ঠিক কবে প্রথম নিজেকে 'পুরুষ'জাতির নবীন সদস্য হিসেবে চিনতে পেরেছিলাম---- এতদিন পরে সে কথা আমার মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে যে খুব অল্প বয়সেই জেনে গিয়েছিলাম যে, খেলাধুলায় আর মারামারিতে মেয়েদের চাইতে 'আমরা' এগিয়ে আছি।
ধীরে ধীরে বুদ্ধি গজানোর সাথে সাথে বুঝতে পারলাম, ক্লাস ওয়ান-টু তে যে মেয়েদের সাথে ধুম মারপিট করা গিয়েছে, খেলার সময় অনাবিল আনন্দে ল্যাং মেরে দিয়েছি, খেলায় সুবিধা না করে উঠতে পারে তাদের চুল ধরে টেনে কাঁদিয়ে দিয়েছি, বড় ক্লাসের নিয়মনীতি সেখানে একটু অদ্ভুত।'বড়' ক্লাসে উঠে জানতে পারলাম আমার ক্লাস ওয়ান-টুর 'বান্ধবী'দের এখন হেলা ফেলা করতে হবে। ওদের দেখে নাক সিটকানোটা হতে হবে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা, ওদের সাথে আর আগের মত খেলাধুলা করা যাবেনা। কারন--- ওদের খেলাটা 'মেয়েলি'। সেই প্রথম বুঝতে শেখা, আমার চেনা পৃথিবীটা আসলে দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। আগে 'মা' মা ছিল, 'বাবা' ছিল বাবা। এখন তার সাথে নতুন তথ্য যুক্ত হল। মা আসলে 'মেয়ে', আর বাবা হল আমার মত 'ছেলে'। আমি ঠিক জানিনা এই নতুন তথ্যকে আমি কিভাবে স্বাগত জানিয়েছিলাম। শুধু জানি যে, আমার ছোট্ট মাথাটা সেদিন থেকেই ব্যথা করা শুরু করেছিল। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে মেয়েদের দেখে স্কুলে আমি নাক সিটকাই, বাসায় এসে কিন্তু আরেক মেয়ের সাথে (মা) দিব্যি ভালো সম্পর্ক রাখি। মা কে নাক সিটকানোর প্রশ্নই উঠে না। বাসায় মা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। শুধু তাই নয় আমার যে সুন্দর সবুজ সুয়েটারটা আছে, সেইটা মা নিজ হাতে বুনে দিয়েছে আর স্কুলে আমি সেটা পরে গিয়ে সতীর্থদের 'ঈর্ষা'র কারন হয়েছি। সেই তুলনায় বাবার সাথে আমার তেমন হৃদ্যতাপুর্ন সম্পর্ক ছিল না। বাবা কে অপছন্দ করার অবশ্য মুল কারন ছিল তার সদা গম্ভীর মুখ, দুপুর বেলা প্রচুর অঙ্ক দিয়ে বসিয়ে রাখা আর ট্রান্সলেশান না পারলে রক্তবর্ন চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা।
খুব শিঘ্রই আমি আমার 'মেয়ে বন্ধু'দের মিস করা শুরু করলাম। মুলতঃ দুটি কারন ছিল। এক, তাদের সাথে খেলা খুব সহজ। খেলায় তারা আমার ধারে কাছেও আসতে পারেনা। দুই, মতানৈক্য দেখা দিলে মারামারি যেখানে অনির্বায, সেখানে নিশ্চিত বিজয়। সেই তুলনায় আমাদের 'ছেলেদের' খেলাগুলো ছিল মোটামুটি ভয়াবহ। প্রায় সবাই আমরা একই রকম ভালো। আমার ছেলে বন্ধু ঠিক আমার মতাই ভালো দৌড়ায় ( অনেক সময় আমার চেয়ে ভালো ), সে ঠিক জানে কখন আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে হবে এবং সব চাইতে মন খারাপের বিষয় হল, মারামারিতে ঠিক সুবিধা করা যায় না। যা হোক কি আর করা যাবে। নিজেকে কোনরকম সান্তনা দিয়ে ক্লাস এইটে উঠে গেলাম। এর মাঝে মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। আমার ছিল ব্যস্ত জীবন। স্কুলে দল পাকানো, ফুটবল মাঠে ঘাম ঝরানো, প্রতি বছর পরীক্ষায় পাস করা, ঘুড়ির মাঞ্জা দেবার একে বারে হালফিল রসায়ন কি তা জানা, কেন ডিম দিয়ে আর কাঁচের গুড়ো দিয়ে মাঞ্জা বানালে তা অব্যর্থ কিন্তু স্বল্পজীবি হয়--- এই ধরনের অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নিয়ে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হত। কিন্তু ক্লাস এইট আমাদের অপার ব্যস্ততায় রাশ টেনে ধরল। আমাদের তখন মাত্র দুটি নেশা, রুবিক্স কিউব আর...রুবিক্স কিউব। এই দুর্জ্ঞেয় রহস্য নিয়ে আমরা যখন রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছি, ঠিক তখনি জনাব ফজলে লোহানী তার 'যদি কিছু মনে না করেন' অনুষ্ঠানে এক পিচ্চি পোলাকে দিয়ে এক মিনিটে রুবিক্স কিউব সমাধান করা দেখিয়ে দিলেন। সেই প্রথম আমার বড় পর্যায়ের পরাজয়ের সাধ গ্রহন। যাই হোক, এই হতাশ সময়ে আমাদের স্কুলের ছেলেদের একদিন নিয়ে যাওয়া হল এয়ারপোর্টে। রাষ্ট্রপতি আসছেন। তাকে ফুলেল সম্বর্ধনা দিতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিনিসটা কি, সেটা খায় না মাথায় দেয় সেই বাছবিচারে না গিয়ে আমরা একটা মিনি পিকনিকের সম্ভাবনায় উদবেল হয়ে রইলাম। আমরা যখন এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌছুলাম, তখন সেখানে রাষ্ট্রপতির সাথে সাথে একরাশ মেয়েও অপেক্ষা করে ছিল। তারাও এসেছে একই উদ্দেশ্য নিয়ে। হঠাৎ করে আমি একটা মৃদু কিন্তু নিশ্চিত পরিবর্তন টের পেলাম। আমি টের পেলাম যে, আসেপাশের কোলাহল ছাপিয়ে আমার সমস্ত মনোযোগ নিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। আমি খুব সম্ভবত হা করেই তাকিয়ে ছিলাম। অচিরেই মেয়েদের নজরে সেটা পড়ে গেল এবং অমোঘ ভাবেই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু হল। আমি প্রবল বীরত্ব নিয়ে তা উপেক্ষা করলাম। সেদিন আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, আমার সঙ্গে এল এক অচেনা অনুভুতি এবং সেই ব্যাটা
আর আমার সঙ্গ ছাড়ল না। হঠাৎ করেই আমার সকল কিছু জুড়ে কিছু সুখের মত ব্যথা ছেয়ে গেল।
তখন জানলাম, আমি শুধু ক্লাস এইটের থার্ডবয় নই, আমি একজন 'পুরুষ'।
আমার পরবর্তি সময় গুলো দ্রুত কেটেছে। আমার বাইরের জীবন আর ভেতরের জীবন সম্পুর্ন ভিন্ন হয়ে গেল। যে মেয়েদের এতদিন উপেক্ষা করে এসেছি, হঠাৎ করেই তাদের সবকিছু আমার কাছে গুরুত্বপুর্ন হয়ে উঠল। তাদের 'তাকিয়ে থাকা' আমার কাছে তখন 'বিলোল কটাক্ষ', তাদের হাসি যেন ঝর্নার গান, তাদের ঠোট কেবল ঠোট নয়, সেটা 'তাম্বুল রঙ্গে রাঙ্গানো বিল্ব ওষ্টাধর'। এতদিনের পরম হিতৈষী আমার পুরুষসত্তাকে অসহ্য বোধ হতে লাগল।
জীবনের এই ক্রান্তি কালে আমি বিষ্ময়কর ভাবে জড়িত হয়ে পড়লাম এক অদ্ভুত 'নেশা'র সাথে। আর সেটা হল 'মহাপুরুষ' খোজা। আমি ভেবে দেখলাম যে, এই পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার জন্য কেবল ঐশ্বরিক
নির্ভরতা যথেষ্ঠ নয়। মানুষ আরো বেশি কিছু চায়। সে খুব খুশি হয় যদি সেই 'বেশি কিছু' রক্ত মাংসের কোন মানুষ হয়। সোজা কথা, তার 'মহাপুরুষ' দরকার।
ঠিক কি কারনে এই জিনিসটি আমার মাথায় চেপে বসেছিল আমি ঠিক করে আজ বলতে পারবনা। কিন্তু এই নুতুন নেশা আমাকে আরেক অমোঘ 'নেশা' থেকে মুক্তি দিয়েছিল। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি part time 'মহাপুরুষ-সন্ধানী' হিসেবে আবির্ভুত হলাম। আমার ধারনা হল যে, আমাদের আশে পাশেই তারা রয়েছেন। সাধারন মানুষের বেশে। কারন তাদের মুল লক্ষ্য হল মানুষের দুঃখ লাঘব করা। আর সেটা করতে হলে তাদের কে মানুষের মাঝেই থাকতে হবে। আমি নিশ্চিত হলাম যে পীর-ফকির সাধু-সন্ন্যাসী-- আসলে এই গ্রুপের লোক (অবশ্য এই ধারনা ভাংতে আমার তেমন দেরী হয়নি)। কিন্তু আমার নিজস্ব মহাপুরুষের ধারনার সাথে তেমন মিল খুজে পেলাম না।
আমি দিনে রাতে মহাপুরুষ খোজা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এই পর্যায়ে আমার সাথে দেখা হল মুহাম্মদ জাফর ইকবালের। আমাদের ঠিক ওপর তলাতে তারা থাকতেন। আমি আমার এই অকল্পনীয় সৌভাগ্যে অভিভূত। জাফর ইকবাল! 'ক্রুগো' লিখেছেন যেই লোক! 'দুষ্ট ছেলের দল', 'হাকার বিন', 'মেতসিস','পৃ'-----এই অসাধারন বইগুলো যে লিখেছেন সেই লোক আমার উপর তলায় থাকে!!!
ক্রমে ক্রমে জাফর স্যারের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল। আমি নিশ্চিত হলাম--- আমার মহাপুরুষ খোজা শেষ হয়েছে। ঘটনাক্রমে স্যারকে সেটা জানিয়ে দিলাম। তখন স্যার আমাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে বোঝালেন, তিনি সেই লোক নন। Infact তিনি নিজেও খুজে বেড়াচ্ছেন। তার লেখা আমার ভাল লাগে, তার জীবন আমাকে অনুপ্রানীত করে---- তার মানে এই নয় যে তিনি মহাপুরুষ। জাফর স্যার ক্ষেদের সাথে মাথা নেড়ে জানালেন তার চেনা অনেক বড় লেখকই ব্যক্তিগত জীবনে মহা দুর্বৃত্ত।
আমি আবার ফিরে এলাম আমার যাত্রা শুরুর স্থানে। একটা জিনিস অন্তত জানা গেল যে, কাউকে পছন্দ হলেই লাফ দিয়ে তাকে মহাপুরুষ বলা ঠিক হবে না।
আমি আশা ছাড়লাম না। কিন্তু ছাড়লাম ঈশ্বরকে। মানুষের এমন ঈশ্বরের দরকার নেই যে পথে ঘাটে শিশুকে অনাহারে মরে যেতে দেয়, যুদ্ধের মাঠে নিয়ে যায় স্বপ্নালু যুবকদের, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় মানুষে মানুষে বিভেদ, ২৪ ঘন্টায় আঠাশ বার নরকে যাবার ভয় দেখায়।
আমি রক্তাত হতে লাগলাম। নিষ্পেষিত হতে লাগলাম। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম। বার বার হোচট খেতে খেতে শিখলাম এই জীবনে কোন কিছুই Granted ভেবে নেয়া ঠিক না। আমি আমার দু'পায়ের মাঝে প্রক্ষিপ্ত একটি অঙ্গ নিয়ে জন্ম নিয়েছি বলেই আমি পুরুষ না। আমি আমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়ে দিয়েছি 'নপুংসক' ভাবে। রাতে রেল ষ্টেশনে যে লোক আমার বোনের ওড়না ফেলে দিয়েছিল, আমি তার পেছনে দৌড়ে যাইনি, প্রতিবাদ করিনি বরং আমার অপমানিত ক্ষুব্ধ বোন কে নিয়ে মেরুদন্ডহীনের মত সরে গেছি...(বোন আমাকে মাফ করে দিস, আমি ঈশ্বর মানিনা..আমি আজ হাটু গেড়ে বসে সবার সামনে তোর কাছে মাফ চাইছি) আমার বন্ধু যখন অন্যায় ভাবে রিক্সা ওয়ালাকে চড় মেরেছে, আমি কিছুই হয়নি ভাব করে হেটে সরে গেছি, কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করিনি জোর গলায়। তার পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছি 'ভদ্রলোক' এর তক্মা।
মাঝে মাঝে সুখের অসুখের মত হলে, মহাপুরুষ খুজতে বেরোই।
যে তার জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়ে দিয়েছে 'কাপুরুষত্ব' আর 'ক্লীবত্ব' নিয়ে, যে 'পুরুষ' হিসেবে হয়ত টেনেটুনে পাশ করবে কি না সন্দেহ, সে রাতের বেলা বের হয় 'মহাপুরুষ' খুজতে।
এর চেয়ে মজার কথা কখনো কেউ শুনেছে কি?
মন্তব্য
মহাপুরুষের দরকার নাই। ' মানুষ' চাই, মানুষ
==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।
নতুন মন্তব্য করুন