গত ২৪ শে অক্টোবর মান্না দে আমাদের এই ধরাধাম ছেড়ে সুরলোকের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। সুদীর্ঘ চুরানব্বই বছরের জীবন তাঁর। সক্রিয় সংগীত জীবনও বেশ দীর্ঘ বলতে হবে--- সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিক থেকে শুরু করে প্রায় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সঙ্গীতের সাথেই জড়িয়ে ছিলেন। এই দশকের পর দশক পেরুনো সময়ে মান্না দে গেয়েছেন অজস্র গান, সুর দিয়েছেন, করেছেন সঙ্গীত পরিচালনাও। চার হাজারের মত গান, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ আর দাদা সাহেব ফালকের মত পুরষ্কার তার অর্জনের ঝুলিতে রয়ে গেলেও মান্না দে-র সবচাইতে বড় অর্জন খুব সম্ভবত তার নিজের ভাষাভাষী লোকজনের কাছেই।
উত্তর কোলকাতার মদন ঘোষ লেনে জীবনের শুরু। আসল নাম প্রবোধচন্দ্র দে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে ফিল্মের বেছে নেয়া নাম 'মান্না দে'-র আড়ালে। বাসা থেকে চাপ ছিল ওকালতিতে অর্থাৎ 'উকিল' হবার জন্যে--- মান্না দে তার বদলে 'কোকিল' হবার পেশাই বেছে নিয়েছিলেন। ঘরের আপনজন কাকাবাবু কৃষ্ণচন্দ্র দে তখন ফিল্মী দুনিয়ার চেনা-জানা সুরকার। তার হাত ধরেই হিন্দী ফিল্মের জগতে মান্না দে-র পদার্পণ। 'রামরাজ্য' ছবিতে তার প্রথম প্লেব্যাক আর পরে 'অমর ভূপালী' ছবিতে পেলেন সবচেয়ে বড় ব্রেক। এরপরে তাকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। ভাবগম্ভীর গান, বিরহী গান, হাসির গান---যেকোন ধরনের গানেই মান্না দে সমান রকম সাবলীল ছিলেন---এইটে একটা বিশাল গুন যা পরবর্তীতে কিশোর কুমার ছাড়া আর কেউই তেমন সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।
১৯৫৩ সালে অবাঙ্গালি সুলোচনাকে বিয়ে করেন। ঠিক সেই বছরেই বাংলায় বেরোয় তার প্রথম বেসিক রেকর্ড--গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথা আর তার নিজের সুরে গাওয়া--'কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো' এবং 'হায় হায় গো, রাত যায় গো'। সেই প্রাথমিক সাফল্যের পর গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার,নচিকেতা ঘোষ, পুলক বন্দোপাধ্যায়--বাংলা সমসাময়িক সঙ্গীত বিশ্বের সকল জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের সাথে চুটিয়ে কাজ করেছেন মান্না দে। আর তারই ফল হিসেবে এসেছে একের পর এক কালোত্তীর্ণ সব গানঃ
আমি তার ঠিকানা রাখিনি .....
ললিতা গো ওকে আজ .....
সুন্দরী গো দোহাই দোহাই ....
আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে .....
যদি কাগজে লেখো নাম....
এই কুলে আমি আর ঐ কুলে তুমি ....
সবাই তো সুখী হতে চায় .....
সে আমার ছোট বোন ....
আমি যামিনী, তুমি শশী হে ...
কফিহাউজের সেই আড্ডাটা ....
গানের পর গান! বাংলা গানের জগতে একজন গায়কের একসাথে এত জনপ্রিয় গান আর কারো আছে কি না আমি নিশ্চিত নই। হয়ত কিশোর কুমার আর হেমন্ত কাছাকাছি আসবেন।
মান্না দে-র সাথে আমার পরিচয় ছোট বেলাতেই। 'সে আমার ছোটবোন' এই গানটা ছিল তার গাওয়া প্রথম গান যেটা আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। আমার নিজের কোন ছোট বোন নেই। বড় বোন আছে একটা। 'ছোটবোন' গানটার ছোটবোনের মত আবার সেও গান গায়। সে গানের কাহিনীর সাথে আরো অস্বস্তিকর মিল বাড়ল যখন খেয়াল করলাম--আমিও ওর সাথে গানে সঙ্গত করি, তবলা বাজাই। বড়বোনের সাথে তখন আমার সম্পর্ক মধুর নয়। মাঝেমাঝেই মার-পিট লেগে যায়, ঝগড়া-ঝাঁটি মন কষাকষি হয়। কিন্তু এই গানটা বাজলেই আমার মনটা দ্রবীভূত হয়---শুধু তাই না, মাঝে মাঝে বোনটার জন্যে উৎকন্ঠা বোধ করি। এই অনুভূতিটা আমার জন্যে একেবারে নতুন! তার ঠান্ডা লাগলেই, কাশি হলেই আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই (এমনকি এখনো!)। মান্না দে-র জন্যে প্রথমবারের মত ছোটবেলায় আমার জানতে শেখা---বোন শুধু ঝগড়াঝাঁটি করার জন্যে না, বোন শুধু বিকেল বেলা খেলা শেষে হাত ধরে বাড়ি ফেরার জন্যে না, বোন শুধু দুপুর বেলার হারমোনিয়ামের রীড টিপে টিপে গাওয়া ছোট্ট কোন মেয়ে না--- বোন আমার আত্মার আত্মীয়! তখন খুব ইচ্ছে হত, মান্না দে কে গিয়ে বলি বড়বোন নিয়ে একটা গান গাওয়ার জন্যে--একটা হাসি-খুশীর গান!
পরে মান্না দে-র আরো অনেক গান শুনেছি--কিন্তু কেন জানি মনে দাগ কাটেনি। যতটা কিশোর কুমার কেটেছিলেন। মান্না দে বোধহয় টের পেয়েছিলেন। তিনি অপেক্ষায় রইলেন---
তার পর আসল সেই সময়! সেই সময়--যখন সবাই প্রথম প্রেমে পড়ে, যখন সবাই নিজের হাতের মুঠোয় হৃদয়টা নিয়ে হাঁটে---যখন প্রথমবারের মত জানতে পারে এই পৃথিবীটা কত নিষ্ঠুর! বাঙ্গালির ছেলে জীবনে ছ্যাকা খায় নি প্রেমে পড়ে---এইটা যে কেউ ডাঁহা মিথ্যে কথা বলে ধরে নেবে। জন্ম-মৃত্যুর মত এটাও এক অমোঘ সত্য। সেই কঠিন সত্যের সাথে আমারো একদিন চেনাজানা হল---এতদিনের দিব্যি হাসিখুশি সহজ-সরল মনটা আমার ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে এক অপরূপ মেয়ে কোথায় জানি হারিয়ে গেল। ছ্যাঁকা খেলে কী করতে হয় সেইটা মোটামুটি আগেভাগেই পাড়ার কিছু বড়ভাইয়ের বদৌলতে জানা ছিল। আমি আর দেরী না করে সেইসব পথে অগ্রসর হলাম। বয়েস অল্প বলে দাঁড়ি রাখা অসম্ভব বলে 'নেক্সট বেস্ট থিং' হিসেবে করুণ মুখে মান্না দে-র বিরহী সব গান শোনা শুরু করলাম। এই প্রথম মান্না দে তার সকল ক্ষমতা নিয়ে হাজির হলেন। তার এক একেকটি গান আমার দুখী মনে সুখের প্রশান্তি না আনলেও কেন জানি মনে হতে লাগল, আর কেউ না বুঝুক এই লোকটা আমার দুঃখ বুঝতে পারছে!
সেই থেকে শুরু। তারপর যতবার প্রেমে পড়েছি--যতবার নিঠুর মেয়েরা এই হৃদয় ভেঙ্গে দিয়ে হাসিমুখে চলে গেছে, ততবার আমি নতমুখে ফিরে এসেছি ঘরের কোনে মান্না দে-র কাছে। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখেছেন, কানের কাছে এসে বলে গেছেন--'ক'ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে?'
যতদিন এই বাংলা রইবে, যতবার এই ভূখন্ডে কিশোররা যুবক হবে, যুবক হয়ে যুবতীর প্রেমে পড়বে আর হৃদয়ভাঙ্গার সাক্ষী হবে, ততদিন পর্যন্ত এই বাংলার বুক থেকে দুইজন মানুষের নাম কখনো মুছে ফেলা যাবে না---তাঁদের একজনের নাম মান্না দে--
মান্না দে-র সুর দিয়ে আমাদের হৃদয়ে তাঁর নাম লিখেছেন---এই নাম রয়ে যাবে চিরদিন!
আমার স্বল্পসাধ্যে মান্না'দের উদ্দেশ্যে জানিয়েছি এই অকিঞ্চিতকর শ্রদ্ধার্ঘ্যটুকু। আপনাদের ভাল লাগলে খুশি হব।
বরাবরের মত--যন্ত্রানুষঙ্গ আয়োজন পরিচালনা এবং কন্ঠঃ অনিকেত
মন্তব্য
বাহ্!
থ্যাঙ্কু সুমিমা'পু
শুভেচ্ছা নিরন্তর--
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কবি--
শুভেচ্ছা জেনো--
একজন মান্না দে আরেক জন কে? কিশোর কুমার? নাকি হেমন্ত? নাকি অন্য কেউ?
কতবার ভেঙ্গেছে হৃদয় এটাও বর্ণনা সহ জাতি (সচল পরিবার) জানতে চায়?
মান্নাদের বিরহের গান সবাইকে টানে, হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোকে স্মৃতির ভেলায় ভাসাতে সবচেয়ে বেশি যে গানটা সাহায্য করে সেটা হলো “ খুব জানতে ইচ্ছে করে তুমি কি সেই আগের মতই আছো, নাকি অনেকখানি বদলে গেছো?” অতীত আর বর্তমানকে একটা সেতু বন্ধনে দাড়ঁ করিয়ে দেয় গানটি, ভালোবাসা যে কখনো অতীত হয় না এটি তার সাক্ষ্য। ভালোথাকুক হারিয়ে যাওয়া সব প্রিয় মুখেরা, ভালোথাকুক তারা মান্নাদের গানের খাতায় আর স্মৃতির পাতায়। আর আপনার গান যথারীতি ভালো হয়েছে।
মাসুদ সজীব
মাসুদ সজীব
চমৎকার মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ সজীব ভাই।
আমার মতে দ্বিতীয় মানুষটির নাম জীবনানন্দ! জীবনানন্দ আর মান্না দে যেভাবে বাংলার হতাশ, হতশ্বাস বুক-ভাঙ্গা মানুষের কথাগুলো বলতে পেরেছেন, আমার মনে হয় না আর কেউ এত সফল ভাবে এইটা করতে পেরেছেন বলে! তবে এইটা নেহায়েতই আমার নিজের ধারণা---
আবারো ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে
ভাল থাকুন সকল সময়ে
মান্না দের গান বুকে নিয়ে বড় হওয়া এক অপরূপ প্রাপ্তি!
কেন যে এত দূরে থাক, অনিকেত! আমার নিজের গলায় গান নেই। তাই গান গাইতে পারে এমন মানুষ পেলে মন একে বারে ধরে আনি, ধরে আনি করতে থাকে। কোন এক ধ্যাদ্ধেড়ে জঙ্গলে গিয়ে পড়ে আছ! আর এখানে তোমার মত মানুষ না পেয়ে মন হাঁপিয়ে ওঠে।
বুঝতেই পারছ, লেখা, গান দুই-ই খুব ভাল লেগেছে। আশা রাখি একদিন মুখোমুখি বসে তোমার গান শুনব।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দাদাআআআআআআআআ-----
কেমন আছেন?
যেকোন লেখা দিয়েই আমি আপনার মন্তব্য পাবার আশায় বসে থাকি--হে হে হে--
আমি ঠিক জানি, একদিন আপনার সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে---
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল
ভাল থাকুন সকল সময়ে, সকলকে নিয়ে---
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
গান খুব ভালো লেগেছে। অসাধারণ।
অনেক ধন্যবাদ কমল ভাই
শুভেচ্ছা নিরন্তর--
গান অসাধারন।লিখেছেন চমৎকার।
অসংখ্য ধন্যবাদ বনি
ভাল থাকুন সকল সময়--
গান চমৎকার লাগলো।
____________________________
অনেক ধন্যবাদ প্রোফেসর সাহেব
নিরন্তর শুভ কামনা
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
গান ভালো লাগলো।
শব্দ পথিক
ধন্যবাদ শব্দ পথিক
শুভেচ্ছা নিরন্তর
আপনার গান ভালো লাগে, লেখাও।
মান্না দের কফি হাউজ গাইতাম ওয়ান-টুতে পড়ার সময় থেকেই। ছোট মামা ওয়াকম্যানে শুনতেন, আমি কচি গলায় অনুকরণ করতাম। গান শুনে অনুকরণ করার স্বাভাবিক ক্ষমতা আমার ছিল, কিন্তু সঙ্গীতশিক্ষা মেয়েলি বলে মনে হত বলে মা-বাবার অনেক চেষ্টাতেও আমাকে গান শেখানো যায় নি। শেষকালে বুড়োবয়সে মায়ের কাছে হাতে খড়ি আঠারো কি উনিশে। কফি হাউজ আজো গাইতে চেষ্টা করি।
আপনি যে মান্নাবাবুর গানগুলো নিজস্ব ঢঙে একটু কিশোর ঘরানার "স্ট্রেইট" গায়কীতে গেয়েছেন সেটা ভীষণ ভালো লাগল। তবে পিচটা আরেকটু চড়ালে ভালো লাগত। 'এ'তে গেয়েছেন- গলাটা মনে হয় একটু বসা ছিল, হাস্কি লেগেছে। দুটো নোট চড়ালে গলাটা খুব ফ্রেশ লাগত।
অনেক ধন্যবাদ নির্ঝর অলয়! আপনার পর্যবেক্ষন যথার্থ আমার নিজেরও মনে হচ্ছিল আরো একটু চড়ায় গাইলে হয়ত খারাপ হতো না---অনেক ধন্যবাদ ব্যাপারটা খেয়াল করার জন্যে এবং উৎসাহ দেবার জন্যে--
অফুরান শুভ কামনা---
গায়কীর কারিগরির দিকটা আমার মতো অগায়ককেই দেখতে হয়। যে যন্ত্রটা বাজবে তার আওয়াজের টিম্বারটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ!
দুর্দান্ত হয়েছে অনিকেতদা
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
অনেক অনেক ধন্যবাদ ফাহিম ভাই---
ভাল থাকুন সকল সময়ে, সকলকে নিয়ে---
বাহ
facebook
থ্যাঙ্কু বস---
দারুন লাগল, আপনার গান সবসময় খুব ভাল লাগে অনিকেতদা।
লেখাও খুব ভালো হয়েছে।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
অনেক ধন্যবাদ সাফিনাজ আরজু
শুভেচ্ছা জানবেন---
বাহ্ বেশ! 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে' এ গানটা তুলতে চেষ্টা করবেন ভাইয়া?
তাপর সচলে দিবেন। যদি করেন তবে ওটার যন্ত্রষঙ্গতটুকু আমাকে পাচার করলে অশেষ কৃতজ্ঞ থাকবো।
আব্দারটা রাখা সম্ভব কিনা দেখবেন ভাইয়া।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে--
আমি নিশ্চয়ি চেষ্টা করব গানটা তোলার---তবে আমি যে স্কেলে গাইব সেইটা তো আপনার স্কেলের সাথে নাও মিলতে পারে--তাই বলছিলাম কি, আপনি যে স্কেলে গানটা গেয়ে থাকেন সেই স্কেলে একটু গেয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিন---আমি তখন সেই অনুযায়ী মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট করলাম--
কী বলেন?
নতুন মন্তব্য করুন