রূপকথার গল্পে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার কথা আমরা শুনেছি। রাজপুত্র পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়ায়। দুঃসাহসিক অভিযানে চলে যায় অজানা দেশে। শুনেছি এসব গল্প। আমরা চোখে দেখিনি পঙিখরাজ ঘোড়া। পঙ্খিরাজ ঘোড়া দূরে যাক, সাধারণত ঘোড়ায়ও চড়ি নি। আমাদের দেশে বাহন হিসেবে ঘোড়ার প্রচলন নেই। এক সময় ঘোড়ার গাড়ি ছিল। এখন তাও বিলুপ্তির পথে।
টগবগিয়ে চলছে টমটম
ওরে তোরা সরে দাঁড়া,
কে কে যাবি জলদি আয়
জলদি করে পা-টা বাড়া।
কিন্তু সে দিন কি আর আছে? হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে।
আমাদের দেশের অনেক জায়গাতেই এক সময় নানারকম ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। একেক জায়গায় ঘোড়ার গাড়িকে একেক নামে ডাকা হতো। কোথাও এটাকে বলা হতো টমটম। কোথাও এক্কাগাড়ি। কোথাও এটি টাঙ্গা, কোথাওবা জুড়িগাড়ি নামে পরিচিত। আবার কোথাও বলা হতো ঠিকাগাড়ি। টমটমের বিভিন্ন নামের পাশাপাশি এর বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য লক্ষ্য করার মতো। কোথাও টমটম দুই চাকার। আবার কোথাও চার চাকা বিশিষ্ট। কোনো কোনো এলাকায় টমটমে যাত্রীদের আসন পুরোপুরি খোলা। আবার কোনো এলাকার টমটমে যাত্রী বসার জায়গাটি পুরোপুরি আবৃত। এতে আবার আলো বাতাসের জন্য জানালার ব্যবস্থা রাখা হতো। কোনো গাড়ি চালাতে এক ঘোড়া লাগে, আবার কোনো গাড়ি চলে দুই ঘোড়ায়। মোট কথা, একেক এলাকার ঘোড়ার গাড়ির আকৃতি একেক রকম ছিল। এসব গাড়ি যারা চালাত তাদের বলা হতো কোচোয়ান।
আমরা ছেলেবেলায় আমাদের গাঁয়ে ঘোড়ার গাড়ি দেখেছি। আমাদের গাঁয়ে ঘোড়ার গাড়িকে বলা হতো টমটম। টমটমের আকৃতি ছিল ছোট ঘরের মতো। তাতে দুইজন যাত্রী ভালোভাবে বসতে পারত। সামনে ছিল চালকের বসার জায়গা। গাড়ির পুরো কাঠামোটি দুই চাকার উপর বসানো হতো। টমটম টেনে নিয়ে যেত একটি ঘোড়া।
আমরা নানাবাড়ি যেতাম টমটমে চড়ে। টমটমে চড়ার জন্যই কখন নানাবাড়ি যাব সে আশায় দিন গুনতাম। টমটমে চড়া ছিল আমাদের জন্য মহাআনন্দের ব্যাপার। টমটম দেখাটাও ছিল উত্তেজনার বিষয়। আমরা টমটম দেখার জন্য বড় রাস্তার ধারে বসে থাকতাম। টমটমের পেছন পেছন অনেক দূর ছুটে যেতাম। আবার জানালায় বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম টমটম দেখার জন্য।
টমটম শব্দের আভিধানিক অর্থ এক ঘোড়ায় টানা দুই চাকার গাড়ি। টমটম শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে একটি ইংরেজী শব্দ থেকে। ইংরেজী ট্যান্ডেম শব্দের অর্থ দুই বা ততোধিক ঘোড়ায় টানা খোলা গাড়ি বিশেষ। এই ট্যান্ডেম শব্দটির বিকৃত উচ্চারণ হলো টমটম।
ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ায় টানা গাড়ির প্রচলন হয় ইংরেজ আমলে। আঠারো শতকের শেষ দিকে এদেশীয় ধনীক শ্রেণী ইংল্যান্ড থেকে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি আমদানি করত। এসব ঘোড়ায় টানা গাড়ির মধ্যে ছিল ল্যান্ডো, ল্যান্ডোলেট, ফিটন ইত্যাদি। এসব গাড়ি টানার জন্য অস্ট্রেলিয়া, আরব দেশ থেকে ওয়েলার ঘোড়া, আরবি ঘোড়া আমদানি করা হতো। এসব ঘোড়ায় টানা গাড়ির প্রথম প্রচলন হয় কলকাতায়। তারপর তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের বড় বড় শহরে এসব গাড়ির প্রচলন ঘটে। পরে ক্রমন্বয়ে মফস্বল শহরেও ছড়িয়ে পরে এসব গাড়ি। সে সময়ে ইংরেজ এবং এদেশীয় অভিজাত শ্রেণীর প্রধান বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি।
ঢাকায় প্রথম টমটম প্রচলন করেন আর্মেনীয় বণিক সি.এম. সিরকোর। ঢাকায় তার বিভিন্ন জিনিসের ব্যবসা ছিল। তিনিই প্রথম ১৮৫৬ সালে ঢাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টমটম চালু করেন। তার টমটমের ব্যবসা বেশ জমে উঠেছিল। এক সময় এই টমটমই হয়ে উঠেছিল ঢাকার প্রধান যানবাহন। ঢাকায় এই টমটমকে বলা হতো ঠিকাগাড়ি।
এক সময় ঢাকায় টমটমের বেশ কদর ছিল। যানবাহন হিসেবে উলে¬খযোগ্য ছিল টমটম। অভিযাত পরিবারের সদস্যরা যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতো টমটম। নওয়াব পরিবারের সদস্যরা টমটমে চড়ে বেড়াতে বের হতো। টমটম ছাড়া অন্য তেমন কোনো যানবাহনের অস্তিত্ব ছিল না।
ঢাকার টমটমের একটি পরিসংখ্যান দেওয়া যায়। ১৮৬৭ সালে ঢাকায় টমটমের সংখ্যা ছিল ষাটটি। ১৮৭৪ সালে ছিল তিনশত। ১৮৮৯ সালে ছিল ছয় শত। বর্তমানে ঢাকায় টমটমের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বছর পাঁচেক আগেও ছিল ত্রিশটির মতো। এখন প্রায় পনেরটি।
যুগ বদলেছে। এখন যন্ত্রের যুগ। বেড়েছে মোটর গাড়ির ব্যবহার। কমে গেছে টমটম। বলা যায়, মোটর গাড়ির সঙ্গে পাল¬া দিয়ে মিটমিট করে টিকে আছে টমটম। এখন ঢাকায় শুধু নওয়াবপুর-সদরঘাট রাস্তায় টমটম চলে। এই লাইনে পনেরটির মতো টমটম চলে। একটি টমটমে মোট ৯ জন যাত্রী ধরে। ভাড়া যাত্রী প্রতি দশ টাকা।
নওয়াবপুর-সদরঘাট ছাড়াও উৎসব উপলক্ষে শহরের অন্যত্রও টমটম দেখা যায়। কোনো উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত র্যালিতে, নববর্ষের মিছিলে সুসজ্জিত টমটম দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা টমটমে চড়ে উল¬াস করে। পুরোনা ঢাকার বিয়ে কিংবা মুসলমানির অনুষ্ঠানে আজও আছে টমটম। যার মুসলমানী হয়েছে তাকে নিয়ে টমটমে চড়ে পুরনো ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করা হয়। টমটমে চড়ে বরযাত্রী যায়। এরকম সামাজিক অনুষ্ঠানে টমটমের খানিকটা গুরুত্ব বেড়ে যায় বৈকি!
মন্তব্য
টমটম নিয়ে এতো সুন্দর আলোচনা অথচ একটিও মন্তব্য নেই! লেখাটি কি প্রথম পাতায় আসেনি?
যাই হোক, ধন্যবাদ আবু রেজাকে সুন্দর সুন্দর তথ্য প্রদানের জন্য।
আর একটি কথা- ঢাকার প্রতিষ্ঠা মতান্তরে ছয়শত বছর।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
ধন্যবাদ। মানলাম,ঢাকার প্রতিষ্ঠা বিষয়ে মতান্তর আছে।লেখায় তখ্যগত ভুল থাকলে তা অবশ্যই সংশোধনযোগ্য।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
- প্রথম টমটমে চড়ার স্মৃতিটা মনে আছে। দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ঝুলে চড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য কোচোয়ান মহাশয় হুমকি ধামকি দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলো। তারপর সুস্থভাবে কখনো টমটম বা কোনো ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছি বলে মনে পড়ছে না। অভিজ্ঞতার কথা তাই বয়ান করতে পারছি না।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আপনার প্রথম টমটম চড়ার স্মৃতি পড়ে ভালো লাগলো। আমার লেখাটি পড়েছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
নতুন মন্তব্য করুন