টিনচালা একটি ঘর, কোথাও আবার কংক্রিট ঢালাই, মিরাবাজারের এই টিনচালা ঘর আর কংক্রিটের ছাদের নিচে সর্বক্ষণ শুয়ে থাকেন মুনিরের মা। বয়স কত হবে তার, অনুমান করি, একেবারে কম হলেও আশি বছর, সব দাঁত পড়ে গেছে, ছেলেরা কেউ আজ তার পাশে নেই, বড় ছেলে মারা গেছে পঁচানব্বুইয়ে, বাকি তিন ছেলে বউ বাচ্চা নিয়ে কানাডার প্রবাস জীবনে। টিনচালা ঘরের দেয়ালে হাসনাহেনার গাছ, মাতাল করা গন্ধ আসে, বারান্দায় ছোট ছোট গাদা ফুল, দরজার পাশেই ঝুলে আছে ডালিম, ছায়াঘেরা পুরো বাড়ি ঘিরে পাখির কিচির মিচির ডাক, পাখি ডাকে, মুনিরের মা কাঁদেন, কান্না আজ তার সন্তানের মতো, কান্নাই যেনো সন্তান। পাখির ডাক শুনলে তার মনে পড়ে ছেলে মুনিরের কথা, মুনির শখের বশে পাখি পুষতেন, কেউ ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে দেখলে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকেন, তার ছেলে মুনিরও যে ক্রিকেট খেলতো, দাপিয়ে বেড়াতো মিরাবাজার শিবগঞ্জ এমসি কলেজের মাঠ।
বহুদিন থেকে শয্যা পেতেছেন সেগুন কাঠের পুরনো খাটে, এপাশ ওপাশ করেন সারাদিন, নীরবে কাঁদেন, কেউ বাড়িতে বেড়াতে এলে গল্প ফাঁদেন নিজের ছেলের, জিজ্ঞেস করেন, মুনির কি ফিরে আসবে, মুনির তো খেলতে বাইরে গেছে, কখন সে ফিরে আসবে ? ছেলেহারা মায়ের কষ্ট কোন গহীনে লুকিয়ে থাকে তা আমার জানা নেই, চোখের জল দেখে মনে হয়, আমি না থাকলে আমার মা হয়তো এমন করে কাঁদতেন, মায়ের কান্না বোঝার সাধ্য কি আছে এই পৃথিবীর কোনো সন্তানের ?
মুনির ক্রিকেট খেলতেন, ক্রিকেট খেলার জন্য ছুটে বেড়াতেন মিরাবাজার শিবগঞ্জ এমসি কলেজের মাঠে, এখন ক্রিকেট ব্যাট হাতে যখন নাতি ঘর থেকে বের হয় তখন মুনিরের মা'র চোখ ছলছল করে উঠে, হয়তো নিজের ছেলের কথাই ভাবেন, মুনিরও এভাবে ক্রিকেট ব্যাট হাতে ঘর থেকে বের হতেন। মুনির এমসি কলেজের সেরা স্পিন্টার ছিলেন, কলেজের একশো আর দুইশো মিটারের দৌড়ে তিনি ছিলেন বরাবর চ্যাম্পিয়ন, বাড়ির দেয়ালে একটা লোহার পেরেকে এখনো ঝুলে আছে মুনিরের মেডেলগুলো, কান্নাভেজা চোখে মুনিরের মা হাত তুলেন, আঙ্গুলের ইশারায় মেডেলগুলো দেখান, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে, বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেন, চোখের জল গড়িয়ে পড়ে ম্যাট্রেসে।
মুনির নাটক করতেন, শহর সিলেটে তার পদচারণা ছিলো ক্রীড়া সংস্কৃতি রাজনীতির মাঠে। নাটক দিয়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন, রাজনীতি করতেন বিপ্লবে সমাজ পাল্টে দিবেন বলে, তার বিপ্লব করা হয়নি, মিছিলে তার হাত যখন স্লোগানে স্লোগানে উর্ধ্বে উঠেছিলো, মা তখন জানতেন না ছেলে মিছিলে গেছে। মা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মুনিরকে বলেছিলেন, শহরে খুব ঝামেলা হচ্ছে, নিজেরে নিরাপদে রাখিস বাবা।
মুনির বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার কথা বলে, কিন্তু এমসি কলেজের মাঠে ক্রিকেট খেলতে না গিয়ে তিনি গিয়েছিলেন শিবির প্রতিরোধে ব্যারিকেড গড়ে তুলতে শহরের শাহী ঈদগাহ এলাকায়, সেখানে মানবদেয়াল গড়ে উঠেছিলো জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের, সবাই শিবিরকে রুখতে চায়, একটা শরীরের সাথে আরেকটা শরীর লেগে আছে, সবার গলায় স্লোগান, শিবিরের হায়েনারা হুশিয়ার সাবধান, স্লোগান কে তুলেছিলেন, মিছিলে বরাবর মুনিরের কন্ঠ উর্ধ্বে, তাই মুনির চিৎকার করে স্লোগান ধরেছিলেন, শিবিরের হায়েনারা হুশিযার সাবধান, এই শহরে আমরা, তুলবো তোমাদের চামড়া, মিছিলে ও ব্যারিকেডে মুনির ছিলেন অগ্রসৈনিক, মুনির যোদ্ধা ছিলেন, নিজের ভিতরে সাহস টগবগ করে ফুটতো সবসময়, যোদ্ধারা তো সবার আগেই থাকে, তাই শিবিরের হায়েনাদের প্রতিরোধ করতে মুনির যখন সবার আগে তখন হায়েনারা মুনিরের উপরে আক্রমণ চালিয়েছে, ক্ষতবিক্ষত করেছে মুনিরের দেহটাকে...
মুনিরের মৃত্যুর পর থেকে ডালিম গাছে ডালিম ঝুলে থাকে, পাখিরা কিচির মিচির শব্দে ডাকে, হাসনাহেনা আর গাদা ফুল যেনো কেমন নিষ্প্রাণ, তারাও যে অপেক্ষায় ছিলো মুনির বিপ্লব করে কোনো একদিন চে গুয়েভারা হয়ে উঠবেন ! বিপ্লবী চে'কে হত্যা করা হয়েছে বলিভিয়ার জঙ্গলে আর মুনিরকে সিলেটের রাজপথে, দুজনেই বিপ্লবী ছিলেন, দুজনেই স্বপ্ন দেখতেন বিপ্লবে বিপ্লবে সমাজ বদলের...
মৃত্যুর কিছুদিন আগে মুনির সমুদ্র দেখতে কক্সবাজার গিয়েছিলেন, ফিরে এসে মাকে বলেছিলেন, এতো সুন্দর সমুদ্র, তুমি না দেখলে কল্পনাই করতে পারবে না, এরপর যখন কক্সবাজার যাব তখন তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাব, তোমাকে আমি সমুদ্র দেখাবো...মুনিরের মৃত্যুর পর শোকে পাথর মা মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে বিছানায় ছটফট করেন, খুব কাছের কাউকে বলেন ছেলে তাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে বলেছিলো, কিন্তু মুনিরের মা'র আর সমুদ্রে যাওয়া হয়নি...
( ১৯৮৮ সালে সিলেটে শিবিরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে শিবিরের সন্তাসীদের হাতে খুন হয়েছিলেন মুনির ই কিবরিয়া চৌধুরী। ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর একইদিনে শিবিরের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন শিবির বিরোধী আন্দোলনের কর্মী তপন জ্যোতি দে ও এনামুল হক জুয়েল। শিবির ও মৌলবাদ বিরোধী যুদ্ধে এই তিন যোদ্ধার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা...)
মন্তব্য
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
জামাত-শিবির নিপাত যাক।
কামরুল হাসান
কতো শোক বুকে নিয়ে ঝিমায় নগর,
কুকুরেরা অট্টালিকা বানায়
দূরে পড়ে থাকে মুনিরের নিঃসঙ্গ কবর।
-------
দুফোটা অশ্রুপাত শুধু, নীরবে।
------
একদিন গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, কামরুজ্জামানের ফাঁসি হবে,
সেদিন তোমার কবরটা দেখতে যাব মুনির ভাই।
জাহামজেদ ভাই এমসি কলেজে ছিলেন নাকি? আমি ইন্টারমিডিয়েট এমসি কলেজ থেকে দিছি, ২০০৫ ব্যাচ।
সত্যান্বেষী
আমি আপনার চার বছর আগে।
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
আপনার এই উদ্যোগটা ভাল, শিবিরের কুকীর্তীগুলো এভাবে লিখে না রাখলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। আপনি যেমন সিলেটের কথা লিখছেন, তেমনি বাংলাদেশের সব এলাকার কথাই সংগ্রহ করে রাখা উচিত। নাগরিক ব্লগে শিবিরনামা একটা ট্যাবে সব সংকলিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তেমনি আপনার এই লেখাগুলিও সংকলিত করলে ভালো হয়।
-লাবণ্য-
শুধু সিলেট না, বাংলাদেশের সব এলাকার কথাই লিখছি। তবে মুনির তপন জুয়েল হত্যাকান্ড সিলেটের আলোচিত ও সিলেটে শিবিরের প্রথম তান্ডব হওয়ার কারণে আলাদাভাবে এদেরকে নিয়ে লিখছি। শিবিরের হাতে নিহত এই তিনজন শিবিরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে একইদিনের হামলায় খুন হয়েছিলেন। তিনজনেরই আদর্শ ছিলো, তারা শিবিরকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তাদেরকে নিয়ে এই আলাদা আয়োজন।
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
আপনার লেখাগুলোর আমি খুব বড় ভক্ত হয়ে যাচ্ছি। শুধু প্রামাণ্য দলিল হিসেবেই নয়, লেখার ধরনও অনবদ্য।
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
আমি আবার ধন্যবাদে বিশ্বাসী না, তারপরও ধন্যবাদ দিলাম।
অফটপিক : গুড়ের ইমোটা কিভাবে দিতে হয় মডুদের কেউ কি বলে দিবেন ?
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
একই মন্তব্য দুবার বলে ঘ্যাচাং
চালিয়ে যান। অনেক কিছুই জানা ছিল না।
অজ্ঞাতবাস
অজ্ঞাতবাস
amr chok panite vijlo...amr chacha..dadu ke nea ato sindor lekha kau likbe kunudin chintaw korte parini..onek onek dhonnobad.
আপনার কমেন্ট দেখে ভালো লাগলো রুহানা, আপনার কান্না বুঝতে পারার ক্ষমতা আমার হয়নি, তারপরও বলি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, মুনির তপন জুয়েলের শুরু করা যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে...
ভালো থাকবেন।
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন