রোদ ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের কৃষককুল ব্যবহার করত মাথাল। বাঁশের চটা ও গাছের শুকনো পাতা দিয়ে তৈরি মাথাল দেখতে অনেকটা হ্যাটের মতো। এখনো এদেশের কৃষকরা হালচাষের সময়, বীজ বোনার সময়, নিড়ানি দেওয়ার সময় রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে মাথাল ব্যবহার করে। অবশ্য হঠাত্ বৃষ্টিতে মাথাল না থাকলে বা হাতের কাছে না পেলে, মাথা বাঁচায় কলাপাতা বা বড় আকৃতির কচুপাতা দিয়ে।
কিন্তু, আধুনিক কালে দৈনন্দিন কাজে যেতে, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, আফিস-আদালতে যেতে মানুষ রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচে কী দিয়ে? কেন ছাতা আছে না? প্রচণ্ড গরমে রোদ থেকে বাঁচতে চাই ছাতা। বর্ষাকালে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতেও চাই ছাতা।
মুক্তোমালার ছাতি মাথায়
বর্ষা এলো রে,
সারা গায়ে গোলাপ পানি
ছিটিয়ে দিলো রে।।
এমন দিনে ছাতা না হলে চলে? কিন্তু এই ছাতা আবিষ্কার হয়েছিল কবে, ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, আজ থেকে চার হাজার বছর আগে। সেই সময়ের মিশর, গ্রীস, চীন ও আশিরীয় শিল্পে ও শিল্পজাত বস্তুতে ছাতার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরের প্রাচীন ভাষ্কর্য ও চিত্রশিল্পে ছাতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসব চিত্রে দেখা যায়, রাজকন্যা রথে চড়ে ভ্রমণ করছে, রথের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ ধরনের সুসজ্জিত ছাতা। আরও দেখা যায়, বিভিন্ন অলঙ্কার ও ফুলসজ্জিত ছাতা ব্যবহার করছে রাজপুরুষরা, যার ধার ঘেঁষে ঝুলে আছে লিলেন বা সিল্কের পর্দা, এই পর্দা রাজপুরুষকে সূর্যালোক ও তাপ থেকে আড়াল করে রাখছে। আরও অনেক চিত্রশিল্প রয়েছে যেখানে দেখা যায়, ছাতার নিচে বসে আছে রাজা, আর তার মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে ক্রীতদাস নারী। এশিয়া ও আফ্রিকাতেও খুব সীমিত পর্যায়ে রোদপ্রতিরোধক ছাতার ব্যবহার ছিল। গ্রীস ও রোমে ছাতা ছিল সম্মান ও আভিজাত্যের প্রতীক। সেখানকার বিশিষ্টজনদের কাঠ ও পাথরের তৈরি প্রতিমূর্তির মাথার ওপরে থাকত ছাতা। নারীরা রোদ থেকে নিজেদের আড়াল করবে ছাতার সাহায্যে এক সময় এমনি প্রথা ছিল রোমে।
এসব তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, সূর্যালোকে ছায়া পাওয়ার জন্য ছাতার ব্যবহার অতি প্রাচীনকালের। তখন ছাতা তৈরি হতো মূলত রোদ নিবারনের জন্য। এই ছাতাকে বলা হতো রোদ নিবারক ছাতা। এই ছাতার কাজ ছিল রোদে ছায়া দেওয়া। এরপর চীনারাই প্রথম বৃষ্টি নিবারক ছাতা উদ্ভাবন করে। এই ছাতা বৃষ্টির পানি থেকে মানুষকে রক্ষা করে। বৃষ্টির সময় ব্যবহারের জন্য চীনারা কাগজের তৈরি রোদ নিবারক ছাতায় মোমের প্রলেপ লাগিয়ে নিত।
সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইতালিতে প্রাচীন রোমান সভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ ছাতা ব্যবহারের সূচনা হয়। রোদের তীব্র তাপ থেকে বাঁচার জন্য ইতালির অনেকে পাখার মতো একটি বহনযোগ্য শেড ব্যবহার করত। ইতালীয় ভাষায় একে বলা হতো আমব্রেলাসেস (umbrellaces), যাকে মাথার ওপর এক ধরনের আচ্ছাদন বলা যায়। এটি চামড়া দিয়ে তৈরি হতো। এর ভিতরে কাঠের কাঠামো লাগানো থাকত। সাধারণত এটি ব্যবহার করত ঘোড়সওয়ারীরা। একটি হাতলের সাহায্যে আমব্রেলাসেস ঘোড়সওয়ারীদের উরুতে বসানো থাকত। ঠিক একই সময়ে স্পেন ও পর্তুগালে এই ধরনের ব্যবহার্যের অস্তিত্ব ছিল।
ছাতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Umbrella শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষার মূলশব্দ Umbraথেকে। এর অর্থ ছায়া। প্রথম দিকে ইউরোপে ছাতা শুধুমাত্র নারীদের ব্যবহার উপযোগী তৈজসরূপে বিবেচিত হতো। সম্ভবত নারীরা সূর্যালোকে ছায়া পাওয়ার জন্য ছাতা ব্যবহার করত বলেই এ ধরনের নামকরণ করা হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে ছাতা আরামদায়ক ও বিলাসী রৌদ্রনিবারক তৈজস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রানী এনের শাসনামলে লন্ডনে ছাতার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে তখন এখানেও ছাতার ব্যবহার শুধুমাত্র নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও ছাতা দুই ধরনের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো। প্রথমত: ছাতা ব্যবহৃত হতো গরম আবহাওয়ার দেশে রোদ থেকে বাঁচার জন্য, দ্বিতীয়ত: বৃষ্টিবহুল আবহাওয়ার দেশগুলোতে তুষার ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। তখনকার দিনে প্রধানত কাঠের ফ্রেমে কাপড় লাগানো ছাতা তৈরি হতো, যা মূলত নারীরা রোদ ও বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য ব্যবহার করত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর ইংল্যান্ডে নারী-পুরুষ উভয়ে ছাতা ব্যবহার করতে শুরু করে। ইংল্যান্ডের সকল বড় শহরে প্রথম যখন ছাতার ব্যবহার শুরু হয় সেই স্মৃতি নাগরিকদের মনে দীর্ঘদিন গেঁথে ছিল, যা বিভিন্ন স্মৃতিকথায় বর্ণিত হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (পরবর্তীকালে জেনারেল) উলফ প্যারিস থেকে লিখেছেন, ‘মানুষ এখানে গরম আবহাওয়া এবং তুষার ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছাতা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ইংল্যান্ডে এ ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবহার নেই দেখে আমি অবাক হই ।’
ঠিক এই সময়ে পারস্য (বর্তমান ইরান) থেকে আগত জোনাস হেনওয়ে (১৭২২-৮৬) ইংল্যান্ডে ছাতা ব্যবহার শুরু করেন। তিনিই প্রথম লন্ডনের রাস্তায় প্রায় ত্রিশ বছর প্রকাশ্যে ছাতা ব্যবহার করে পুরুষদের মধ্যে ছাতার ব্যবহার জনপ্রিয় করে তুলেন। এ কারণেই ইংরেজরা ছাতাকে ‘হ্যানওয়ে’ বলে। এ ক্ষেত্রে জোনাস হেনওয়ে স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার কারণে ছাতা ব্যবহার করছেনÑ এমন যুক্তিই তার কাছে ছিল একাধারে ছাতা ব্যবহারের পিছনে মানসিক শক্তি এবং অন্যান্য পথচারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র ভিত্তি।
পরিস্থিতি বোঝাতে সে সময়ের একটি ঘটনা উপস্থাপন করা যেতে পারে। ১৭৭০ সালে জন ম্যাকডোনাল্ড নামে ফ্রান্স থেকে আগত এক পথচারী সিল্কের চমত্কার একটি ছাতা মাথায় দিয়ে যাচ্ছিলেন, যা সে স্পেন থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তাকে এজন্য বিরূপ মন্তব্য ও বিদ্রুপ শুনতে হয়েছিল। তাকে অন্য পথচারীরা বিদ্রুপ করে বলেছিল, ‘তুমি কেন একটি বাস নিয়ে আসনি?’
প্রথম দিকে ইউরোপে কাঠ বা তিমির চোয়ালের অংশ বিশেষ দিয়ে ছাতার কাঠামো তৈরি হতো। আর কাঠামোর ওপর ছাউনি দেওয়া হতো পশুর লোম দিয়ে তৈরি কাপড় বা তেলতেলে মোটা কাপড় দিয়ে। কোনো কোনো ছাতা তৈরি হতো সিল্কের কাপড় দিয়ে। ভেজা অবস্থায় এই ছাতা খোলা ও বন্ধ করা ছিল খুবই কঠিন। আবার, আবলুস কাঠ বা এ কাঠের মতো শক্ত কাঠ দিয়ে ছাতার বাকানো হাতল তৈরি হতো। এ কাজের জন্য কারিগররা অনেক সম্মানী পেত। এ রকম ছাতার লাঠি এবং কাঠামো ছিল খুবই ভারী, যা ব্যবহার করা ছিল বেশ কঠিন। এই ছাতা দামের দিক থেকেও ছিল খুবই ব্যয়বহুল।
সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ। ১৭৮৭ সালে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, ইংল্যান্ডে পকেটে বহনযোগ্য ছোট আকৃতির ছাতাও তৈরি হতো। বিজ্ঞাপনদাতার দাবি অনুযায়ী, এটি ছিল ওই সময়ে তৈরি বা বাইরে থেকে আমদানি করা যে কোনো ছাতার চেয়ে উত্কৃষ্টমানের। এই ছাতা তৈরি হয়েছিল মূলত ফ্যাশনের দিকটি বিবেচনা করে। এর হাতলে আংটা লাগানো ছিল। হাতের আঙুলের সাহায্যে আংটা ধরে ছাতা বহন করা যেত এবং ব্যবহার শেষে দরজায় ঝুলিয়ে রাখা যেত। আবার কাঠের হাতল ও ভিতরে লম্বা লাঠি থাকার কারণে মাটিতে ভর দিয়ে হাঁটাও যেত। সাধারণত বয়ষ্ক মহিলারা এই ছাতা ব্যবহার করত।
১৮৫২ সালে স্যামুয়েল ফক্স নামে জনৈক ব্যক্তি ইস্পাত মোড়ানো কাঠামোযুক্ত ছাতা তৈরি করল। স্যামুয়েল ফক্স ইংলিশ স্টীল কোম্পানী নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার দাবি তিনিই প্রথম ইস্পাত মোড়ানো ছাতা উদ্ভাবন করেন। এর এক শতক পরে ছাতা তৈরির ক্ষেত্রে বড় ধরনের উদ্ভাবনের সূচনা হয়। তখনই প্রথম ভাঁজ করে গুটিয়ে রাখা যায় বা ভেঙ্গে বন্ধ করা যায় এমন ছাতা তৈরি হয়।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য
ইন্টারেস্টিং। এবং ধন্যবাদ।।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
সাধুবাদ জানাই আপনাকে।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
ছাতার সালতামামি ভালৈছে।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যটাও ভালৈছে।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
ছাতা সম্পর্কে এতো কিছু জানা ছিলো না আমার!
ধন্যবাদ। ভাল্লাগলো খুব।
...সচলায়তনে লোকজ বিষয় নিয়ে এরকম পোস্টের খুব অভাব।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
ধন্যবাদ।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
কতো সামান্য জিনিস আজকে ছাতা, অথচ কতো অসামান্য ইতিহাস আছে এর পেছনে।
খুব ভালো লাগলো।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
নতুন মন্তব্য করুন