যারা চলে যায়, তাদের তো আর কোন দায় থাকে না।
তাদের সকালে উঠে আর অফিস যেতে হয় না, স্কুলের বাস মিস করে মন খারাপ করতে হয় না। বৃষ্টির দিনে তারা অফিসে ছাতা ভুলে ফেলে আসে না, গায়ে জ্বর নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় না। তাদের নেই মাস শেষে নানান বিলের খরচা মেটানো, নেই কোনো জন্মদিনের অথবা বিয়ের দাওয়াত রাখার দায়। ক্লান্ত দিন শেষে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে তাদের ঘরে ফেরার টান নেই--
যারা যায়--তারা সবকিছু থেকেই নিজেদের মুক্ত করে নিয়ে চলে যায়।
আর আমরা যারা রয়ে যাই পেছন পানে--জীবনের সকল দায় মাথায় নিয়েও আরো বড় একটা কষ্টের জিনিস আমাদের জন্যে রয়ে যায়---যারা চলে গেছে, তাদের স্মৃতির দায়! তাদের অসময়ে চলে যাওয়ায় আমাদের জীবনে যে বিপুল ওলট-পালট ঘটে যায়---সেইটে সামাল দেবার দায় আমাদেরই।
আমরা যারা বেঁচে গিয়ে মরে রইলাম--তাদের জন্যে সব রইল---অফিস রইল, অফিসে যাবার পথের জ্যাম রইল, গ্রীষ্ম-বর্ষা রইল, বসের গাল-মন্দ, বউয়ের মুখ ঝামটা, সন্তানের হতাশ মুখ---সবই রইল--আর তারও পরে রইল চলে যাওয়া মানুষটার দুঃসহ স্মৃতির ভার। আমাদের সযত্নে চর্চিত জীবন-যাপনের ফাঁকে ফাঁকে উকি দেয় সেই সব মুখ---তাদের টুকরো কথা, তাদের হাসি, তাদের গান, তাদের লেখা, তাদের ব্যথা। আমরা সাহসী মুখ নিয়ে জীবনকে মোকাবেলা করতে উঠি রোজ সকালে। আমাদের সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায় তাদের শূন্যতা। জমাট বাসের ভেতরও তাদের সিটটা খালি পড়ে থাকে--যেমন খালি পড়ে থাকে পার্কের রোজ বসার বেঞ্চিটা। নতুন মুখ আসে --- কিন্তু জীবনটা আর ভরে ওঠে না। আমাদের বাকীটা জীবন শুধুই যাপিত জীবন আর স্মৃতি-তর্পন।
বাসে পুড়ে যাওয়া বাবাটা আর ফেরে না ঘরে। খেলার মাঠে বল হাতে খেলতে আসে না পুড়ে যাওয়া স্কুলের ছেলেটা। হুমায়ুন আজাদের লেখার ঘরে কিছু একলা হাওয়া ঘুরে ঘুরে ফিরে যায়। প্রতি রাতে তৃষার কান অপেক্ষায় থাকে একটা পরিচিত কন্ঠের 'গুডু-নাইটু' শোনার জন্যে। বাবুর কিবোর্ডে জমতে থাকে সময়ের ধুলো--অনন্ত অম্বরে ঝাপসা চোখে একটা পরিচিত মুখের আদল খুঁজতে থাকেন অনন্তের বাবা!
সরকার প্রধান ঘুমুতে যাবার আগে পানির গেলাসটা হাতে নিয়ে হয়ত কিছুখন নিজের সাথে যুদ্ধ করেন---অথবা হয়ত করেন না। হয়ত নিজেকে সান্তনা দেন এই বলে--আমার টিকে থাকাটা অনেক জরুরি, বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যে কিছু প্রাণ উৎসর্গ করা সময়ের বিধান ইত্যাদি ইত্যাদি-- হয়ত কখনো দুর্বল মুহূর্তে তারও কাছে ফিরে আসে অসময়ে হারিয়ে ফেলা কিছু মুখের মিছিল! ড্রয়ার হাতড়ে খুঁজে নেন অব্যর্থ ঘুমের ঔষধ। সকল বেয়াড়া স্মৃতিকে চাবকে বোবা করে নিয়ে জাগতিকতার কাছ থেকে সাময়িক নির্বান খুঁজে পান।
আমরা যারা রয়ে গেলাম সময় আর বিবেকের চাবুকের সামনে--প্রত্যেকে যার যার মত করে মুখোমুখি হই আরেকটা সকালের। আমরা চাই বা না চাই---এই আকালেও সকালেরা আসতে থাকে আমাদের জানালায়--যতদিন না আমাদেরও স্মৃতির ভার অন্য কারো অনিচ্ছুক হাতে দিয়ে যাবার সময় হয়।
আচ্ছা, মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো কখনোও কি ভাবে-- কেমন করে আমরা বেঁচে থেকে মরে আছি??!!
মন্তব্য
ভাবনার জগতে সময়কে তুলে আনার জন্য যে শব্দগুলো সাজালে একটা চিত্রকল্প তৈরী হয় এই লেখাটা সেরকম একটা শিল্পকর্ম। কেউ কেউ হয়তো এরকম ভাবনাগুলো ভাবে, কিন্তু এত সুন্দর করে লিখতে পারে না। অনেক ভালো লাগলো বললে কিছুই বোঝানো যায় না। বরং বলি অনেক মন খারাপ হয়ে গেল। যারা চলে গেছে তাদের জন্য নাকি আগামীর দুর্ভোগ পোহানোর জন্য যারা রয়ে গেল তাদের জন্য? এটাও নিশ্চিত নই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ নীড়'দা
ভাল থাকুন অহর্নিশ!!
পাঁচতারা
কতদিন পর লিখলেন! এমন গীতিময় গদ্য কিভাবে লিখেন? আবেগ, অনুভূতি, ব্যর্থতা, হতাশা, ক্ষোভ, বেদনা, দীর্ঘশ্বাস কি করে অব্যক্ত ভাষাতে এমন প্রবল হয়ে ওঠে? হারিয়ে যাওয়া আলোর পথের যাত্রীরা থাকবে সব সময় আমাদের জীবনের প্রতিনি স্পন্দনে। এমন করে যদি কোনোদিন লিখতে পারতাম
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
অনেক ধন্যবাদ মাসুদ!!
শুভেচ্ছা নিরন্তর--
অনেকদিন হল সচলে মন্তব্য লিখিনা। আলস্যভেঙ্গে লগইন করতে বাধ্য করলেন আপনি। কারণ যাপিত জীবনের এই স্মৃতি তর্পণ , এই বেদনার ভার যে আমি-আমরা কেউ এড়াতে পারিনা!
অভিজিতদার আর কোন বিশ্লেষণী ব্লগ পড়া হবেনা জানি। বিশ্বাসী আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, অনন্ত অম্বরে তারা হয়ে যাওয়া মানুষগুলো ভালো আছে!
ভালো থাকুন আপনি। দীর্ঘশ্বাসে এই প্রত্যাশা ছাড়া আর কিছু লেখা আসে না।
রাজর্ষি
পড়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ রাজর্ষি--
আমিও একই বিশ্বাস করতে চাই!
জানিনা চিনেছেন কিনা, উনি মনে হয় সচলের মূলত পাঠক।
সত্যি নাকি?? আমাদের মূপা-দা? রাজর্ষি'দা??!!
আমার তাই ধারণা।
যদি উনি রাজর্ষি দেবনাথ হয়ে থাকেন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
না ভাই, আমি মূলত পাঠক নই। আমি নেহাতই রাজর্ষি রায়। তবে ভাল হল, এই ফাঁকে 'নিরুদ্দেশ মহীরুহ' মূলত পাঠক'দার কিছু লেখা পড়ে নিলাম।
রাজর্ষি
"নতুন মুখ আসে --- কিন্তু জীবনটা আর ভরে ওঠে না। আমাদের বাকীটা জীবন শুধুই যাপিত জীবন আর স্মৃতি-তর্পন।" -
দোহাই, বোলো না আবার, ভাল থাকুন।
অঃ টঃ - 17/08/2014 - 9:32 অপরাহ্ন-তে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলাম। নজরে পড়েনি মনে হয়। শুভেচ্ছা নিও।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখাটা পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ দাদা!
আপনার বার্তাটা কোন এক অদ্ভুত কারনে মিস করে গিয়েছিলাম। আজ উত্তর পাঠিয়েছি।
অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যে কর জোড়ে ক্ষমা প্রার্থী।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ তিথী--ভাল থাকিস!
ভাল থাকুন বস
মন খারাপ করিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে খুব পছন্দের একটি গান উপহার দেয়া হলো: https://www.youtube.com/watch?v=OtN0NHAZb9E
অনেক ধন্যবাদ তানিম--ভাল থাকুন অহর্নিশ।
সানী জুবায়ের আমার খুব পছন্দের গায়ক---লোকটার যথেষ্ট নাম-ডাক হল না---এইটা আমার একটা আফসোসের বিষয় হয়ে রইবে
গুল্লি এবং “আমার টিকে থাকাটা অনেক জরুরি, বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যে কিছু প্রাণ উৎসর্গ করা সময়ের বিধান”
masum007
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ মাসুম !!
শুভেচ্ছা অহর্নিশ
তিন মাস কেটে গেল কী সহজেই!
হ্যা রে বস---কত দ্রুত সময় যায়!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দেবদ্যুতি
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ দেবদ্যুতি! ভাল থাকুন--
আলো হাতে যারা মিছিলের আগে হাঁটে তাদের অনেকেই হয়তো হোঁচট খায়, কিন্তু আবার উঠে গিয়েই তো আরেকজনকে মশাল ধরতে হয়। থেমে গেলে চলবে কি করে? বোধ করি সমমনাদের হারানোর ক্ষত কতটা গভীর। এ শূন্যতা পূরণ হবার নয়!
শ্রীপদ দাস
এই আশাতে আমিও আছি---
--------------------------------------------------------------------------------
ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ বস!
চুপ করে পড়ে গেলাম। কিছু বলার নাই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনি বরাবরই বড্ড মন খারাপ করিয়ে দ্যান।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
সরি বস
কঠিন প্রশ্ন। উত্তর পাওয়া যাবে না যদিও।
কিচ্ছুটি বলার নেই। বলার থাকে না আসলে...
কেন জানিনা সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়ের বলা একটা কথাই মনে আসছে শুধু -- "জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করে না।"
ডাকঘর | ছবিঘর
এই প্রশ্নের আদৌ কোনো জবাব হয় কি না জানি না। লেখা, লেখার পিছের আবেগটুকু ছুঁয়ে গেল। না-ফেরার দেশে তারা ভালো থাকুক। আর আমরা দিন গুনি সেখানে তাদের সঙ্গী হবার।
--সেইটাই বস !! শুভেচ্ছা রইল!
কতো দ্রুত সময় যায়! তিনমাস হয়ে গেলো!
লেখায় আপত্তি উত্থাপন করতে ইচ্ছা করতেসে ভাইয়া, মন খারাপ করতে ইচ্ছা করেনা আর!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
হুমম--
দেরীতে পড়লাম। মাঝে কয়দিন সচলে ওইভাবে বসা হয়নি, ভেবেছিলাম, আজ না পড়া লেখাগুলো পড়ে ফেলবো। আপনার লেখাটা থমকে দিল। এখন এইসব প্রশ্ন মাথায় করে পথ হাঁটা ছাড়া আর উপায় কী?
শুভেচ্ছা জানবেন।
স্বয়ম
পড়ার জন্য ধন্যবাদ স্বয়ম!!
শুভেচ্ছা অহর্নিশ!
অভিজিৎ, অনন্তদের মতো যারা যায়, তারা জিতেই যায়, হারিয়ে দিয়ে যায় আমরা যারা রয়ে যাই । ওঁরা উদয়ের পথের নির্ভীক যাত্রী, আমরা কখনও অকৃতজ্ঞ, কখনও কৃতঘ্ন আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভীরু । তাইতো ওঁরা মরে গিয়ে বেঁচে থাকে, আর আমরা বেঁচেও মরে রই ।
চমৎকার একটি লেখা, অনুভূতিকে নাড়া দেয় !
ভাল থাকবেন ।
অন্য চোখে
পড়ার জন্যে আর মন্তব্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, অন্য চোখে!
শুভেচ্ছা নিরন্তর
বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ, সুলতানা
শুভেচ্ছা অফুরান
অনেকবার এই লেখাটা পড়ে চুপ করে চলে গিয়েছি। এবার মুগ্ধতাটুকু জানিয়ে গেলাম।
আমি তোমাদের কেউ নই
অশেষ ধন্যবাদ, 'আমি তোমাদের কেউ নই'
ভাল থাকুন সকল সময়ে--
নতুন মন্তব্য করুন