বিন্দু থেকেই সিন্ধু। অল্প অল্প করে পলি জমে জমে চর হয়ে যায়। ঠিক সেরকম বিবাহিত জীবনের ছোট ছোট খিটমিটগুলো, জমতে জমতে অসহ্য হয়ে যায়। বিয়ে নিয়ে কত গবেষণাই তো কত জনে করছেন, কিন্তু স্বামী একটুশখানি পড়তে বসলেই তাকে বিরক্ত করবার যে চিরন্তন মেয়েলি স্বভাব সে নিয়ে আজ অবধি তেমন গবেষণা চোখে পড়ে না।
মানবসভ্যতার শুরুর দিকের রোজকার জীবনযাত্রা লক্ষ্য করলে নারীর এহেন আচরণের ব্যাখ্যা মিলতে পারে। তখন পুরুষের কাজ ছিলো খাবার এবং কাপড়ের জন্যে শিকার করা, গুহা খোঁড়াখুড়ি করা, কূঁড়েঘর বানানো, প্রয়োজনে শত্রুর সাথে হাতাহাতি ফাটাফাটি করা। এবং একথা বলাই বাহুল্য যে সব কাজগুলোই ভাবীসাহেবার আরাম-আয়েশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে। ঠিক তেমনি ভাবে ভাইজান যদি চিৎকাত হয়ে পড়ে থাকেন বা শুধুমুধু ঘরেই বসে থাকেন সেটা একধরনের অশনিসংকেত। কাজেই সেই আদিকাল থেকেই ভাবীসাহেবানরা, মিনসের ঘরে শুয়ে-বসে থাকাটা সইতে পারেন না এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তাতে বিঘ্ন ঘটাবার।
যদিও সেই দিন আর নেই, কিন্তু নারী জাতির ভেতরে সেই ভয়টা রয়ে গেছে। কাজেই সেই হাবিল-কাবিলের যুগে ব্যাটাছেলে যখন গুহার দেয়ালে পিকাসোগিরি করত, তখন তেনারা যেমন অহেতুক চিৎকার চেচামেচি করতেন অথবা পাথর ছুঁড়ে মারতেন আজও যখন সায়েব বাসায় ফিরে বই বা ম্যাগাযিন নিয়ে তাতে ডুবে যান সেই পুরনো ভয় ফিরে ফিরে আসে।
যখন ম্যান ইউ না বার্সা, মেসি না ক্রিস্টিয়ানো বা খানিক লুল পাঠক হলে শারাপোভার খাঁজভাজ নিয়ে নিমগ্ন ঠিক তক্ষুনি আপনার উনি শুরু করবেন, জানো আজকে না ওই বাসার ভাবী এবং তার হা-বিতং। আপনি যত চাইবেন শারাপোভার ডাকে সাড়া দিতে আপনার উনি তত চাইবেন আপনাকে সবিস্তারে বলতে এই জুটি কিভাবে গড়ে উঠলো, অথবা বাইরে থেকে যদিও মাখোমাখো ভালোবাসা দৃশ্যমান কিন্তু সংসারটা আর টিকছে না।
এর সমাধান কি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাইজান গজগজ করে ওঠেন, কিঞ্চিত কটুবাক্য নিক্ষেপ করেন অথবা হাতের বই বা পত্রিকা সজোরে এবং সশব্দে মেঝেতে ছুঁড়ে মারেন। সমাধান হিসেবে এগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের, কারণ শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে ঝগড়াঝাটি, কান্নাকাটি, গোঁসাঘরে খিল, ভগবান না করুন স্যুটকেস গোছানো অব্দি ঘটনা গড়াতে পারে। এটা ঠিক যে ভাবী বাপের বাড়ি গেলে ঘর ঠান্ডা থাকে, কিন্ত সেই সাথে অন্যান্য উষ্ণতায়ও ঘাটতি পড়ে আর এতো জানা কথাই সব কিছুর পড়ে আপনি তাকে ভালোইবাসেন। আর সেই সাথে দুশ্চিন্তা তো থাকেই, বাপের বাড়িতেই গেলো তো নাকি অন্য কোথাও। আপনি যদি একেবারেই পাষণ্ড না হন তাহলে সুখের দিনগুলোর কথা মনে পড়বে, শেষমেষ ট্যাঁকের কড়ি খসিয়ে ডজনখানেক গোলাপ আর একখানা শাড়ি নিয়ে হাসিমুখে রিকনসিলিয়েশন করতে যাবেন। গোলাপে যদি নাও হয়, শাড়িতে মন ভেজাবার কাজটা অনেকটাই সহজ হবে। তবে সব কথার শেষ কথা যে প্রতিবাদ এর উপায় হিসেবে বড্ড খরচান্ত এবং পুনরাবৃত্তি না হওয়াটাই বাঞ্জনীয়।
সবচাইতে ভালো সমধান হচ্ছে, ভাবী যখন বয়ান শুরু করবেন তখন আপনাকে ভান করতে হবে যে আপনি পুরোটাই শুনছেন। ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে আসলে ততটা না। আপনার মনসংযোগকে প্রয়োজন অনুসারে ভাগ করে বেশিরভাগটা নিজের পড়ায় আর বাকিটা ভাবীর প্যানপ্যানানিতে দিন। বোবা হয়ে থাকলে চলবে না, মাঝে মাঝে উপযুক্ত সময় আসলে, উৎসাহ নিয়ে “তাই নাকি” অথবা গলায় রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে “না” বলুন এবং অতি অবশ্যি আপনার নিজের পড়া তো চলছেই। এর মাঝে আন্দাজমত মাঝে মাঝে “উম”, “হুম” এবং “উম হুউম” ব্যবহার করবেন তবে ভুলেও “হু?” বলবেন না। এতে আপনার মুখোশ খুলে যেতে পারে মানে আপনার অমনোযোগ ভাবী টের পেয়ে যেতে পারেন। “ এটা তুমি কি বললা”, এই ধরনের শব্দাবলী খুব সাবধানে ব্যাবহার করবেন এবং তার আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার বেগমসাহেবার গলার ওঠানামা থেকে আপনি সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারেন যে পরিস্থিতি আপনার কাছে কী দাবি করে।
এই ধরনের প্রতারণা চালিয়ে যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ যদি উনি কোনো বই বা পত্রিকা থেকে পড়তে থাকেন, কারণ সেক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই ওনার চোখ বইয়ের পাতার থাকবে। ব্যাপারটা একটু ঘোঁট পাকিয়ে যায় যদি উনি বই-পুস্তক ছাড়াই ঘটনার ঘনঘটা এবং তার আগের এবং তার পরের ঘটনা বলে যেতে থাকেন, এই সময় দৃষ্টি আপনার ওপরেই থাকার কথা। সেক্ষেত্রে কী করনীয়? উনি বলতে শুরু করলেই আপনার বই বা পত্রিকা হাঁটুর উপরে রাখুন এমন ভান করুন যাতে মনে হয় যে আপনি ওটা একেবারেই রেখে দিয়েছেন, যদিও এমনভাবে রাখুন যাতে আপনি পড়া চালিয়ে যেতে পারেন। আমি একজনের ঘটনা জানি, উনি খবরের কাগজ মাটিতে ফেলে দেন, তারপর সোফায় বসা অবস্থায় একটু ঝুঁকে বসেন, চোখ নিচের দিকে এবং হাত দিয়ে চোখ আড়ালে রাখেন, দুই কনুই থাকে হাঁটুর ওপরে। আপনি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছেন এইরকম আবেশ তৈরি করুন এবং আপনার পড়া চালিয়ে যান।
অতর্কিত আক্রমনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। মানে আধুনিক ফুটবলে যেমন ডিফেন্ডাররা মাঝে সাঝে উপরে উঠলেও আবার খুব দ্রুত নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারে অনেকটা সেরকম আরকি। ধরুন আপনার উনি জানতে চাইলেন, “তোমার কি মনে হয়, ও কি এরকম করার কথা?” এই ধরনের আচমকা আক্রমন ঠেকাতে আপনার কান খাড়া রাখতে হবে “কি”, “কেন”, “কে”,”কোথায়”, “কবে”, “উচিত” এই শব্দগুলোর প্রতি। সাধারনত “হ্যা” বা “না” তেই কাজ চলে যাবে। যদি উপরের প্রশ্নের কথাই ধরি, আপনি “হ্যা” বললে উনি হয়ত বলবেন, “হু, আমারো তাই মনে হয়।” বা আপনি যদি “না” বলেন তাহলে উনি হয়ত বলবেন “আমি ওকে যতটা চিনি তাতে করলেও করতে পারে।” মোদ্দা কথা হচ্ছে এটা একটা জেনারেল গাইডলাইন। প্রতিটি স্বামীকে আপন আপন স্ত্রীকে ভালো করে জানতে হবে, উনি কি কি ভাবে আক্রমণ শাণাতে পারেন সে সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল হতে হবে এবং সে অনুযায়ী রক্ষণভাগ সাজাতে হবে। আরো একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, যে প্রশ্নটি ভাবী করছেন সেটি আপনার প্রতি নাকি সেটা ওনার কাহিনীর অংশ। ধরুন উনি বললেন, “তখন আমি জানতে চাইলাম, ক’টা বাজে?” আপনি যদি বেখেয়ালে বলে বসেন “সোয়া আটটা”, তাহলে বারোটা বাজতে বেশিক্ষণ লাগবে না। অভিযোগ, অপমান, ঝগড়া, কান্না, এগুলো অবশ্যম্ভাবী হয়তোবা আরেকখানা শাড়ি বা নেকলেসও।
আমার পরিচিত কয়েকজন আছেন যারা এই সমস্যা থেকে বাঁচতে পড়াশোনাই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এখন ওনারা আর কিছুই পড়েন না। আমি বলবো, এটা কাপুরুষোচিত।
ডিসক্লেইমারঃ “Listen to This, Dear” by James Thurber এর ভাবানুবাদ। ১৯৩২ সালে জানুয়ারি মাসে Harper’s Magazine এ প্রকাশিত হয়েছিলো।
মন্তব্য
অনুবাদক কি বিবাহিত? অবিবাহিতরা শুনুন - নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কেউ যদি এই গল্পটাকে গাইডলাইন মনে করে থাকেন তাহলে মাঠে মারা পড়বেন।
অনুবাদ চমৎকার হয়েছে, ভাষার সাবলীলতার জন্য একে অনুবাদ বলে মনে হয়নি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পাণ্ডবদা, বিবাহিত হলে কি আর অনুবাদের ঝামেলায় যেতাম? এক্কেবারে এক্সপেরিমেন্টাল রেজাল্ট পাব্লিশ করতে পারতাম।
আপনার গাইডলাইন কি বলে? আপনি এই পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেন?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
এখানে গাইডলাইন বলে কিছু নাই। contingency approach চালাতে হয়। এটা যে formulate করতে পারবে পরবর্তী দশ বছরের জন্য তার কপালে সব বিষয়ে নোবেল পুরস্কার বাঁধা থাকবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার কথা শুনে শাড়ি যদি ২ টা লাগে, তাহলে আপনি দায়ী থাকবেন (
ও আচ্ছা, লেখা খুব ভাল লেগেছে
আপনি তো মশাই হাড়কেপ্পন লোক, নাহয় দিলেনই খান কতক শাড়ি।
পড়বার জন্যে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
এত প্ল্যান কষে লাভ নাই। ঐ পত্রিকা বা বই যেটাই হোক ভালমত মুড়িয়ে ধপাধপ চাঁদির ওপর খান কতক লাগালেই সব ফন্দি ফিকির ঘুলিয়ে জল হয়ে যাবে
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা অসহায়। তবে জেনে রাখবেন, অত্যাচারিতের দোয়া স্রষ্টার আরশে তুফানের বেগে পৌঁছে যায়।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
লাফাংব্যাপার কী? আজকাল তো লিখেন-ই না!
অনুবাদ চমৎকার হয়েছে। শুরুর ট্যাগ খেয়াল করি নি, ডিসক্লেইমার না থাকলে বুঝতেই পারতাম না এটা অনুবাদ!!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
আজকাল ব্যাপক গবেষণা করছি, নোবেল কমিটি আমায় খুঁজে খুঁজে হয়রান।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
"অনুবাদ চমৎকার হয়েছে। শুরুর ট্যাগ খেয়াল করি নি, ডিসক্লেইমার না থাকলে বুঝতেই পারতাম না এটা অনুবাদ!!"
ধন্যবাদ। আমি আসলে কি করছি সেটা বলে না দিলে মানুষজন প্রায়শই বুঝতে পারে না। যেমন ছবি এঁকে তলায় লিখে দিতে হয় এটা কলা না কমলা।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম। দারুণ মজারু হয়েছে অনুবাদ
পড়বার এবং সেটা জানিয়ে যাবার জন্যে ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
ক্রমেই চতুষ্পদি হওয়ার দিকে এগুচ্ছি, এই সময়ে এরকম ভয় ধরান লেখা!!!
আত্তসুদ্ধি
ভয় পাবার কিছু নেই, সামান্য সাবধানতা অবলম্বন করলেই হবে।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
অতীত
এত হাসির কি হলো?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
স্ত্রীয়াশ্চ্রিত্রম দেবা ন জানতি কুতো মনুষ্যা!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
সে তো বটেই, সে তো বটেই।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
মজারু, তবে এইসব ১৯৩২ সালের স্ট্র্যাটেজি এখন আর চলে না...
আহা, এক কথায় বাতিল করে দিলেন? ধরুন আমি যদি ১৯৩২ সাল এর মনমানসিকতার বউ পেয়ে যাই?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
মজা লাগলো...
সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হইলো বউরে চাকরিতে ঢুকায়া দেওয়া...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এই বুদ্ধি আফনে টেরাই দিছিলেন?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
খুবই ফ্লুয়েন্ট হয়েছে, অনুবাদ বলে বুঝাই যায় না। দারুণ!
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
শুকরিয়া জনাব।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
সুপার লাইক অন্য সবার সাথে একমত, অনুবাদ মনেই হয় নাই, এটা অবশ্যই অনুবাদকের ক্রেডিট
ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
নতুন মন্তব্য করুন