মন্তব্যের মন্তাজ-১০

অনিকেত এর ছবি
লিখেছেন অনিকেত (তারিখ: বুধ, ০৭/০১/২০০৯ - ৪:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতিদিন সকালে উঠে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
এক কাপ চা হাতে নিয়ে যখন টিভির সামনে বসি---চোখের সামনে ভীড় করে কিছু দৃশ্য। অনেক দিন ধরে দেখা, অনেক দিন ধরে চেনা দৃশ্য। তারপরও প্রতিটি বার, প্রথম বারের মত তীব্রতা নিয়ে আঘাত করে।

সি এন এন -এর সকালের খবর। এক মুখ হাসি নিয়ে সংবাদ পাঠিকা জানাচ্ছেন---- আজ আমেরিকার কোথায় ঝড় আশংকা করছেন, কখন ওবামার মন্ত্রী সভা শপথ নেবে, তেলের দাম আবার বাড়বে কি না, দিন কে দিন ব্যায়াম না করে শুধু বটিকা গিলে কি স্লীম হওয়া যাবে---এমনিতর "জন গুরুত্ব" পূর্ণ সংবাদ। তার ফাকে হালকা ঠাট্টা মশকরা চলে। একজন নতুন একটা সোয়েটার পরে এসেছেন--সেই নিয়ে বিশ্রম্ভালাপ। এক ফাঁকে দেখি----দর্শকদের পাঠানো ভিডিও ক্লিপিং দেখানো হচ্ছে। দেখি এক মহিলার ভিডিও ক্যামেরায় ধরা কিউবান রিফিউজিদের উদ্ধারের দৃশ্য। এক বিলাস-বহুল প্রমোদ তরী থেকে তোলা। সামান্য একটা ডিঙ্গির মত কিছু একটা চেপে কিছু কিউবান অথই সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রমোদ তরীর কিছু সজ্জন নাবিক তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন। ডেকে দাঁড়িয়ে প্রাচূর্য্যে ডুবে থাকা কিছু মানুষ দেখছে অথই সাগরে ডুবতে বসা কিছু মানুষের প্রান বাঁচানোর সংগ্রাম। করতালি দিয়ে স্বাগত জানানোর হচ্ছে---না কিউবানদের নয়, সেই কতিপয় নাবিকদের।

আর ঠিক সেই মহূর্তে গাজায় ঝাঁঝরা হচ্ছে শত শত প্রান।

নাহ আমেরিকায় এগুলো কোন খবর নয়।

গতকাল দেখছিলাম----এক আমেরিকা প্রবাসী প্যালেস্টাইনির সাক্ষাৎকার। অত্যন্ত সতর্ক তাঁর প্রতিক্রিয়া। এর মাঝে হঠাৎ করে বোধহয় দেশ মাতৃকা টুঁটি চেপে ধরায় মুখ ফসকে বলে ফেলেন, ইজরায়েল এর নারকীয় ধ্বংস যজ্ঞের কথা। সাথে সাথেই সদা-সতর্ক সি এন এন -এর নিউজ কাস্টার ভুল ধরিয়ে দেন----নাহ, শুধু ইজরায়েল নয়, হামাসের লোকজনও কিন্তু----- লোকটির সম্বিৎ ফেরে। মাথা নেড়ে বলতে থাকে, হ্যা, হ্যা,আসলে দুই পক্ষই প্রচুর তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। সি এন এন-এর নিউজ কাস্টার এর মুখের বিরাগ ভাব তাতেও যায় না।

আর এই দিকে ইজরায়েলের 'তুখোড়' বোমারুদের আঘাতে উড়ে যায় গাজাতে জাতিসঙ্ঘের নিজের পরিচালিত একটি স্কুল ঘর---৪০-টি তরতাজা প্রান সাথে নিয়ে।

এইখানে একটি ভিডিও লিঙ্ক দিলাম। ইজরায়েলের কিছু সৈন্য গুলি চালাচ্ছে কিছু নিরস্ত্র প্যালেস্টাইনি শিশু-কিশোরের দঙ্গলের উপর। তাদের বুলেটের বিরুদ্ধে আছে আদিম যুগের কিছু অস্ত্র--পাথর। পাথর এর বিপরীতে বুলেট(মতান্তরে রাবার বুলেট)। একই জায়গায় হাজার বছর তফাতে দাঁড়ানো দুইটি যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার। পুলকিত হবার মতই।

তারচেয়েও আশ্চর্যজনক হল---এদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক প্যালেস্টাইনি তরুনী। নিরস্ত্র, নির্ভীক। খালি হাতে আড়াল করার চেষ্টা করছে বুলেট। না, সে সুপারম্যান নয়। বুলেটের বিরদ্ধে সে দাঁড়িয়েছে---এক সহজ প্রশ্ন নিয়ে।

-এদের গুলি করছ কেন? দেখতে পাচ্ছ না এরা কেবল কিছু শিশু?

বার দুয়েক সৈন্যটি গুলি করার চেষ্টা চালায়। প্রতিটা বার মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাগে গজ গজ করতে করতে সৈন্যটি জানিয়েছে--ওরা মোটেও শিশু-কিশোরের দল নয় (যেন শিশু কিশোর না হলে গুলি করা জায়েজ)।

এই দৃশ্য গুলো খুব চেনা।
এই আঘাত গুলোও খুব চেনা।
আর--এই প্রতিবাদটুকুও খুব চেনা।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

আমি জানি ঈশ্বর শালা নিতান্তই "ইজারায়েলি"।

অনিকেত এর ছবি

হা হা হা

ঈশ্বর আসলে ঘন ঘন পার্টি বদলায়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ইহুদীদের জিজ্ঞেস করলেই শুনতে পেতেন সম্পুর্ণ ভিন্ন উত্তর----ঈশ্বর আসলে জার্মান

তারও আগে ঈশ্বর ছিলেন, রোমান, গ্রীক ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঈশ্বর সব সময় সবলের পক্ষে থেকেছেন---সেইটাই তার জন্যে সহজ ছিল, এখনও তাই আছে--ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।

বর্ণচোরা এর ছবি

মানিক বন্দোপাধ্যায় 'পদ্মা নদীর মাঝি'-তে বলেছিলেন- "ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্র পল্লীতে..."।
...বর্ণচোরা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

কিচ্ছু বলার নাই। এবারে খুব সচেতন ভাবেই যাবতীয় সংবাদমাধ্যম থেকে দূরে আছি। আর ভাল লাগে না ক্রুব্ধ হয়ে শক্তিক্ষয় করতে।

অনিকেত এর ছবি

মানছি তোমার কথা---আসলেই অকারন শক্তিক্ষয়
কিন্তু এর শেষটা কোথায়?

হিমু এর ছবি

কয়েক হাজার বছর আগে ইজরায়েলিদের পূর্বপুরুষ দাভিদ প্যালেস্টাইনি দানব গলাইয়াথকে সামান্য পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছিলো। এই গল্প তাদের পবিত্র গ্রন্থে লেখা। তারা হয়তো সময়ে সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আবৃত্তিও করে এই গল্প। কিন্তু দাভিদের সন্তানেরা নিজেরাই এক একটি গলাইয়াথে রূপ নিয়েছে। তারা অতীত থেকে শিক্ষা নিক, তাদের পতন ঘটানোর জন্যেও দাভিদরা জন্ম নেবে প্যালেস্টাইনি শিবিরে। এ শুধু সময়ের ব্যাপার।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত এর ছবি

এই শিক্ষাটা আসলে কেউই নেয় না। পাশার দান উল্টে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অনিকেত এর ছবি

এইটে আসলেই বেশ অদ্ভুত লাগে ভাবতে।

আমার যদি ঘর পোড়ে, তাহলে আমার সহানুভুতি, আমার সাহায্য, আমার আনুকুল্য--সবই থাকবে আরেক ঘর পোড়ার জন্যে।

যে জাতি আউশভিতসের মত বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তারা নিজেরা কি করে এত নির্মম স্বার্থপর অন্ধ হয়? কেন তারা দেখতে পায় না, যে এখন তারা যা করছে তা কোন অংশেই সেই কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পের ভয়াবহতার চেয়ে কম না----

হয়ত এক সময়ের পাশবিকতার শিকার এখন নিজেই পিশাচ হয়েছে----

ধুসর গোধূলি এর ছবি
অনিকেত এর ছবি

-জানি, ধু গো। আমারো মন খারাপ---

রানা মেহের এর ছবি

বিবিসি দেখছিলাম।
ইসরায়েলী মুখপত্র বললেন তারা লড়ছেন আত্মরক্ষার জন্য।
তিনি আরো বললেন বিবিসি অবস্থাকে 'অতিরন্জন' করছে।

ইসরাইলের মৃত চার সৈনিকের শেষকৃত্য দেখানো হলো।
কাঁদছিল সবাই লাশ মাটিতে নামানোর সময়।
তারা শুধু গাজার কান্না শুনতে পায়না
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অনিকেত এর ছবি

--তারা শুধু গাজার কান্না শুনতে পায়না

সেইটাই

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কয়টা দিন খুব খারাপ যাচ্ছে। আজ ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় মৃত একটি শিশুর মাথা বেরিয়ে আছে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে। এতটা খারাপ অনেকদিন লাগেনি। প্রতিবাদের উপায় নেই, অসহায় অবস্থা আমাদের। সত্যিই মানবতা আজ কোথায়। রাস্তার কুকুরকে মারলেও এরা পুলিশে ফোন করে অভিযোগ দেয়, অথচ কোথায় আজ সেই সভ্যতা!

অনিকেত এর ছবি

সভ্যতা বলুন, ইতিহাস বলুন--- সব সময় শক্তিমানের পেছনে থেকেছে

আমরা সকলে হয়ত প্রতিবাদ জানাব, হয়ত এক দলা থুথু ছুঁড়ে দেব তাদের মুখে--
কিন্তু দিনের শেষে শ্মশানে যে লাশ পুড়বে, সে তো আমাদেরই লাশ----

অনিকেত এর ছবি

এই ভিডিও-টার মেয়েটা কে দেখে আসলে আমার মনে পড়ল ১৯৮৯ এর তিয়েনামেন স্কয়ারের সেই নির্ভীক লোকটার কথা---যে তার বাজারের থলি হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিল ট্যাঙ্কের সামনে। একা সেই লোক আর তার মুখোমুখি চার চারটে ট্যাঙ্ক।
ঠিক এই ভিডিওটার 'বিব্রত' ইজরায়েলি সেনাটার মতই অবস্থা ছিল সে ট্যাঙ্ক গুলোর---নানা ভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চেয়েছে কিন্ত প্রতিটি বার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে থলে হাতে সেই লোক----

একদিকে শত শত নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রী আর আরেকদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সরকারের
পেটোয়া বাহিনী----তাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই নির্ভীক লোকটি

আমাদের যদি মন খারাপের, মন ভাঙ্গার একশটা কারনও থাকে, তারপরও আমাদের নিজেদের মনুষ্যত্বের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার কোন কারন নেই

এই সব Tank man রাই আমাদের কালে কালে জানিয়ে দেয়, অসুরের যেমন মৃত্যু নেই---ঠিক তেমনি মৃত্যুহীন এরা। যতবার অস্ত্র উঠবে কোন নিরস্ত্র প্রানের দিকে---ততবার এদের সামনে দাঁড়াবে এক একটি Tank man!

পান্থ রহমান রেজা [অতিথি] এর ছবি

ধিক্কার ইসরায়েলকে।

সবজান্তা এর ছবি

এই বাংলাদেশে বসে কি আমাদের কিছুই করার নেই ?


অলমিতি বিস্তারেণ

বিপ্রতীপ এর ছবি

লাশ দেখতে দেখতে আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, তবু ঘাতকেরা ক্লান্ত হচ্ছে না। থামছে না মানুষ মারার আয়োজন। সত্যি আর ভালো লাগে না আমাদের এই অর্থহীন নিরব প্রতিবাদ...

ভিডিও'র প্যালেস্টাইনি তরুনীর সাহসকে স্যালুট জানিয়ে গেলাম...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...

নিবিড় এর ছবি

তারা শুধু গাজার কান্না শুনতে পায়না........................ আসলেই তাই ।
*********************************************************
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

তুলিরেখা এর ছবি

কিছু বলতে পারিনা, শুধু আত্মগ্লানি হয়। মনে হয় সবকিছু ছেড়ে চলে যাই। দুনিয়াটা এত ভয়ানক! মানুষের সভ্যতার আড়ালে হিংস্র বর্বরতা। অথচ আমরা নাকি জ্ঞানী মানুষ-হোমো স্যাপিয়েন্স!!!!! পশুপাখিরা ও আমাদের থেকে উন্নত, ওরা জীবনের প্রয়োজন ছাড়া অকারণে হত্যা করে না। আর আমরা? জ্ঞানবিজ্ঞান দিয়ে মারণাস্ত্র বানিয়ে মানুষ মারি হাজারে হাজারে লাখে লাখে। আমরাই আসল ঘৃণ্য!!!!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।