প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সাকিব ম্যারিল্যান্ড থেকে নিউজার্সীর ইউনিয়ন শহরে গেল। ভাল লাগছিল এই ঐতিহাসিক মুহুর্ত্বে সাকিব থাকবে। অন্তত তার কাছ থেকে একটু বিশদ জানতে পারব। অপেক্ষার পালা শেষে সাকিবের ই-মেইল হাতে এলো কিছুক্ষণ আগে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে জেনোসাইড নিয়ে তার লেখাটা বাংলায় টাইপ করতে করতে আমি নিজে হারিয়ে গেলাম ১৯৭১-এ। বিশেষ করে ই-মেইলের শেষ লাইনগুলো উস্কে দিল আমার আর আমাদের সম্মিলিত অপরাধবোধ। ৭১-এর ঘাতকরা পূনর্বাসিত যখন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আমাদের জাতীয় চেতনায় প্রচন্ডভাবে উপেক্ষিত। কি চরমভাবে আমরা এদেশের শহীদদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে ভুলে গেছি যাদের রক্তে এদেশ গড়া তারা ও তাদের স্বজনদের রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি। কবে হবে ৭১-এর চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের প্রচ্ছদপত্র? এর উত্তর আমার জানা নেই।
আমি এতো দীর্ঘ ই-মেইল কখনও পাইনি। তার লেখার প্রত্যেকটা অক্ষর কস্টে ভেজা। সাকিব লিখছে, "মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা যখন একের পর এক তাদের আপনজন হারাবার কথা বলতে শুরু করলো, জনাকীর্ণ সেমিনার হল পিনপতন নিস্তব্দতায় নিপতিত হলো। প্রায় তিনশত দর্শকে ভরা হলরুম প্রত্যক্ষ করতে থাকল স্বজন হারাবার কস্ট, বেদনা সংক্রামিত প্রত্যেক দর্শেকর অশ্রুসিক্ত চোখ নতুন করে দেখল ১৯৭১-এর গণহত্যার বিভীষিকা"। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ার চাপা থাকা কস্ট সাকিবের ই-মেইলের প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠল। আমাদের জাতীয় গ্লানি যে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি, বরং তাদেরকে পুরস্কৃত করেছি ও পূনর্বাসিত করেছি। সেমিনারে একজন গবেষক বললেন, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার প্রধানমন্ত্রী হয়েছে, রাস্ট্রপতি হয়েছে সামরিক সরকারের আমলে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকটা নিষিদ্ধ করেই রাখা হয়েছিল। আমরা বারবার ভুলে যাই, দেশদ্রোহী আর যা-ই হোক, দেশপ্রেমী কখনও হয় না।
বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের নিউজার্সী অঙ্গরাজ্যের কীন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ১৯৭১ সেমিনার হলো ডিসেম্বরের ৯ তারিখে। গণহত্যা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী দেওয়া হচ্ছে। তাতে যোগ হচ্ছে বাংলাদেশের ১৯৭১-এর গণহত্যার বিষয়টি। গতকাল ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি। কীন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশে ১৯৭১-এর গণহত্যা নিয়ে গ্রাজুয়েট কোস ওয়ার্ক সকল মুক্তিযুদ্ধের মননের মানুষকে গভীরভাবে আলোড়িত করে আসছিল। ৭১ নিয়ে স্বপ্নের বুনন তাহলে বাস্তব হচ্ছে। ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, নির্যাতন, যুদ্ধাপরাধ, বিচার- এসব বিষয় যখন আমাদের সার্বিক জীবনধারায় বেদনাদায়কভাবে উপেক্ষিত তখন ভিন মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এধরণের যুগান্তকারী পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে নতুন প্রজন্মের কিছু সচেতন সাহসী যোদ্ধা। এরা কয়েকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে কীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে দেখিয়েছেন ১৯৭১-এর গণহত্যার ব্যাপকতা ও গভীরতা। তাদের ভাবনার ফসল গতকালের সেমিনার। নিউজার্সীতে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ড: নুরুন্নবী তাদের উদ্যোগের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তরুণ আর প্রবীণরা চেস্টা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের আর শহীদ পরিবারের স্বজনদের জড়ো করতে। ৭১-এর চেতনায় তাড়িত একটি ভাবনার সফল ও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পাচ্ছে কীন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৭১ কোন বিবর্ণ স্মৃতি নয়। সময়ের ও অবস্থানগত ব্যবধানে ১৯৭১ কে ব্যবচ্ছেদ করা যায় না। শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের ছেলেরা যখন অশ্রুসিক্ত কন্ঠে ভোররাতে তাদের বাবাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন তখন শহীদ সিরাজউদ্দীন আবারও ফিরে এলেন প্রবলভাবে। শাহীন শাহ মনে করিয়ে দিলেন তার ভাই জহির রায়হান আর শহীদউল্লাহ কায়সারের কথা। সিলেট মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা: শামসউদ্দীন ভেবেছিলেন হাসপতালে কর্মরত অবস্থায় তাকে কেউ ক্ষতি করবে না। জেনেভা কনভেনশন আর মানবাধিকার কনভেনশন বর্বর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেনি ডা: জিয়া আহমেদের বাবাকে। সিলেট হাসপাতালের পাশে নিমর্মভাবে তার সহকর্মীদের সাথে কর্মরত অবস্থায় শহীদ হলেন। একইভাবে শহীদ মেজর হাসিবের কন্যা তার ৭ বছরের স্মৃতির পাতা থেকে নিয়ে এলেন শেষবারের মতো দেখা তার বাবার মুখটির কথা। একইভাবে চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সার্জন ডা: আশরাফ আলী তালুকদারকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে হত্যা করা হয়। বাবার মৃত্যুর সাক্ষী তখনকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ডা: মাসুদুল হাসানও গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন। রাস্তার পাশে ফেলে রাখা বাবার মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার পাওয়া আহত ডা: মাসুদুল হাসানের রক্তক্ষরণ এখনও হচ্ছে। আরও অনেকের স্বজন হারাবার কস্টের চিত্র শব্দে ধারণ করা সম্ভব নয়। কথা দিচ্ছি, বন্ধুবর মূল ডকুমেন্টটি পাঠালে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব।
এসব কস্ট, বেদনা আর যন্ত্রণার মধ্য থেকে নিস্ক্রান্তির একমাত্র পন্থা: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। ১৯৭১এর চেতনাকে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনে মূলমন্ত্র হিসেবে ফিরিয়ে আনার খুব দরকার। শোষণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ আর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কোন বিকল্প নেই। স্বৈরাচারের হাত ধরেই পূনর্বাসিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীরা। খেয়াল রাখতে হবে, স্বৈরাচার যাতে আবারও ছদ্মবেশে নতুন করে ফিরে আসতে না পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমাদের আন্দোলন আরও বেগবান হোক। তাদের বিচার হোক আগামীকালের বাস্তবতা । এই আহবান থেকে সরে আসব কিভাবে? তিরিশ লাখ শহীদ আর তাদের স্বজনরা আবারও স্মরণ করিয়ে দিল, ১৯৭১ শেষ হয়নি। যুদ্ধ চলছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন তাড়িত চেতনায় উদ্ভাসিত নতুন প্রজন্ম অপেক্ষা করছে বিজয়ের পতাকা হাতে। তাদের বিজয় মিছিলে যোগ দিতে হলে ঠিক এক্ষুণি এগিয়ে আসুন দৃপ্তপদে।
মন্তব্য
সহমত।
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
সহমত।
অপূর্ব লেখা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নয় । অবশ্যই নয় ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
যে ভোলে ভুলুক, আমি ভুলি নাই...
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
১৯৭১ শেষ হয়নি। যুদ্ধ চলছে।
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। যুদ্ধ চলছে আর চলবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সম্মিলিত সংগ্রাম চলুক। এনওয়াই বাংলা অনুষ্ঠানটি নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন করেছে, পড়ে দেখুন এখানে (পিডিএফ ফাইল)।
অন্ধকারের উতস হতে উতসারিত আলো
যখন পড়ি কেমন এক অনুভূতি হয়... এরে কি বলে...
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অনেক অনেক ধন্যবাদ জানানোর জন্যে।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
এ কোন সুখকর অভিজ্ঞতা নয়, কিন্তু যাঁদের স্বজন নিহত হয়েছেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, বিহারী মিলিশিয়া কিংবা বাংলাদেশী সশস্ত্র বিশ্বাসঘাতক-হন্তারকদের হাতে, তাঁরা এগিয়ে আসুন, বলুন মুখ ফুটে, জানান কিভাবে তাঁদের স্বজনদের হত্যা করা হয়েছে। এ উচ্চারণ বড় প্রয়োজন এখন।
দেশের বাইরে যাঁরা আছেন, যাঁরা হয়তো বাংলায় প্রাযুক্তিক অনভ্যাসের কারণে লিখতে অপারগ, তাঁরা প্রয়োজনে ইংরেজিতে লিখুন, বা অডিও সাক্ষাৎকার পাঠান। সচলায়তন এই ব্যথিত বিবরণ ধারণ ও প্রচারে সক্ষম এবং ইচ্ছুক।
হাঁটুপানির জলদস্যু
এই বক্তব্যসম্বলিত একটি পোস্ট ছেড়ে স্টিকি করে দিন দু'দিনের জন্য। কমেন্ট অনেকেই পড়ে না বলে আমার ধারণা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সুশান্ত,
আমি মন খারাপ করব না। আমাদের কস্ট ও শোক পরিণত হোক শক্তিতে। ম্যাশের পোস্টে দেওয়া শহীদ পরিবারের স্বজনদের বেদনার্ত স্মৃতিচারণ এখানে তুলে দেওয়ার চেস্টা করব। অপেক্ষায় আছি বন্ধু সাকিবের ফলো আপ ই-মেইলের জন্য। তবে কীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা গতকাল এটা পাঠিয়েছিলেন: দেশীভয়েসে প্রকাশিত লেখা রিপোর্ট অন জেনোসাইড সেমিনার পড়ুন। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কীন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারের পটভূমি ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে পারবেন এই লেখায়। ধন্যবাদ।
অন্ধকারের উতস হতে উতসারিত আলো
আমি আপনার ব্লগটি মন দিয়ে পড়লাম। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি কি কীন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোনো লিংক আমাকে দিতে পারেন (অথবা, অন্য কোনখানের), যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের গণহত্যার সংখ্যাটি আছে?
আমাকে ব্যক্তিগত মেসেজের মাধ্যমেও পাঠাতে পারেন এখানে। ধন্যবাদ।
জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা
নতুন মন্তব্য করুন