আমি কোন জ্ঞানী মানুষ নই। আমার জানার পরিধি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, আর অজানার দৌরাত্ম বহুদূর । জগতের খুটিনাটি, ছোট-বড়, সাধারন-অসাধারন, লৌকিক-অলৌকিক এমন বহু ঘটনাই আছে আমার অজানা । নিজের দেশের ইতিহাসটুকুও যে পুরোপুরি বিশুদ্ধরুপে জানি এ দাবীও করব না। এও দাবী করব না যে আমার জানার আগ্রহ অপরিসীম। তবে দাবী করব আমার শ্রদ্ধা জড়ানো ভালবাসা সে সকল জানা অজানা যোদ্ধাদের প্রতি যারা যুদ্ধের ময়দানে নেমে একবারও চিন্তা করেননি নিজেদের কথা, ভেবেছিলেন শুধু এক স্বাধীন ভূখন্ডের কথা; ভেবেছিলেন স্বাধীন দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা-আমাদের কথা। আমি প্রবলভাবে ঋনগ্রস্থ এক জাতির এক সাধারন মানুষ যে তার ঋণের ভার নিয়েই হয়তো কাটিয়ে যাবে পরবর্তী মূহুর্তগুলোর প্রতিটা ক্ষন।
আমার স্বল্প জ্ঞানের ক্ষুদ্র সংগ্রশালা থেকে আজ এমন একজন মানুষের কথা লিখছি যার কথা ইতিমধ্যে হয়তো অনেকেই জানেন তবে অবশ্যই সবাই নয়। এর মস্ত বড় উদাহারন হল যখন আমি আমার কিছু বন্ধুকে বললাম আমি অদারল্যন্দকে নিয়ে খানিকটা লেখালেখি করার চেষ্টা চালাচ্ছি তারা ফট করে জিজ্ঞেস করে বসলো “দোস্ত এইটা কি জিনিস?” খানিকখন চুপ থাকার পর বললাম “তোরা যে আমারই ফ্রেণ্ড আর আমার মতই আকাট মূর্খ তা কি পদে পদে প্রমান করা জরুরি?” আমি জানি সচলায়তন এমন একটি জায়গা যেখানে অসাধারন কিছু গুনীজনদের বাস যাদের বিশ্লেষনী ক্ষমতা অসাধারন,যাদের জ্ঞানভান্ডার প্রাচুর্যে ভরপুর। সবার সাথে মিলেই আবারও একবার তাই স্মরণ করতে চাই সেই মানুষটির কথা যিনি একজন বাঙ্গালী না হয়েও বাঙ্গালীর অস্তিত্বের লড়ায়ে পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন ,লাখো বাঙ্গালীর হৃদয় জয় করার পাশাপাশি জয় করে নিয়েছিলেন অসম সাহসিকতার নিদর্শন “বীর প্রতীক”। তিনি হলেন উইলিয়াম এ এস অদারল্যন্দ।
ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান, উইলিয়াম এ এস অদারল্যন্দ ১৯১৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর জন্মেছিলেন আমস্টার্ডাম।
১৯৩৪ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন বাটা শু কম্পানিতে একজন সাধারন কর্মচারী হিসেবে। দু’বছর পর তিনি সার্জেন্ট হিসেবে ডাচ রয়েল সিগনালসে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে দুর্ঘটনাবশত তিনি নাযিদের হাতে বন্দী হন এবং একসময় সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একজন গেরিলা কমান্ডো হিসেবে ডাচ আর্মির পক্ষ থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে এই অসীম সাহসি যোদ্ধা পুনঃরায় যোগ দেন বাটা শু কোম্পানীতে। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে অদারল্যন্দ প্রথম ঢাকায় আসেন বাটা কোম্পানীর প্রোডাকশান ম্যানেজার হিসেবে এবং কয়েক মাসের মাঝে তিনি কোম্পানী ম্যানেজার পদে উন্নিত হন। এখানে ফিরে এসে তিনি যেন ফেলে আসা পুরনো স্মৃতির মানসপটে দেখতে পান নতুন যুদ্ধের ছায়া, উপলব্ধি করতে পারেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারন মানুষের উপর নেমে আসা পৈশাচিক বর্বরতার কষাঘাত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ঐ মূহুর্তে প্রয়োজন ছিল সেই ভয়াবহতার ছবি পৃথিবীর কাছে তুলে ধরার। একজন উচ্চপদস্থ বিদেশী নাগরিক হিসেবে তিনি সহজেই প্রবেশাধিকার পেতেন পাক আর্মি হেডকোয়ার্টারে, এমনকি অনেক গুরুত্বপূর্ন সভাতেও যা ক্যান্টনমেন্টে সংগঠিত হত, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল জেনারেল টিক্কা খান এবং নিয়াজীর সাথে। তিনি বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে চক্রান্তকারী পাকসেনাদের সুক্ষাতিসূক্ষ তথ্য মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌছে দিতেন অবলীলায় সকল বিপত্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।তার ক্যামেরায় তুলে ধরতেন বীভৎষতার জ্বলন্ত স্বরুপ সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। এই প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন “I recollected and resumed in myself the experiences of my youth in Europe, and I felt that I should get the world informed of what was happening in Bangladesh”
যেহেতু অদারল্যন্দ নিজে একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন তাই ১৯৭১ এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি গোপনে তরুন যোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং দিতে শুরু করলেন টঙ্গী এলাকায়, এমনকি তার কর্মস্থল বাটা শু কোম্পানীর ফ্যাক্টরিতেও। তিনি তার পরিবারকে বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যেন তিনি তার আবাসস্থলকে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প এবং অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। মুক্তিবাহিনীকে শুধু মানসিক ভাবেই নয় তিনি তাদের সাহায্য করেছিলেন আর্থিক ভাবেও ।
এই বিশাল হৃদয়ের মানুষটি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাকে বদলি হয়ে চলে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়া। তার পরবর্তী জীবন কেটে যায় সেখানেয়। ২০০১ সালের ১৮ই মে তিনি ৮৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মহান ভূমিকা রাখার তরে তাকে শেষ বিদায় কালে লাল সবুজ রঙ্গে জড়ানো ভালবাসায় আবৃত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা
এই ইতিহাসটুকু অনেকের জানা...বহু বছর ধরে... বহুজন বলে এসেছে......বলছে......বলে যাবে। যতদিন পৃথিবী আছে ততদিনই বাংলাদেশ আছে আর ঠিক ততদিন এসব বীর যোদ্ধাদের ইতিহাস অটুট থাকবে।ত্রিশ লাখ শহীদদের পাশাপাশি আজ অদারল্যন্দও নিশ্চয় সেই অচিনপুর থেকে আমাদের দেখছেন...আমাদের ব্যর্থতায় নিশ্চয় আহত হচ্ছেন...আমাদের সফলতায় নিশ্চয় আনন্দে মিটিমিটি হাসছেন। জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত যিনি বাংলাদেশকে ভালবেসে গেছেন মৃত্যুর পর কিভাবে সেই মায়ার বাঁধন কাটাবেন? তার শেষজীবনে তাইতো তিনি বার বার বলে গেছেন “বাংলাদেশ মন আমার। Maintain this flow of emotion for the generation to come".
আজও প্রতিধবনিত হয়...... “ Maintain this flow of emotion for the generation to come".
আমার লেখাটা বড্ড বেশী এলোমেলো কারন আমি লেখক নই, আমার আর লেখালেখির সহবস্থান কখনই হয়নি।তাতে কি?আজ আবারো আমার এই এলোমেলো লেখার মধ্যে দিয়েই না হয় মুক্তিযোদ্ধা অরল্যন্দকে আরো একবার শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করা যাক।
গুরু তোমাদের জানাই অযুত নিযুত সহস্র কোটিবার সালাম...............
মন্তব্য
আমি ও জানতাম না। প্রথম জেনেছিলাম হাসান মোরশেদের পোস্ট থেকে। কত কিছুই যে জানি না তা নিজেও জানি না। পোস্ট ভালো লেগেছে।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
Ouderland
দৃশা আপনাকে ধন্যবাদ ।
আর অডারল্যান্ডের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
কে বললো আপনি লিখতে জানেন না? চমৎকার লিখেছেন তো! বাংলাদেশে জন্মে, বাংলাদেশের আলোবাতাসে পুষ্ট হয়েও অনেকে অডারল্যান্ডের মানসিকতা ধারণ করতে পারেনি। আজও।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
প্রচন্ড আবেগ - অনুভব করলাম।
অপরিসীম শ্রদ্ধা রইলো বীর সেনানীর প্রতি।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
অডারল্যান্ড নিয়ে প্রথম পড়েছিলাম আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কলামে।
দৃশাকে ধন্যবাদ স্মরণ-পোস্টের জন্য।
দৃশা,
একদম ভুল কথা। আপনি খুবই সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
উইলিয়াম এ এস অদারল্যন্দকে লাল সালাম!
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ঝরাপাতা আমি মোরশেদ ভাইয়ের পোস্টখানা পড়ি নাই...নিশ্চয় আমার মত আপঝাপ লিখে নাই...আপনি পারলে একটু লিংকটা দিয়েন।পড়তে চরম ভাবে ইচ্ছুক।
আমারে কেউ প্লিজ ধন্যবাদ দিয়েন না...আই রিয়েলি ডোন্ট ডিজার্ভ দ্যাট।
আমার সাথে আপনারা যে শরিক হয়েছেন এরজন্য বরং আপনাদের ধন্যবাদ।
দৃশা
নতুন মন্তব্য করুন