"মফস্বলি বৃত্তান্ত": যে জীবনের গল্পপাঠ 'ফড়িংয়ের দোয়েলের' জীবন না দেখার রোমান্টিকতায় সপাটে চড় কষায়!

আয়নামতি এর ছবি
লিখেছেন আয়নামতি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৭/০১/২০১৬ - ২:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ তার একটি লেখায় বলেছিলেন, "পৃথিবীর সব গল্প বলা হয়ে গেছে, এখন কীভাবে বলতে হবে সেটাই জানা প্রয়োজন।" এ ব্যক্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে যথেষ্ট যুক্তিতর্কের অবকাশ আছে। সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে বলে ফেলা গল্পগুলোকেও অন্যভাবে বলবার আকাঙ্ক্ষায় কেউ কেউ কলম ধরেন বৈকি। তখন জানা কাহিনি কিংবা জানাশোনা জনপদের চেহারা নতুনভাবে ধরা দেয় যেন আমাদের চোখে। নইলে ক্ষুধার্ত জনজীবন কিংবা নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে কাহিনি কী লেখা হয়নি সেভাবে? ঢের হয়েছে। কিন্তু কারো কারো লেখনীর কারণেই যেন সেটা অজানা কাহিনির মাদকতা নিয়ে ধরা দেয়। আর তিনি যদি প্রচলিত নিয়ম ভেঙে "তাঁর সৃষ্ট আখ্যানের পর্বে পর্বে আঙ্গিক নিয়ে, ভাষা ও সংলাপ নিয়ে নতুন নতুন পরিক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে খুঁজতে চেষ্টা করেন উপন্যাসের নতুন ধরন" তবে সেটি পাঠকের কাছে নতুনত্বের আদর নিয়েই উপস্হিত হয় বটে। এমনই এক লেখকের একটা বই হুট করে পড়ে ফেলা হলো। আসলে অভিজিৎ সেনের "রাহু চণ্ডালের হাড়" পড়বার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম মনে মনে। কিন্তু হুট করে পড়ে ফেলা হলো দেবেশ রায়ের একটি উপন্যাস।

শুধু পড়া না বলে বরং যে জীবনের অস্তিত্ব আছে জানি, অথচ চিনিনা, কিংবা শোনা হয়নি সেভাবে যে জীবনের গল্প, সেরকম একটা অচেনা পৃথিবী দেখা হলো যেন "মফস্বলি বৃত্তান্ত" পড়ে। এক পৃথিবীর মানুষ অন্য পৃথিবীতে চলে গেলে যেমন হতবাক, বোকা বোকা ভাবসাব.. ক্ষণে ক্ষণে ভিন্নমাত্রার চমকে মুগ্ধতা কিংবা বিমূঢ়তা ছড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ে। দেবেশ রায়ের এই বই পড়তে পড়তে আমার হয়েছিল সে দশা। এই লেখকের সাথে মূলত "মফস্বলি বৃত্তান্ত" দিয়ে আমার প্রথম পরিচয়, উপন্যাসে ব্যবহৃত সম্পূর্ণ নতুন একভাষা, অতি জীবন্ত সব খুঁটিনাটির বর্ণনা পাঠক হিসেবে মুগ্ধ, ব্যাকুল। ব্যাকুলতা তাঁকে আরো বেশি করে জানার, সঙ্গে আফসোসও, বেশ দেরিতে এমন একজন লেখকের সাথে পরিচয় ঘটলো। প্রথম পরিচয়ের ধাক্কাটা ঠিক বলে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না

ভূমিকার আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে বইটির শুরুর লাইনে চোখ রেখে নড়েচড়ে বসতে হয় পাঠককে " এই শেষ রাতটাতে সারারাতের হিমের ভারে গোয়ালের চালের তিন সনের খড়েরও রঙ বদলায়।" পাঠক বুঝে যান যে আখ্যানের বর্ণনা দেয়া শুরু করলেন লেখক, তার সাথে লেখকের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। গরু আর মানুষকৃত(উপন্যাসের মানুষটি চ্যারকেটু) পেশাবের তুলনামূলক গভীর অভিজ্ঞতামূলক বর্ণনা ছাড়িয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে উপন্যাসের বিস্তার ঘটে, বাড়ে পাঠকের বিস্ময়। যে জীবনের বা পরিবেশের গল্পটা লেখক বলছেন সে সম্পর্কে গভীরতম পর্যবেক্ষণ না থাকলে বা মিশে যাবার আন্তরিকতা না থাকলে এতটা বাস্তবমুখী করে লিখে যাওয়া কিভাবে সম্ভব! সম্ভব এ জন্যেই যে দেবেশ রায় এ বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত, এবং তিনি ভাবেন, "লেখকের আড়াল দরকার। নিজের অস্তিত্বকে আড়ালে রেখে তার লিখে যাওয়া দরকার। এটা একজন লেখককে লালন করতে হয়। এটা যদি লালন না করা যায়, তাহলে লেখক তার লেখা তৈরি করে তুলতে পারবেন না। সেটিকে বানোয়াট গল্প মনে হবে।" মফস্বলি বৃত্তান্তে দেবেশ রায়ের লেখক সত্ত্বা আড়ালে থেকে চরিত্রগুলোকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেন নিপুণ কারিগরের মত। একবারও চরিত্র ফুঁড়ে বানোয়াট কিছু উঁকি দিচ্ছে এমনটা মনে হয় না পাঠকের। অবশ্য সেরকম ত্রুটি বিচ্যুতি আমার মত নিরালম্ব আকাঠ পাঠকের পক্ষে বুঝে নেয়া দুঃসাহসিক এবং অসম্ভব বটে। কাজেই এই অনুভূতির প্রকাশ ভীষণভাবে পক্ষপাতদোষে দুষ্ট, দায়ভার স্বীকার করে নিয়েই লিখছি।

"মফস্বলি বৃত্তান্ত" উপন্যাসের পটভূমি জলপাইগুড়ি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম দ্বারিকামারি। আশ্বিনের শেষ কটাদিন এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের আধাপেট ভাত জুটে। "তারপর শুরু হয়, চেয়ে চিনতে আনা, ধার করা। তারপর ঘটি বাটি বিক্রি। আর তারপর মাঠেঘাটে বুনো আলু আর কচু, নালায় ডোবায় মাছ।" এই স্তরপরম্পরার শৃঙ্খলায় বুনো আলু কিংবা কচু তুলে নেবার প্রতিযোগিতা চলে পেটে খিদে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে। খেতখেতুর বউ টুলটুলি সে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যুদ্ধে অগ্রগামী থাকতে চায় জীবনের ঝুঁকি আর মর্মান্তিক যাতনা সয়েও। নাহ্ "মফস্বলি বৃত্তান্ত" দ্বারিকামারির গোটা গ্রামবাসীর উপোস থাকার গল্প নিয়ে বিশাল ক্যানভাসে লেখা উপন্যাস নয়। এর পরিসর বেশ ছোট, বলতে গেলে দুই আড়াই দিনের মাত্র। কোনো এক রবিবার থেকে পরের দিন মঙ্গলবারের মধ্যরাত পর্যন্ত এ উপন্যাসের বিস্তার। রিক্ত নিঃস্ব ভাগচাষী(আধিয়ার নামে যারা ঐ অঞ্চলে পরিচিত) খেতখেতু,"স্যানং স্যানং টাইমত খেতখেতু রায় বর্মন" তার বউ টুলটুলি, তাদের তিন সন্তান যথাক্রমে বৈশাখু, বেঙ্গু এবং খেতশ্বরী; আর ভাইপো চ্যারকেটুর অভুক্ত থাকবার যাতনা ,টানাপোড়েন নিয়েই এ উপন্যাস। ঘরের ঘটিবাটি বিক্রি করে খেতখেতু ও পরিবারের বাকি সবাই গেল রবিবার ভাত খেয়েছে শেষবার। সেই ভাতের ফেনে নুন গুলে মঙ্গলবার পর্যন্ত খাওয়া হয়েছে। এই নিঃস্ব পরিবারের প্রত্যেকের গত তিনদিনের বাসী খিদে এবং অনির্দিষ্ট আগামী কদিনের(ধানকাটার আগ পর্যন্ত) নিশ্চিত উপবাসের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় খাদ্য সংগ্রহের এক প্রাণান্তকর লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী চালচিত্র নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে গেছেন দেবেশ রায়।

উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র খিদে মেটাবার জন্য খাদ্য সংগ্রহের কাজে বেরিয়ে পড়ে যে যার মত করে। খেতশ্বরী নিতান্তই শিশু হওয়ায় শূন্য ভাতের ফেনের গ্লাসটি নিয়েই ভুলে থাকতে চায় তার পেটের খিদে। যা দেখে তার নিঃস্ব অক্ষম জন্মদাতার ইচ্ছা হয় "এক লাথি মেরে মেয়েটার পেটের থলি ফাটিয়ে দেয়, শালা দিন রাত এক গেলাশ চুষিবার ধরোছে।" এমন মর্মান্তিক মনোভাবের ধাক্কা সামাল দিতে পাঠক হয়ত পালাবার পথ খুঁজতে চাইবেন, 'দ্বিধা হও ধরণী' প্রার্থনায়। কিন্তু টুলটুলির তো পালিয়ে বাঁচার উপায় নেই। তাকে অভুক্ত তিন সন্তানের মুখে অন্তত কিছু একটা তুলে দিতেই হবে। তাই টুলটুলিকে চলে যেতে হয় বুনো আলু কচু ইত্যাদির রুদ্ধশ্বাস অনুসন্ধানে। দুই পুত্র বৈশাখু আর বেঙ্গু দিগন্তব্যাপী ধানখেতের মাঝে খাল নালায় মাছ ধরার চেষ্টায় রত হয়। খাদ্য খোঁজার কাজে অবসন্ন বেঙ্গুর খিদের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেবার জন্য বড়ভাই বৈশাখু নানান কল্পিত গল্প বলে প্রবোধ দিয়ে যায়। দুই ভাইয়ের এই অংশে অনুভূতিশীল পাঠকের মন ডুকরে ওঠবে সন্দেহ নাই। খুব স্বাভাবিক, মানুষের কষ্টেই মানুষের মন কাঁদে। আর ওরা তো নিতান্ত ছোট্ট দুই অভুক্ত বালক, একমুঠো ভাত যাদের সমস্ত চিন্তা জুড়ে। অন্যদিকে বাবা খেতখেতুর জন্য খাদ্য সংগ্রহের বৃত্তান্তটি একটু বেশিই জটিল। কারণ তার শরীরে আছে মারণ ব্যাধি আলসার। হেলথ্ সেন্টারের ডাক্তারের পরামর্শ মত খিদে পেটে থাকা বারণ। যদি ব্যথা উঠে মুখে রক্ত আসে, কালো কালো পায়খানা হয়, তবে তার মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনা। যদিও ডাক্তারের কাছ থেকে খেতখেতুর জেনে নেয়া হয়নি "আলসারিয়াফাটা মরণ কেনং করি আসিবার পারে?" একটা প্রায় মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে খেতখেতু রওনা হয় রমণী পঞ্চায়েতের কাছ থেকে ফ্রি রেশন পাবার আশায়। কিন্তু রিক্ত হাতেই ফিরিয়ে দেয় রমণী পঞ্চায়েত, খেতখেতু তার আধিয়ার না এই অজুহাতে ধান কর্জের আর্জিটিও নাকচ হয় খেতখেতুর। উপরন্তু, বোঝার উপর শাকের আঁটি চাপিয়ে দেয় সুযোগ সন্ধানী রমণী পঞ্চায়েত যে, সে জমি চাষবাসের ব্যাপারটি চুকিয়ে দিয়ে মাছ চাষের ব্যবসায় নামবে। তাতে করে খেতখেতুর মত চারপুরুষ ধরে বর্গাচাষীদের বসত ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন নিদারুণ নিষ্ঠুর সংবাদে দিশেহারা খেতখেতু, গন্ধ শুঁকেই যে কিনা বেলা কত সেটা বলে দেবার ক্ষমতা রাখে, পথের দূরত্বের হিসাব না কষেই যে হাঁটতে জানে; তার যাবতীয় হিসাব নিকাশ কেমন উলট পালট হয়ে যায়। অনাহার, শারীরিক অসুস্হতার ভেতর অনাগত দুর্দিনের বাড়তি দুঃশ্চিতার প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখে, খেতখেতুর ধারণা হয় সে মাসান(যে পথ ভুলিয়ে দিয়ে বেপথুকে হত্যা করে) আক্রান্ত হয়েছে, যার ফলে সে দিকভ্রান্ত হয়ে চিরচেনা আদিগন্ত ধানখেতে ঘুরপাক খেতে থাকে।

ভাইপো চ্যারকেটুর হাতে ঘরের একমাত্র সম্বল গরুটা বিক্রির জন্য দেয়া হয়, যেটি বিক্রি হলে চাল কেনা হবে, তাতে খিদে যুঁঝতে থাকা মানুষ ক'জনার মুখে ভাত উঠবে। গরু নিয়ে চ্যারকেটু গৌরীহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও পথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মোর্চা নিয়ে এক গন্তব্যে সামিল হবার ডামাডোলে পড়ে যায়। এইসব মিছিল কেন, কী তার কার্যকারণ, মিছিলের শরীরকে পুষ্ট করার কাজে আসা মানুষগুলোর অধিকাংশেরই জানা নাই। ভোটের রাজনীতি এইসব ভুখা নাঙ্গা মানুষেরা বোঝে না। তারা বোঝে পেটে দীর্ঘ সময়ের ভুখ থাকলে মরণ আসিবার পারে, "মুই মরিম, নিচ্চয় মরিম" তাদের এই আর্তনাদকে পুঁজি করে নেতারা মিছিলের শরীর ভারী করেন। নেতার জন্য চাটুকার চ্যালাদের অভাব কোনোকালেই ছিল না। এখানেও তার ব্যাতিক্রম ঘটে না। চ্যালাচামুণ্ডাদের বাড়তি উৎসাহ গিয়ে পড়ে চ্যারকেটুর গরু আর লাঙ্গলের উপর। মিছিলে আগত ভিন্ন দুটি দলের একই পতাকা, অথচ আর্দশের বাঁক বদলের হুজ্জুতের মীমাংসায় নতুন প্রতীক চিহ্নের দায় বর্তায় লাঙ্গল আর গরুর উপর। চ্যারকেটুর হাটের পথ ঘুরে যায় মিছিলের গন্তব্যে। চ্যালাচামুণ্ডাদের মিথ্যা আশ্বাসের জোয়ারে খুব সত্যিটাও যেন বোধে আসে না চ্যারকেটুর। কিংবা হয়ত বা আসেও, শিক্ষাহীন, খাদ্যহীন, আশাহীন মানুষের নির্লিপ্ততা নিয়ে সেও মানুষের চলমান জোয়ারে ভেসে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার খিদে ভোলার চেষ্টায় যেন পৌঁছাতে চায় কোনো এক গন্তব্যে। দীর্ঘ একটা সময় দেবেশ রায় বামরাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন, সন্দেহ নাই এই অংশে তার কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে। পাঠক মনে হয়ত প্রশ্ন জাগে, সমাজের কাঁধে রাষ্ট্রের থাবা বসানোর এটি কী একটি সূক্ষ্ণ প্রতীকী উদাহরণ দেবেশ রায়ের? উপন্যাসের সবগুলো চরিত্র খাবারের খোঁজে গিয়ে কী ছড়িয়ে ছিটিয়েই থেকে যায় দিকভ্রান্ত হয়ে? তাদের কিভাবে ঘরে ফেরা হয়, কিংবা আদৌও ফেরা হয় কিনা, সেসব বৃত্তান্ত তোলা থাক বরং "মফস্বলি বৃত্তান্ত" না পড়া পাঠকের জন্য।

সেই এক কবি, পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি বলে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন। দেবেশ রায়ও তাঁর নির্মোহ শব্দের জাদুর বিন্যাসে খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয় হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের বৃত্তান্ত শুনিয়ে আমাদের চমকে দেন। "এই জোছনার আলোর নাখান ভাতখান এ্যানং কিছু হবা পারে।" কিংবা " এই ধানত্ চাইল নাই, এই জ্যোছনাত আইল নাই, এই পেটত ভাত নাই।" খাদ্যহীন মানুষের কষ্ট, ক্ষিদের সাথে যুঁঝতে থাকা মানুষ.. ওরা যেন আমাদের মত সব কিছু গ্যারান্টেড পৃথিবীর কেউ না, বড্ড অচেনা অথচ কত সত্যি সে জীবনের গল্প! ওরা আমার আপনার মত মানুষ। পৃথিবী নামের এই অবাক গ্রহের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রাম দ্বারিকামারিতে যাদের বাস। যারা রাজবংশী ভাষায় নিজেদের খাদ্যহীনতা, সেক্রেটারির কপটতা, পঞ্চায়েতের সুযোগ সন্ধানী বিলাসী জীবন, স্বার্থপর নেতাদের নিজস্ব স্বার্থচিন্তা আর নিজেদের জীবন ধারণের দীনতার কথা শোনায়। আর সেসব শুনে, বিলাস ব্যাসনে থাকার লজ্জায়, অপরাধবোধে বিদ্ধ হতে হতে বইটা পড়ে যেতে হয় পাঠককে। 'যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা'র রোমান্টিকতা সপাটে চড় কষায় দেবেশ রায়ের এইসব নিম্নবর্গীয় মফস্বলি মানুষের বৃত্তান্ত।


মন্তব্য

দেবদ্যুতি এর ছবি

দেবেশ রায় পড়িনি কখনও, উপন্যাস সম্পর্কে বলার কিছু নেই। বলার নেই তোমার পোস্টের চমৎকারিত্ব নিয়েও নতুন কিছু, তবে অনেক দিন পর লিখে তুমি আমার মন ভরিয়ে দিলে, বালিকা।

ফড়িংয়ের দোয়েলের জীবন না দেখার রোমান্টিকতায় দিনরাত কেটে গেলেও এ জীবন আমার বড্ড পরিচিত। উত্তরের চির অশান্তির ‘মঙ্গা’ আমি দেখে এসেছি আজীবন। এখন সেই মঙ্গা দূরীভূত, অন্তত আমি যে জীবন দেখে বড় হয়েছি, সেখানে কিন্তু সেই গত হওয়া আশ্বিন-কার্তিকের দিন হাঁড়-পাঁজরে উত্তরের হু হু করা শীত মাখা মানুষগুলোর পক্ষে ভোলা কোনোদিন সম্ভব নয় রে। এ জীবন বড্ড বেশি রকম মানুষের, বুক-পাঁজরে অভাবের চিহ্ন সারাজীবনের জন্য বসিয়ে নেয়া হাজার হাজার মানুষের।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

আয়নামতি এর ছবি

এই লেখাটায় তোমারও ক্রেডিট আছে হে! তুমি তাগাদা না দিলে লেখাটা হতো কিনা সন্দেহ। সাথে আমার এক দুষমন বন্ধু।
তাই তোমাদের দু'জনকেই আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

এক্ষেত্রে কী বলা যায় বলো দেখি! শহুরে ফার্মের মুরগীর জীবন থেকে চলে এসেছি টবের জীবনে। জীবনের আরেকটা দিকের বিষয়টা তাই অজানাই থেকে গেছে। চাক্ষুস অভিজ্ঞতা বুকের যতটা গভীরে পৌঁছাতে পারে বই পড়ে তার কতটুকু আর হয় বলো? আমার বই পড়েই যেটুক জানা। তাও পড়ুয়া হিসেবেও তো অতটা অগ্রসর নই। যেকারণে জানায় ব্যাপক খামতি আছে। সেজন্য এমন পরিস্হিতির মুখোমুখি হলে কেমন বোকা বনে যেতে হয়। কোর্ট মুভিটা দেখেও এমন একটা অনুভূতি হয়েছে জানো! বিষয়টা(আমলাতান্ত্রিক হুড়োতে পড়ে খুব সাধারণ মানুষকে কতটা হ্যাপা সামলাতে হয়।এমন বিষয় নিয়ে মুভিটা) তো অজানা না একদমই। কিন্তু চাক্ষুস করিনি তো অভিজ্ঞতাটা।.... পড়ে ফেলো বইটা। তোমার সংগ্রহে না থাকলে আওয়াজ দিও। ভালো থেকো।

দেবদ্যুতি এর ছবি

আমি ক্রেডিট খুব ভালু পাই, জানো তো! খুশি হয়ে গেলুম। কোর্ট ম্যুভিটা দেখতে ইচ্ছে করছে। বইটা আমার নেই রে, পিডিএফ থাকলে পাঠায়ে দাও দয়া করে। আর লিখতে থাকো আবার, অনেক অনেক কিছু। অনেক অনেক বইয়ের গল্প, না হয় তোমারই গল্প হতে পারে কিছু। আমি তোমার লেখামুগ্ধ মানুষ হে হাসি

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

আয়নামতি এর ছবি

:)। কোর্ট মুভিটা ইউটিউব থেকে দেখেছি। তবে সেদিন খোঁজ করতে গিয়ে দেখি কপিরাইটের কারণে তুলে নিয়েছে।
আচ্ছা দেঁতো হাসি । এমন প্রশংসা করতেছো না পেঠিয়ে উপায় কী বলো! সময় মত পেয়ে যাবে বইয়ের ই-কপি।
ভালু থেকো। হাসি

ঘুমকুমার এর ছবি

রিভিউ চমৎকার হয়েছে। রিভিউ পড়তে পড়তেই যেন হারিয়ে গিয়েছলাম খেতখেতুর জীবনে।

আয়নামতি এর ছবি

ধন্যবাদ ঘুমকুমার। সময় সুযোগ করে এই অসাধারণ(ওঁর তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নাকি আরো ভালো বই শুনেছি) লেখকের লেখা পড়ে ফেলুন, তখন বুঝবেন চমৎকার কারে বলে। ভালো থাকবেন ভাই।

ঘুমকুমার এর ছবি

দুটাই তালিকায় যুক্ত করলাম। হাসি

আয়নামতি এর ছবি

জ্বী আচ্ছা। আনন্দপাঠ হোক। হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বইটা পড়ে আমার তাৎক্ষনিক অনুভুতি ছিল যেন আমি ভিন্ন একটা গ্রহের কাহিনী পড়লাম যা আমার অচেনা। চ্যারকেটু, খেতখেতু ও টুলটুলি যে গ্রহে বাস করে সেই গ্রহের কিছুই জানি না আমি। মানুষের বেদনার্ত অনুভুতির এত সুক্ষ্ণ এবং দীর্ঘ বর্ণনা আর কোন বইতে পড়িনি। কতোটা অসাধারণ সংবেদনশীল মন থাকলে এরকম একটা বই লেখা যায়! এরকম একটা বইয়ের রিভিউ লেখা দুঃসাহসের কাজ বলা চলে এবং কাজটা সফল হয়েছে। বই নিয়ে লেখাজোকা অব্যাহত থাকুক।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আয়নামতি এর ছবি

অনুভূতিটা আমারও সেরকমই হয়েছে ভাইয়া, তবে আপনার মত করে গুছিয়ে লিখতে পারিনি।
ধন্যবাদ জানুন। ভালো থাকবেন।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

দাও না বইটা, প্লিজ।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

আয়নামতি এর ছবি

ঠিকাছে আপু তোমার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে ই-কপি। হাসি ধন্যবাদ জেনো।

দময়ন্তী এর ছবি

আঃ দেবেশ রায় ..... আমার কি যে পছন্দের লেখক। 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' একটা অসহ্য অসাধারণ বই। আর দেবেশ রায়ের লেখায় ডিটেল অবিশ্বাস্য, আখ্যানের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় ঐ ডিটেল।

অনেক অনেকদিন আগে একটা পুজোসংখ্যা (বোধহয় আজকাল কিম্বা প্রতিক্ষণ) একটা নভেলা পড়েছিলাম, এক মহিলা সাংবাদিক বহরমপুরের এক ধর্ষণের কেস কভার করে ট্রেনে ফিরছেন, একটু রাত হয়ে গেছে। সে আলোজ্বলা ট্রেনের কামরায় বসে কনক, ঐ সাংবাদিক ক্রমশঃ অনুভব করতে শুরু Kঅরেন যে আসলে ঐ ধর্ষিতা মেয়েটির সাথে তাঁর খুব একটা পার্থক্য নেই ... শেষপর্যন্ত এও একটি ধরষণযোগ্য মাংসখন্ড। উফ্‌ ঐ ডিটেলে একটু একটু করে ঐ অনুভুতির উন্মোচন .... অসম্ভব ডিস্টার্বিং গল্প।

আপনার লেখাটাও বেশ ভাল হয়েছে। এইসব বই পড়লে প্রয় ভাগ্যে বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে করে।

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

আয়নামতি এর ছবি

আমি দুইদিনের বৈরাগি ভাতকে অন্ন বলা ঠিক হবে না যদিও, তবে ওঁর একখানা পুস্তক পড়েই এক্ষেত্রে তাঁর ধারটা বেশ আঁচ করা গেছে। অবাক হতে হয় ওঁর ডিটেলের জাদুতে। আহা আপনার এই টুকুন বর্ণনা শুনেই তো নভেলাটি পড়বার লোভ হচ্ছে! পোস্ট পাঠের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানুন দয়মন্তীদি। হাসি

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! ভালো রিভিউ হয়েছে।
অনিয়মিত পাঠে যখন যতটুকু দেবেশ রায় পড়েছি, কখনো মুগ্ধতার কোন কমতি ঘটেনি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আয়নামতি এর ছবি

ভাবছি, তুমি যদি দেবেশ রায়ের এই বইটা কিংবা অন্য কোনো বই নিয়ে একখানা পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে কত অসাধারণই না হতো! লিখবে দাদাই? "তিস্তাপারের বৃত্তান্ত" নিয়ে লিখে ফেলো। ওঁর "হাড়কাটা" বা "দুপুর" গল্প পড়েছো? অনেক ভালো নাকি এগুলো। পোস্টপাঠের জন্য এত্তগুলা ধন্যবাদ হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দেবেশ রায় পড়িনি মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

যেটা পড়া হয়নি, সেটা না পড়াই থাক। সব পড়লে নষ্ট জীবন খাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।