বৈশাখে মেলা
আবু রেজা
আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি
বাঁশি তো আগের মতো বাজে না
মন আমার তেমন কেন সাজে না
তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি ॥
সত্যিই তো! ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি। সেই ছোটবেলায় চৈত্রের শেষে বা বৈশাখের পহেলা উপলক্ষে গাঁয়ের হাটে মেলা বসত। সেই মেলার কত আকর্ষণ ছিল! নাগরদোলায় চড়তাম, আমরা এটিকে বলতাম চড়কি। নানা রকম বাঁশি কিনতাম। বাশির পেঁ-পুঁ আওয়াজে মেলার চত্বর, মেলার পথ সরগরম থাকত। মাটির কত খেলনা কিনতাম, পুতুল কিনতাম। মাটির তৈরি পাখি, হাতি, ঘোড়া আমাদের আকর্ষণ করত!
আর একটি বিশেষ জিনিস কিনব বলে মেলার জন্য অপেক্ষা করতাম। তা হলো কভারে গুটানো ছুরি। আমরা বলতাম চাকু। ছুরিটি এমন যে ভাঁজ দিয়ে খোলসের ভিতর গুটিয়ে নেওয়া যায়। আবার প্রয়োজনে ধারাল অংশ বের করা যায়। এ ধরনের ছুরি মেলা ছাড়া পাওয়া যেত না। এ সময় বিশেষ করে চৈত্র থেকে শুরু হয়ে বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাস আমের মওসুম। এ সময় ছুরি বা চাকুর বিশেষ প্রয়োজন হতো। এ সময়টা কালবোশেখির মওসুম। ঝড়ে আম পড়বে। সে আম কুড়িয়ে গাছতলায় বসেই ছুরি দিয়ে ছিলে খাওয়ার স্বাদই আলাদা!
আমাদের গায়ের হাটে এ মেলা বসত, সারাদিন চলত। দুপুরের পর বেশি ভিড় হতো। আমরা দুপুর বেলা গোসল-খাওয়া সেরে মেলায় চলে যেতাম। সারা বিকাল মেলায় ঘুরে বেড়াতাম। মণ্ডা-মিঠাই কিনে খেতাম, বাড়ির জন্যও আনতাম। মেলায় পাওয়া যেত, বাতাসা। আর ছিল চিনির তৈরী হাতি, ঘোড়া, পাখি ইত্যাদি। বিন্নিখই শুধুমাত্র মেলাতেই পাওয়া যেত। পছন্দের খেলনার প্রতি শিশুদের বেশি ঝোঁক থাকত। মেলায় ঘুরে, পছদেমতো খেলনা কিনে সন্ধ্যায় বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরতাম।
মেলা যে শুধু ছোটদের কাছে আকর্ষণের বিষয় ছিল তা নয়। বড়রাও সমান তালে মেলায় যেত। তারা কিনত ঘর, গৃহস্থালী আর সংসারের নানা জিনিস। হালচাষের লাঙল-জোয়াল-মই থেকে শুরু করে খাট, পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল, দা, খন্তা, শাড়ি, গয়না, চুড়ি, মালা ইত্যাদি ঘর সংসারের এমন জিনিস নেই যা মেলায় আসত না। সারা বছর ধরে বিক্রেতারা অপেক্ষা করত কবে মেলা হবে, নানান পসরা সাজিয়ে বসবে তারা। তারা গৃহী মানুষ অপেক্ষা করত কবে মেলা বসবে, সংসারের জন্য তারা কিনবে নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র।
আমাদের জন্য মেলার আরেকটা আকর্ষণ ছিল সাপের খেলা, বানরের নাচ। মেলা উপলক্ষে সার্কাস প্যান্ডেল বসত, পুতুল নাচের আসর বসত। আরো ছিল কবির গান, যাত্রার আসর।
বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে, মেলা মানে বিশেষ কোনো উপলক্ষে হাট-বাজার অপেক্ষা প্রচুরতর পণ্য ক্রয়-বিক্রয় এবং আমোদ-প্রমোদের অস্থায়ী ব্যবস্থা, যেমন-রথের মেলা। আবার মেলাকে অস্থায়ী প্রদর্শনী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেমন-শিল্প মেলা। মেলাকে বলা হয়েছে জনসমাগম, সমাবেশ। ভিন্ন অর্থে মেলা মানে সমাজ বা সভা বলা হয়েছে, যেমন- পণ্ডিতদের মেলা। মেলা শব্দের সাদা-মাটা অর্থ পণ্য কেনা-বেচার সমাবেশ। মেলার প্রতিশব্দ আড়ং। আড়ং মানে মেলা।
অভিধানে যাই থাক, মেলা বাংলার লোকজীবন, এমন কি আধুনিক কালের শহুরে জীবনের সঙ্গেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ঠিক কবে এ মেলার শুরু হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে দিনক্ষণ বলা যায় না, মানুষ পণ্য বিনিময়ের জন্য প্রাচীনকালে গড়ে তুলেছিল হাট-বাজার ব্যবস্থা। হাট-বাজারের আনুষ্ঠানিক রূপ বলা যায় মেলাকে। ধারণা করা হয়, মেলার সূচনা ঘটেছিল মানুষ ব্যবসায়-বাণিজ্য শেখার পর থেকে। হাট-বাজার নিত্তনৈমিত্তিক। আর মেলা বার্ষিক বা কোনো উপলক্ষভিত্তিক ও উৎসবকেন্দ্রিক। লৌকিক উৎসব হিসাবে মেলার আয়োজন হয়।
মেলা আয়োজনের উপলক্ষের শেষ নেই। আমাদের দেশে ধর্মীয় উৎসবও মেলার একটি সর্বজনীন উপলক্ষ বটে। ঈদ উপলক্ষে মেলা বসে, মেলা বসে পূজা উপলক্ষেও। জন্মাষ্টমীর মেলা হয়, মেলা বসে মুহরমের। রথযাত্রা উপলক্ষে মেলা বসে। চৈত্রের শেষে হয় চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, বৈশাখের শুরুতে হয় বৈশাখি মেলা। ঈদ বা পূজার মেলায় ধর্মীয় ভাব-ধারা থাকলেও বৈশাখি মেলা সর্বজনীন।
গ্রামীণ লৌকিক জীবনের আরেকটি লোকজ মেলা হলো পৌষ মেলা। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেলাই পালা-পার্বণকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয়। যেমন- নববর্ষে বসে বৈশাখি মেলা, নবান্ন উপলক্ষে অঘ্রানে বা পৌষে বসে পৌষ মেলা। আবার জাতীয় দিবসকে কেন্দ্র করেও মেলা বসে। যেমন-বিজয় মেলা, একুশের বই মেলা।
সাধক, পীর, ফকির, কবি বা খ্যাতিমান ব্যক্তির স্মরণেও মেলা বসে। যেমন- লালন মেলা বসে কুষ্টিয়ায়। যশোরের সাগরদাড়িতে বসে মাইকেল মধুসূধন মেলা। নড়াইলে বসে সুলতান মেলা।
আবার উপলক্ষ ছাড়া মেলারও অভাব নেই। এ মেলার উদ্দেশ্য অনেকটাই বাণিজ্যিক। যেমন-বাণিজ্য মেলা, বসতি মেলা, ইত্যাদি। আয়োজিত হচ্ছে পণ্য বা শিল্প ভিত্তিক মেলা, যেমন- শিল্প মেলা, কুটিরশিল্প মেলা, তাঁতশিল্প মেলা, চামড়াশিল্প মেলা, পোশাকশিল্প মেলা ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু মেলা আছে ব্যতিক্রমধর্মী। যেমন- মৎস্য মেলা, কৃষি মেলা, বই মেলা। এর মধ্যে কিছু মেলার উদ্ভব ঘটেছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রসারের কারণে। যেমন কম্পিউটার মেলা বসছে, বিজ্ঞান মেলা হচ্ছে।
আবার মানুষের জীবনধারা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মেলার ধরন ও প্রকৃতি। এক সময় ভাবাই যেত না বসতি মেলা হবে। মেলায় বিক্রি হবে প্লট কিংবা ফ্ল্যাট। মানুষ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শিল্প ও বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে এসব মেলা আয়োজন করছে।
এত মেলার ভিড়ে আমাদের লোকজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মেলা বলতে বোঝায় বৈশাখি মেলাকে। যেখানে এক সময় তালপাতার বাঁশি থেকে শুরু করে লৌকিক এমন কোনো জিনিস ছিল না যা পাওয়া যেত না। আর এখন তালপাতার বাঁশি না মিললেও নিদেন পক্ষে বছরে এক বার অন্তত ঐ বাঁশের বাঁশি তো মিলে। আর পাওয়া যায় লোকজ উপকরণের পাশাপাশি আধুনিক দ্রব্যসামগ্রীও।
বৈশাখি মেলা বসত খোলা ময়দান, বটের ছায়া, নদীর কিনারায়। আগের দিনে তাই বেছে বেছে নদীর কিনারে বটের ছায়ায় কিংবা খোলা ময়দানে মেলার জায়গা নির্বাচন করা হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন ভালো থাকে তাও বিবেচনায় রাখা হতো। সেই জন্য আগে মেলা বসত বড় রাস্তার ধারে, রেল স্টেশনের কাছে, নদীর তীরে। মেলা উপলক্ষে রকমারী সাংসারিক পণ্য, ভিন্ন ধরনের মিষ্টি, নানারকম খেলনা ইত্যাদি বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকত। মেলার মাঠে থাকত পুতুল নাচের আসর। থাকত নাগরদোলা, কবি গান ও বাউল গানের আসর। রাতে হতো যাত্রাপালা।
বাংলাদেশের মেলা বসে বার মাস ধরে। বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত বছরের এমন কোনো মাস নেই যে মাসে দেশের কোথাও না কোথাও দুই/চারটি মেলা হচ্ছে না। এ সব মেলার কোনোটি এক দিন, কোনোটি দুই দিন, কোনোটি তিন দিন ধরে চলে। কোনো মেলা চলে সাত দিন। কোনোটি দুই সপ্তাহ। আবার কোনো মেলা চলে মাসব্যাপী।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, দেশে সারা বছরে প্রায় তের শত মেলা বসে। বাংলা একাডেমীর ধানশালিকের দেশ, ২৫ বর্ষ ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত এক তালিকায় ১২৯৩টি মেলার নাম, ঠিকানা, উপলক্ষ, স্থায়ীত্ব ও প্রধান আকর্ষণ উল্লেখ করা হয়েছে।
পালা-পার্বণ, উপলক্ষ, উৎসব ইত্যাদি বিবেচনায় আমাদের প্রধান প্রধান মেলা হলো বৈশাখিমেলা, পৌষমেলা, ঈদমেলা, দুর্গাপূজার মেলা, কালিপূজার মেলা, মুহরমের মেলা, জন্মাষ্টমীর মেলা, বিজুমেলা, পুন্যাহমেলা, বৌদ্ধমেলা, শিবমেলা, বাউলমেলা, শীতলীর মেলা, মঙ্গলচণ্ডির মেলা, মনসার মেলা, কালিপূজার মেলা, দেওয়ালি মেলা, বসন্তমেলা, চৈত্রসংক্রান্তি মেলা, দোলপূর্ণিমার মেলা, বইমেলা, কম্পিউটার মেলা, কৃষিমেলা, মৎসমেলা, বৃক্ষমেলা, ঝুলনমেলা, নববর্ষের মেলা, ওরস উপলক্ষে মেলা, স্নানের মেলা, ক্ষেত্রঠাকুরের মেলা, কীর্তনমেলা, রথযাত্রার মেলা, উল্টোরথ মেলা, নৌকাবাইচ উপলক্ষে মেলা, ভাদ্র সংক্রান্তির মেলা, আবির্ভাব ও তিরোধান উপলক্ষে মেলা, আশ্বিন সংক্রান্তির মেলা, রাস পূর্ণিমার মেলা, নবান্ন উৎসবের মেলা, ঘোড়দৌড়ের মেলা, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, মাঘীপূর্ণিমার মেলা, গণেশ পূজার মেলা, সূর্যপূজার মেলা, চড়কপূজার মেলা, বাসন্তিপূজার মেলা ইত্যাদি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পশু-পাখি প্রদর্শনী ও বিক্রির উদ্দেশ্যেও মেলা আয়োজন করা হয়।
গ্রাম বাংলার সনাতন মেলায় বিচিত্র পণ্য সামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রি হয়। দৈনন্দিন জীবনের নিত্ত প্রয়োজনীয় সকল জিনিস মেলায় পাওয়া যেত। মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলস, সানকি, সরা মালসা, ঘটি ইত্যাদি মেলা উঠত। মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা যেমন-পুতুল, হাতি, ঘোড়া, নৌকা ইত্যাদি মেলায় বিক্রি হতো। কাঠের তৈরী খাট-পালঙ্ক, আরমারী, চেয়ার-টেবিল, আলনা, সিন্দুক, পিঁড়ি, খড়ম, বেলন, ডালঘুটনি, লাটাই, লাটিম, লাঙল, জোয়াল, মই পাওয়া যেত। বাঁশ ও বেতের কুলা, ডালা, টুকরি, ধামা, পাখির খাচা, মাছ ধরার চাঁই, খালুই, ভেলকি, দরমা, মাদুর, চাটাই, পাটি, পাখা, বাঁশি ইত্যাদি মেলায় উঠত। লোহার দা, বটি, কুড়াল, নিড়ানি, পাচন, খন্তা, কুদাল, কড়াই, তাওয়া, জাঁতি, হামান, বেড়ি, লাঙলের ফলা ইত্যাদি মেলায় পাওয়া যেত।
মিষ্টি জাতীয় ও অন্যান্য খাবারের মধ্যে মুড়ি, মুড়কি, চিড়া, খই, দই, নাডু, তক্তি, মণ্ডা, মিঠাই, জিলাপি, বরফি, মোরব্বা, বাতাসা, কদমা, মুরালি, চিনির তৈরী হাতি, ঘোড়া, বাঘ, পাখি ইত্যাদি পাওয়া যেত। সাজ-সজ্জার বিভিন্ন জিনিস যেমন-শঙ্খ ও ঝিনুকের শাঁখা, বালা, রাজু, আংটি, কাচের চুড়ি, আয়না, চিরুনি, বিভিন্ন ধাতব গয়না মেলায় উঠত। ফলমূলের মধ্যে পাওয়া যায় আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, আতা, ডালিম, পেয়ারা, আনারস, কলা, নারকেল, বরই, শসা, খেজুর ইত্যাদি।
মেলায় বিনোদন মাধ্যম ছিল মূলত লোকজ আঙ্গিকের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। যেমন-যাত্রা, সার্কাস, সঙযাত্রা, ঘোড়দৌড়, যাদু, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, সাপখেলা, বানরনাচ, পায়রা ওড়ানো, নাগরদোলা ইত্যাদি। কিছু খেলার আয়োজন থাকত। যেমন-হাডুডু, লাঠিখেলা। মেলায় বসে লোকসংগীত, কবিগান, বাউলগান, বিচার গান, যাত্রাগানের আসর।
কিন্তু গ্রাম-বাংলার স্মৃতি জাগানিয়া লোকজ সেই মেলার আমেজ অনেকাংশে হারিয়ে গেছে। আধুনিক বাণিজ্যিক মেলার চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সেই লৌকিক মেলা।
মন্তব্য
সচল পরিবারের সকল সদস্যকে নববর্ষের শুভেচ্ছা!
নতুন বছরে সচলের কলম আগের মতই সচল থাকবে, এই প্রত্যাশা! বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সচল স্পন্দিত হবে প্রগতিশীলতার ধারক ও বাহক হয়ে, এই কামনা!
সবাইকে শুভ নববর্ষ!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
নতুন মন্তব্য করুন