আগের পর্বে লিখেছিলাম---পরমানুর ঘরে উঁকি দিতে হলে বা সেটার ঘরে সিঁদ কাটতে হলে আমাদের দরকার বিশেষ অস্ত্র----আর সেই অস্ত্র হল Particle Accelerator।
নাম শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এইটা এমন এক যন্ত্র যেটা ইলেক্ট্রন বা প্রোটন কে ত্বরন দেয়। ত্বরন বা Acceleration জিনিসটাই বা কি? ধরুন, আপনি এক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছেন। আপনি দেখবেন যে আপনার নামার গতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। একটা সময় প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নামবেন। এই যে ধীরে ধীরে ছুট লাগানো---একেই আমরা বলি ত্বরন। আপনি যত দীর্ঘ সময় ধরে বা যত উঁচু পাহাড় থেকে নামবেন---আপনার 'অধঃপতনের' বেগ ততই বাড়বে(অবশ্য এর মধ্যে যদি হুমড়ি খেয়ে না পড়েন)।
আমরা আগেই জেনেছি যে পরমানু ভাঙ্গতে দরকার ক্ষিপ্র গতির মৌলিক কণিকা। যত জোরে আমরা তাকে ছোটাব---তত গভীরে সে প্রবেশ করবে। এখন দুইটা সমস্যা নিয়ে একটু মাথা চুলকাতে হবে।
এক) ইলাক্ট্রন আর প্রোটন তো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে থাবড়া দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে তারপর ছুড়ে ফেলা যাবে। এই কণিকা গুলো এত্ত ছোট যে এদেরকে আপনার ইচ্ছে মত কোন এক দিকে ছোটাবেন কি করে??
দুই) আমাদের তো কেবল একটা বা দুইটা ইলেক্ট্রন পাঠিয়ে সারা দিন বসে থাকলে চলবে না। আমরা যত বেশি কণিকা গুলো একসাথে পাঠাতে পারব--তত ভাল পরমানু-র 'ফটূক' তুলতে পারব। অনেকটা আগের পর্বে বলা টর্চের গল্পে--- কম জোরী আর খুব জোরী টর্চের কথা ভাবতে পারেন। কম জোরী টর্চের আলোয় দেখা যাবে ঝাপ্সা---আর টাটকা নতুন ব্যাটারী ভরে দেখলে দেখবেন--কি তার রোশনাই!
তো বেশি বেশি করে কণিকা পাঠাব কি করে?
প্রথমেই দেখা যাক এই পিচ্চি গুলোকে কি করে 'একসাথে' কাজ করানো যায়। এমনিতে এরা বেশ 'বেয়াড়া' তার উপর বেজায় ছোট। কাজেই এদের কানে ধরে কোন কাজ করানো মুশকিল। কিন্তু যত মুশকিল তত আসান। বিজ্ঞানীরা ঠিক খুঁজে পেতে এদের 'কান' বের করে ফেলেছেন---সেই সাথে বের করেছেন কি করে এদের 'কানমলা' দিয়ে কাজ করানো যাবে।
আগের পর্বে জেনেছি যে ইলেক্ট্রন আর প্রোটন দু'টোরই চার্জ রয়েছে---পজিটিভ আর নেগেটিভ। এইটাই হল এদের 'কান'। আমরা বাইরে থেকে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরী এদের কানটা ধরে টানাটানি করতে পারি। যাদেরই চার্জ থাকে তাদের আসলে কোন বিদ্যুত ক্ষেত্র বা চৌম্বক ক্ষেত্রের 'টানে' সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। এই ব্যাপারটা উনিশ শতকের শুরুর দিকে ষোল বছরের এক ছেলে আবিষ্কার করে ফেলছিল।
যাক গে। এখন কনা গুলোকে টানাটানির একটা উপায় তো পাওয়া গেল। কিন্তু টান বললেই তো টানা যায় না। সব কিছুর একটা কায়দা আছে। কনা গুলোকে টানার কায়দা কি??
প্রথমে আমাদের কিছু কনা 'যোগাড়' করতে হবে, তারপর ঐ কনার চার্জের প্রকৃতি খেয়ালে রেখে আমাদের বিদ্যুত ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।অর্থাত যদি ইলেক্ট্রন হয় এবং আমরা যদি এদের কাছে টানতে চাই, তবে ব্যবহার করতে হবে পজিটিভ বিদ্যুত ক্ষেত্র আর যদি এদের কে দাবড়ে দিয়ে ভাগাতে চাই তাহলে ব্যবহার করতে হবে নেগেটিভ বিদ্যুত ক্ষেত্র।কেন? কারন হচ্ছে ইলেক্ট্রন/প্রোটনদের মাঝে 'স্বজাতি বিদ্বেষ' ভয়াবহ। এক ইলেক্ট্রন আরেক ইলেক্ট্রন কে সহ্য করতে পারে না। প্রোটন ও তাই। কিন্তু ইলেক্ট্রন আর প্রোটন দু জনে দুজনকে বেশ পছন্দ করে।
এই ফাকে বলে দেই ছোট্ট করে--বিদ্যুত ক্ষেত্র জিনিসটা কি। ঐ 'ক্ষেত্র'-'টেত্র' শুনলে পরে মাথা খানিক ঝিম ঝিম করে। আসলে এটা কিছুই না। আপনি টর্চের একটা ব্যাটারী খুলে নিয়ে তার দুই প্রান্তে দুটো তার লাগিয়ে দিন। তার গুলোর মুক্তপ্রান্ত দু'টো পরস্পরের কাছে নিয়ে আসুন। এই যে জিনিসটা তৈরী হল(যেটা দেখে আপনি কিছু বুঝছেন না---ভাবছেন, কিস্যুই তো দেহি না) সেইটা হল বিদ্যুত ক্ষেত্র। আপনি ঠিকই ধরেছেন---খালি চোখে এই সব 'ক্ষেত্র' দেখা যায় না। এরা হল ভূতের মত। তবে গল্পের ভূতের মত ভুয়া না। এরা যে আছে সেইটা বুঝিয়ে দেবার মত যথেষ্ট অদ্ভুতুড়ে কান্ড-কারখানা এরা করতে পারে। উদাহরন স্বরুপ আপনার তার দূটোর মুক্ত প্রান্তের মাঝে যদি একটা ছোট্ট বাল্ব বসিয়ে দেন----- কি মানিক?? এক্কেবারে ফকফকা...!!!
বিদ্যুত এর মত চুম্বক ব্যবহার করে আমরা চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি। যখন বিদ্যুত আর চুম্বক ক্ষেত্র 'একসাথে' ব্যবহার করা হয় তখন বেশ চমৎকার একটা ঘটনা ঘটে।ধরুন লাইন বেধে ইলেক্ট্রন/প্রোটনের দল
দৌড়ে যাচ্ছে কোথাও। কাছে পিঠে একটা চুম্বক বসিয়ে দিন। দেখবেন কি চমৎকার করে তাদের পথ বেকে গিয়েছে---অনেকটা রামধনুর মত বাঁকা (অবশ্য রঙ ছাড়া)।
কাজেই সহজ ভাবে বলতে গেলে পরপর বিদ্যুত আর চুম্বক ক্ষেত্র সাজিয়ে আমরা এই মৌলিক কনাগুলোকে সহজেই টানা হেচড়া করতে পারি, ইচ্ছে মত বাকিয়ে দিতে পারি, চাইলে জোরে শোরে টেনে (=বিদ্যুৎ ক্ষেত্র শক্তিশালী করে) তাদের গতিবেগ বাড়িয়ে দিতে পারি।
এই রকম 'জোশ' জিনিস আপনার নিজের একটা থাকলে বেশ হত তাই না? আপনার ভাগ্য আজ বেজায় ভাল। আপনি নিজের অজান্তেই একটি ছোট খাট particle accelerator এর মালিক!!! কি বিশ্বাস হয় না বুঝি? না হলে, আপনার ঘরের টিভিটা ছাড়ুন। এইটেই আপনার একেবারে নিজস্ব accelerator। আমরা এতক্ষন যা যা বকবক করলাম একেবারে সেই ঘটনা টিভির ভেতর ঘটে চলেছে। এ গল্প আরেক দিনের জন্য তোলা রইল।
LHC এই রকম accelerator ব্যবহার করছে। কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী এই accelerator বা ত্বরানায়ক তো আর আমাদের ঘরের টিভির মত হলে চলবে না। সাত মন তেল না পুড়লে, রাধাও নাচবে না।
এই রাধা কে 'নাচাতে' তাই আমাদের এত্ত ব্যয় বহুল আয়োজন।
এই ফাকে ছোট্ট করে বলে দিই---- আদতে দুই ধরনের ত্বরনায়ক আছে----একটা হল রৈখিক আকৃতির আর আরেকটা হল গোলাকার। রৈখিক আকৃতিরটা আমাদের টিভির ভেতরের মতই কাজ করে। একটা যন্ত্র ইলেক্ট্রন/প্রোটন তৈরি করে আর তারপর লম্বা এক চোঙ্গের মধ্যে দিয়ে পর পর সাজানো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সহায়তায় হিড় হিড় করে এদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। বেচারা কণা গুলোর ভীষন জোরে না ছুটে আর উপায় থাকে না। এইগুলোকে বলে Linear Accelerator(Linac)। আমাদের LHC এর ভেতরেও আছে এসব।
তা বেশ। কিন্তু গোলাকারটা কি দরকার? জিনিসটা না প্যাঁচালেই কি চলছিল না? আসলে সমস্যা হল এই বেকুব কনা গুলোকে আমাদের আরাধ্য গতিতে গতিময় করতে হলে যে LINAC দরকার পড়ত সেটা হতো বিশালকায়। এত বিশাল জায়গায়ই বা পাবেন কোথায় আর এত্ত খরচই বা কে দেবে?
এর মাঝে দেখা গেল, কনা গুলোর পথ যেহেতু চুম্বক দিয়ে বাঁকানো যায় এবং গোলাকার পথে ঘুরতে থাকলে কনা গুলোর 'মাথা-পাগলা' হয়ে যায়---তারা বেদম জোরে দৌড়তে থাকে----এই বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তৈরী করে ফেলা হল গোলাকার ত্বরনায়ক যাদের আবার একটা বাহারী নাম আছে--Synchotron!
Synchotron এসে পড়ায় আমাদের লাভ হল এই যে লম্বা লম্বা LINAC তৈরী না করে ছোট ছোট কিছু Synchotron দিয়ে অবলীলায় আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল করা গেল।অল্পের মাঝে ভাল গতিবেগ সম্পন্ন
কনা পাওয়া গেল।
কিন্তু প্রকৃতিতে গিট্টু জিনিসটা খুব কমন। গোলাকার গুলোর মাঝে দেখা গেল কিছু ঝামেলা আছে। দেখা গেল 'অনির্দিষ্ট' ভাবে এদের গতিবেগ বাড়ানো যায় না। চার্জ গুলো গোলাকার পথে ঘুরতে থাকলে তারা
অল্প অল্প করে শক্তি হারাতে থাকে। গতিবেগ যত বাড়বে বেচারীদের শক্তিক্ষয়ও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। তাই অনেক মাথা চুলকে বিজ্ঞানীরা দুটোই---LINAC আর Synchotron---- রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
LHC তে আসলে এই ঘটনাই ঘটছে। প্রথমে ছোট্ট একটা LINAC কিছু গতিশীল প্রোটন সাপ্লাই দিচ্ছে। ঐগুলো আবার সাথে সাথে ঢূকে পড়ছে ছোট্ট একটা synchotron এ, সেখান থেকে আরেকটু বড় ব্যাসার্ধের synchotron এরকম করে সবশেষে আমাদের LHC এর
মুল ২৭ কিমি পরিধির চক্করে এসে হাজির হয়। এই সময়
প্রোটন গুলো ছুটছে প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি এক গতিবেগে। যদি খুব নিখুত ভাবে বলতে চাই---- প্রায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন প্রোটন ঘুরতে থাকবে LHC এর ভেতরে, আলোর বেগের ৯৯.৯৯% গতিবেগে। ঐ ২৭ কিমি পরিধির বিশাল রিঙ্গের ভেতর প্রতি সেকেন্ডে ১১, ২৪৫ বার চক্কর খেতে এক সময় মুখোমুখি সংঘর্ষ!
গোটা ব্যাপারটার একটা চমৎকার সিমুলেশান দেখতে পারেন এইখানে।
সে সৃষ্টিছাড়া মুহুর্তের বিবরন আসছে আমাদের পঞ্চম তথা শেষ কিস্তিতে।
মন্তব্য
জমজমাট কোন থ্রিলার পড়ছি যেন।
অনিকেত ভাই, তাড়াতাড়ি চাই!
অপেক্ষা করতে রাজি নাই!!!!
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
হা হা হা---নতুন পর্ব দিয়েছি। দেখ কেমন হল।
বেশ সহজবোধ্য ভাষায় বলছেন অনিকেত ভাই। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
থ্যাঙ্কু বস। পরের পর্ব দিয়েছি। দেখ কেমন লাগে।
বিষয়টি সম্বন্ধে আমার মনোভাব যাই হোক না কেন, লেখা কিন্তু অনবদ্য। ছোটবেলাতে পড়া আব্দুল্লাহ আল মূতীর লেখার কথা আমাকে মনে করিয়ে দেয়।
অ-নে-ক ধন্যবাদ এত্ত চমৎকার মন্তব্যের জন্য।
আব্দুল্লাহ-আল-মুতী'র প্রসঙ্গ এনে লজ্জায় ফেলে দিলেন ভাই। উনি আমার ছেলে বেলার হিরো!
ভাল থাকবেন।
দুর্দান্ত!
_________________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
থ্যাঙ্কু বস
নতুন মন্তব্য করুন