মানুষ সংস্কারা : ০-৭

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: বুধ, ১৬/০২/২০২২ - ৯:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০ (শূন্য)
।।।।।।।।।
কে আমি?
বিস্তৃত মহাকাশে ছুটে চলা সহস্র লক্ষ কোটি গ্রহ তারার মধ্যে
পৃথিবী নামের একটি গ্রহে- এই যে আমি;
কে এই আমি?
কী আমার পরিচয়?

৮৭ লক্ষ প্রজাতির জীব পৃথিবীতে আছে
বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন।
এই এত জীবের মধ্যে মানুষই একমাত্র জীব
যে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়ায়-
আর কেউ নয়-

আড়াই হাজার বছর আগে
মানুষের লিখিত ইতিহাসের প্রথম যুগে
আদি শিক্ষক সক্রেটিসকে
এই মর্ত্যের পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী বলে
ঘোষণা করা হয়েছিল।
কেন তাকেই বলা হলো, তিনিই জ্ঞানী, আর সবার চেয়ে।
কী জানতেন তিনি-
যার জন্য তাকেই জ্ঞানের শিরোপার সন্মান দেয়া হলো?
আমরা তাকে মানব সভ্যতার আদিতম শিক্ষক মেনে নিলাম…

আমি জানি না। কিন্তু এটা আমি জানি যে,
আমি জানি না…
সক্রেটিস বলেছিলেন।
সক্রেটিসের এই কথার মধ্যেই
মানুষ আর অন্য জীবের পার্থক্য লুকিয়ে।

‘জানি না’,
এই বোধ শুধু মানুষেরই।
যা দেখছি তাই কি সত্যি?
যা জানি, আসলে কি তাই ?

নিজেকেই সন্দেহ করেছে মানুষ,
প্রশ্ন করেছে-
ভেবেছে-
যা দেখি, যা শুনি, যা জানি, যা চিনি
যাকে সত্য বলে জানি সেটাই কি আসলে সত্যি
না কি
এই জানা-শোনা-জানা-চেনা সত্যের বাইরে
আসল সত্য লুকিয়ে আছে?

এই বোধ মানুষকে
খাওয়া আর প্রজননের মধ্যে আবদ্ধ জীব ধর্মের থেকে
মুক্ত হয়ে জানার রাজ্যে পা বাড়াতে শিখিয়েছিল।
আমি জানি না। তার মানে ‘জানবো’।

কী জানবো?
আদি শিক্ষক সক্রেটিস আমাদের সেটা বলে গেছেন।
নিজেকে জানো। Know thyself.

নিজেকে জানার, নিজেকে চেনার এই অভিযাত্রা থেকে
জন্ম নিয়েছে দর্শনের, ধর্মবোধের, বিজ্ঞানের।
মানুষ, এই পৃথিবীর যত জায়গায় ছড়িয়েছে
নিজের মতো করে আপন আপন ভাষায়
এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছে।
এই উত্তর অন্বেষন করতে গিয়ে
মানুষ আর আগের মতো থাকেনি
বারবার নিজেকে ভেঙেছে
বারবার নিজেকে নতুন করে গড়েছে।
নিজেকে নিজে সংস্কার (পরিবর্তন) করেছে।

মানুষই শুধু এটা পেরেছে।
এজন্য মানুষকে বলা হয় মানুষ সংস্কারা।
কালে কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষ গড়ে তুলেছিল
আপন আপন সংস্কৃতি, সভ্যতা।
এর ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়
মানুষের ইতিহাস, এই সংস্কারেরই ইতিহাস।
প্রত্যেকে একা এবং সম্মিলিতভাবে
নিজেকে এবং নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে
নিজেদেরকে আবিষ্কার করেছে।
নিজেকে নতুনভাবে গড়ার মধ্য দিয়ে
নিজেদেরকে নতুনভাবে গড়েছে।
নিজেকে নতুন করে জানা, আবিষ্কার
মানুষকে দিয়েছে মানুষের মধ্যেই
আপন আপন স্বাতন্ত্র্য।নিজস্বতা। বৈচিত্র্য।
বিভিন্ন জাতির মধ্যে তৈরি হয়েছে
নিজেকে জানার নিজস্ব পথ।

পৃথিবী জুড়ে নানা কালে
বিভিন্ন জাতি নিজেদের মতো করে
নিজেকে জানার চেষ্টা করেছে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকায়ত দর্শনে
এর বিভিন্ন রূপ পাওয়া পাওয়া যায়।
বিভিন্ন হলেও, এর মধ্যে একটা একাত্মতা পাওয়া যায়।
এই মিলের পেছনে আছে
স্বতন্ত্রতার মধ্যেও একটা বিশ্বজনীন একাত্মতা বোধ, অভিন্ন দর্শন।
আমরা মানুষ।
সব দর্শনের লক্ষ্যই নিজের আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে
মানুষকে জানা।
এই বিশ্বপ্রকৃতির মাঝখানে-
আমি কে, আমরা কে
এই চরাচরের সবকিছুর সাথে কী আমার সন্মন্ধ্য
কেন আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি
কী আমাদের কাজ, কী আমাদের লক্ষ্য
কোথায় আমাদের স্বার্থকতা
এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে
মানুষ নিজেকে মানুষ হিসেবে চিনেছে।
কখনও ব্যক্তি-দর্শন আর কখনও ধর্মচিন্তা, কখনও বিজ্ঞানীর চিন্তারূপে
সক্রেটিস, কনফুসিয়াস,
তাও, জৈন, বাইবেল, কোরান, উপনিষদ, গীতায়
আধুনিক দার্শনিক চিন্তাবিদদের রচনায়
এই পথের বর্ণনাই আমরা পেয়েছি-
যা আমাদের মানবজীবনের অন্বেষণে
আলোর মতো কাজ করেছে।
নতুন পথ দেখিয়েছে…

প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতিতে
নিজেকে খোঁজার, নিজেকে জানার পথের
একটি নিজস্বতা আছে।
বাংলায় এই পথের সর্বোত্তম প্রকাশ দেখা যায়
বাউল সনাতনী দর্শনে।
বাংলার লোকায়ত দার্শনিকরা
নিজেকে ক্রমাগত খোঁজা এবং আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে
এই নিখিল বিশ্বে মানব জীবনের স্বরূপকে তুলে ধরেছেন।
এটা প্রকাশে স্বতন্ত্র, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়।
বাউল ও লোকায়ত দর্শনের শিক্ষকদের সাধু বলা হয়।
সাধুদের মূল কাজই হলো
মানুষ হিসেবে নিজেকে খুঁজে বেড়ানো
আর এর মধ্য দিয়ে মানব জীবনকে উপলব্ধি করা।
এই জীবনকে উপলব্ধি করতে গিয়ে
তারা চারপাশের সবকিছুকে স্বরূপে (সত্যিকারভাবে) চিনতে চেয়েছেন।

যেদিকে তাকাই- রূপের শেষ নেই
বাইরে আমরা সবাই আলাদা আলাদা,
কিন্তু অন্তরে?
বাউল সাধকরা অন্তরে অনুসন্ধান করেছেন।
এজন্য ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম-
বাইরে থেকে যাদের আলাদা মনে হয়
সেই ধর্মের মূলে গিয়ে ধর্মের মর্মবোধকে আত্মস্থ করেছেন
দেখেছেন, যা ভিন্ন ভিন্ন মনে হচ্ছে
তা হচ্ছে দেশ-কাল-পাত্রের রূপের প্রকাশ মাত্র। এটা বাইরের।
ভেতরে, মর্মে তা আসলে এক।
এক অভিন্ন বোধে সকলই আপন। এক।
কী সেই বোধ?

বাউল সনাতনী সাধকরা
সেই বোধকে যে তত্ত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করেন
তা হলো মানুষ তত্ত্ব।
বাইরের জগত, প্রকৃতি এবং নিজের ভেতর
এই দুইকে চিনে, উপলব্ধি করে
এই জগত-সংসারে নিজেকে আবিষ্কার করা
নিজের কর্মকে চিনতে পারা, এবং তা জীবনে প্রয়োগ করে
নিজ নিজ মানবজীবনকে স্বার্থক করে তোলা
এই হলো মানুষ তত্ত্বের মূলকথা।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই মানুষ তত্ত্বকে বোঝার চেষ্টা
জীবনের একটা অভিযাত্রা।
যে অভিযাত্রা মনের মধ্যে, বোধের মধ্যে
নিজের মধ্যে মানুষের নানা রূপের জন্ম দেয়।
রূপের ভিন্নতার মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে নেয়া, চিনে নেয়া
এই রচনা তারই এক প্রকাশ চেষ্টা।


“এমন কিছু আছে কি জীবনে
যা তুমি ভুলতে পারো না?
বারবার মনে পড়ে
ফিরে আসো সেখানেই?”

সাধুদের কথা এরকম।
থমকে দেবে। নিজের মধ্যে নিয়ে যাবে।
চারপাশে যা কিছু, মনে হবে যেন নেই।
শুধু আমি আছি। আর আমার ভেতরে একটা জগত।
স্মৃতির। কল্পনার।
সজ্ঞানতা- হচ্ছে স্মৃতি।
স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়
আমি আছি।
স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়
আমি এখন নেই।
একটা শূন্যতা…
শূন্যতাও একটা অস্তিত্ব।
আমি কোথায় আছি? কোথায় নেই?
ভাবতে শুরু করলে থামা যায় না।
আসলেইতো কোথায় আছি আমি?
আর কোথায় বা নেই?
যখন আমি ছিলাম না, তখন আমি কী ছিলাম?
যখন আমি থাকবো না, তখন আমি কোথায় থাকবো?
“তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।”
সাধুর গলায় রবীন্দ্রনাথ বেজে ওঠেন।
গানটা ভাল লাগে।
মনে হয়, মৃত্যুর ভয় কেটে যাচ্ছে।
মনে হয়, আমি থাকবো।
এইযে আমরা বলি না-
আমার চোখ, আমার হাত, আমার পা, আমার হৃদয়
সবইতো আমার। আমিতো নই।
তাহলে ‘আমি’টা কে?
আমরা যখন নিজের সাথে নিজে কথা বলি
কার সাথে কথা বলি?
সে কে?
সেও কি আমি?
কোন আমি সে?

একটা নদী, বয়ে চলেছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ, ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
আমি ঢেউয়ের দিকে তাকাই।বাতাসে সুর উঠেছে।
“আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে
আমি দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে
কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে…”
গগন হরকরা গান গেয়ে গেয়ে হেঁটে চলে যান।
সে কোথায় থাকে আসলে?
সাধু জিজ্ঞাসা করেন, চোখের দিকে তাকিয়ে।

“মন একটা ইচ্ছেঘোড়া।
কোথায় যে যাবে, নিজেও জানে না।
যেদিকে তাকায় সেদিকেই ছুটে যায়।
এখান থেকে ওখানে
ওখান থেকে সেখানে-
কোন ঠিক নেই।
কেশর উড়িয়ে লেজ দুলিয়ে
খালি ছুটে বেড়ায়। আর ছুটে বেড়ায়।
যেন তার চোখের সামনে একটা সোনার হরিণ
সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
‘সোনার হরিণ চাই- আমার সোনার হরিণ চাই।
অমল ধবল চপল কোমল সোনার হরিণ চাই।’
ইচ্ছের আলেয়ার তৈরি সোনার হরিণের পেছনে সে ছুটছে
জানেও না… কোথায়…

এতো তোমার মনঘোড়া। তুমি নও।
তুমি কি কখনও টের পেয়েছো
এই যে তুমি, সে ঠিক তুমি নও।
মনঘোড়ায় চেপে যখন উথাল পাতাল ঘুরে বেড়াও
তখন আর কাউকে টের পাও কি?
তোমার মনের মধ্যে
সেই মনঘোড়ার ওপর প্রজ্ঞার লাগাম হাতে
বসে আছে একজন।শুনতে পাও তার কথা?
থামো।
সেই তোমার মনের মানুষ।”
মনের মানুষ থাকেন, সজ্ঞানতায়।
যখন তুমি চিন্তা করো
সেই তোমার মধ্যে।
সাধু বলে যান।
ভাবি আমি। মনে পড়ে, আসলেইতো
মানুষ যখন চিন্তা করে
তখন তাকে খুব সুন্দর দেখায়।
কেন?
মনের মানুষ জেগে ওঠেন বলে?


সূর্য ঘুমিয়ে পড়েনি একদিনের জন্য-
আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।
তান্ত্রিকেরা শক্তির উপাসক।
সব শক্তি প্রকৃতিতে।
বৈজ্ঞানিকরাও প্রকৃতির মধ্য থেকেই যত শক্তি আবিষ্কার করেন।
বৈজ্ঞানিকরাও তান্ত্রিক।
অথবা তান্ত্রিকরাও বৈজ্ঞানিক…
বৈজ্ঞানিকরা প্রকৃতির রহস্য খুঁজে বেড়ানোর জন্য
বাইরে দৃষ্টি মেলেন।
আর তান্ত্রিকরা নিজের ভেতরে। নিজের দেহে
যা নেই দেহভান্ডে, তা নেই বিশ্বভান্ডে…
ঐ সূদুর নক্ষত্র, পাহাড়, সমুদ্র, প্রবাহমান বাতাস, এই মৃত্তিকাভূমি
সবই আছে এই দেহের মধ্যে।
তান্ত্রিক এই বিশ্বশক্তিকেই আবিষ্কার করেন
আপন দেহে।
নিজেকে না জানলে, সকল জানা বৃথা।
বলেই সাধু নিরব হয়ে গেলেন।
বাতাস ওঠে।ফসল কাটা হয়ে গেছে। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে থাকি।
কোথাও একটা ঘুঘু ডেকে উঠলো।ওর ডাকে দুপুরের স্তব্ধতা
হু হু ছড়িয়ে পড়ে। ফসলের গন্ধের মতো…

আমি হয়তো চিনি না, জানিনে, পথ ঘাট।
কিন্তু জীবনে যা জানলাম, তাকি মিথ্যে?

তোমার দয়া ছাড়া কিছু হয় না জানলাম।
কিন্তু আমি যা জানলাম তাকি মিথ্যে।

সাধু হাসেন।
এবার তুমি বুকে হাত দিয়ে অনুভব করো
তুমি কী জানলে? জেনেছো কি কিছু
যা তুমি জানো
সত্যিই জেনেছো?

সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে।
সাধু প্রেমগীতি গাইছেন।
হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এসে মন্ত্রধ্বনির মতো
আকাশের অসীম অন্ধকারে গ্রহ নক্ষত্রের সাথে মিশে যাচ্ছে।
ঘর, ঘরকে ঘিরে আঙিনা-
বেশ কয়েকজন, তন্ময় মূর্তির মতো
গান শুনছেন।
তাদের দেখি। সব অচেনা মুখ।
কিন্তু মনে হচ্ছে, আপন।খুব আপন।
হাজার, সহস্র হাজার বছর, মহাকালের পথ ধরে
একসাথে আছি। খুব আপন মনে হয়। খুব চেনা।
কেন এমন মনে হয়?

আমি একা, প্রায়ই ভাবি আমরা- ভাবি না?
ভাবি। কতবার একথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। আমি একা।
কীভাবে আপনি একা? বলেন তো…
কীভাবে আমি একা আসলে? ভাবি।
আমাকে দেখার চেষ্টা করি-
আকাশের দুটি তারার থেকে আলোর সূতোয় একটি দোলনা ঝুলছে।
সেই দোলনায় বসে আছি।
দোলনাটা দোল খেতে খেতে একবার ফিরে যাচ্ছে এমন একটা জায়গায় যেখানে,
থরে থরে সাজানো খাবার,
সোনায় মোড়া সুন্দরী মেয়েরা লাস্য করে খাবার টেবিলে ডাকছে

আবার সেখান থেকে দোল খেয়ে চলে যাচ্ছে আরেক প্রান্তে-
সেখানে একটা আয়না বসানো। আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখা যাচ্ছে।
আয়নায় আমাকে দেখি। নিজের চোখে চোখ রাখি।
আয়নার আমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বলে দেখছো তোমাকে-
দোলনাটা আবার আমাকে নিয়ে চলে গেল সেই প্রান্তে
সেখানে জুয়ার আড্ডা বসেছে, মদের ফোয়ারা বসেছে,
ঝাঁ চকচকে একটা দামী গাড়ি হর্ণ দিয়ে আমাকে ডেকে উঠতেই
দোলনাটা আবার দোল খেয়ে নিয়ে গেল আয়নার কাছে
এভাবেই দোল খেতে থাকি আমি… আমি আমাকে দেখতে থাকি
কামনার বাগান থেকে আয়নায় আমার মুখ
আয়নার আমার মুখ থেকে ইচ্ছেলোভের নদীতে
দোল খেতে খেতে হঠাৎ
লাফিয়ে পড়তেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়।

সাধুকে দেখি। সৌম্য একটা হাসি মুখে।
ঝড়ের সমুদ্রে ডুবুডুবু নাবিকের কাছে
হঠাৎ জেগে ওঠা সবুজ দ্বীপের মতো
মনে হয় তাকে। আশ্রয়ের মতো।

একা আসলে আমরা না।
আমাদের একা করে দেয় আমাদের লোভ।
আমাদের কামনা। অহং থেকে উঠে আসা ইচ্ছেরা।
আমাদের স্বার্থবুদ্ধি আর ঈর্ষার আগুন।
দেয়াল তৈরি হয়।
তুমি আমি আলাদা হই।
কিন্তু আমরাতো আলাদা নই..
ঐ চিরদিনের চিরন্তন, অনন্ত অসীম
আমিও তারই কোলে আছি
সেও তারই কোলে আছি
আমরা অনুভব করি
এই আমি, এই তুমি
জিজ্ঞেস করে দেখো নিজের কাছে
কোন দিন তুমি সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছিলে?
একা না কি সেদিন তোমার সাথে সকলে ছিল?
উৎসবের মতো…

সত্যের পরিপূর্ণতাই প্রেম। আনন্দ।
যখন মন আনন্দিত
সকলকেই মনে হয় আপন।
উৎসবদিনের মতো, উৎসবের রাত্রির মতো
সবাই একসাথে মিলেছে।
ঘরের দুয়ার খোলা।
আপন পরের ভেদাভেদ নেই
আমার আনন্দ, তোমার আনন্দ সেখানে একাকার।
কোন দৈন্যতা নেই।
সবাই ঝলমলে।
যেন সবার মধ্যেই জগতের আনন্দযজ্ঞ বাসা বেঁধেছে।

“জগতের আনন্দযজ্ঞে তোমার নিমন্ত্রন হে।।।”
সাধু গেয়ে ওঠেন।
সাধুরা কথা বলেন গানে গানে।
গান সেই বিশুদ্ধ অনুভবের ভাষা
যা হৃদয় থেকে উঠে আসে বলে
তা পূর্ণসত্যের মতো-

আর যা সত্য
তা আমাদের মিলিয়ে দেয়।।।

৫.
মনের মানুষ
আপনি খুঁজে পাবেন কোথায়?
তার আগে বলতে পারেন,
আপনি এখন কোথায়?

কোথায় আমি? কোথায় আসলে?

আপনি আসলে এখানে নেই।
আপনি আছেন, অন্য জায়গায়।
আপনি ভাবুনতো কোথায় থাকেন আপনি, বেশিরভাগ সময়?
বর্তমানে? না কি
অতীতের মায়া স্মৃতিতে?
বা বিজয়ের আনন্দের কল্পনায়।
অথবা আসন্ন পরাজয়ের নতজানু শঙ্কায়।
আপনার মন, বর্তমানে থাকেন আসলে?

আমরা বর্তমানে থাকি না আসলে।
সাধু বলে যান।
আমরা বেশিরভাগ সময়ে থাকি আসলে
অতীত আর ভবিষ্যতের কল্পনার জীবনে।
আমরা জানি না
ঠিক এখন, এই মুহূর্তে
আমার আসলে কী প্রয়োজন...
এই মুহূর্তে জগত, সংসারের সাথে আমি কীভাবে জড়িয়ে
তাই আমি ভুলে যাই সম্পর্ক আমাকে এখন কী করতে বলছে
ভুলে যাই ঠিক এই সময়ে আমাদের কর্ম,
যা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমাদের আনন্দ।
তাই অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের কল্পনায়
ডুবে থাকে মন।
দেখতে পায় না, এই যে এখন
তার জগত সংসারে কী ঘটে চলেছে
ফুল ফুটছে, পাখি ডাকছে, বাতাস বইছে
দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিতে সন্ধ্যা নামছে
একটু পরে রাত্রি নেমে আমাদের এক করে দেবে
তারপর উঠবে নতুন ভোর
নতুন হয়ে উঠবো বলে।
প্রকৃতিতে, সংসারে এখন এই মুহূর্তে
যেভাবে জড়িয়ে আছি, যা কিছু ঘটে চলেছে আমাকে ঘিরে,
যে কর্ম আমার জন্য অপেক্ষা করছে
অতীত আর ভবিষ্যতের ভাবনায়
সব নেই হয়ে যায়।
ভুলে যাই, এই সময়টা এই সময়েই
আর ফিরবে না।
ভুলে যাই, সময় গেলে সাধন হবে না।
এখন যা করার কথা ছিল
তা এখনকারই। পরে আর হবে না।
সময়টা ব্যর্থ হয়ে গেল
আমার জীবনে।

জাপানে, অনেককাল আগের কথা-
ম্রাট, সত্য কি, তা জানার জন্য
এক সম্রাট জেন সাধুর ঘরে এসেছেন।
সাধু তখন ঝাড়ু দিয়ে
ঘর পরিষ্কার করছেন।
বাইরে কেউ এসেছে বুঝতে পেরে
ঝাড়ু ফেলে দরজায় এসে তাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন-
আপনার জন্য কী করতে পারি বলুন।
সম্রাট তার আগমনের কারণ জানিয়ে বললেন,
তিনি এসেছেন, সত্য কী তা জানতে।
সাধু রেখে দেয়া ঝাড়ুটা তুলে নিয়ে
ঘর পরিষ্কার করতে লাগলেন।
সময়ের কাজটা সময়ে করাই সত্য।

বর্তমান চিনেছিল ঐ মানুষ
যাকে পাহাড়ি রাস্তায় তাড়া করেছিল এক বাঘ
আর সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটছিল প্রাণপনে।
কিন্তু ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পা ফসকে পড়ে গেলেন নিচে
কিন্তু একটা গাছের শেকড় ধরে
তিনি পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করলেন।
নিচে তাকিয়ে দেখেন, একটা বাঘ
তার দিকে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
এমন সময় একটা কূট কূট শব্দ কানে যেতে
তাকিয়ে দেখলেন একটা ইঁদুর
তিনি যে শেকড় ধরে ঝুলছেন
সেটা কাঁটছে।
তিনি পাশে তাকিয়ে দেখলেন
পাহাড়ের গায়ে বুনো আঙুর ধরেছে, পেঁকে টকটকে হয়ে আছে।
তিনি এক হাতে শেকড়টা ধরে আরেক হাত বাড়িয়ে
সেই আঙর ছিড়ে মুখে দিয়ে বললেন
‘আহ! কী মিষ্টি!!’

পাবি অমূল্য নিধি বর্তমানে...
গল্প ছেড়ে গান ধরেন সাধু।


একলা মনে হয় নিজেকে কখনও? খুব একলা…
কেমন লাগে তখন?
নিজের সাথে নিজে থাকার পথ
জানা না থাকলে
একলা একা থাকাটা অসহ্য হয়ে ওঠে…

“নিজের সাথে নিজের থাকার পথটা কী?”
শুনে সাধু হাসেন।
“খেলাটাইতো ওখানে- নিজের সাথে নিজে…”
এই যে বাউল দর্শন, সাধু কথা
এ আসলে সেই সাধু সক্রেটিসেরই পরম্পরা।
আড়াই হাজার বছর আগে সাধু বলেছিলেন
‘নিজেকে জানো’
তারই খেলা চলছে সাধুদের দরবারে।
নিজের কাছে নিজের আসা
নিজের সাথে নিজে চলা
নিজের মাঝে নিজে থাকা
নিজের মাঝে নিজে দেখা
সাধুকথা... আয়নার মতো।
নিজেকে দেখা যায়।

নিজেকে কখনও নিজের চোখে দেখেছেন তখনও?
নিজেকে নিজে দেখা যায় না।
নিজে কাকে দেখতে পারি?
অন্যকে। তাহলে নিজেকে দেখতে পাবো কোথায়?
অন্যর দিকে তাকালে।
নিজের দিকে তাকালে আপনি আপনাকে পাবেন না
আপনার নিজেকে দেখতে গেলে
অন্যকে দেখতে হবে।
আপনার ছায়া পড়ে ওর ওপর
সেই ছায়া দেখে আপনি নিজেকে দেখতে পাবেন।
আমরা আসলে আয়না।
আমি আপনার আয়না। আপনি, আমার আয়না।
কী যে সত্যি মনে হয়
সাধু নত্য জানেন। তার কাছ থেকেই
সত্যকে জানা যায়।

কিন্তু সাধুর কাছে আপনি সত্য পাবেন না। কারণ সাধুর কাছে সত্য থাকে না।’
তাহলে কার কাছে যাবো?
সাধুর কাছে।
সাধুর কাছে সত্য নেই! তাহলে সাধুর কাছে আমরা সত্য খুঁজি কেন?
‘সত্য কারো কাছে নেই।
সাধুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার সঙ্গ সংস্পর্শে সত্য উদ্ভাসিত হয়।
যেমন করে একটি প্রদীপ থেকে জ্বলে ওঠে আরেকটি প্রদীপ।’
সাধুকে মনে হয়- সাধু আসলে কেউ নন,
নৃতত্ত্বের একজন নিমগ্ন দেহ-মন-আত্মার বিজ্ঞানী মাত্র।
নৃবিজ্ঞানীর মতই গোটা জীবনভর
তারা মানব প্রকৃতিকে অবলোকন করছেন।
মানব জীবনের শত সহস্র বিচিত্র রূপকে আবিষ্কার করে চলেছেন।
এই রূপের রসে মজেছেন।
কবিতার ভাষায়, গানের সুরে
তার বর্ণনা করে যান শুধু।
সাধু আকাশের দিকে তাকান। যেন অসীমকে অনুভব করলেন।
বলে যেতে লাগলেন-

যদি কখনও দ্বিধা হয়
কখনও শংশয় আসে অথবা প্রশ্ন জাগে তোমার মনে
দিকহারা নাবিকের মত-
আকাশের চাঁদ, সূর্য যার চোখে ঢাকা পড়ে আছে মেঘের আড়ালে
প্রতিটা দিক যার কাছে মনে হয় ভ্রান্ত
অথচ জ্বলে আশার প্রদীপের মত-
কোরাণ বলে, “তুমি তোমার আত্মাকে জিজ্ঞাসা করো।
সে যা উত্তর দেবে তা করার জন্য
তুমিতো দায়ী নও।”

ভাবতে থাকি।
নিজের ভেতরে টের পাই আর এক আমি।
“কোন পথে যাবো?”
তাকে জিজ্ঞেস করে উঠি।
ভেতর থেকে কথা বলে ওঠে ও।
সরল পথ ঝলমল করে ওঠে উজ্জ্বল আলোর মত।

মনের মানুষ থাকেন, সজ্ঞানতায়।
যখন তুমি চিন্তা করো
সেই তোমার মধ্যে।
সাধু বলে যান-


সাধুগৃহ যেন শান্তি নিকেতন।
রোদ আর ছায়া মেশানো গোধূলীবেলার প্রশান্তি মাখা।
চোখ মেলে দেখি।
পাখিরা গান গাইছে। ফুল ফুটে আছে।লাল, নীল, সাদা…
নাকে ভেসে আসছে তার মিষ্টি ঘ্রাণ।
ঝিরিঝিরি বাতাস। গায়ে আরাম বুলিয়ে যাচ্ছে।
পুরো ঘর জুড়ে যেন প্রকৃতির ঐশ্বর্য ঝলমল করছে।
অন্তর পূর্ণ হয়ে ওঠে।
একটা থালায় খাবার সাজিয়ে এনে সাধু বললেন
একটু সেবা গ্রহণ করুন।
সাধুর খাবার খুব সাধারণ। নিরামিষ।
জীব হত্যা মহাপাপ। শুধু এই জন্য নয়
সাধু বলেন
আমরা যা খাই, সেই খাদ্য বস্তুর ধর্মও আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
আমরা পশু আহার করার সাথে সাথে
আমাদের মধ্যে পশু ধর্ম জেগে ওঠে।

একটা প্রাচীন ধর্মীয় গল্প গাথা মনে পড়ে।
এক মুসলমান সাধুর কাছ থেকে গল্পটা শুনেছিলাম।
শয়তান কীভাবে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করেছিল
সেই গল্প।
তখন মানুষ মাংস খাওয়া শেখে নি।
শস্য, শাক সবজি, ফল আর বীজই মানুষের আহার।
শয়তান যখন কিছুতেই মানুষকে প্ররোচিত করতে পারছিল না
সে তখন পশুর রূপ ধরে এসে বলেছিল
‘আমাকে খাও, খুব মজা পাবে তুমি।
পশু খাওয়া যায় না কি! মানুষ অবাক।
যায়তো বলে, শয়তান তাকে মাংস খাওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দিল।
মানুষ নতুন খাবারের লোভে
সেই পশুর মাংস খেল, আর তারপরেই
মানুষের মধ্যে শয়তান প্রবেশ করে, রক্তে মিশে যায়।
এরপর থেকেই আহার শরীরের শক্তির উৎস নয়
হয়ে উঠলো রসনা বিলাস।
দোলনায় দেখা সুন্দর সুন্দর মেয়েদের কথা মনে পড়ে
নানা রকম লোভনীয় খাবার হাতে দাঁড়িয়ে
বেহেশতের লোভের মতো।
কিন্তু সাধুর ঘরে এই সাদামাটা সবজীর তরকারীটা যেন
অমৃত। কী স্বাদ!
খুব, মজা হয়েছে। আমি বলি।
খাবারের স্বাদ কোথায় জানেন?
ভক্তিতে।
এটা সত্যি।
সাধুরা খাবারটা তৈরি করেন সেবার মন দিয়ে।
সেবাটা করাটাকে তারা দেয়া মনে করেন না
মনে করেন, এ তাদের অর্জন। তাদের প্রাপ্তি।
তারা যে ভক্তি মিশিয়ে খাবারটা তৈরি করেন
যেভাবে নিবেদন করেন
সেটাই খাবারের মধ্যে স্বর্গীয় সুধা এনে দেয়।
মনে হয়, আহা! পৃথিবীর সকল আনন্দ এখানে এসে মিশেছে।
ভক্তিই সব। ভক্তি না থাকলে কিছুই হয় না।
ভক্তিতে মুক্তি, কর্মে বহুদূর। মনে পড়ে।
প্রাচীন সাধু কথা।

ভক্তিটা আসে কোথা থেকে?
কোথা থেকে?
সাধু উত্তর দেন না। উল্টো প্রশ্ন করেন
মানুষের কয়টা ইন্দ্রিয়?
পাঁচটা। চোখ, কান, নাক, ত্বক আর জিহ্বা।
আমরা বলি জ্ঞানেন্দ্রিয়।
জীবের মধ্যেও এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে।
মানুষের একটি বেশি আছে।
কোনটা?
অন্তরেন্দ্রিয়। মানুষের অন্তর একটি ইন্দ্রিয়।
অন্তর জেগে উঠলেই মনে ভক্তি আসে।
শুধু মানুষেরই ভক্তি আছে।
মানুষ ছাড়া আরও কারও এই ইন্দ্রিয় নেই।
তাই ভক্তিও নেই। বলতে পারেন,

এই অন্তর ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা কী টের পাই?
আত্মাকে।
আত্মা কী?
যা তোমার দেহের মধ্যে থাকে, কিন্তু দেহের নয়।
এই যে তুমি তোমার নিজের সাথে কথা বলো
যাকে বলো, বিবেক, চেতনা
তোমার ভেতরে থেকে
যে তোমাকে পথ দেখায়
সে।সেই আত্মা।
এই দেহটা তার, সে দেহের নয়।
সে দেহের নয়। সে কোথাকার?
সে অসীমের। অনন্তের।
এই নিখিল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যার থেকে সৃষ্টি
সেই পরমাত্মার।
তাই আত্মার স্বভাবকে টের পেলে
অসীমকে টের পাওয়া যাবে।
অসীম পরমাত্মার সাথে তার যোগ।
আত্মার স্বভাব কী?
যা পরমাত্মার স্বভাব।
পরমাত্মার স্বভাব কী?
নিয়ে নয় দিয়েই সে খুশি।
আত্মাও আসলে নিয়ে খুশি নয়। সে দিয়ে খুশি।
যে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের আমরা নিয়ে খুশি।দিয়ে নয়।
যখন অন্তর জেগে ওঠে, তখন আমরা দিয়ে খুশি হই।
ভালবাসার মতোন।
আমরা আর দেহে আটকে থাকি না।
নিজের দেহের বাইরে নিজেকে অনুভব করি।
সীমানা বাড়ে।
নেবো, কাড়বো, সঞ্চয় করবো এই হলো
সর্বগ্রাসী ক্ষুধার অহং ধর্ম।
মুঠোয় ধরতে চায় সবকিছু।
এই অহংটাকে ত্যাগ করলেই
আত্মা জেগে ওঠে।
আত্মা জেগে উঠলেই
পরমাত্মাকে টের পাই
নিজের ভেতরে।
তিনি আছেন-
আমার ভেতরেই।


মন্তব্য

Ahmad Musa এর ছবি

নিজেকে না জানতে পারলে,সত্যিই এ জীবন বৃথা। বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের অবস্থান ঠিক করতে হবে।
অনেক ভালো লিখেছেন,ধন্যবাদ আপনাকে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।