একটা শব্দ মাথাটা প্রায় নষ্ট করে দিয়েছে আমার, সবকিছু যেন কেমন উলটপালট করে ফেলছি বারবার। অথচ এই শব্দের মানে কঠিন কিছুই না, সবকিছুই একেবারে সহজ, সহজ করে দেখলে সহজের মতো। অথচ এই একটি সহজ শব্দ কেন যেন যেন আমার জীবনে অনেক জটিল হয়ে গেছে। ঠাস বুনোটের বৃত্তে বন্দী জীবনটাকে যেন নিয়ে যাচ্ছি আরো এক বৃত্তবন্দী চক্রের ভেতরে, যেখানে সবকিছু জটিল, এমনকি আমিও। এখানে একটা শব্দ নিয়ে তৈরি জীবনে জটিলতা যেন আমার সব, আমার সকাল দুপুর রাত, বৃষ্টির দিনে যেন আমার মেঘলা আকাশ।
ডেফিনেশন শব্দের সহজ বাংলা সংজ্ঞা বাংলা, অভিধানে তাই লেখা। কিন্তু একাকীত্বের কোনো ডেফিনেশন নেই, পৃথিবীর কোনো ভাষাতে একাকীত্বের কোনো সংজ্ঞা নেই, কোনো অভিধানে নেই একাকীত্বের গভীরতার কথা। বাংলা একাডেমীর সব ধূলো ঝেড়ে, পাতার পর পাতা অভিধান দেখে হয়তো একটা অর্থ পাওয়া যাবে, কিন্তু শেষমেষ এটা আভিধানিক একটা অর্থই থেকে যাবে। মানুষের নিজের কাছে একাকীত্বের কোনো সংজ্ঞা কোনোকালে ছিল না।
কিন্তু তারপরও কোনো এক বিকেলে শাহবাগের নব্য গেঞ্জি পাড়া থেকে হেঁটে হেঁটে বাংলা একাডেমীতে গিয়ে একাকীত্বের মানে খুঁজি, পাবলিক লাইব্রেরীতে খুঁজি, মনমতো কিছুই খুঁজে পাই না।আভিধানিক একটা অর্থ নিয়ে হেঁটে আসি শাহবাগে, পড়ন্ত বিকেলে কেউ একজনকে জিজ্ঞেস করি-আপনি কি একাকীত্বের মানে জানেন। তিনি আমাকে জানান, তিনি জানেন না। তার আগে তিনি বেশ কিছুক্ষণ কবি সুলভ একটা ভাব নিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আমার প্রশ্নটা অনেক জটিল, এই প্রশ্নটা তাকে ফেলে দিয়েছে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের মত একটা জটিল কাজে। অন্যদিকে আমি ভাবতে থাকি, সাহিত্য নিয়ে সারাদিন আড্ডা মারে যে যুবক, খবরের কাগজের পাতায় পাতায় থাকে যার কবিতা, সেও তাহলে জানেনা একাকীত্বের মানে।
ভাবতে থাকি, তাহলে কি একাকীত্বের কোনো মানে নেই ?
হয়তো আছে, আবার হয়তোবা নেই !
তিন চাকার যানে চড়ে বৃষ্টিভেজা দিনে পথ চলতে থাকি, রিকশার চাকা ঘুরে, মাথার মধ্যে চিন্তা খেলা করে, আসলেই কি একাকীত্বের কোনো মানে নেই। আমার ভুল ভেঙ্গে দিতে নেয় না যে রিকশায় করে বাসায় ফিরছি তার চালক। পেছনে ফিরে মুখ ঘুরিয়ে দার্শনিকের মতো সে আমাকে বলে, ভাইজান একলা থাকাডারেই তো একাকীত্ব কয়। তারপরও আফনারে একখান কথা কই, বহুদিন থাইকা এই শহরে একলা আছি, বাড়িতে বউ বাচ্চা, ওদের দেখতে মনটা বড় টানে। রিকশা চালক কোনো দার্শনিক না, তবুও কেন যেন তার কথাটা আমার খুব মনে টানে, ওদের দেখতে মনটা বড় টানে, আহারে কি আকুলতা তার। তার কাছে একাকীত্বের নিজস্ব একটা মানে আছে, যা শাহবাগের গেঞ্জিপাড়ায় আড্ডারত কবির কাছে নেই, বাংলা একাডেমী বা পাবলিক লাইব্রেরীর ধূলো জমা বইয়ের পাতায়ও নেই।
একাকীত্বের মানে খুঁজতে কোনো এক ঘুমভাঙ্গা সকালে আমি রমনা পার্কে যাই। যদি একাকীত্বের মানে এসে আমার কাছে ধরা দেয়, কিন্তু সে আসে না, সে কি আর মানুষের মতো যে এসে বসে থাকবে পার্কের বেঞ্চে। বসে বসে আমি ঢাকা শহরের সব ভূঁড়িওয়ালা মানুষ দেখি, ইচ্ছে করে তাদের সাথে দৌড়াতে, জগিং করতে। কিন্তু আমার পেটে তো গ্যাস নেই, রক্তে হাই কোলেস্টেরল নেই, শরীরের সাথে লাগানো শরীরের সমান ওজনের ভূঁড়িও নেই, আমি কেন দৌড়াবো ওদের মতো করে। আমি তো এখানে এসেছি একাকীত্বের মানে খুঁজতে। পার্কে বসে থাকতে থাকতে কখন যে আমার নি:শ্বাসগুলোও একা হয়ে যায় তা আমি নিজেও টের পাই না, তারা একা উড়ে যায়, হারিয়ে যেতে চায় অথবা তারাও হয়তো আমার মতো একাকীত্বের মানে খুঁজতে বেরিয়ে যায়। নগর কর্তৃপক্ষ হলুদ বাতি জ্বালার অনেক আগেই আমি বাসায় ফিরে আসি, ফিরতি পথে চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনের রাস্তায় থরে থরে ফুটে থাকা কৃঁষ্ণচূড়া আমাকে মুগ্ধ করে, আমার মনে হয় তারাও হয়তো আমার মতো একা, এই কৃঁষ্ণচূড়াগুলোও হয়তো শেষ বিকেলে গোধূলীর রঙ মেখে আমার মতোই একাকীত্বের মানে খুঁজছে। সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে আগে ছাদে দাঁড়িয়ে যখন নিজে একা একা আরো একা হয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখনই দেখি জানালায় দাঁড়িয়ে পাশের বাসার মেয়েটা আকাশ দেখছে। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন এসে ঘুরে আসে যায়। মেয়েটির কি আকাশ ভাল্লাগে, কোন আকাশ, নীল আকাশ, সন্ধ্যার আকাশ, নাকি একলা আকাশ। হয়তো আবার মেঘলা আকাশও তার ভালোলাগার তালিকায় থাকতে পারে, মেয়েরা মেঘলা আকাশ পছন্দ করে, মেঘলা আকাশে কেমন যেন একটা রোমান্টিকতা আছে, আর মেয়েরা তো বরাবরই রোমান্টিকতা প্রিয় হয়। তারপর আবার মনে হয়, হয়তো মেয়েটা আকাশ দেখছে না। সে হয়তো আমারই মতো জানালার গ্রীল ধরে সন্ধ্যার আকাশে একাকীত্বের মানে খুঁজছে। গোধূলির আলো এসে মেয়েটার মুখে পড়ে, অদ্ভূত মায়াময় এক মুখ, কিন্তু মুখে কোনো হাসি নেই, চোখের পলকও পড়ে না সবসময়, কেমন যেন একা একা, সারাদিন জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, সারাদিন শুধু আকাশ দেখে।
মেয়েটা আমার পাশের বাসায় আসার পর প্রথম তার সাথে আমার এই ছাদেই দেখা হয়। আমি ছাদে হাঁটছি, সে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আকাশ দেখছে। আমি তার উদ্দেশ্যে একটা হাসি দেই, এমনিতেই, শুধু শুধু। কিন্তু সে হাসে না, সে আকাশের দিকে আগের মতোই তাকিয়ে থাকে। আমার কাছে যেমন একাকীত্বের কোনো মানে নেই, মেয়েটার কাছেও তেমনি আকাশের কোনো মানে নেই, তার কাছে পৃথিবীর সব আকাশই একলা আকাশ, তার কাছে পৃথিবীর সব আকাশ-ই যেন বিষন্নতার একেকটি খোলা জানালা।
মেয়েটা চোখে দেখে না, সে জন্মান্ধ।
মন্তব্য
এই গল্প আমি আগেই পড়েছি। হে হে...
চোখ শিরোনামে আপনার আরেকটা গল্প পড়েছিলাম, দুর্দান্ত!
এটাও বেশ লাগলো।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কি আর বলবো, কিছুই বলার নেই। বিখ্যাত হয়ে গেছি মনে হচ্ছে, প্রকাশ হওয়ার আগেই আজকাল মানুষ আমার লেখা পড়ে ফেলে !
কষ্ট করে দু'বার পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
...............শেষ লাইনটা বুকে ভীষণ রকম বাজলো! অনেকদিন পর আপনার লেখা পেয়ে ভালো লাগলো
আগের মতো আর লেখার সময় পাইনা, হাতে সময় ছিলো বলে এটা লিখতে পেরেছি। আমার লেখা দেখে ভালো লেগেছে জেনে ভাল্লাগলো, ধন্যবাদ।
__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________
একা একা, খুব একা একা
অতঃপর সে তার নিজের সাথে কথা বলে
আনমনে সে পায় তার ভেতরের দেখা
যেখানে আজন্ম বেড়ে উঠা তার; অদ্ভুত কৌতুহলে
সে চুপ করে ঢুকে পড়ে ভেতরের নিরাক আধাঁরে -
সেখানে তুলট মেঘে ঢাকা পড়া সবকিছু।
কোলাহলেও মানুষেরা খুব করে একা হতে পারে
তারপর সবকিছু আপনার সাথে, আর সব নৈঃশব্দ পিছু!!
- তানিম এহসান, ২৮.০৬.২০১১ (২৩:২৩)
নতুন মন্তব্য করুন