিতার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে সেই চর্চার ভাষা। হয়ে উঠছে কবিতাশ্রয়ী।
এর কারণ প্রযুক্তিগত জায়গা থেকে ভাষা মাধ্যম হিসেবে অডিও ভিজ্যূয়াল যুগের বিস্তার। মানুষ এখন ছবি আর ধ্বনি এই দিয়ে বুঝতে চাইছে বোঝাতে চাইছে।
ছবি আর ধ্বনির চর্চা বেড়ে যাওয়ার কারণে কবিতা জন্ম নিচ্ছে। কারণ কবিতার মধ্যে ধ্বনি আর ছবি থাকে।
আর কী কারণ?
কারণের শেষ নেই। অসীম কারণ থাকে, একটি বদলে যাওয়ার মধ্যে। তার মধ্যে থেকে আরেকটি তুলে আনা হয় যদি-
সমাজের প্রতি রাগ। ভাষা শুধু ভাষাই নয়। ভাষার একটা কাঠামো আছে, যা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকে উঠে আসে। আমাদের প্রচলিত পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন আমাদের জীবনকে যে বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা আগামীর নাগরিকদের ভাষা পাল্টে দিয়েছে। যা প্রচলিত অর্থে শুদ্ধতা, তারা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে।
ভাষার পরিবর্তন, সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ভোর হওয়ার আগে পাখি ডাকার মতোন।
৪। নামগোত্রহীন
.............................
যখন কেউই তোমাকে দেখছে না
তখন কি তুমি থাকো না?
ভাবো, তিনি কহিলেন।
আমরা সবাই সবার কাছ থেকে লুকিয়ে পড়লাম
আর ভাবতে লাগলাম
আমি কী নেই?
মন্তব্য
পোস্ট পড়তে পড়তে বহুকাল পরে বদ্দা'র জেনেসিসের কথা মনে পড়লো। জেনেসিসের সরল বঙ্গানুবাদের মতো এই পোস্টেরও সরল বঙ্গানুবাদের প্রয়োজন হবে - অন্তত আমার মাপের পাঠকদের জন্য। কর্ণজয় মশায় বদ্দা'র সুহৃদ বলে জানতাম। জীবিত বদ্দা'র ভূত জীবিত কর্ণজয় মশায়ের কী-বোর্ডের ডগায় চাপলো কি না তা কে জানে! রাজকুমাররে পাওয়া গেলে জিগানো যাইতো।
"কারণের শেষ নেই। অসীম কারণ থাকে, একটি বদলে যাওয়ার মধ্যে। তার মধ্যে থেকে আরেকটি তুলে আনা হয় যদি-
সমাজের প্রতি রাগ। ভাষা শুধু ভাষাই নয়। ভাষার একটা কাঠামো আছে, যা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকে উঠে আসে। আমাদের প্রচলিত পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন আমাদের জীবনকে যে বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা আগামীর নাগরিকদের ভাষা পাল্টে দিয়েছে। যা প্রচলিত অর্থে শুদ্ধতা, তারা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে।
ভাষার পরিবর্তন, সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ভোর হওয়ার আগে পাখি ডাকার মতোন।"
অনেক ভারী ভারী বিশ্লেষণ হচ্ছে ভাষার এই পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে গিয়ে। তবে এত সহজ ও সুন্দর বিশ্লেষণ এই প্রথম পেলাম। খুব ভাল লাগল আমার ।
নতুন মন্তব্য করুন