বাংলা নববর্ষের আনন্দ উদযাপন করি না আজ প্রায় তেরো বছর ধরে।
দেশে যখন ছিলাম অনেক বছর আগে, কোন এক হারানো জীবনে---তখনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, এখনো স্পষ্ট করেই মনে আসে। নববর্ষের সময়ে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসতাম বাড়ি। প্রতিটা সকাল বেলা যেমন ঘুম ভাঙ্গে--সেদিনের সকালেও তেমন করেই ঘুম ভাঙলেও আমি ঠিক টের পেতাম---এ এক অন্যরকম দিন! বাতাসটা অন্যরকম, চেনা বাসার বারান্দাটা অন্যরকম, বাসার সামনের গাছটাও কেমন জানি অন্যরকম। মা রোজ সকালে ওঠে গুনগুনিয়ে কোরাণ শরীফ পড়ে। আজ সেটাও অন্যরকম লাগছে। মা পড়তে পড়তেই ইশারা দেয় আপাকে ডেকে তুলতে। আপা যে গাইতে যাবে সকালে! গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় রানা'দার বাসায় গিয়ে গান প্র্যাক্টিস করেছে।
বোনকে ডেকে এসে দেখি মা সকালের নাস্তা দিয়ে দিয়েছেন টেবিলে। পাতলা চিকন-চাকন রুটি আর ভাঁপ ওঠা আলু-ভাজি খেতে খেতেই দেখি বোন রেডি! সাথে মাও রেডি। বাবা যাবে আরো একটু পর। বুয়ার কাছে বাবার নাস্তার হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে আমি, মা আর বোন রওনা দিই ব্লু-বার্ড স্কুলের দিকে। সেইখানে সংস্কৃত কলেজের প্রাঙ্গনে রানা'দার 'আনন্দলোক' বহু বছর ধরে নিয়মিত ভাবে আয়োজন করে আসছে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান। সিলেটে ঐটাই রমনা-বটমূল!
সকাল সকাল রিক্সা পাওয়া ভার। অন্যদিন হলে মায়ের মন ভার হতো। আজ নয়। আজ যে নববর্ষ!!
পা চালিয়ে হাঁটি আমরা তিনজন। এক সময়ে হাসিমুখ এক রিক্সাওয়ালাকেও পেয়ে যাই। আজ তার মুখটাও হাসিতে ভরা। আমরা তিনজন সমস্বরে বলি, শুভ নববর্ষ! আনন্দে তার মুখের হাসি একান-ওকান হয়ে যায়--অস্ফুট কন্ঠে সেও কি জানি আমাদের বলে।
আজ নববর্ষ।
যখন সংস্কৃত কলেজের প্রাঙ্গনে গিয়ে পৌঁছাই দেখি সারাটা প্রাঙ্গন ঝলমল করছে--মানুষে মানুষে! সবার মুখে একটা আলতো হাসি। যে খুব বিরক্ত সেও কেন জানি হাসি মুখ। সাদা শাড়ি লাল পেড়ে মেয়েরা উচ্ছল হসিতে ভেঙ্গে পড়ছে, বাচ্চারা ঝলমল করছে, ঝলমল করছে তাদের মা-বাবা, ঝলমল করছে গাছের লতা-পাতা--
আজ নববর্ষ!
রোদ একটু একটু করে চড়তে শুরু করেছে। মা আর মায়ের পরিচিত সবাই জমায়েত হতে শুরু করেছেন একখানে। রিনরিনে গলায় কিছু শিশু কি জানি বলে খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে। এই বিশাল আনন্দমেলায় আমার কোন বন্ধু নেই। তারপরও আমার একটুও খারাপ লাগে না--
আজ নববর্ষ!
একটু পরেই রানা'দার নেতৃত্বে ছোট ছোট বাচ্চারা হাসিমুখে ভুলভাল সুরে নানান স্কেলে গান ধরে "এসো হে বৈশাখ এসো এসো"
ছোট ছোট মানুষ গলার রগ উঁচিয়ে গাইছে, অনেকের মুখ হাসি হাসি, অনেকের মুখ গম্ভীর---কিন্তু সব কটা কন্ঠের কলস্বরে সেই মুহূর্তে এ প্রাঙ্গনে হয় আনন্দের গাঙ্গেয়প্রপাত! মা আমার পাশে বসে দুলে দুলে গান শুনতে থাকে। মাঝে মাঝে কনুই দিয়ে ঠেলা মেরে দেখায়-- কোন বাচ্চাটা গানের মাঝেও দুষ্টুমি করে চলেছে --
এত এত দিন ধরে এই দৃশ্যটা আমি দেখিনা যে মাঝে মাঝে মনেই হয় না এই দৃশ্যটাতে আমি একদিন নিজে উপস্থিত ছিলাম।
আমি খুব আশা করি, আবার একদিন আমরা সবাই মিলে উপস্থিত হবো সেই আনন্দের মেলাতে। সেদিনও থাকবে এমনি এক আলোয় ভরা ভোর। ভোরের আকাশে সেদিনও ভেসে আসবে কোনো মন ভালো করা সুর--কোন ভৈরবীর সুর---
এই স্বপ্নটুকু সত্যি হোক আমাদের সবার জীবনে
সবাই কে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা!
আনন্দম!
---------------------------------
নতুন বছরের শুরুতে আমার তরফ থেকে আপনাদের জন্যে একটা ছোট্ট উপহার--একটা গান। এই গানটি ঠিক প্রথাগত বৈশাখের আবাহনী গান নয়। এইটি ভোরের গান। সকল ক্লেদাক্ততা থেকে মুক্ততার গান।
আজ পৃথিবীর যে প্রান্তে ভোর এসেছে, আর যে যে প্রান্ত এখনও ভোর আসবে বলে উদগ্রীব হয়ে আছে--- সেই সকল প্রান্তে সূর্য নিয়ে আসুক নির্মল জীবনের আশ্বাস! বাঙ্গালির নতুন বছরের আনন্দ ছুঁয়ে যাক সকল প্রান্ত, সকল প্রান্তর---
বরাবরের মত যন্ত্রানুষঙ্গ আয়োজন,বাদন ও কন্ঠঃ অনিকেত
মন্তব্য
আজো বসে বসে ভাবছিলাম আর মনে বড় ব্যথা পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে বাংলা কবিতায় বৈশাখ বড় উপেক্ষিত ঋতু। শুধু রবিবুড়োর গানটি নিয়েই বোশেখের শীর্ণ নদীটি কোনক্রমে বেঁচে আছে! এমনি নিদাঘ সময়ে যন্ত্রানুষঙ্গ ও বাদনসহ আপনার কন্ঠগীত মন নির্মল করে দিল। আপনাকে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কবি রোমেল।
নতুন বছর বয়ে আনুক সুখ শান্তির পশরা আপনার উঠোনে--
শুভেচ্ছা নিরন্তর!
বা: কি ভাল যে লাগল, বলে বোঝানর নয়! নববর্ষের অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা, অনিকেত!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দাদা-আ-আ-আ-আ-আ
অনেক ধন্যবাদ, অনেক ভালবাসা আপনার জন্যে, আপনাদের জন্যে--
জীবন মধুর হোক
শুভ নববর্ষ দাদা!
অসাধারণ বড়দা।
তবে রেয়াজ না থাকলে মুড়কি-গিটকিরি কম ব্যবহার করাই ভালো। মানে ওই কাজ-টাজ আর কি! আর শুরুর আলাপটা তবলর ছাড়া স্রেফ অর্গ্যানের কর্ড অথবা তানপুরার ঝংকারে আরো মর্মস্পর্শী হত। এমনিতে গান খুবই ভালো হয়েছে, কারণ আমি বরাবরই আপনার গলার ভক্ত।
গানটা কার?
অনেক ধন্যবাদ গুরুভাই!
মুড়কি গিটকিরির প্রসঙ্গে আপনার মতামত একেবারে অব্যর্থ! সচেতন থাকব ভবিষ্যতে!
তানপুরা বা অর্গান দিতে চেয়েছিলাম---পরে মনে হল যে আসলে এইগুলো তো সব সময়েই ব্যবহার হয়--অন্য কিছু ট্রাই করা আর কি!
গানটা মূলত অমিত কুমারের গাওয়া, ব্যবধান ছবিতে। সুর দিয়েছিলেন অজয় দাস।
আবারো ধন্যবাদ গুরুভাই। ভালো থাকুন, সুখে, সুরে, শান্তিতে থাকুন---
অজয় দাসের সুরে কিশোরজির অনেক দুর্দান্ত গান আছে।
গানটা বেশ সুন্দর। ধন্যবাদ।
শোনার জন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ, আল মামুন!
অজস্র ধন্যবাদ।ঘন ঘন নতুন গান চাই।।। ।।।
শোনার জন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ!
নতুন মন্তব্য করুন